গত ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্মদিন। ১৯০৬ সালে বিহারে তাঁর জন্ম। বাংলা উপন্যাসে তিনি এক বিরলতম প্রতিভা। অথচ তাঁর নাম ও লেখাপত্রের সঙ্গে বাঙালির পরিচিত খুব কমই। ঢোঁড়াই চরিতমানস বাংলা উপন্যাসে একেবারেই ব্যতিক্রমী সৃষ্টি — যা সত্যিকার অর্থে ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা। সতীনাথ ভাদুড়ীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি লেখাটি প্রকাশের মাধ্যমে।
লিখেছেন শ্রীঘরি কাঙ্গা দাস
বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশের পিছনে বৈদেশিক প্রভাব প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত সমানতালে সক্রিয় রয়েছে। দুই-একজন এর মধ্যে আলাদা — যেমন দেবেশ রায়। কিন্তু উপন্যাস রচনার প্রাথমিক যে, প্রচেষ্টা তা নানাভাবে সক্রিয় থেকেছে পাশ্চাত্যের উপন্যাস-কৌশলের ভিতরে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে তাঁর সার্থক উপন্যাস-রচনার ছাঁচ খুঁজে পেয়েছিলেন, তাও ছিল পাশ্চাত্যঘেঁষা। বিশেষ করে বারবার বলা হয় যে, তিনি তাঁর উপন্যাস-ছাঁচ নির্মাণ করেছিলেন স্কটের উপন্যাস-কৌশলের মাধ্যমে। কিন্তু সময় তো আর একস্থানে স্থির নয়। সময় ক্রমাগতই বদলে যায়। সময়ের এই বদল-প্রক্রিয়া নানা কারণে সম্পৃক্ত থাকে সভ্যতার বদল-প্রক্রিয়ার সাথেও। তাই সাহিত্যের পূর্বতন বিষয় ও কৌশল ক্রমাগতই বদলে যায়। সেই ধারায় প্রভাবিত অঞ্চলের সাহিত্যের বিষয় ও কৌশলও বদলে যেতে থাকে। সতীনাথ ভাদুড়ীও (১৯০৬-১৯৬৫) সেই বদলে যাওয়া ধারার ধারক, বাংলা সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক। বিশেষ করে তাঁর উপন্যাসের বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর উপন্যাস-কৌশল। তাঁর উপন্যাস-কৌশলের জন্যই তিনি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যের ইতিহাসে, বিষয় যে একেবারেই ফেলনা তা তো অবশ্যই নয়।
সাহিত্যে কম ও বেশি লেখার ভালো-মন্দ দুই দিকই রয়েছে। এর নানা কারণও আছে। ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে যেমন বিশেষভাবে প্রভাব বজায় রাখে, তেমনি করে খ্যাতির প্রতি লেখকের এক দুর্মর আকাঙ্ক্ষাও বেশ দারুণভাবে সক্রিয় থাকে এই ব্যাপারে। বলে নেওয়া ভালো, নাম-উদাহরণ নাই দিলাম, এর ভ‚রিভ‚রি উদাহরণ আছে। বেশি লেখা খারাপ না, যদি লেখক নতুন চিন্তার ক্রমাগত উৎপাদন ও বণ্টন করতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি যদি তা করতে অক্ষম হন, এবং তার পূর্ববতী বিষয়-চিন্তাকেই ক্রমাগত পুনরুৎপাদন করতে থাকেন, তা হলেই সমস্যা। কারণ আগেই বললাম, বেশি লেখা দোষের না। কিন্তু একই বিষয়ের চর্বিতচর্বণ যে কোনো পাঠকের জন্য বিরক্তিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এসব বিষয় ভেবে-চিন্তে লেখকের উচিৎ হবে লেখাজোখায় মন দেওয়া।
এতোক্ষণ যে ফিরিস্তি প্রদান করা হলো; তা করার মূল লক্ষ্য হলো সতীনাথ ভাদুড়ী ও তাঁর লেখাজোখার বিষয় নিয়ে কথা বলার পূর্ব-প্রস্ততি হিসেবেই। কারণ বাংলা সাহিত্যে কম লিখেও [একেবারেই যে কম লিখেছিলেন, তাও না] বেশিদিন টিকে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সতীনাথ ভাদুড়ী। আরেকটা ব্যাপার হলো এই লেখার বেলায় সতীনাথ ভাদুড়ী এক্ষেত্রে ‘আধুনিক’ সাহিত্য-কৌশল দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ করে কৌশলের কারণেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ। একটা ব্যাপারে ঐতিহাসিক কিছু কথাও বলা জরুরি বলে মনে করছি : মানে বাংলা সাহিত্যের ‘আধুনিক’ হয়ে উঠার ব্যাপারটা আরকি। কারণ বিষয় হিসেবে বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এই বিষয়টাই স্পষ্ট হবে যে, বিষয়ে নয়, সাহিত্য-কৌশলেই ক্রমাগত পার্থক্য নির্মিত হয়েছে এক সময় থেকে আরেক সময়ের সাহিত্যের : যেমন প্রাচীন থেকে মধ্যযুগের সাহিত্যের; আবার মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের সাহিত্যের। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’ যতোটা না তাঁর বিষয়ের ক্ষেত্রে আধুনিক, তার চেয়ে আধুনিক তাঁর বিষয়ের পুনর্বিন্যাস ও সাহিত্য-কৌশলে। এই কারণে নাকউঁচা হুমায়ুন আজাদ মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন “প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা”। প্রবন্ধের শিরোনামের কিন্তু একটা গভীর তাৎপর্য রয়েছে; পণ্ডিতজনেরা মানুন আর নাই মানুন।
ঢেঁকি পাড় দিতে গিয়ে কামান মারার মতো কল হয়ে পড়েছে। ঢেঁকিতে পা দেই, মানে সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস-কৌশল নিয়ে কথা বলি; এবং এই কৌশলের সামনে-পিছনের বিষয় নিয়ে। মনে রাখা জরুরি বাস্তব জীবনে সতীনাথ ভাদুড়ী নিজেও ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী; বিবর্তিত হয়েছিলেন ‘ভারতীয় রাজনৈতিক এরিনায়’ — কংগ্রেস থেকে সমাজতান্ত্রিক। নিজের একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। সেই অভিজ্ঞতা তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর জাগরী উপন্যাসে। বিশেষ করে ইংরেজ আমলে স্বাদেশিক আন্দোলনের যে প্রভাব এবং তার ফলে স্বাদেশিক আন্দোলনের লোকজনের যে জেলজীবন সেই জেল-জীবনের বাস্তবতা প্রকটিত হয়েছে জাগরীতে। সেটা নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই কৌশলের রয়েছে একটা সুপ্রাচীন কাহিনি-ইতিহাস। বিশেষ করে সাইকোলজির ক্রমায়ত উন্নতি এবং সাইকোলজিতে নতুন নতুন তত্তে¡র উদ্ভব ও বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য এসব প্রভাবকে ‘ফাত্ড়া’ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে পছন্দ করেন। তবে তা তারা করতে পারেন। আসলে করতে পারেন বলেই এটাও সম্ভব হয়, মানে বন্দে আলী মিয়ার সাথে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার পার্থক্য নির্মাণ করার মতো আরকি। বিশেষ করে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম জেমসের প্রিন্সিপল্স অব সাইকোলজি আগের সব মনস্ততত্ত¡ বিষয়ক চিন্তা-ভাবনাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। ফলে মানুষের মন, এবং সেই মনের বহুস্তরের বিষয়টা স্পষ্ট হয়। তা আরো স্পষ্ট করেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড, তাঁর লিখিত মনস্তাত্ত্বিক লেখাজোখায়। সেইসব প্রভাব এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না তাঁর। যেমন উপায় ছিল না মাইকেল মধুসূদন দত্তের, মিল্টনের প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়া; কিংবা মেঘনাদবধ কাব্য লেখা, প্যারাডাইজ লস্ট কিংবা প্যারাডাইজ রিগেইনড-এর প্রভাব বাতিল করে দিয়ে।
ফলে সমসময়ে [সতীনাথ ভাদুড়ীর সময়] দেশে-বিদেশে রচিত উপন্যাস-কৌশল দ্বারা সতীনাথ ভাদুড়ী বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এবং তার পিছনে কারা কারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, তা তো আর হলফ করে বলা সম্ভব নয়; তবে এটা বলা যেতে পারে বাংলা সাহিত্যের প্রথম দিককার উপন্যাসের লিনিয়ার বয়ান-কৌশল বদলে ফেলার পিছনে যে সমস্ত লেখক সক্রিয় থেকে উপন্যাস রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সতীনাথ ভাদুড়ী। এই বিষয়ে কেউ কেউ আপত্তি তুলতে পারেন তাঁর অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ঢোঁড়াই চরিত মানস নিয়ে। কারণ এই উপন্যাসের বয়ান-কৌশল আবার অনেকটা লিনিয়ার, একইসাথে আবার খানিকটা চৈতন্যপ্রবাহরীতি সম্পর্কিত। বেশি সম্পৃক্ততা রয়েছে মেটা-ন্যারেটিভের একত্রীকরণে একটা পূর্ণাঙ্গ মেগা-ন্যারেটিভ তৈরি করা। এক্ষেত্রেও এই উপন্যাস-কৌশলের ব্যাপারটাও বেশ চমৎকার!
তাহলে জাগরী উপন্যাসে সতীনাথ ভাদুড়ী কী এমন কাজ করেছেন যে তার জন্য তাঁকে ‘আধুনিক’ সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে? তাছাড়া তাঁর জাগরীর অসামান্য গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কারও (১৯৫০) তাঁকে প্রদান করা হয়। সে যাক্গে। আসলে যে কথা বলা হচ্ছিল, উপন্যাসের বিষয়, যে বিষয়ে সতীনাথ ভাদুড়ী দৈশিক পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার করেছেন; কিন্তু কৌশলে বহিরাগত-প্রভাব বজায় ছিল তাঁর উপন্যাসে। আরেকটা ব্যাপার, সতীনাথের অধিকাংশ উপন্যাসই রাজনৈতিক বিষয়-সম্পৃক্ত। বিষয়টা জাগরী থেকে শুরু হয়ে পরবর্তীতে প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য উপন্যাসেও সমানভাবে সক্রিয় থেকেছে। জাগরীর উপন্যাস-কৌশল এক কথায় দারুণ। বলা যেতে পারে বাংলা সাহিত্যে ‘পারফেক্ট’ চৈতন্যপ্রবাহরীতির মাইলফলকগুলোর মধ্যে এটি একটি। কারণ পূর্ববর্তী অনেকেই এই কৌশলের ‘পারফেক্ট’ ব্যাপারটা করে উঠতে পারেননি; কিন্তু তাঁদের প্রচেষ্টা শ্রদ্ধার যোগ্য।
‘আধুনিক সাহিত্যের’ প্রকাশভঙ্গিই যে এর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য — তা আর বলার অবকাশ থাকে না। কারণ উইলিয়াম জেমসের বিখ্যাত মনস্তত্ত¡ বিষয়ক গ্রন্থ প্রিন্সিপলস্ অব সাইকোলজি (Principles of Psychology, 1890) প্রকাশিত হওয়ার পরই মূলত পুরোনো উপন্যাস-বয়ান-কৌশল (Narration-Technique) বদলে যেতে থাকে। নতুন নতুন উপন্যাস এই পুস্তক-পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম জেমস জয়েসের (James Augustine Aloysius Joyce, 1882-1941) ইউলিসিস (Ulysses, 1922) ও ভার্জিনিয়া উলফের (Adeline Virginia Woolf, 1882-1941) উপন্যাস মিসেস ড্যালওয়ে (Mrs Dalloway, 1925)। বিশেষ করে ইউলিসিস এক্ষেত্রে অন্যতম। যে উপন্যাসের বয়ান কোনো প্রথাগত ধারাবহিক বা লিনিয়ার বয়ান-কৌশল মানে না। এই উপন্যাস নির্মিত হয় চৈতন্যপ্রবাহরীতির আখ্যান-বর্ণনা-কৌশলের মাধ্যমে। আসলে ‘আধুনিক’ সাহিত্যে উপস্থাপনরীতিটাই বিশেষভাবে জরুরি, অর্থাৎ উপস্থাপন-রীতি গুরুত্বপূর্ণ এক্ষেত্রে, বিষয়ের চেয়ে। এই বিষয় কার্যকর থেকেছে সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী উপন্যাসে।
জেমস জয়েস তাঁর ইউলিসিস উপন্যাসে বয়ান নির্মাণ করেছেন একটানা, কথকের ভূমিকায় চরিত্রকে উপস্থাপন করে, চরিত্রের চিন্তা-জগতের মাধ্যমে একই স্থানে বসে একের পর এক কাহিনি লিখে ফেলেছেন। যা লিনিয়ার নয়, আবার লিনিয়ার। কারণ এই চিন্তা ও বয়ানের উল্লম্ফনধর্মীতা কিন্তু বাস্তবের কার্য-কারণকে বাতিল করে দেয়নি। ইউলিসিস উপন্যাসের লিওপোল্ড ব্লুম যেমন একনাগাড়ে চৈতন্যপ্রবাহরীতির ওপর সওয়ার হয়ে ডাবলিন শহর আর তার চারপাশকে বর্ণনা করে যায়; তেমনি করে জাগরী উপন্যাসের চরিত্ররাও সেই একই কাজটা করে জেল-পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থান করে। লিওপোল্ড ব্লুম যেমন ডাবলিনে একটা নির্দিষ্ট অংশে বসে একদিনে সমগ্র ডাবলিন ও ডাবলিন সম্পর্কিত কাহিনি বলে যাচ্ছেন, তেমনি করে জাগরী উপন্যাসে ‘ফাঁসি সেল : বিলু’, ‘আপার ডিভিশন ওয়ার্ড : বাবা’, ‘আওরৎ কিতা : মা’ এবং ‘জেল গেট : নীলু’ — এই চারটি অংশে চারটি চরিত্র তাদের নিজস্ব স্মৃতিচারণায়, মগ্নচৈতন্যে চৈতনাপ্রবাহরীতির মাধ্যমে বয়ান নির্মাণ করে যাচ্ছে, যা মূলত সেই সময়ের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস। ফলে ইউলিসিস উপন্যাসের লিওপোল্ড বøুম ও জাগরী উপন্যাসের চরিত্র সমূহের মাধ্যমে বাস্তব ঘটনার বর্ণনা-পদ্ধতি একইসূত্রে গ্রথিত। তাই উপন্যাসের ‘টেকনিক্যাল এলিমেন্টস’ এর কথা বলতে গেলে সতীনাথ ভাদুড়ী অনেকাংশেই জয়েসপন্থী। কিন্তু সেটা কি জেনে; না, না জেনে? তবে নিশ্চিতভাবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়া বোকামি। কারণ মিলের এবং প্রভাবের ব্যাপারটা হিসেব করতে হয় আগে এবং পরে সৃষ্টির হিসেবের সাথে। সেই হিসেবে বলা যায় জয়েসের উপন্যাসের সাহিত্য-কৌশল সতীনাথের আগের। আর তা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হতেও পারেন, আবার নাও পারেন। কিন্তু মিল খুঁজে তুলনামূলক আলোচনা এক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান প্রদান করবে।
উপন্যাসের নামকরণও কেন যেন গুরুত্বপূর্ণ জাগরীর ক্ষেত্রে। কারণ ‘জাগরী’-এর আভিধানিক অর্থ নিদ্রাহীন। এই উপন্যাস অবশ্যই নিদ্রাহীনতায় চিন্তা-জগতের একটানা বর্ণনার মাধ্যমে সম্পূর্ণতা পেয়েছে। চরিত্রগুলো একে অপরের থেকে অবস্থানগত দিক থেকে আলাদা, কিন্তু চিন্তাগুলো একে অপরের থেকে বাস্তব-জগতে বিচ্ছিন্ন হলেও চিন্তা-জগতে এক। এই উপন্যাসের চারজন চরিত্রই সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলন-বিক্ষোভ-অভিঘাত দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। ফলে সেই অভিঘাতে রাজনৈতিক চিন্তার বিভক্তির বিষয়ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এবং এই রাজনৈতিক চিন্তা কীভাবে কার ওপর কতোটুকু প্রভাব ফেলেছে; এবং একই পরিবার কীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে — তার সত্য-বয়ান নির্মাণ সম্ভব হয়েছে এই চৈতন্যপ্রবাহরীতি ব্যবহার করে। কারণ বাস্তবে চরিত্রের মুখে কাহিনি-স্থান-কালের ঐক্যে নির্মিত বয়ানে আদতে কতোটুকু সত্য-বয়ান নির্মিত হতো, তার প্রতি একটা সন্দেহসূচক জিজ্ঞাসা রয়েই যায়। কিন্তু চরিত্রের অন্তর্গত সংলাপ-প্রক্রিয়া কিছুই আর গোপন রাখলো না; চরিত্র মন ও বাস্তব — একইসাথে সম্পূর্ণ হয়ে কাহিনিকে ভরপুর সত্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে এই [জাগরী] উপন্যাসে। ফলে প্রভাব ও প্রস্তুতির যে বিষয় সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে অহরহ দেখা যায়, তার সাথে একটা সখ্য অবশ্যই গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের সাহিত্য-কৌশলে। তাই উপন্যাস-কৌশলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী বাংলা উপন্যাস-সাহিত্য-ইতিহাসে হয়ে আছে এক উজ্জ্বল মাইলফলক — একথা জোরের সাথেই বলা যায়।