প্রচ্ছদ-কথা : ২
ধর্ষণ স্থায়ী এক মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করে যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তির মনে। বাংলাদেশে নারী ও শিশু এই সহিংসতার প্রধান শিকার। ধর্ষণের পর পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা ধরনের সংকটের মুখোমুখি পড়ে নিপীড়িত ব্যক্তি। পাশাপাশি থাকে আক্রমণকারীর বিভিন্ন মাত্রার হুমকি। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, ক্ষমতাসীন বা সরকার পক্ষীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপ ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। বাংলাদেশে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড দুটি সমান্তরাল ঘটনায় পরিণত হয়েছে। একারণে নারী ও শিশু-মনস্তত্ত্বে তৈরি হয়েছে প্রবল ভয় ও শঙ্কা। কিন্তু ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনার ভেতর দিয়ে যাকে যেতে হয়েছে সে-ই সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে সকল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে থাকে।
দুর্বিষহ স্মৃতি
দ্যা কজ অফ রেইপ বইয়ের ভূমিকায় মার্টিন এল. লালুমিয়েরে বলেছেন, ধর্ষণ ভয়াবহ, ধ্বংসাত্মক। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন নারীর অধিকাংশই অ্যাংজাইটি ডিজর্ডার, ডিপ্রেশন, যৌন প্রতিবন্ধিতা, অবসেসিভ কমাপালসিভ ডিজর্ডার, আসক্তি, আত্মবিশ্বাসহীনতা, অসুস্থতার বোধ ইত্যাদি মানসিক সংকটে ভুগতে থাকে। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে ভেঙে পড়েন, যা থেকে উত্তরণ সহজে ঘটে না। শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংকট আরও ভয়াবহ; কারণ তা সারা জীবনের জন্য তাদের মধ্যে অনিরাপত্তাবোধের জন্মায়। পরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো আঘাত হানে ধর্ষণ ও নিপীড়নের দুর্বিষহ স্মৃতি।
ধর্ষণ, বারবার
ধর্ষণের শিকার অনেকেই ভাবতে থাকেন ধর্ষণের জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী। অযৌক্তিক অপরাধবোধ তাকে মানসিকভাবে গ্রাস করতে থাকে। ২০০২ সালে ওয়ান নাইট : রিয়েলিটিজ অফ রেইপ বইয়ে ক্যাথি উইঙ্কলার বলেন, একজন ধর্ষিতা কমপক্ষে তিনবার ধর্ষিত হন; প্রথমত, অপরাধীদের দ্বারা, দ্বিতীয়ত, অবিরত দোষারোপ করার মাধ্যমে সামাজিক ব্যবস্থা দ্বারা, তৃতীয়ত, বিচার ব্যবস্থার দ্বারা, যা ন্যায়বিচার দানে ব্যর্থ। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিরা জীবনকে দুভাগে বিভক্ত করেন : ধর্ষণ-পূর্ববর্তী জীবন এবং ধর্ষণ-পরবর্তী জীবন। দুই জীবনের পার্থক্য তাদের হতাশ ও বিহ্বল করে তোলে।
ধর্ষণ-পরবর্তী জীবন
ধর্ষণ-পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। যারা তাদের অভিজ্ঞতাকে অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে তাদের ক্ষেত্রে ধর্ষণ-পরবর্তী জীবনে ন্যূনতম স্বাভাবিকতা ফিরে পাওয়া সহজ হয়। কিন্তু যারা নীরব থাকে, নিজের বেদনাগুলো লুকিয়ে রাখে, তাদের জীবন হয়ে ওঠে স্থায়ী মনস্তাত্ত্বিক সংকটে ভরপুর। একজন রেইপ ভিক্টিম একজন ভালো শ্রোতা খোঁজেন, যার সঙ্গে কথা বললে মনের ভার লাঘব হবে। বাংলাদেশে পরিবারগুলোর পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের নির্ভরতা জোগানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। উল্টো পরিবার থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় দোষের বোঝা। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে রেইপ ভিক্টিমদের জন্য আছে রেইপ কাউন্সেলিঙের ব্যবস্থা। ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিরা সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্টদের সঙ্গে কথা বলে জীবনের ভঙুর গতিকে স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টা করেন।
রেইপ ট্রমা সিনড্রোম
যৌন নিগ্রহের শিকার অধিকাংশ নারী রেইপ ট্রমা সিনড্রোমে ভোগেন। এটি আদতে পোস্টট্রমাটিক সিনড্রোমের একটি রূপ। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি অন্তত চার স্তরের ট্রমায় ভোগেন : মানসিক আঘাত ও অবিশ্বাস; সংশয়, ভয়, বিষাদ ও ক্রোধ; নবায়ন ও অনুসরণ; অভিযোজন। তারা অসহায়তা, অপরাধবোধ, অবমাননা, নির্ভরতার বোধ, হিস্টিরিয়া ইত্যাদিতে ভুগতে পারেন। ধর্ষণের এক সপ্তাহের মধ্যে ৯৪ ভাগ ধর্ষিতার মধ্যে দেখা দেয় রেইপ ট্রমা সিনড্রোম।
শারীরিক প্রতিক্রিয়া
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির শরীরও চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ঘুমের সমস্যা, খাদ্য গ্রহণে অরুচি, বমির ভাব, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, শরীর ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ডায়াবেটিস, গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যা, পারকিনসন্সের মতো রোগও বাসা বাঁধে অনেকের শরীরে। মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়ায় অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশা হারিয়ে ফেলেন এবং আত্মহত্যাকে শেষ পথ হিসেবে বেছে নেন। ১৭ থেকে ২০ ভাগ ভিক্টিম আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
সবার মানসিক প্রতিক্রিয়া কি এক?
ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার সব বয়সের সবার মানসিক প্রতিক্রিয়া এক নয়। ধর্ষণ-পরবর্তী জীবনে টিকে থাকার সংগ্রামও এক রকমের নয়। একজন পাঁচ বছর বয়সী শিশু, একজন ষোল বছর বয়সী তরুণ, একজন ত্রিশোর্ধ্ব নারীর ধর্ষণ-অভিজ্ঞতায় টিকে থাকার লড়াই সমান নয়। পরিচিত কারো দ্বারা এবং অপরিচিত কারো দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া এবং তৎপরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ধরনেও পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে একজন পুরুষ শিশু তার নির্যাতনের কথা সহজে বলতেই পারে না। সারা জীবনে সম্ভবত কাউকেই বলতে পারে না। এই না বলতে পারার বোধ বয়ে বেড়াতে হয়। তার প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ। সে হয়ে উঠতে পারে অপরাধপ্রবণ ও সহিংস। বাংলাদেশে একজন চাকমা, মারমা, মণিপুরী নারী যখন ধর্ষিত হয় তখন তার মধ্যে কেবল লৈঙ্গিক ভীতি গড়ে ওঠে না। তার ভয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায় জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি। অর্থাৎ সব ভিক্টিমকে একই মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। শিশুদের ক্ষেত্রে ধর্ষণজনিত ভয় স্থায়ী মানসিক ক্ষত তৈরি করতে পারে; যা কখনোই আর স্বাভাবিক নাও হতে পারে। অনেকে দাম্পত্যের স্বাভাবিক যৌনতাকেও ভয় পেতে আরম্ভ করে। অনেক নারীর মধ্যে দেখা দেয় যৌনশীতলতা।
রেইপ ক্রাইসিস সেন্টার
ধর্ষিতা নারীর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রয়োজনে প্রয়োজন পড়ে রেইপ ক্রাইসিস সেন্টারের। ষাট ও সত্তরের দশকের নারীবাদী আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯৭২ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে গড়ে ওঠে রেইপ ক্রাইসিস সেন্টার। এ ধরনের সেন্টারের কাজ হয়ে ওঠে ধর্ষিতার মানসিক সংকটে সহায়তা করা, সামাজিক ও সাংস্কৃতি নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করা। সত্তরের দশকে বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাসেও রেইপ ক্রাইসিস সেন্টার স্থাপন করা হয়; কারণ ‘‘ডেট রেপ’’ বা প্রেমের সম্পর্কের সূত্রে ধর্ষণও প্রবল মানসিক সংকট তৈরি করে। বাংলাদেশে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা আসলে ‘‘ডেট রেপ’’। বাংলাদেশে রেইপ ক্রাইসিস সেন্টার প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের দায় ধর্ষিতার নয়; ধর্ষিতা যৌন অপরাধীর নির্মম শিকার। এই সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে সবার আগে। নারীর পোশাক, আচরণ, কথা বলা, ইঙ্গিত ইত্যাদির দোহাই দিয়ে যৌন সহিংসতাকে বৈধ করার সুযোগ নেই। যারা এ ধরনের ভাবনা দ্বারা তাড়িত তাদের কাউন্সেলিং জরুরি। কারণ তারা একটি অভ্যস্ত ছকে নারীকে দেখতে চায়। কিন্তু তারা এটা খেয়াল করে না যে, ছয় মাস বয়সী শিশুও ধর্ষিত হয়েছে, চার-পাঁচ বছর বয়সী ছেলে শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে পোশাক, আচরণ, কথা বলা, ইঙ্গিত ইত্যাদির তত্ত্ব কোন যুক্তিবোধ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত?
রাষ্ট্রের কর্তব্য
রাষ্ট্রের কর্তব্য নির্যাতিতের পক্ষে আইনি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল ধরনের সুবিধার দুয়ার খোলা রাখা। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ধর্ষককে বাঁচানোর চেষ্টা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা। কারণ সরকার ও রাষ্ট্র স্বয়ং যদি ধর্ষকের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে নাগরিকের আস্থার আর কোনো জায়গা থাকে না। তাছাড়া নতুন করে ভাবতে হবে ধর্ষণ, ধর্ষক, ধর্ষিতার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উন্মুক্ত গবেষণার ব্যবস্থা করা দরকার; এর ফলে ধর্ষণ সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য বেরিয়ে আসবে। যৌনতা বিষয়ক শিক্ষা ও নৈতিকতা, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, লৈঙ্গিক সম্পর্ক ইত্যাদি ধারণাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। আরও দরকার কাউন্সেলিং। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি উদ্যোগে ধর্ষণ ও নিপীড়ন বিরোধী কাউন্সেলিঙের বন্দোবস্ত করা দরকার। তার আগে রাষ্ট্রকেই নিপীড়কের আসন থেকে সরে দাঁড়াতে হবে; কেননা রাষ্ট্র যদি ধর্ষণের মতো বিরাট ঘটনার বিরুদ্ধে সংঘটিত সামান্য আন্দোলনকেও হটিয়ে দিতে চায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাবে।