ধর্ষণ, ধর্ষণের সংস্কৃতি ও আইন

সূত্র : www.coe.int

প্রচ্ছদ-কথা : ১

আজকের বাংলাদেশের সব চেয়ে মারাত্মক লিঙ্গীয় নির্যাতনের নাম ধর্ষণ। এদেশে নতুন করে ধর্ষণ শব্দের সংজ্ঞায়ন হয়তো জরুরি নয়; কারণ সংজ্ঞায়নের চেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে ধর্ষণের প্রতিকার ও প্রতিরোধ। তবে সারা বিশ্বে ধর্ষণ বিষয়ক তাত্ত্বিক আলোচনা থেমে নেই, প্রতিকারও থেমে নেই। ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশে দেশে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে; একই সঙ্গে চলছে গবেষণা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পাঠ।

 

ধর্ষণ

ধর্ষণের কোনো সর্বজনীন ও সার্বজনীন সংজ্ঞার্থ নেই। সংস্কৃতি, স্থান, কাল, লিঙ্গভেদে ধর্ষণের সংজ্ঞার্থ গড়ে ওঠে। রোমানরা ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন —per vim stuprum, or “intercourse by force,” হিসেবে। প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার নানা বিবরণ পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যেও তা বিরল নয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নায়ক হিসেবে কৃষ্ণকে ধর্ষকামী পুরুষ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়; রাধাকে যে বারবার উত্যক্ত করেছে, কাঁচুলি ছিঁড়ে স্তন মর্দন করতে চেয়েছে, আলিঙ্গন করতে চেয়েছে। প্রাচীন কালে যুদ্ধ শেষে জয়ীরা ভাগাভাগি করে নিত নারীকে। ভাগাভাগি করতে গিয়ে আবার যুদ্ধ বেঁধে যেত। মূলত ধর্ষণ, লৈঙ্গিক নির্যাতন ছিল আর এই তথাকথিত ‘‘সভ্য’’ জগতেও তা বিদ্যমান। একেই বলা চলে ধর্ষণের সংস্কৃতি।

 

ধর্ষণের সংস্কৃতি

ধর্ষণের সংস্কৃতি মূলত সত্তরের দশকে তৈরিকৃত একটি অভিধা। এই অভিধা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা মনে করে নারী ও শিশুর ওপর যৌন আধিপত্য বিস্তার করা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এই সংস্কৃতির ধারকরা মনে করে যৌন আধিপত্য ও আগ্রাসন পুরুষের জীবতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য; এটি সে শেখে না, অর্জন করে না। ধর্ষণের সংস্কৃতি মনে করে, যৌন দিক থেকে নারীরা হবে প্যাসিভ, পুরুষ হবে সক্রিয়। নারীর শরীর ও যৌনতা নিয়ন্ত্রিত হবে পুরুষ কর্তৃক। এ ধরনের বিশ্বাস পোষণকারীরা সমাজে ধর্ষণ সম্পর্কে বিভিন্ন গল্প বা মিথ ছড়ায়। ধর্ষণ বিষয়ক তাত্ত্বিকরা এগুলোকে বলে থাকেন ‘‘রেইপ মিথ’’।

 

রেইপ মিথ ধর্ষণ ও ধর্ষকের পক্ষে যুক্তি তৈরি করে ও সমর্থন জোগায়। প্রচলিত রেইপ মিথ হলো : মেয়েরা মূলত ধর্ষিত হতে চায়; আগ্রাসনের মাধ্যমে নারীর যৌন জাগরণ ঘটে; ধর্ষিতা চাইলে ধর্ষণ ঠেকাতে পারত; ধর্ষণের সময় নারীরা যৌনভাবে সক্রিয় থাকে। রেইপ মিথগুলো মিথ্যা, বানোয়াট, পুরুষের যৌনইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। সাধারণ সাংস্কৃতিক মাধ্যম সূত্রে (সিনেমা, বিজ্ঞাপন, পর্নোগ্রাফি) এসব ছড়িয়ে থাকে। ধর্ষণের সংস্কৃতি মূলত জটিল বিশ্বাসের সমষ্টি, যা নারীর ওপর সংঘটিত নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বৈধ মনে করে এবং সহিংসতার পক্ষে কাজ করে থাকে।

 

আইন

ধর্ষণ বিষয়ক আইন নানা দেশে নানা রকম। চেক প্রজাতন্ত্রে কেবল যোনীতে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করানোকে ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; মুখ বা পায়ুপথে পুরুষাঙ্গের প্রবেশকে ধর্ষণের আওতায় আনা হয় নি। বরং এই দুই ঘটনাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ব্ল্যাকমেইল বা প্রতারণার অধীন। নামিবিয়াতেও ধর্ষণের যোনীকেন্দ্রিক সংজ্ঞার্থ দেয়া হয়েছে। ফিজিতে কেবল যোনীতে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করানো ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃত; স্বামী কর্তৃক বলপ্রয়োগে সঙ্গম ধর্ষণ বা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বাহামিয়ান আইনে স্বামী/স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ বা শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

 

২০০০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর মাত্র ২৬টি দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ে বৈবাহিক ধর্ষণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বৈবাহিক ধর্ষণ বেআইনি; তবে দাম্পত্যজীবনে কতোখানি জোরারোপ ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে, তার মাত্রাগত ভেদ আছে। কলম্বিয়াতে বৈবাহিক ধর্ষণের ক্ষেত্রে হালকা শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে; কারণ দাম্পত্য সম্পর্কে ‘‘সম্মতি’’র অনুপস্থিতি নির্ণয় করা কঠিন। মধ্যযুগীয় আইনশাস্ত্রানুসারে একজন পতিতাকে ধর্ষণ করা অসম্ভব বিবেচিত হয়েছে। কারণ তার সম্মতি ছিল না প্রমাণ করা কঠিন!

 

বিশ শতকের শেষ দিকে ধর্ষণের সংজ্ঞায়নকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালে জার্মানির নতুন আইন যৌন সহিংসতাকে ধর্ষণের আওতাভুক্ত করেছে। জার্মানিতে শারীরিক বলপ্রয়োগের পাশাপাশি মানসিক বলপ্রয়োগকেও ধর্ষণের সংজ্ঞায়নে যুক্ত করেছে। এই আইনগুলো লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাষায় লিখিত; এতে করে বোঝা যায়, পুরুষ বা নারী উভয়ই যৌন আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে; একইভাবে নারী বা পুরুষ উভয়ই হতে পারে আক্রমণকারী। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে যৌন আগ্রাসনের শিকার ও আক্রমণকারী দুজন পুরুষ হলে পায়ুকাম হিসেবে স্বীকৃত হবে, কিন্তু ধর্ষণ হবে না। ড্যানিশ আইনে এটিকে যোনীতে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করানোর সমান অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং ধর্ষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এ কারণে মুখ, পায়ুপথ বা যোনীতে পুরুষাঙ্গ বা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ বা অন্য কোনো বস্তু প্রবেশ করানো ধর্ষণ।

 

১৯৯৮ সালে ধর্ষণের সবচেয়ে প্রসারিত সংজ্ঞার্থ দিয়েছে International Criminal Tribunal for Rwanda। ট্রাইবুনাল ধর্ষণকে গ্রহণ করেছে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যাধর্মী অপরাধ হিসেবে। ট্রাইবুনালের মতে, ধর্ষণ কোনো ব্যক্তির ওপর সংঘটিত যৌন স্বভাবের শরীরী আধিপত্য, যা ব্যক্তিকে শরীরীভাবে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এই সংজ্ঞার্থে কোনো লৈঙ্গিক পরিচয় নির্দিষ্ট করা হয় নি, যৌন আক্রমণের পরিসীমা নির্ধারণ করা হয় নি; এমনকি পরিস্থিতিও নির্ধারণ করা হয় নি। আধুনিক জিম্বাবুয়ে ও কানাডায় ধর্ষণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত কোনো অপরাধ নয়; বরং ধর্ষণ হলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ।

 

বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণ

বাংলাদেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন আইন নিয়ে অনেকের মধ্যেই অস্পষ্টতা রয়েছে। অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন, আইনেই রয়ে গেছে অপরাধীর ছাড়া পাবার পথ। বিশেষ করে অপরাধ প্রমাণ, সাক্ষী, সাক্ষ্য দান ইত্যাদিন নিয়ে জটিলতা থাকায় অপরাধীরা শাস্তি পায় না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ বলা হয়েছে :

ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, ইত্যাদির শাস্তি

৯৷ (১) যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷

ব্যাখ্যা৷- যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত 1[ষোল বত্সরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা 2[ষোল বত্সরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন৷

 

(২) যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷

 

(৩) যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষন করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷

(৪) যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে-

(ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন;

(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷

(৫) যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী ধর্ষিতা হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বত্সর কিন্তু অন্যুন পাঁচ বত্সর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যুন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন৷

1 “ষোল বত্সরের” শব্দগুলি “চৌদ্দ বত্সরের” শব্দগুলির পরিবর্তে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ (২০০৩ সনের ৩০ নং আইন) এর ৩ ধারাবলে প্রতিস্থাপিত
2 “ষোল বত্সরের” শব্দগুলি “চৌদ্দ বত্সরের” শব্দগুলির পরিবর্তে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ (২০০৩ সনের ৩০ নং আইন) এর ৩ ধারাবলে প্রতিস্থাপিত

২০১৯ সালের ২২ এপ্রিলে প্রকাশিত বিবিসির প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশে এখনও ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি মোতাবেক; এই প্রতিবেদনে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, ‘‘বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং দণ্ডবিধিতে সাক্ষীদের রক্ষাকবচ সীমিত। কেউ ঘটনার শিকার হলে তার নাম প্রকাশ করা যাবেনা কিংবা প্রয়োজন হলে নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থা করতে পারে আদালত। কিন্তু এর বাইরে তেমন কোন সুরক্ষার ব্যবস্থার নেই।’’

1 COMMENT

  1. রাষ্ট্রীয় বিচার কতটুকু দুর্বল হলে বর্বরোচিত একটা বিশ্রী বিষয়কে ‘সংস্কৃতি’ শব্দের অভিধায় লিখতে হয়।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here