ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব

প্রচ্ছদ-কথা : ৩

একজন ধর্ষক প্রকৃতপক্ষে কী ভাবে? ধর্ষণের পক্ষে তার যুক্তি কী? কী তার মনস্তত্ত্ব? এই প্রশ্নগুলোর জবাব ছাড়া ধর্ষণ ও ধর্ষককে ঠিকভাবে বোঝা যাবে না। পৃথিবী জুড়ে এ-সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা হয়েছে। কেউ কেউ ধর্ষকের সঙ্গে সরাসরি সংলাপে অংশ নিয়েছেন এবং সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষণা-ফল উপস্থাপন করেছেন। আমরা দেখতে চাই ধর্ষকের মনের পরিসর।

 

অদ্ভুত বিজ্ঞাপন

১৯৭৬ সালে স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান একটি অদ্ভুত বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন পত্রিকায় : ‘‘আপনি কি ধর্ষক? গবেষক আপনার সাক্ষাৎকার নিতে ইচ্ছুক। পরিচয় ‍লুকিয়ে বেনামে আপনার সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। কল করুন…. নম্বরে।’’ তিনি ভাবেন নি কোনো ফোনকল পাবেন। কিন্তু একের পর এক বেজে উঠল ফোন। ২০০টি ফোনকলে কথা বললেন তিনি। বিচিত্র সব ঘটনার মুখোমুখি হলেন। টেলিফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী যিনি তার বান্ধবীকে ধর্ষণ করেছেন, একজন চিত্রশিল্পী, যিনি তাঁর পরিচিত একজনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন।  একজন স্কুল অভিভাবক যিনি ১০-১৫টি ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা করেছেন। স্মিথ ৫০জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর গবেষণার ভিত্তি : The Undetected Rapist। স্মিথিম্যানের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিলো এই যে, কতো স্বাভাবিক ছিল তাদের কণ্ঠস্বর, আর কতো বিচিত্র ছিল তাদের ভিত্তিমূল। স্মিথিম্যান একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।

 

কেন বুঝতে হবে?

সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স গবেষণা-পত্রিকার সম্পাদক শেরি হ্যাম্বি মনে করেন, ‘‘আপনি যদি অপরাধীকে বুঝতে না চান, আপনি যৌন-আগ্রাসনকেও বুঝতে পারবেন না।’’ এ লক্ষ্যে অনেক গবেষক ধর্ষণকে গবেষণায় বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যেমন : মার্টিন এল. লালুমিয়েরে, গ্র্যান্ট টি হ্যারিস, ভারনন এল. কোয়েনসি, মারনি ই রাইস, আন্তোনিয়া অ্যাবি। ধর্ষণ বিষয়ে সবার মত অভিন্ন নয়। শেরি যেমন মনে করেন, ‘‘যৌন আগ্রহ থেকে যৌন নির্যাতন ঘটে না, বরং মানুষকে দমিত বা নিয়ন্ত্রণে রাখাই ধর্ষণের উদ্দেশ্য।’’ কিন্তু অনেকেই মনে করেন, যৌন আগ্রহ থেকেই ধর্ষণের জন্ম। ধর্ষণের নানা ধরনের ব্যাখ্যা আছে : সমাজতাত্ত্বিক, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক, আইনতাত্ত্বিক ইত্যাদি। কোনোটিই পরস্পর সম্পর্কবিহীন নয়। তাই বলে এ মীমাংসা কেউ মেনে নেন নি যে, ধর্ষণ মূলত মনস্তাত্ত্বিক রোগ। কোনো কোনো ধর্ষকের ক্ষেত্রে মনোরোগ প্রভাব ফেললেও ধর্ষণ মূলত একটি যৌন অপরাধ। অন্য সব অপরাধের মতো ধর্ষণও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ধর্ষক কী ভাবে? তার মনের জগতের ভাবনা কী? আচরণিক মনোবিজ্ঞান, যৌনমনোবিজ্ঞান, সমাজ-মনস্তত্ত্ব নানাভাবে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেগুলোর সরলীকৃত রূপ অনেকটা এমন :

 

যৌনবস্তু

ধর্ষকরা মনে করে নারীরা যৌনবস্তু। যেকোনো সময় যেকোনো নারীকে ভোগ করা যায়। এই ভোগ বৈধ। পুরুষের জন্যেই নারীর সৃষ্টি। এই যুক্তি কেবল ধর্ষকদের মধ্যেই থাকে না; এই যুক্তি যাঁরা সমর্থন করে তারা প্রকৃতপক্ষে সম্ভাব্য ধর্ষক, সুযোগাসন্ধানী নিপীড়ক।

 

নারীর না মানে ‘‘হ্যাঁ’’

ধর্ষকের ধারণা নারীরা আদতে যৌনকর্মে অংশ নিতে চায়। কিন্তু সহজে তারা সম্মতি দেয় না। মেয়েরা স্বভাবতই লাজুক। তাই তারা অসম্মতির ভাণ করে। পুরুষ জোর করলেই তারা সম্মত হয়ে যায় এবং শরীরীভাবে অংশগ্রহণ করে। নারীর না মানে, আদতে হ্যাঁ। তারা আরও মনে করে, নারীকে ঠিক বোঝা যায় না। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ধর্ষকরা নিজেদের কাজকে যৌক্তিক মনে করে।

 

পোশাক-তত্ত্ব

নারীর পোশাকের এক ধরনের ব্যাখ্যা করে থাকে ধর্ষকেরা। তারা মনে করে, বুক-পেট দেখানো, ওড়না না পরা, টি-শার্ট, হাফপ্যান্ট পরা, পাতলা শাড়ি বা কাপড় পরা ইত্যাদি যৌনভাবে আহ্বান করার জন্যই করে থাকে। আর তাই ধর্ষণ মানে যৌনতায় অংশ নেয়া; একে অপরাধ বলার সুযোগ নেই। যারা ধর্ষণে অংশ নেয় নি, এমন ব্যক্তিও এ ধরনের চিন্তা করে থাকে। এরাও প্রকৃতপক্ষে সম্ভাব্য ধর্ষক ও নিপীড়ক; সমাজে ধর্ষণের পক্ষে পরোক্ষ অবস্থান সৃষ্টি করে।

 

ক্ষমতা

পুরুষ হলো ক্ষমতার আধার। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ক্ষমতার সকল কাঠামোতে পুরুষ সক্রিয়। অতএব নারী মূলত পুরুষের অধীন; সে কারণে পুরুষের ক্ষমতার চাহিদা মতো আচরণে নারী সাড়া দানে বাধ্য। ধর্ষণ করা তাই ক্ষমতার প্রকাশ।

 

পৌরুষ

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে পুরুষ, পুরুষত্ব, পৌরুষ ইত্যাদি বিষয়ে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস বিদ্যমান। যৌন-আধিপত্য বিস্তার করা, নারীকে দখল করতে পারা পৌরুষ বা পুরুষত্বের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। আর তাই নারীর ‘‘গায়ে হাত দেয়া’’, ‘‘ধস্তাধস্তি করা’’, ‘‘কুপ্রস্তাব’’ দেয়া এগুলো অনেবে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়। পুরুষের মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায় পৌরুষের ধারণা। নারীকে কব্জা করা পৌরুষের ব্যাপার বলে মনে করে ধর্ষক।

 

ইয়াং মেইল সিনড্রোম

ধর্ষকের মনস্তত্ত্বে কখনো কখনো কাজ করে ইয়াং মেইল সিনড্রোম। কিশোর বা তরুণরা যখন বয়সন্ধি থেকে যৌবনে উপনীত হয় তখন তাদের মধ্যে দেখা দেয় ইয়াং মেইল সিনড্রোম। এই বয়সে তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যত জীবন, সঙ্গী নির্বাচন, সামাজিক মর্যাদা নিয়ে ভাবনা তৈরি হয়, ঝুঁকি নেবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা গড়ে ওঠে। আর তাই বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতাপূর্ণ সমাজবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে নব্য যুবকরা। ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতা তার উপজাত হিসেবে জন্মায়।

 

প্রতিযোগিতা ও গ্যাং

প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকে এমন মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বাসও গড়ে ওঠে যে, আধিপত্য, দুঃসাহসিকতা, শরীরী শক্তি প্রভৃতি সঙ্গী নির্বাচনে সহায়ক। যার যত যৌনসঙ্গী আছে কিংবা যৌনভাবে যে যতো বেশি আধিপত্য ও আগ্রাসন চালাতে পারবে সে-ই গ্যাং লিডার বা নেতা। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে যেমন তৈরি হয়েছে কিশোর গ্যাং। গ্যাংগুলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও যৌন আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

 

সাইকোপ্যাথ

ধর্ষকামী মনোভঙ্গি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মনস্তাত্ত্বিকরা সাইকোপ্যাথের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকের মতে, সাইকোপ্যাথদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা বেশি; তারা অপরাধকে অপরাধ মনে করে না। অন্য অপরাধগুলোর মতো করে যৌন অপরাধকেও সাইকোপ্যাথরা অপরাধ মনে করে না।

 

পর্নোগ্রাফির প্রভাব

ধর্ষণ, যৌন আগ্রাসন  ও নিপীড়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ পর্নোগ্রাফি বা পর্নো-উপাদানের সহজপ্রাপ্যতা। পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে বলা হয়, পর্নোগ্রাফি যদি হয় তত্ত্ব, ধর্ষণ হলো তার প্রয়োগ ও অনুশীলন। আদতে তা-ই ঘটে থাকে। গবেষকরা এ বিষয়ক বিস্তর তথ্য-উপাত্ত হাজির করেছেন। পর্নোগ্রাফির আগ্রাসী যৌনতা পুরুষের মনস্তত্ত্বে নারী প্রসঙ্গে এবং নারী-পুরুষের যৌন-সম্পর্ক বিষয়ে ভুল বার্তা প্রেরণ করে। এ কারণে যে কাউকে ভোগ্য মনে করার মানসিকতা গড়ে ওঠে।

 

সক্ষম ভাবা

বিভিন্ন বয়সী ব্যক্তি ধর্ষণ ও নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বয়স্ক ব্যক্তিও ধর্ষণ করেন বা নারীকে নানাভাবে উত্যক্ত করেন। এর কারণ হিসেবে অনেক ধর্ষক মনে করেন, তিনি যৌনতার দিক থেকে ফুরিয়ে যান নি। ধর্ষণ কিংবা নারীকে সম্মত করা তার যৌন সক্ষমতার নির্দেশক।

 

পুরুষের যৌনতা অদম্য

ধর্ষকদের অনেকের ধারণা পুরুষের যৌনতা অদম্য, নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য। আর তাই দমন করতে না পারার দায় আসলে প্রকৃতির ওপর বর্তায়। ধর্ষণ করে ফেলার অর্থ হলো : অদম্য যৌনতাকে দমন করতে না পারা; এটা ধর্ষকের ব্যর্থতা নয়, পুরুষোচিত স্বভাব।

 

ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিতে জয়দীপ সরকার বলেন, প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ধর্ষকের মনোরোগ নেই; সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেউ কেউ অস্বাভাবিক যৌন আচরণ বা ধর্ষণ করে থাকলেও ধর্ষণ করার সঙ্গে মনোরোগের সম্পর্ক অনিবার্য নয়। ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব কোনো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আদলে গড়ে ওঠে না। একেক ধর্ষক একেক রকম মনোভঙ্গি প্রকাশ করে থাকে। প্রত্যেকের শ্রেণি, শিক্ষা, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান এক নয়। এ কারণে ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব একটি মাত্র প্রবণতা দ্বারা গঠিত নয়। তবে সব ধর্ষকই নারীকে যৌনবস্তু মনে করে থাকে; নারীর সম্মতি ধর্ষকের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।

 

সামগ্রিকভাবে মনে হয়, ধর্ষণকে শুধু ঘটনা হিসেবে না দেখে ধর্ষকের মনস্তত্ত্বের পাঠ নেয়াও জরুরি। একজন ধর্ষকের ধর্ষক হয়ে ওঠার কার্যকারণ ‍অনেক ধরনের। শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা ধর্ষণ ও ধর্ষকের ব্যাখ্যা ধর্ষণের অনেক ঘটনাকেই ব্যাখ্যা করতে পারে না। যেমন, ধরা যাক, বিবাহিত পুরুষ কর্তৃক ছেলে শিশু ধর্ষণ, পঞ্চাশোর্ধ্ব বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষ কর্তৃক ছেলে বা মেয়ে শিশু ধর্ষণ। সমাজের নিম্ন শ্রেণিরাই ধর্ষণ করে এই ধারণাও ব্যাখ্যা করতে পারে না পুরুষতন্ত্র বিষয়ক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। আসলে কে ধর্ষক নয়? এটিই একটি গুরুত্বপূূর্ণ প্রশ্ন; কারণ যেকোনো পেশা, শ্রেণি, বয়সের মানুষ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত কিংবা ধর্ষকামী মনোবৃত্তি পোষণ করেন। বাংলাদেশে বিষয়ক গবেষণা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ সম্ভাব্য ধর্ষক নিমূলে গবেষণাফল সহায়তা করতে সক্ষম।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here