ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ৩

নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান।

 

আফ্রিকান সাহিত্যের ভাষা

 

১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়ে আফ্রিকান সাহিত্য পাঠদান বিষয়ে নাইরোবিতে আয়োজিত এক কনফারেন্সে পঠিত ‘‘রিটেন লিটারেচার অ্যান্ড ব্ল্যাক ইমেজেজ’’ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধে কেনিয়ান লেখক ও বিদ্বজ্জন প্রফেসর মিকেরে মুগো উল্লেখ করেছিলেন রাইডার হ্যাগার্ডের কিং সলোমন’স মাইনস রচনায় গাগুল চরিত্রে একজন বয়স্ক আফ্রিকান নারীর বর্ণনা কিভাবে তাঁকে দীর্ঘসময় বয়স্ক আফ্রিকান নারীদের সামনে পড়লে সাংঘাতিক আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলতো।২২ সিডনি পয়টায়ার তাঁর আত্মজীবনী দিজ লাইফ-এ লিখেছেন কিভাবে তাঁর পঠিত সাহিত্যগুলোর কারণে তিনি আফ্রিকার সাথে সাপকে যুক্ত করেছিলেন। ফলে আফ্রিকার একটি আধুনিক শহরের আধুনিক হোটেলে তিনি ঘুমাতে পারেন নি সর্বদা সাপের ভয়ে থেকে, এমনকি বিছানার নিচেও! এই দুইজন তাদের ভয়ের উৎপত্তিস্থল ঠিকমতো খুঁজে বের করতে পেরেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই এই নেতিবাচক চিত্রকল্পগুলো গভীরে গেঁথে যায় এবং এর ফলে তাদের দৈনন্দিন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পছন্দের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে।

 

এজন্যই লিওপোল্ড সেদার সেংহর খুব স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে যদিও তার উপর ঔপনিবেশিক ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তথাপি পছন্দের সুযোগ পেলে তিনি ফরাসিকেই বেছে নিতেন। তিনি ফরাসির প্রতি তাঁর এই বিগলিত ভাব নিয়ে ছিলেন আবেগপূর্ণ :

আমরা আমাদের প্রকাশ করি ফরাসি ভাষায় কারণ এর রয়েছে সার্বজনীন যোগ্যতা এবং যেহেতু আমাদের বার্তা ফরাসি ও অন্যান্য মানুষকেই সম্বোধন করে। আমাদের ভাষাসমূহে ২৩ যেসব বলয় শব্দগুলোকে ঘিরে থাকে প্রাকৃতিকভাবেই সেগুলো হলো রক্ত ও প্রাণরস; আর ফরাসি শব্দ থেকে বিচ্ছুড়িত হয় হীরকের মতো হাজারো রশ্মি।২৪

 

এই তেল লেপনের পুরস্কার হিসেবে সেংহরকে ফ্রেঞ্চ একাডেমিতে একটি সম্মানিত স্থান দেয়া হয়েছে, এটি হলো সেই প্রতিষ্ঠান যার কাজ ফরাসি ভাষার নিরাপত্তা বিধান করা।

 

মালাউয়িতে বান্দা তার নিজের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলেছেন দ্য কামুজু একাডেমির পথ থেকে, এই একাডেমির পরিকল্পনা করা হয়েছে মালাউয়ির উজ্জ্বল ভবিষ্যতসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে ওস্তাদ হতে সাহায্য করতে।২৫

এটি একটি ব্যাকরণ বিদ্যালয় যার পরিকল্পনা আছে সেইসব ছেলে ও মেয়ে তৈরি করার যাদেরকে পাঠানো হবে হার্ভার্ড, শিকাগো, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ এবং এডিনবার্গের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে আর তারা অন্য যে কোন স্থানের যে কারো সাথে সমানভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।প্রেসিডেন্ট নির্দেশনা দিয়েছেন যেন লাতিনকে পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রীয় অবস্থানে রাখা হয় তার জন্যে। সকল শিক্ষকেরই তাদের শিক্ষাগত অভিজ্ঞতায় ন্যুনতম হলেও কিছুটা লাতিন থাকতে হবে। ড. বান্দা প্রায়ই বলে থাকেন যে ল্যাটিন ও ফরাসি ভাষার মতো ভাষাগুলোতে জ্ঞান না থাকলে কারো পক্ষেই ইংরেজি ভাষায় পুরোপুরি দক্ষ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়…২৬

 

মালাউয়ির কেউই এই একাডেমিতে শিক্ষাদান করার অনুমতি পান নি, কেউই যথেষ্ট ভালো নন, তাই সকল শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে ব্রিটেন থেকে। একজন মালাউয়ি নাগরিকের দ্বারা ইংরেজি ভাষার মান বা পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে! আপনি কি জাতীয় বিষয়ের প্রতি ঘৃণার এমন আর কোন উদাহরণ পাবেন? এবং বিদেশি, যদিও মৃত এমন কিছুর প্রতি এমন দাসোচিত পূজনীয় মনোভাব?

 

ইতিহাসের বই ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যে অনেক কিছুই আন্দাজে বা সত্য ধরে নিয়ে বলা হয়েছে বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কর্মসূচী বা নীতিমালা, ব্রিটিশদের পরোক্ষ শাসন (অথবা সাংস্কৃতিক কর্মসূচীর অভাব) এবং ফরাসি ও পর্তুগিজদের সচেতন সাংস্কৃতিক আত্মীকরণের কর্মসূচী নিয়ে। এগুলো হলো বিস্তারিত ও গুরুত্ব দেয়ার মতো বিষয়। চূড়ান্ত প্রভাব ছিল একই রকম। সার্বজনীন যোগ্যতাসম্পন্ন ভাষা হিসেবে সেংহরের ফরাসি ভাষাকে গ্রহণ করার সাথে ১৯৬৪ সালে চিনুয়া আচেবের ইংরেজিকে গ্রহণের কোন পার্থক্য নেই। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা যারা উত্তরাধিকারসূত্রে ইংরেজি ভাষাকে পেয়েছি তাদের এই উত্তরাধিকার প্রাপ্তির সঠিক মূল্যায়ন করা হয়তো সম্ভব নয়” ।২৭ আমরা যারা আমাদের চিন্তার সৃজনশীল বাহন হিসেবে আমাদের মাতৃভাষাগুলোকে বাদ দিয়ে ইউরোপিয়ান ভাষাকে গ্রহণ করেছি তার পেছনের ধারণাগত ভিত্তি কারোরই এর চেয়ে আলাদা নয়।

 

আসলে ১৯৬২ সালের আফ্রিকান রাইটার্স অব ইংলিশ এক্সপ্রেশন শীর্ষক কনফারেন্সটি ছিল বছরের পর বছর ধরে বাছাইকৃত শিক্ষা ও কঠোর অভিভাবত্বের ফলে আমরা যা গ্রহণ করে নিয়েছিলাম — ‘‘আমাদের সাহিত্যে ইংরেজির অনাক্রম্য অবস্থান বিষয়ে নিয়তিবাদী যুক্তি” — সমর্থন ও গৌরবের সাথে তারই স্বীকৃতি। যুক্তিটি গভীরভাবে নিহিত ছিল সাম্রাজ্যবাদে, আর মাকারেরেতে আমরা এই সাম্রাজ্যবাদ ও তার প্রভাব নিয়ে কোন আলোচনা করিনি। এটা হলো কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যবস্থার চূড়ান্ত বিজয়ের মুহূর্ত যখন কর্তৃত্বের অধীনস্তরা কর্তৃত্বের গুণ গাইতে থাকে।

ছয়
মাকারেরে কনফারেন্সের পরের ২০ বছরে ইউরোপীয় ভাষায় আফ্রিকানদের অনেক উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক রচনা করতে দেখা যায়। অল্প সময়ের ভেতর এগুলো দলগত পাঠের ঐতিহ্য ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ শিল্পে পরিণত হয়।

 

এসব সাহিত্য ছিল ঔপনিবেশিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে জন্ম নেয়া পেটি-বুর্জোয়াদের সাহিত্য। এসব রচনাকে যে ভাষিক মাধ্যম দেয়া হয়েছিল তা দিয়ে এর চেয়ে অন্য কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বে¡র ক্ষেত্রে এই শ্রেণিটির ক্রমবর্ধমানতাই এসব সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হতো। কিন্তু আফ্রিকার পেটি-বুর্জোয়ারা হলো বিভিন্ন ধারাসম্পন্ন একটি বৃহৎ শ্রেণি। আমি আমার ডিটেইনড: আ রাইটার’স প্রিজন ডায়েরি গ্রন্থে যাদের বিদেশি শক্তির দালালি করা বুর্জোয়া বলেছি সেরকম পশ্চিমা মেট্রোপলিসের বুর্জোয়াদের সাথে উপনিবেশের মানুষের ভেতর যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা সাম্রাজ্যবাদের স্থায়ী সহায়তাকারী অংশটি থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদী বা দেশিপ্রেমিক বুর্জোয়ারা যারা ভবিষ্যত খুঁজে পায় একটি বলিষ্ঠ স্বাধীন রাষ্ট্রে যার ভিত্তি হলো আফ্রিকান পুঁজিবাদ বা কোন এক ধরনের সমাজতন্ত্র। স্রষ্টা, বিষয়গত আগ্রহ ও ভোগগত দিক থেকে ইউরোপীয় ভাষায় লেখা এসব আফ্রিকান সাহিত্য ছিল মূলত জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া ঘরানার।

 

এসব সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গণে উপনিবেশ থেকে উদ্ভূত হয়ে রাজনীতি, ব্যবসা ও শিক্ষার মতো খাতে দেশকে নেতৃত্ব দিতে থাকা এই শ্রেণিটিকে সহায়তা করেছিল। এবং তাদেরও সহায়তা করছিল যারা সামনে উঠে আসার চেষ্টা করছিল। এই সাহিত্যের দ্বারা আফ্রিকাকে বিশ্বের কাছে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিলো এই বলে যে আফ্রিকারও একটি অতীত আছে এবং আছে মর্যাদাপূর্ণ সংস্কৃতি ও অন্যান্য মানবিক দুর্বোধ্যতা।
এই সাহিত্যগুলোর মাধ্যমে এই শ্রেণিটি নিজেদের ভেতর আসঞ্জনশীল হয়ে উঠছিল এবং একই সাধারণ সাহিত্যিক কাঠামোতে নিজেদের দেখতে পাচ্ছিলো। আবার এর ফলে মেট্রোপলিটন বুর্জোয়াদের সাথে কৃষকের সংস্কৃতির যে অসহজ স¤পর্ক তা আরো বেশি শিথিল হয়ে যাচ্ছিল। তবে এই সাহিত্য এই শ্রেণিটিকে আত্মবিশ্বাসী করেছিল। ইউরোপের বর্ণবাদী গোঁড়ামির বিপরীতে এখন পেটি-বুর্জোয়াদের ছিল একটি অতীত, একটি সংস্কৃতি ও নিজস্ব একটি সাহিত্য। এসব রচনার লিখনশৈলীর ধরনে এই আত্মবিশ্বাস চোখে পড়তো। এতে থাকতো ইউরোপীয় বুর্জোয়া সভ্যতার নিহিতার্থের তীক্ষ্ণ সমালোচনা কিংবা আফ্রিকার যে পৃথিবীকে নতুন কিছু দেয়ার আছে সেরূপ বর্ণনা করার এক ধরনের তৈরিকৃত ছাঁচ। স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগের ও অব্যবহিত পর পেটি-বুর্জোয়াদের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী অংশটির রাজনৈতিক প্রাবল্যের প্রতিফলন ঘটে এসব রচনায়।

 

ফলে এসব সাহিত্য ছিল যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব যেমন চীন ও ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ও উপনিবেশের বিরুদ্ধে মুক্তি, কেনিয়া ও আলজেরিয়ার সশস্ত্র উত্থান, ঘানা ও নাইজেরিয়ার স্বাধীনতার সাথে সাথে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আরও আরও স্বাধীন হতে চলা রাষ্ট্রগুলোর জন্যে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মহান অভ্যুত্থান। সাধারণ রাজনৈতিক জাগরণ দ্বারা এগুলো উদ্বুদ্ধ ছিল। কৃষকশ্রেণির প্রবাদ, পৌরাণিক কাহিনি, গল্প, ধাঁধা এবং জ্ঞানমূলক বক্তব্য থেকে এগুলো শক্তি সঞ্চয় ও নিজেকে গঠন করেছিল। এতে ছিল আশাবাদ। কিন্তু পরে যখন বিদেশিদের দালালি করা অংশটি রাজনৈতিক ক্ষমতায় এলো এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে অর্থনৈতিক সংযোগ দুর্বল না করে আরো শক্তিশালী করে একটি নিশ্চিত নব্য-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো, তখনই এই সাহিত্যগুলোর ধরন অনেক বেশি সমালোচনামূলক, নৈরাশ্যবাদী, তিক্ত, অভিযোগে পূর্ণ ও স্বপ্নভঙ্গের মতো হতে শুরু করলো। বিস্তারিত বর্ণনা, গুরুত্বারোপ এবং অন্তর্দৃষ্টির মাত্রার পার্থক্য থাকলেও এসব সাহিত্যে স্বাধীনতা পরবর্তী আশাবাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ছিল সর্বসম্মতভাবে উপস্থিত। কিন্তু কাদেরকে লক্ষ্য করে এসব ভ্রান্তিকর কাজ, অপরাধ ও ভুল, গুরুত্ব না দেয়া অভিযোগসমূহ অথবা নৈতিক বিষয়াদির পরিবর্তনের জন্যে ডাক দেয়া হচ্ছিল? সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের? ক্ষমতায় থাকা পেটি-বুর্জোয়াদের? সামরিক বাহিনীর, যারা ঐ শ্রেণিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ? এটি বেছে নিয়েছিল অন্য এক অডিয়েন্সকে, সাধারণ জনগণ হিসেবে পরিচিত শ্রমিক শ্রেণি ও বিশেষত কৃষকশ্রেণিকে। নতুন অডিয়েন্স ও নতুন মুখীনতার বিষয়টি এসব সাহিত্যের সরল হয়ে যাওয়া গঠনে প্রতিফলিত হয়, যেখানে খুবই সরাসরি কথা বলা হতো, এমনকি সরাসরি কাজে নেমে যাওয়ার কথাও বলা হতো। রচনাগুলোর বিষয়েও এই বিষয়টি প্রতিফলিত হতো। ঐতিহাসিকভাবে ভুল অন্ধকারে আবৃত একটি অভিন্ন জনতা হিসেবে আফ্রিকাকে না দেখে এসব সাহিত্যে নব্য-ঔপনিবেশিক সমাজের এক ধরনের শ্রেণি বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের প্রয়াস দেখা যায়। তবে এই অনুসন্ধানগুলো তখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ভাষাগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল, আর এসব ভাষার ব্যবহারকে আগের চেয়ে কম শক্তি ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে প্রতিহত করা হতো। ভাষাগত পছন্দের কারণে এর উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হয়। এবং পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, দাপ্তরিক কর্মচারীরাই সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ছিল আর এদের মাধ্যমেই এসব সাহিত্যের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের ভাষাগত বেড়ায় আটকা পড়ে এখানেই সাহিত্যগুলো খুঁটি গেড়ে বসলো।

 

এর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা অডিয়েন্সেই থেকে গেলো, যা সবসময়ই ছিল। ভাষার পছন্দের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পেটি-বুর্জোয়ারাই এসব সাহিত্যের পাঠকে পরিণত হয়। অনেকগুলো প্রতিযোগী শ্রেণির ভেতর অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে চলমান টানাপোড়েনের ফলে পেটি-বুর্জোয়াদের মনস্তাত্ত্বিক গঠনে ছিল দোদুল্যমানতা। যখন যে শ্রেণির কাছাকাছি আসতো তখন সেই শ্রেণির আদলেই সাহিত্যগুলো গিরিগিটির মতো রঙ পাল্টাতো। এগুলো জনগণের ভেতর বিপ্লবী সুর তুলতে পারতো, অথবা নিশ্চুপতা, ভয়, নৈরাশ্যবাদ, আত্মকেন্দ্রিকতা, অস্তিত্ববাদী যন্ত্রণার দিকে নিয়ে যেতে পারতো, অথবা প্রতিক্রিয়াশীল সময়ের ক্ষমতা কাঠামোর সাথে সহযোগিতা করতে পারতো। আফ্রিকায় এই শ্রেণিটি সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া ও তার দালাল নব্য-ঔপনবেশিক শাসক শ্রেণি আর কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি তথা জনগণের মাঝে সবসময় দোদুল্যমান থেকেছে। নিজের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক গঠনে এই যে পরিচয় সংকট তা এই শ্রেণি দ্বারা উৎপাদিত সাহিত্যেও প্রতিফলিত হতো। মাকারেরে কনফারেন্সে সংজ্ঞায়ন নিয়ে যে চিন্তাবিষ্টতা তাতে এই পরিচয় সংকটটিই ফুটে উঠেছিল। এই পরিচিতি বা পরিচয়ের সংকটকে সাহিত্যে বা রাজনীতিতে পুরো সমাজের পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হতো। ইউরোপীয় ভাষাসমূহে রচিত সাহিত্যগুলোকে এমনভাবে আফ্রিকান সাহিত্য বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো যেন আফ্রিকান ভাষার কোন সাহিত্য কখনোই ছিল না। ভাষা প্রশ্নে বাস্তব মোকাবেলা এড়িয়ে গিয়ে পরিচয়ের মিথ্যা একটি পোশাক পরে থাকার এই চেষ্টা ছিল স্পষ্ট। এটি ছিল আফ্রিকান সাহিত্যের সিংহাসনে বসার দাবিদার। ইউরোপীয় ভাষাগুলোই আদতে আফ্রিকান ভাষা, এই ধারণার উপর উপর্যুপরি জোর দিয়ে কিংবা ইংরেজি বা ফরাসি ভাষার আফ্রিকায়ন করে — যদিও এটুুকু নিশ্চিত করা হতো যে এই ভাষাগুলো তবুও ইংরেজি বা ফরাসি বা পর্তুগিজ হিসেবে শনাক্তোপযোগী — জানহেইঞ্জ জাহন যাকে নয়া-আফ্রিকান সাহিত্য বলেছিলেন তা এই উভয় সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল।

 

এই পদ্ধতিতে, এ সাহিত্যগুলো মিথ্যা ও উদ্ভটরূপে একটি ইংরেজিভাষী (অথবা ফরাসি বা পর্তুগিজ) আফ্রিকান কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি তৈরি করলো যা ছিল ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া ও বাস্তবতার স্পষ্ট বাতিলীকরণ বা মিথ্যাকরণ। এহেন ইউরোপীয় ভাষাভাষী কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি শুধুমাত্র এসব উপন্যাস ও নাটকেই দেখা যেত। আর এসবের সাথে কখনো কখনো যুক্ত হতো পেটি-বুর্জোয়াদের দ্বিধান্বিত মানসিকতা, পরিহারপ্রবণ আত্মপ্রত্যাশা, মানুষের অস্তিত্বশীল তীব্র মনোঃকষ্ট অথবা দুইটি বিষয়ের মাঝে সিদ্ধান্ত নিতে না পারার বাস্তবতা।
যদি এই শ্রেণিটির হাতে আফ্রিকান ভাষাগুলোকে স¤পূর্ণভাবে ছেড়ে দেয়া হতো, তাহলে ভাষাগুলোর অস্তিত্ব বিলোপ ঘটতো, একেবারে স্বাধীনভাবে!

 

উৎস ও টীকা

২২. প্রবন্ধটি এখন আফ্রিকান লিটারেচার ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত আকিভাগা ও গাচুকিয়াহর দ্য টিচিং অব আফ্রিকান লিটারেচার ইন স্কুলস-এ পাওয়া যায় — লেখক

২৩. আফ্রিকান ভাষাসমূহ — অনুবাদক

২৪. এথিওপিকেস, লে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪-ও তাঁর কবিতাসমূহের ভূমিকায় সেংহর তাঁকে করা প্রশ্ন ‘‘আপনি কেন ফরাসিতে লেখেলেখি করেন?” — এর উত্তর দেন। মূল বইতে এখানে ফরাসি ভাষায় পুরো লেখাটি দেয়া ছিল যেখানে দেখা যায় ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের সাথে নিজের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে তিনি কেমন আবেগপূর্ণ।

কিন্তু আমাকে সেই প্রশ্নটাই জিজ্ঞেস করা হবে: ‘‘কেন আপনি ফরাসি ভাষায় লেখালেখি করেন?” কারণ আমরা সংস্কৃতির বর্ণসঙ্কর, কারণ আমরা নিজেদের নিগ্রোদের মতো ভাবি, আমরা ফরাসিতে কথা বলি কারণ, এটা একটা সার্বজনীন ভাষা, যা আমাদের বার্তা ফ্রান্সের ফরাসিসহ অন্যদের কাছেও বহন করে, কারণ ফরাসি একটা সহৃদয়বান আর সৎ ভাষা। কে বলে এটা শুধু প্রকৌশলী আর কূটনীতিকদের কাঠখোট্টা ভাষা? তবে এটা অস্বীকার করবোনা যে থিসিসের সুবাদে আমিও এককালে একথা বলিনি। সেজন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ আমি তার আগ্রহ পাওয়ার, চিন্তা করার, শিক্ষা লাভের উৎস জানি এবং সে দুই ভাষার গুণাতীত। কোখ্নেই শোনো, লওত্রেআমো, হৃমবো, পেগুই শোনো, ক্লদেল শোনো। মহান হুগোকে শোনো। ফরাসিদের আছে অসাধারণ সব বাদ্যযন্ত্র যেগুলো দিয়ে এমন কোন সুর নেই যা বাজানো যায় না, সবচেয়ে মিষ্টি সুর থেকে শুরু করে ঝড়ের শব্দ পর্যন্ত সবই তোলা যায় এগুলোয়। কখনো বারে বারে আবার কখনো একসাথে বাজতে থাকে বাঁশি, ওবো, সানাই/ভেঁপু , মাদল (ট্যাম ট্যাম) অথবা ক্যানন। বিমূর্ত শব্দের ভাণ্ডারও আমরা পেয়েছি ফরাসিদের কাছেই — আমাদের মাতৃভাষায় যেটার বেশ অভাব আছে —যেখানে অশ্রু মূল্যবান পাথরে রূপ নেয়। আমাদের মতে, শব্দগুলো স্বভাবগতভাবেই একটা প্রাাণশক্তি ও আবেগের আভায় পরিপূর্ণ। ফরাসি ভাষার শব্দগুলো যেন হাজার বাতির আলোর মত উজ্জ্বল, ঠিক যেন হীরা। আলো, যা আমাদের রাতকে করে আলোকিত। (অনুবাদকের জন্যে মূল ফরাসি থেকে অংশটি অনুবাদ করে দিয়েছেন তাসনুভা আলম অহনা — অনুবাদক)

ভাষা বিষয়ে সেংহরের আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দেখা যেতে পারে যা আরমান্দ গুইবারের নেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আর যা প্রকাশ হয়েছিল লিওপোল্ড ওয়ার সেংহর শিরোনামে প্রেজেন্স আফ্রিকেইন-এ ১৯৬২ সালে।

একথা সত্যি যে ফরাসি আমার মাতৃভাষা নয়। সাত বছর আগে যখন শেখা শুরু করি, ‘জ্যাম’, ‘চকোলেট’ এ ধরনের কিছু শব্দের বেশি বলতে পারতাম না। আর আজ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফরাসিতেই চিন্তা করতে পারি, বুঝতে পারি- আমার কি লজ্জা পাওয়া উচিত? অন্য অনেক ভাষার চেয়েই বেশি সাবলীল আমি এতে। ফরাসি আর এখন আমার কাছে কোনো বিদেশি বাহকের মতো ভাষা নয় বরং এটা এখন আমার চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফরাসি ভাষার যে দিকটা এখনও আমার কাছে বেশ রহস্যময় লাগে, সেটা হলো এর শাস্ত্রীয় মেজাজ। তবে উষ্ণ আবেগপ্রবণতার প্রভাব ছাড়াই আমি স্বাভাবিকভাবেই এর চাপা ফ্রেমে বড় ছবি আঁটানোর চেষ্টা করেছি। (এই অংশটিও মূল ফরাসি থেকে অনুবাদ করে দিয়েছেন তাসনুভা আলম অহনা —অনুবাদক) — লেখক

২৫. হাস্টিংস কামুজু বান্দা, ১৯৬৬ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত মালাউয়ির রাষ্ট্রপ্রধান — অনুবাদক

২৬. জিম্বাবুয়ে হেরাল্ড, আগস্ট ১৯৮১  — লেখক

২৭. চিনুয়া আচেবে, দ্য আফ্রিকান রাইটার অ্যান্ড দ্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ, সূত্র: মর্নিং ইয়েট অন ক্রিয়েশন ডে, পৃ. ৫৯ — লেখক

২৮. বেশির ভাগ লেখকই এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পাঠকেরা মূলত ছিল বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে। সেসব সাহিত্যের জন্য যে বিষয় নির্ধারিত হয়েছিল, দ্য নভেলিস্ট অ্যাজ আ টিচার শীর্ষক প্রবন্ধে আচেবের এই মন্তব্য ছিল তার জন্যে নির্দেশনামূলক :

‘‘আমি যদি ঈশ্বর হতাম, যে কারণেই হোক না কেন বর্ণবাদী অধস্তনতাকে আমাদের মেনে নেয়ার বিষয়টিকে সবচেয়ে খারাপ মনে করতাম। এটি নিয়ে কাজ করার বা অন্যদের দোষ দেয়ার জন্যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, এই দায় ও দোষারোপের যতটা তাদের প্রাপ্য তার চেয়ে। এখন প্রয়োজন হলো পেছনে দেখে খুঁজে বের করা যে আমরা কোথায় ভুল করেছি, কোথায় বৃষ্টি আমাদের আঘাত করতে শুরু করেছিল (ইগবো প্রবাদÑঅনুবাদক)। এখানে একটি সঠিক বিপ্লব রয়েছে যাকে আমি সমর্থন করি। যার দ্বারা আমার সমাজ তার নিজের উপর বিশ্বাস ফিরে পাবে এবং সরে আসবে বছরের পর বছর ধরে চলা মানহানি ও নীচতার জটিলতা থেকে।” (মর্নিং ইয়েট অন ক্রিয়েশন ডে, পৃ. ৪৪)

যেহেতু কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি কখনো তাদের আফ্রিকানতা নিয়ে সন্দেহে ছিল না, তাই এখানে শিক্ষিত অথবা পেটি-বুর্জোয়া আফ্রিকানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। উপরন্তু যদি ‘আমাদের’ শব্দের স্থলে ‘পেটি-বুর্জোয়া’ এবং ‘আমাদের সমাজ’ শব্দের স্থলে ‘পেটি-বুর্জোয়া সমাজ’ ব্যবহার করা হতো তাহলে এই বক্তব্য হতো এর অডিয়েন্সের জন্যে একেবারে সঠিক, যথাযথ ও বর্ণনামূলক। নিশ্চিতভাবেই এই শ্রেণির ভেতর একটি আদর্শিক বিপ্লব হলে তা সমগ্র সমাজকে প্রভাবিত করতো — লেখক

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here