চিন না চীন?

ভাষা বিষয়ে ধারাবাহিক গদ্য। প্রতি মাসে ৩টি করে গদ্য প্রকাশিত হবে। এতে থাকবে বাংলা ভাষার শব্দ, বানান, উচ্চারণ, ব্যাকরণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।

ধারাবাহিক গদ্য

বানান সমস্যা? এ নিয়ে নানা সমস্যা! ইদানিং প্রশ্ন শোনা যায় : চিন? নাকি চীন? তা-ই নিয়ে চিনচিনে ব্যথা। সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন তারিক মনজুর।

 

দেশটির নাম বাংলায় ‘চিন’ কিংবা ‘চীন’। বানান বোঝার জন্য বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান (২০১৬) খুললাম। না, চ বর্ণের ভুক্তিতে চিন বা চীন শব্দের কোনোটি সরাসরি নেই। ভালো, পৃথিবীতে কম-বেশি দুইশ দেশ আছে। চিন/চীনকে জায়গা দিতে গেলে অন্য দেশগুলোকেও অভিধানে আনতে হবে। তবে চীনবাস, চীনা, চীনাংশুক, চীনাঘাস ইত্যাদি শব্দের সূত্রে জানলাম, জামিল চৌধুরী দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে চীন লেখার পক্ষপাতী।

 

বাংলা বানানের নিয়ম হিসেবে অনেক ব্যাকরণ বইয়ে লেখা আছে: দেশ-জাতি-ভাষার নামে হ্রস্ব ই ব্যবহৃত হবে। এই নিয়মে একসময়ের ‘গ্রীস’ হয়ে গেছে গ্রিস, ‘জার্মানী’ হয়ে গেছে জার্মানি, ‘আরবী’ হয়ে গেছে আরবি; এমনকি ‘বাঙ্গালী’ বা ‘বাঙালী’ হয়ে গেছে বাঙালি। কারণে-অকারণে, যুক্তিতে-অযুক্তিতে অনেক দীর্ঘ ঈ আর এর কারচিহ্নকে আমরা বদলে দিয়েছি। যেমন, ‘পল্লী’ হয়ে গেছে পল্লি, ‘শ্রেণী’ হয়ে গেছে শ্রেণি, ‘দাদী’ হয়ে গেছে দাদি, ‘সোনালী’ হয়ে গেছে সোনালি, ‘রচনাবলী’ হয়ে গেছে রচনাবলি, ‘রাণী’ হয়ে গেছে রানি… উদাহরণ আর বাড়ানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দীর্ঘ ঈ-কারকে অর্ধেক কবরে ঢুকিয়ে এখন চিন/চীনকে নিয়ে যত দুশ্চিন্তা!

 

বাংলা বানানকে সচেতনভাবে ধ্বনিমূলক করার প্রচেষ্টা রবীন্দ্রনাথের কাল থেকে দেখা যায়। মধ্যযুগে যখন ছাপাখানা ছিল না, পুথি হাতে লেখা হতো, তখনও বানান ছিল মূলত ধ্বনিমূলক। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। গোরা আমলাদের শেখানোর জন্য এই কলেজের উদ্যোগে বাংলা গদ্যবই তৈরি হতে থাকে। সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে এ সময়ে বাংলা অনেক বানান নতুন চেহারা লাভ করে। শব্দের আদিরূপ ধরে নিয়ে বানানকে ব্যুৎপত্তিমূলক করার চেষ্টা এখান থেকে শুরু। বিশ শতকে এসে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল হাই ধ্বনিমূলক বানানের কথা বলেছেন। এ সময়ে বিভিন্ন ধ্বনিবিজ্ঞানী যখন বানানের কথা বলেছেন, তাঁরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই বানানকে ধ্বনিমূলক করতে চেয়েছেন। যেমন, ‘স্বাধীনতা’কে সাধিনতা, ‘দুঃখ’কে দুক্খো ইত্যাদি লেখার প্রস্তাব করেছেন। ধ্বনিবিজ্ঞানীদের বাইরেও অনেক ব্যক্তি এ রকম মত দিয়েছেন। বাংলা উচ্চারণে দীর্ঘ স্বর নেই, এই যুক্তিতে দীর্ঘ ঈ আর দীর্ঘ ঊ-কে বাদ দিয়ে হ্রস্ব ই আর হ্রস্ব উ-কে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ঈ, ঊ-সহ আরও কিছু বর্ণ-সংকোচনের প্রস্তাব করেছেন অনেকে।

 

মুশকিল হলো, বাংলা বানানের কোনো মূলনীতি নেই। বানানের মূলনীতি দাঁড় করানোও খুব সহজ নয়। যদি কোনো নির্দিষ্ট মূলনীতি আমরা দাঁড়ও করাই, এর পরিপ্রেক্ষিতে বানানের যে চেহারা দাঁড়াবে তা আমাদের চোখ সইবে না। ওই মূলনীতিকে মেনে লিখতে গেলে আমাদের কলমও চলবে না। বানানের ক্ষেত্রে তাই প্রথাকে মেনে নেয়াই ভালো। গত চল্লিশ বছরে বানানের প্রবণতা দেখুন। ‘পাখী’গুলো পাখি হয়ে গেছে, ‘বাড়ী’ হয়ে গেছে বাড়ি, ‘গাড়ী’ হয়ে গেছে গাড়ি… এখন ‘ঈদ’, ‘ঈগল’ এসব শব্দও ইদ, ইগল হয়ে যাচ্ছে। এখন শব্দের ব্যুৎপত্তি ‘ধরে নিয়ে’ বানান নির্ধারণ করার নীতিতে ফেরা আর ঠিক হবে না। যেসব শব্দ অন্য ভাষা থেকে এসেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে মূল উচ্চারণ কী ছিল, বিশেষ প্রয়োজন না হলে তাও দেখার দরকার নেই। তবে, বিদেশি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণেই দীর্ঘ স্বরের প্রয়োজন ছিল বেশি।

 

গ্রিস, জার্মানির মতো নির্দ্বিধায় ‘চিন’ লেখা উচিত। সমস্যা চিনে আর কতটুকু? সমস্যা তো ‘মালদ্বীপ’ আর ‘শ্রীলংকা’য় আরও বেশি। এসব দেশকেও হ্রস্ব ই দিয়ে মালদিপ আর শ্রিলংকা লিখলে মোটের উপর সমস্যা কমবে। অনেকে অবশ্য ‘দ্বীপে’র সঙ্গে মালদিপের আর ‘শ্রী’র সঙ্গে শ্রিলংকার সম্পর্ক খুঁজবেন। বানানকে ব্যাকরণ বইয়ের অধ্যায় বানিয়ে আমরা সমস্যা বাড়িয়েছি। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা আর চীন লিখতে চাইলে টাইম মেশিনে করে অন্তত তিন দশক আগে চলে যেতে হবে। তারপর দীর্ঘ ঈ আর দীর্ঘ ঊ-কে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলতে হবে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here