মানুষের মন বিচিত্র হওয়া সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে সম্ভবত সাধারণ সূত্রবদ্ধ অনুভূতি প্রকাশ করে। অর্থাৎ, কোনো কোনো অনুভূতি সবার ক্ষেত্রে প্রায় একইরকম। যে-প্রাণীটি আয়তনে, আকারে অন্যদের থেকে বড়, যে-ফুলটির গন্ধ মনে দাগ কাটে, যে-পাখি মিষ্টি সুরে গান করে সবাই সেগুলোকে বেশি বেশি মনে রাখেন। প্রাণীদের মধ্যে উট, হাতি, কুমির ; ফুলের মধ্যে হাসনাহেনা, গোলাপ, জবা, বেলির নাম একটু বেশিই মনে থাকে। গন্ধহীনদের নাম মনে রাখাটা যেন নিষ্প্রয়োজন হয়ে ওঠে। আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয় নি। বনের গহিনে চুপিচুপি ফোটা ফুলকে আলাদাভাবে মনে রাখতে কষ্ট করি নি কখনো। কিন্তু ব্যতিক্রম হয়, মানুষের জীবনে ব্যতিক্রম ঘটে, আমার ক্ষেত্রে ও ঘটেছে।
মোহিনী গন্ধযুক্ত আর নীল ও লাল রঙের ফুল আমার বেশি পছন্দ। কিন্তু এমন কখনো হয়নি যে, শুধু সৌন্দর্যের জন্য আমি কাউকে মনে রেখেছি। প্রায় গন্ধহীন ফুলের দেশের এক রাজকন্যা আমার মনে জেঁকে বসেছে। অন্ধকার রাতে কখনো সূর্যের তেজে দীপ্তিময় মুকুট পরা রাজকন্যা যদি চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভূত হয় সে হবে নাম-না-জানা এক ক্যাকটাসের ফুল। এমনই এক ফুল যার গুণে শুধু নয়, রূপে মুগ্ধ হবেন আপনিও।
Night-blooming cereus একটি ক্যাকটাস (cactus) জাতীয় ফুলের ইংরেজি নাম। ফুলটির নামকরণ করেন সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস। তিনি ফুলটির অর্গানিজম নিয়ে গবেষণা করে ক্যাকটাস উদ্ভিদের ক্লাসিফিকেশন করেছিলেন ১৭৫৩ সালে। Royal Gardens, Hampton Court Palace–এ ১৭০০ সালের আগে গাছটি বেড়ে উঠেছিলো। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম সেলেনাইরাস গ্রান্ডিফ্লোয়াস (Selenicerus Grandiflorus)। Selenicerus শব্দটি গ্রিক এবং লাতিন ভাষার দুটি শব্দের সন্ধির মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। Selene (Greek moon goddess, গ্রিকদের চাঁদের দেবী) এসেছে গ্রিক দেশীয় ভাষা থেকে। Cereus (Candle, বাতি বা দীপ্তিময় আলো) এসেছে লাতিন ভাষা থেকে। Grandiflorus-এর উৎসও লাতিন। যার অর্থ, ‘large flowered বা বৃহদাকার পুষ্প।’
ফুলটি কেবল রাতেই ফোটে। সূর্য ডোবার পর ফুলগুলো পাপড়ি মেলতে শুরু করে, প্রথম প্রহরের কাছাকাছি সময়ে ফুলটি সম্পূর্ণ বিকশিত হয়। তবে রাতে ফোটার কারণে অনেকের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়, অন্ধকারে যার বিকাশ সূর্যের প্রথম কিরণ অনুভবের আগে তার চিরবিদায়। অর্থাৎ, সূর্য ওঠার আগেই পাপড়ি গুলো বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকারে সে নিজেকে মেলে ধরে।
Night-blooming cereus বছরে একটি মৌসুমে ফুটে থাকে। ইউরোপে মে-জুন মাসে, বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে ফুলটি ফুটে থাকে। সাধারণত ফুলটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় ফোটে। ইংরেজিতে ফুলটিকে Night-blooming cereus বা Queen of Night বলা হয়। কিন্তু বাংলাতে সর্বজনগ্রাহ্য কোন নামকরণ হয়নি। সুদূর ইংল্যান্ডে এটাকে প্রথমবার পাওয়া গেছে বলে আমরা জেনেছি। Night-blooming cereus আমাদের দেশেও ছিলো কিন্তু এই অসাধারণ ফুল অথবা গাছ নিয়ে কোন লেখা নেই। রাতের চাঁদ আর দিনের সূর্যের মতো গড়ন নিয়ে যার উৎপত্তি সে ফুলের পরিচয় সবাই পেয়ে ওঠে না ; কারণ, সে অগোচরে ফোটে। চম্পা, চামেলি, গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলীফুলসহ হরেকরকম ফুল বাঙালির সংগীত, কাব্য আর কথা সাহিত্যের উপাদান হয়েছে বারবার। অনেক ফুল ঠাঁই পেয়েছে আমাদের সাহিত্যের পাতায়।
অনেক ফুল যেমনি করে চিত্তাকর্ষণ করেছে প্রেমিক কিংবা লেখকের, তেমনি করে অনেক ফুলের পরিচিতিই গড়ে উঠে নি মানুষের মাঝে । তেমনই অপরিচিতা আমাদের Night-blooming cereus। ফুল-প্রেমীরা কিছু না কিছু লিখবেন আশা করি অসাধারণ এই সৃষ্টিকে নিয়ে।
আমাদের বাড়িতে ক্যাকটাস গাছটি খুব ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। আলাদাভাবে কখনো এই গাছ সম্পর্কে জানার উৎসাহ হয় নি। গত রাতে গোটা দুয়েক ফুল দেখে তাজ্জব বনে যাই। উৎসাহ বোধ করি জানার, কেন এই গাছ বাড়িতে আসলো। কবে, কিভাবে আনা হলো সেই গল্প শুনে ফেলি বাবার কাছে। আমার ঠাকুরদা প্রায় ত্রিশ বছর আগে ঝোপঝাড় থেকে কেটে গাছটি বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাড়ির একটা কুলগাছের সাথে পেঁচিয়ে দেন। কোনো প্রকার মাটির সংস্পর্শ ছাড়াই। ক্যাকটাস গাছটি পরগাছা হিসেবে কুলগাছেই শিকড় বিস্তার করে বেড়ে ওঠে। ঠাকুরদা মনে করতেন, গাছটি বাড়িতে লাগানো থাকলে বাড়িতে সাপ আসার ভয় থাকবে না। সেই হেতু তিনি গাছটি উঠানে প্রতিস্থাপন করেন। এমন মনে করার পেছনে যেমন গাছটির সাপের মতো গড়ন দায়ী, তেমন প্রচলিত বিশ্বাস সমানভাবে উল্লেখযোগ্য। গাছটির আকৃতিও কিছুটা সাপের মতো।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, গাছটি বাড়িতে আনার পর প্রায় ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছিলো কিন্তু সেখানে কোন ফুল দেখা যায় নি। গত ১৯-শে এপ্রিল ২০২০ তারিখ রাতে আনুমানিক ১১.০০টায় আমরা ফুলটি প্রত্যক্ষ করি এবং যারপরনাই বিস্মিত হই। গাছটি ‘মণিরাজ’ নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। নামকরণও সাপের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সাপের মাথার মণির সাথে মিল রেখে নাম হয়েছে মণিরাজ। সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ বারবার এই নামে ফুলটিকে নির্দেশ করছিলেন। কিন্তু গুগলে সার্চ করতেই মণিরাজ নামে যা পাই, তা হলো সাইকাস গাছের ফুল। তাহলে এই ফুলটিকে মণিরাজ গাছের ফুল বলা চলে না। কোন নাম খুঁজেও পেলাম না।
অনিন্দ্য সুন্দর ফুলটিকে ক্ষণদা মধুকরী ডাকতেই বড়ো ভালো লাগলো আমার। ‘ক্ষণদা’ শব্দটি রাতের প্রতিশব্দ, মধুকরী অর্থ মৌমাছি। মৌমাছি’র সাথে সাথে ফুলের একটা সম্বন্ধ আছে। কিন্তু রাতে ফোটা, সূর্যোদয়ের পূর্বে পাপড়িগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মৌমাছির সাথে ফুলটির প্রণয় হয়ে উঠবে না কখনো। আর তাই, ‘রাতের মৌমাছি’ বা ‘ক্ষণদা মধুকরী’ হবে ফুলটির উপযুক্ত নাম। হালকা সুবাস আর হলুদ-সাদা রঙের সংমিশ্রণ ফুলটিকে অসাধারণ ঔজ্জ্বল্যে রাঙিয়ে তুলেছিলো। সাদা ফুলের নিচে হলুদ চিকন পাতা বা ফুলের আরেক ধাপ পাপড়ি ফুলটিকে সূর্যের মাথায় চাঁদের রূপ দিয়েছিলো।
আমরা যারা সহজে বাড়িমুখো হই না, কোভিড-১৯-এর বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে তাদেরকে দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। বাড়িতে অবস্থানের সংক্ষিপ্ত সময়ে ক্ষণদা মধুকরী দেখার সৌভাগ্য হলো আমার, যা আমার দেখা লুকোনো সুন্দরীদের একজন হিসাবে স্মৃতির মালায় প্রথম গাঁথা ফুল।
তথ্যসূত্র
1. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Selenicereus_grandiflorus
- http://floridaflowersandgardens.blogspot.com/2011/06/night-blooming-cereus-or-queen-of-night.html?m=1