দুটো জোকস্ ও দুটো সমস্যা : প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক বাংলা ভাষার প্রমিত ও অপ্রমিত বিবাদ


এই গল্পটা শোনা, শুনেছিলাম এক রসিকজনের কাছে। কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম, তা বলে বোঝানো কষ্টের। গল্পটা এমন, এক লোক তার কমবয়সি পুত্র আর স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে যাবে। কাস্টমস হাউসে তাকে দেওয়া হলো একটা কাগজ, ফিল-আপের জন্য। লোকটা কাগজটা হাতে পেয়ে স্থির বসে আছে দেখে কাস্টমস কর্মকর্তা বললেন, সমস্যা কী? লোকটা বললেন উনি ইংরেজি ফর্ম পূরণ করতে সমর্থ নয়। এই কথা শুনে কর্মকর্তা তাকে বললেন যে, পাতা উলটালেই বাংলা ভার্সনও খুঁজে পাওয়া যাবে। লোকটা বেশ খুশি হয়ে গেল। এবং পূরণ করা শুরু করলো তার ফর্ম। নানা বিষয় পূরণ করার পর ‘লিঙ্গ’ নামে একটা টপিক এসে হাজির। এখানেই গল্পটা জমবে। লোকটা নিজের ‘লিঙ্গ’-এর জায়গায় লিখল, ‘আছে’। স্ত্রীর ‘লিঙ্গে’র জায়গায় লিখল, ‘নেই।’ আর কমবয়সি শিশু পুত্রের ‘লিঙ্গের’ স্থানে লিখল, ‘আছে, কিন্তু ছোটো।’ ভুল লিখেছিল লোকটা, তা বলার উপায় নেই। কারণ লিঙ্গ বলতে তার ভাষা-অভিজ্ঞতায় যে বিষয় সক্রিয় থেকেছে, লোকটা তো তাই লিখেছে। তবে এক্ষেত্রে মজার যে ব্যাপার, সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণও বটে, তা হলো : প্রমিত আর অপ্রমিত ভাষার বিষয়। কারণ মাঝে মাঝে জন-মানসে ভাষা-অভিজ্ঞতা এমনভাবে উলটো-পালটা কাজ করে, যে কেউ বিস্মিত না হয়ে কই যাবে, এমন ফলাফলে!

 

যেমন এই লোকটার ‘ভাষা-অভিজ্ঞতায়’ লিঙ্গ শব্দের ‘আভিধানিক ভাষা-অভিজ্ঞতার’ বিপরীতে তার যে ‘ভাষা-অভিজ্ঞতা’ সক্রিয় ছিল—তাই-ই প্রয়োগ করেছে। বোধকরি, এই কারণেই প্রবাদ চালু আছে, ‘এক দেশের বুলি, আর আরেক দেশের গালি’। আদতে প্রমিত ভাষার সমস্যাটা এখানেই যে, একটা অঞ্চলের সামগ্রিক ভাষা-অভিজ্ঞতাকে মাঝে মাঝে তা ধরতে অসমর্থ হয়। তাহলে কি নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলে [দেশই বোঝাচ্ছে শ্রীঘরী] প্রমিত ভাষা থাকার দরকার নেই? অবশ্যই আছে। কারণ বহু। কিন্তু কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকাকে প্রধান ভূমি-ভিত্তি করে উইলিয়াম কেরি যে ভাষা নির্মাণ-সূত্রপাত্র করেছিলেন, তার সাথে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের ভাষা-অভিজ্ঞতা খাপ খায় না। ফলে একটা বড়ো সমস্যা হয় ভাষার প্রমিতায়নে, প্রথমদিকে। তা যদি আজো মানেন, তো এই অর্বাচীনতার দায়ভার কে নিবে, হে ‘ভাঁড়জন’!

 

এর পিছনে অবশ্য ইতিহাস-নির্ভর কারণও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কারণ বাংলাদেশে প্রাচীন জনপদের যে ইতিহাস, সেখানে বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত সমস্ত জনপদ ‘বঙ্গের’ অধীনে ছিল না। যেমন ধরুন হরিকেল জনপদ, তার ভাষা যে এখনকার প্রমিত বাংলা ভাষার কাছে সবচেয়ে দুর্বোধ্য ঠেকে, তার কারণ এই জনপদের অবস্থানগত ও ইতিহাসগত সমস্যা। এর ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিগত যে পার্থক্য তাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে এই অঞ্চলের ভাষার গঠনে। তাই এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবা দরকার।

 


শ্রীঘরী সিএনজি করে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে এক কাকা এক ফর্দ বের করে বললেন দেখতে; মূলত সেটা ছিল ঠিকানা লেখা একটা চিরকুট। সেখানে আসলে একটা হাসপাতালের ঠিকানা লেখা ছিল। কিন্তু সেটা ছিল এমন, ‘ভোল্টেজ হার্ড সেন্টার’। আসলে ‘হার্ড’ ব্যাপারটা এতো নানামুখী চিন্তা ধারণ করে যে, শ্রীঘরী বেশ বিপদেই পড়েছিল সেই মুহূর্তে। কাকার বয়স ৭০ পার হবে নিশ্চয়; এই লোক কোন হার্ড সেন্টারে যাবে, বা কোন হার্ড সেন্টারের খোঁজে আছে — এই শুরু হলো ভাবনা। পরে নানা জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে বোঝা গেল, এটা ‘হার্ড’ নয় ‘হাটর্’ হবে। যাক বাবা, বাঁচা গেল তাও! ফলে কাকাকে হাসপাতালে নামিয়ে দেওয়া সম্ভব হলো। এরই মাঝে পথিমধ্যে এক নদী-মাঝে এক আশ্চর্য স্থাপত্য দেখে সিএিনজির ড্রাইভারকে শ্রীঘরী জিজ্ঞেস করলো, মামা এইটা কী জিনিস। লোকটা বললো, ‘সুইস গ্যাট’। বেশখানিক ভাবলো শ্রীঘরী, দেশের এই স্বাদেশিক চিন্তার তুঙ্গ পর্যায়ে তাই বলে গেটের নাম হবে সুইস; সুইস কথাটা তো ঘড়ির সাথে সম্পর্কিত। নদীর সাথে শ্রীঘরীর সম্পর্ক কেন জানি ঢিলে, আনোয়ার পাশার নদী নিঃশেষিত হলের মতো করে। ফলে শ্রীঘরী সহজে এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারলো না। পরে আস্তে আস্তে বোঝার চেষ্টা করলো শ্রীঘরী যে, এটা হবে ‘স্লুইচ গেট’। মানে সময় আর প্রয়োজনে তালার মতো খোলা-আটা যায়, এই আরকি।

 

এখানে নির্মিত হলো দ্বিতীয় সমস্যা, যে শ্রেণি ‘লিঙ্গ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বুঝেতে সক্ষম সেই শ্রেণিই আবার ‘লিঙ্গ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ না বুঝতে পারা শ্রেণির ‘হার্ড’ ও ‘সুইস গেট’ বুঝতে অক্ষম। তাহলে কী করা যায় ভগীরথ? পথ তো দেখাবেন, তাই না! সমাধানে তো আসা লাগবে।

 


তো সমাধানে কী কী করা যেতে পারে? তবে সমাধানের পূর্বে একটা গুরুতর সমস্যার কথা বলে নেওয়া যাক। গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার ব্যাপারটা হলো, ভাষার ‘সমাজ-ভাষাতত্ত্ব’ বাদ দিয়ে নতুন নতুন গোষ্ঠী ক্রমাগত নিয়োজিত রয়েছে ভাষার ক্রমায়ত ধর্মীয়করণের কাজে, তা অবশ্যই নানান কারণে রাজনৈতিক। নির্দিষ্ট অঞ্চলের ‘ভাষা’ ঐ অঞ্চলের আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর সাথে যেমন গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকে, তেমনি করে ঐ ভাষা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ধর্মীয় চৈতন্যের সাথে সম্পর্কের হিসেবের বেলায়ও সমান গুরুত্ব বহন করে। এর বেশি ভালো না, ভালো না। গণ্ডগোল হয়, খুনোখুনি হতে কতক্ষণ-ই বা লাগে।

 

ফলে এই ব্যাপারে সাবধান হওয়া দরকার। ভাষার রাজনৈতিক ভূমিকা স্বীকার না করে উপায় নেই, কিন্তু তা ধর্মীয়করণের মাধ্যমে নয়। বাংলাদেশের ষাটের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-ভিত্তি সেরকম সাক্ষ্য নিয়েও প্রস্তুত। আবার এই প্রমিত-অপ্রমিত সমস্যা সমাধানে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের কথাও সাধারণ জনগণ মানতে নারাজ। যদি মানতো তবে লোকজন ‘চেয়ার’ রেখে ‘কেদারায়’ বসতো। কিন্তু তা হয়নি। এখানেই ‘উলুখাগড়া’ হলেও সাধারণ জনগণের গুরুত্ব আর শক্তি। এর জন্য হিসেব কষতে পারি ‘সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব-ইতিহাসের’ মধ্যে। ফলে জন-মানস কী চাচ্ছে, তা নির্দিষ্ট অঞ্চলের যে কোনো ব্যাপারেই হতে পারে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

ফলে সমাধান একটাই, নির্দিষ্ট অঞ্চলের উপ-অঞ্চলভিত্তিক সমগ্র ভাষাগুলোকে নতুনভাবে সংযোজিত এবং রূপান্তরিত করে নতুন প্রমিত ভাষার ছক তৈরি করা যেতে পারে। কারণ, বাংলা ভাষার উদ্ভবের পিছনে কিন্তু ‘প্রাকৃত’ মানুষেরাই কাজ করেছে। সংস্কৃত যে মান্যজনের বা একটা এলিট শ্রেণির ভাষা এবং তার থেকে বিদ্রোহ করে যে বাংলা ভাষার উদ্ভব—এই কথা হুমায়ুন কবিরের মতো অক্সফোর্ড-ফেরত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও বলে গেছেন তাঁর বাঙলার কাব্যে। ফলে এই ‘প্রাকৃতের’ মূল আমজনতার ভাষাকেও গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ, এবং তাদের ভাষাকে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মান্যদের সমগোত্রীয় করে তোলাও জরুরি। না হলে শ্রীঘরীর মতো প্রব্লেম আপনাকেও ফেইস করতে হতে পারে জনাব। এই যে, যেমন ‘ফেইস’ করার কথাটা বলে ফেলা গেল, এটাই তো ‘মুখের’ বিপরীতে পরিভাষার বদলে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন হচ্ছে এইরকম নানান শব্দ। কারণ বিশুদ্ধ ভাষা বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। সবই মিশ্র। বহু ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর সভ্যতার ক্রম বিবর্তনে ‘বদলে যাওয়া রূপ’। ফলে নির্দিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান কী কী ফর্দ দিয়ে দিল তাতে কোনো ভাষারই কিছুই আসে যাবে না। যদি যেতো তবে আজ শ্রীঘরী বাংলায় এই প্রবন্ধ লিখতে পারতো না। লিখতে হতো উর্দুতে। কী সাংঘাতিক হতো ব্যাপারাটা, ভাবতেই গায়ের রোম খাড়া হওয়া সারা!

2 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here