ইতিহাসের ভিত্তি

ফিট্জরয় রিচার্ড সমারসেট (১৮৮৫-১৯৬৪), চতুর্থ ব্যারন র‌্যাগলান (Fitzroy Richard Somerset, the forth Baron Raglan), যিনি লেখক হিসেবে লর্ড র‌্যাগলান নামেই বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন ইংরেজ নৃতাত্তি¡ক এবং ফোকলোরবিদ।  শুধু তার শিক্ষার জন্য নয় মনন ও বুদ্ধির জন্যও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। ‘‘ইতিহাসের ভিত্তি’’ (The Basis Of History)-তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ The Hero :  A Study in Tradition, Myth, and Drama (1936)-এর প্রথম অধ্যায়; যেখানে তিনি এই সমস্ত গুণাবলির প্রমাণ দিয়েছেন। এখানে তিনি তার তত্ত্বকে শুধু বিভিন্ন উৎস থেকে উদাহরণ দিয়েই সমর্থন করেন নি উপরন্তু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে ঘটনার বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ করে যুক্তির দুই প্রধান সূত্র আরোহ এবং অবরোহ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমেও তাকে প্রমাণ করেছেন; যেমন হিউম (David Hume : 1711-1776) করেছেন তাঁর ‘‘অফ ট্র্যাজেডি” (Of Tragedy) প্রবন্ধে।

দ্বিতীয় কিস্তি

১৭
যদি বস্তুতই অশিক্ষিত জনগণ অতীতের ঘটনাবলিতে আগ্রহ অনুভব করে, আমরা আশা করি দেখতে শুরু করবো যে, মানুষ যখনই লিখতে শুরু করে, তখন খুব দ্রুতই তারা অতীতের ঘটনাবলির দলিল তৈরি করতে শুরু করে। যতদূর সম্ভব মনে হয়, এটা ঠিক কোন ঘটনা থেকে শুরু হয়েছে তা সন্দেহজনক, যদিও ইতিহাস শব্দটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনুযায়ী প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটিমিয়ার আদিম অধিবাসীদের মোটের উপর আদৌ কোনো ইতিহাস ছিলো কি না, এটা সন্দেহজনক। ঘটনার এই সমস্ত দলিল মনে হয় সংরক্ষণ করা হয়েছিলো শুধুই ধর্মীয় প্রয়োজনে একটি বিস্তারিত দিনপঞ্জি তৈরির পদ্ধতির সহউৎপাদন (byproduct) হিসেবে। ড. এস. এ. কুক বলেছেন, ‘ধর্মীয় এবং জাদু সম্পর্কিত বিষয় ইতিহাস লিখনের উত্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এবং মেসোপটেমিয়ার ভাগ্যগণনাবিদ্যার ছক ছিলো ছোট দলিল হিসেবে এসম্পর্কিত সবকিছুর এক ধরনের আলামত ও স্বাক্ষর এবং বিপর্যয়ের সংকেত ধ্বনি,’ রাজারা সম্ভবত তাদের সম্ভাব্য পরবর্তী বিজয়গুলোকে আরো বেশি নিরাপদ ও নিশ্চিত করার উদ্দীপনার জন্য তাদের অর্জিত বিগত বিজয়গুলোকে দালিলিক রূপ দিয়েছিলেন; তারা মনে হয় কোনোভাবেই তাদের পূর্বসূরীদের বিজয়কে সংরক্ষণ করতেন না বা দালিলিক রূপ দিতেন না।১৭

 

১৮
হেরোডোটাস (Herodotus)-এর সময়ে মনে হয় মিশরে আদৌ ইতিহাসের কোনো অনুমোদিত অবয়ব (corpus) ছিলো না।১৮ ধর্মযাজকেরা তাকে যে সমস্ত অসংগতিপূর্ণ গল্পকাহিনি বলেছেন তার প্রায় পুরোটাই ছিলো পৌরাণিক, একমাত্র সত্য ছিলো, যা তারা স্বীকার করেছিলেন সেটি হলো মিশরীয়রাই দিনপঞ্জি আবিষ্কার করেছিলেনহেরোডোটাসের বর্ণিত বেশিরভাগ বিষয়ই ছিলো পুরাণ, কিন্তু তার ইতিহাসের জনক হবার যথেষ্ট কারণ ছিলো বলে আমি বিশ্বাস করি, যেহেতু তার পূর্বে ইতিহাস শব্দটি কারো দ্বারা উচ্চারিত হয়েছিলো এমন কোনো প্রমাণ আমরা খুঁজে বেব করতে পারি নি। হেরোডোটাসের ইতিহাস ত্রুটিপূর্ণ ছিলো কারণ তার উপকরণাদি মানসম্পন্ন ছিলো না।

১৯
এখন বিবেচনা করা যাক ইতিহাসের উপকরণ (materials of history) আসলে কোনগুলো :

২০
যারা ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন তাদের লিখিত বর্ণনা — চিঠিপত্র, প্রেরিত ও গৃহীত বিষয়সমূহের (আদান প্রদানের) বিবরণ, প্রতিবেদন, দিনলিপি, স্মারকসমূহ — কে আমরা প্রথম শ্রেণিতে স্থান দেবো।

২১
ঘটনা ঘটার কিছু সময় পরে ও লিখিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চাক্ষুস সাক্ষীÑ আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, নালিশের আরজি বা জবাব, পাথরে খোদিত কিংবা মুদ্রা বা পদকে অঙ্কিত শব্দাবলি বা অভিলিখন দ্বিতীয় শ্রেণির বলে পরিগণিত হবে।

২২
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহকে আমি তৃতীয় শ্রেণিতে ফেলবো। যদিও কদাচিৎ এটা থেকে প্রকৃত তারিখ পাওয়া যায়, এখনো মাঝে মাঝে এগুলো থেকে ঘটনার স্পষ্ট কালানুক্রমিক পরম্পরা বোঝা যায়, এবং এগুলো নির্ভুলভাবেই কোনো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বা দলের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নির্দেশ করে।

২৩
চতুর্থ শ্রেণির বলে পরিগণিত হবে ঘটনা সংঘটিত হবার অল্প সময়ের মধ্যেই এই ঘটনার ক্রীড়ানক, ঘটনা যারা ঘটিয়েছে বা ঘটনার সাথে যারা জড়িত এবং দর্শকদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে যে সমস্ত বাৎসরিক প্রতিবেদন, কালানুক্রম, নিদর্শন বা প্রমাণসমূহ , প্রমাণসমূহের সার-সংক্ষেপ ,সংবাদ প্রতিবেদন, সংবাদপত্রের চিঠি এবং অন্য যে সমস্ত যোগাযোগ সামগ্রী সমকালের মানুষেরা লিখে রেখেছেন।

২৪
বহুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে মানুষকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে উত্তর সংগ্রহ করা, অথবা দ্বিতীয় বা তৃতীয় হাত থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে আমরা পঞ্চম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করতে পারি; যা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও যারা বেঁচে থাকে তাদের গল্প, কথোপকথন স্মৃতি থেকে সংগ্রহ করে মাঝে মাঝে দলিলবদ্ধ করা হয়।

২৫
এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে মাত্রায় তারতম্য থাকলেও শুধুমাত্র প্রথম চারটি শ্রেণিই ইতিহাসের খাঁিট উৎস। পঞ্চম শ্রেণি ঘটনার অসংগতিকে সংগতিপূর্ণ করার জন্য অথবা ঘটনাকে পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করার জন্য ব্যবহারোপযোগী হতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো ভাবে অজানা কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে এগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না। দ্বিতীয় স্তরের কোনো সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না কারণ এটি মারাত্মকভাবে অনির্ভরযোগ্য; এটা ঐতিহাসিকদের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যদি কেবলমাত্র ঘটনা সম্পর্কে অত্যন্ত সুযোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তির সুবিন্যস্ত তথ্য হয়ে থাকে। ঘটনার চতুর্থ স্তরের সাক্ষ্য প্রমাণকে কোনো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য হলেও তাকে ইতিহাস এককভাবে গ্রহণ করবে না, বড়ো জোর তাকে ঐতিহাসিক মনে করা হতে পারে।

২৬
কিন্তু এটা বলা যেতে পারে যে ‘ঐতিহ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তুমি যে বিষয়ে কথা বলছো তা কেবল অত্যন্ত অল্প সংখ্যক লোকের কাছেই পরিচিত, কিন্তু ঐতিহ্য এমন বিষয় যা একটি জনগোষ্ঠীর সবার কাছেই পরিচিত।’ ঐতিহ্য নিশ্চিতভাবেই সমস্ত জনগোষ্ঠীর সকলের কাছে পরিচিত, কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ পুরো সমাজের কাছে পরিচিত থাকে? কতজন মানুষ এটাকে প্রথমত জানে, অথবা এমনকি তৃতীয় পক্ষ যা বীরদেরকে যুদ্ধে নিপতিত করে, তখন রানি রাজাকে কী বলে, অথবা মধ্যেকার চক্রান্তসমূহ কীভাবে চলে? অত্যন্ত অল্প সংখ্যক লোকই বস্তুত জানতে পারে, যদিও জনশ্রুতির মাধ্যমে জনতার ভীড়ের কাছে যে খবর যায় তার কোনো সাক্ষ্যগত প্রামাণ্য মূল্য থাকে না। একটি বিকৃত বিষয় সব সময়ই আরো বেশি বিকৃত হয়, এবং ওভাবেই ওটার পুনঃপুনঃ পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। কোনো একটি যুদ্ধের পরাজয়ের খবর বা একটি নগরের ধ্বংসের কাহিনি অনেকেরই জানা থাকতে পারে যদি সম্পূর্ণভাবে বা প্রধানত এই রকম ঘটনার ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়, তা হলে এটাকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব হতে পারে। এই রকম ঘটনা যদিও ঐতিহ্যের একটি ছোট্ট অংশ হিসেবে ভূমিকা পালন করে, যা প্রধানত, রানি এবং বীরদের জীবনের ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। বিচারিক কাজে গল্পগুলোকে আজকাল ব্যাপকভাবে সবসময়ই ত্রুটিপূর্ণ এবং মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ অসত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণই নেই যে এই সমস্ত জিনিস এক হাজার অথবা পাঁচ হাজার বছর আগে ভিন্ন রকম ছিলো। সাধারণের সাথে এটাকে চলমান রাখা খুবই বিরক্তিকর, সুতরাং আমরা এই বিষয়ের সংগে যুক্ত একটি নির্দিষ্ট গল্প ‘রাজা আলফ্রেডের পিঠার গল্প’কে একটি নিরীক্ষামূলক ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। ধরা যেতে পারে এটি একটি সত্য ঘটনা, কিন্তু কীভাবে জনগণ এটা সম্পর্কে জানতে পারলো? (কীভাবে এটা ঐতিহ্য হলো) এমনকি যদিও বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি তার ঘনিষ্ঠ সহচরদেরকে ফিস ফিস করেও কথাটি বলতে সাহস করে নি, কারণ তারা তাকে বিশ্বাস করবে না, এবং রাজা এমন একটি গল্পকে কখনোই গণনার মধ্যে আনবেন না যা তার সম্মানেকে অবনমন করবে এবং তার সুনাম বিস্তারে বিঘ্ন ঘটাবে; বিশেষভাবে যার উপর তার সার্থকতা নির্ভর করে। গল্পটি আসলেই একটি পুরাণকথা বা পৌরাণিক গাথা, দ্বাদশ শতাব্দীতে যার সাথে প্রথম রাজা আলফ্রেডকে সংযুক্ত করা হয়।১৯


২৭
স্যার ই. কে. চেম্বারস্ (Sir E. K. Chambers) আমাদেরকে জানান এই সমস্ত গল্পে (চরিত্রের) নাম কোনো বিষয় নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি, কীভাবে একজন ঘোড়সওয়ার তার পশ্চাদ্ধাবনকারীর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বদরুগানের মাথা উপর দিয়ে লাভ দিয়েছিলো কর্নওয়ালের সেই গল্পের উল্লেখ করেন। এই গল্প এক সময় ট্রিসট্রাম-এর গল্প হিসেবে প্রচলিত ছিলো, তারপর এটাকে বলা হতো স্যার বোরস এর গল্প, সাম্প্রতিক কালে এটি এক বদরুগানের হেনরির গল্প নামে রূপান্তরিত হয়েছে, যিনি বসওয়ারথের যুদ্ধে ভুল পক্ষ অবলম্বন করেন।২০ তিনি বলেন, ‘ফোক-স্মৃতিকথায় উল্লম্ফন একটি অন্তঃবৈশিষ্ট্য। গত বছর আমি যখন এথেলনি (Athelney) অতিক্রম করছিলাম তখন গ্লাসটনবারির একজন ড্রাইভার আমাকে একটি খামার বাড়ি দেখায়, যেখানে আর্থার তার পিঠা বানাতো।২১

২৮
আমি এখন উপস্থিতভাবেই ‘ফোক-স্মৃতি’ নিয়ে আলোচনা করবো; প্রথমেই একটি প্রশ্ন বিবেচনা করা যাক; প্রশ্নটি হলো, একটি ঘটনা যা লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা হয় নি তা কতদিন পর্যন্ত স্মরণ রাখা যায়। অনেক ভেবে চিন্তে আমি এই সময়সীমা সর্বোচ্চ একশত পঞ্চাশ বছর হতে পারে বলে নির্ধারণ করেছি। আমি অবশ্যই বিভিন্নভাবে অনুমান করেই এই সংখ্যায় উপনীত হয়েছি।২২ আমার দাদা-দাদি এবং তার দাদা-দাদির জানা একটি সতর্ক পর্যবেক্ষণ আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে; কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কোনো ঘটনা যদি তার মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যে লিখে রাখা না হয় বা দলিলবদ্ধ করা না হয় তা হলে তা হারিয়ে যায়। একজন মানুষের পঞ্চাশ বছরের কর্মময় জীবন কল্পনা করে, আমরা তার সীমা একশত পঞ্চাশ বছরই পাই। আমাদের মধ্যে নানাভাবে মৃতব্যক্তিদের নাম নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ মৃত্যুবরণ করলে একশো বছরের মধ্যে সে সম্পূর্ণরূপেই বিস্মৃত হয়। পুনরায় আমি কিছু ঘটনা জানি যেখানে বৃদ্ধব্যক্তিরা তাদের নিজেদের জীবনের ঘটনাসমূহ দ্বারা তাদের সন্তানদের এমনভাবে মোহিত করে যেন সন্তানেরা তাদেরকে স্মরণ করে ; কিন্তু এভাবে তারা এমন কর্ম দিয়ে মোহিত করতে পারে না যে ঘটনাগুলো তাদের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে এটা কোনো গোষ্ঠীগত ঐতিহ্যের ব্যাপার নয়; এভাবেই দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যেই তারা হারিয়ে যায়। একটি ঘটনার পর্যবেক্ষণ যেভাবে টিকে থাকে এবং যে পদ্ধতিতে এটা ছড়িয়ে পড়ে, উভয় ক্ষেত্রেই একশত পঞ্চাশ বছরের সর্বোচ্চ সীমাই পাওয়া যায়।

২৯
ইউরোপে এটা পরীক্ষা করা খুব সহজ, কিন্তু বর্বর বা অসভ্যদের মধ্যে এটা করা খুব কঠিন। একশো পঞ্চাশ বছর পূর্বে (তাদের) কী ঘটেছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা আমরা খুব কমই অর্জন করতে পারি। যদিও আমরা মাঝে মাঝে দেখতে পাই রাজনৈতিক প্রধানেরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় তারা সাংস্কৃতিক বীরদের থেকে দেশের ক্ষতিকারক হিসেবে অধঃপতিত, এবং অভিযোগ তোলা হয় অনেক ঘটনাই তারা বর্ণনা করেছেন এবং নথিভুক্ত করেছেন যা একশত পঞ্চাশ বছরেরও আগে সংঘটিত হয়েছে। আমরা এমন একটা সময়ে আছি যেখানে ঘটনাসমূহ একশত পঞ্চাশ বছর অথবা এমনকি তারচেয়েও কম সমেেয়র মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যায়, এবং এই জন্যই এগুলো পুরাণে বহুল পরিমাণে পাওয়া যায়। এগুলো সময়নিরপেক্ষ ভাবে যে কোনো যুগের ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে।

৩০
সব ঘটনাই ঘটার পরপরই ঘটনা সম্পাদনকারী এবং দর্শক সকলের মন থেকেই ধূসর হতে শুরু করে। সচেতনভাবে স্মরণ না করলেও ঘটনার একটি ছাপ (রেকর্ড) তারা তাদের অবচেতন মনে ধারণ করে, তারই কিছু অংশ যতদিন সম্ভব জীবন্ত থাকে। এগুলো সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, কিন্তু যেটি সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত, তা হলো ঘটনা অবচেতন মন দ্বারা একজন থেকে অন্য জনের কাছে যেতে পারে না। কেবলমাত্র ঐ সমস্ত ঘটনা ছাড়া যা লেখা ছাড়াই আমি আমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, যেগুলো সম্পর্কে আমি সচেতন; এইগুলোই কেবল সম্প্রচারের প্রচেষ্টা দাবি করতে পারে; এবং আমার সন্তানদের স্মরণের জন্য আমি অধিকতর প্রচেষ্ট চালাতে পারি। অতিরিক্ত আত্মগর্বই এগুলোকে সন্তানদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার দিকে আমাকে চালিত করতে পারে, সম্ভবত এটা সম্পূর্ণ যথাযথভাবেও নয়; আমার কর্মজীবনের কিছু সুনির্দিষ্ট নির্বাচিত ঘটনা; কিন্তু কোন্ উৎসাহে তারা সেগুলো স্মরণ করবে এবং পুরুষানুক্রমে স্মরণ করতেই থাকবে? যদি তারা তা না করে, সত্য হলো সাধারণত করে না, তারা তাদের নিকটবর্তী আত্মীয়বর্গের ঘটনাসমূহই সংরক্ষণের কষ্ট সহ্য করে, তারা আরো অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন পুরোনোদের সম্পর্কে কেনো কষ্ট সহ্য করবে? আমি যতদূর জানতে পেরেছি ঐতিহ্য সম্পর্কে লিখেছেন এমন একমাত্র লেখক প্রফেসর চাদউইক যিনি এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের স্মৃতিকথা নিয়ে রচিত একটি কবিতা বা গল্পের অস্তিত্বে প্রয়োজনীয়ভাবেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ইতিহাসের সংগে একীভূত হবার পূর্বধারণাকৃত আগ্রহ জড়িত থাকে।’২৩ তিনি মন্তব্য করেছেন যে, এই আগ্রহ কেবলমাত্র দেশপ্রেমের জন্যই তৈরি হয়, কিন্তু তারা এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে ঐ জরুরি দেশপ্রেম ঐতিহাসিক সত্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর; যে কোনো উপকথা যা তাদের জাতীয় অহংকারকে চরিতার্থ করে এমন সবকিছুই তাদের কাছে ইতিহাস। প্রফেসর চাদউইক আমাদের অনুসন্ধানে প্রশ্নের উত্তর দিতে আর বেশি দূর অগ্রসর হন নি এবং অন্য কোনো লেখকও নন, যাদের সাথে সর্বোপরি আমি প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করেছি। তারা অনুমান করতে চান যে, যুদ্ধ এবং বন্যার আদ্যপান্ত, বিচারালয়ের চক্রান্ত, এবং এমনকি গৃহসংলাপও সেগুলোকে মানুষের প্রচেষ্টায় এমনকি মানুষের ইচ্ছাশক্তিতেই স্বাধীনভাবে কালের প্রবাহে বিস্তারিত করে। মনে হয় রহস্যময় প্রভাবকের সাহায্যে তারা এটা অর্জন করে, যাকে আমরা সবাই যেমন ইচ্ছে তেমন করে দেখি বলে স্যার ই. কে. চ্যাম্বারস্ বলেছেন ‘ফোক-স্মৃতি’ (folk-memory) এই একই বাগধারা ব্যবহার করেছেন প্রফেসর জে. এল. মাইরেস।২৪ যেখানে প্রফেসর টি.এইচ. রবিনসন (T. H. Robinson) বলেছেন ‘রেস-স্মৃতি’ (race-memory)।২৫ একইভাবে প্রফেসর গরডন চিলডে আমাদেরকে নিশ্চিত করেছেন যে, ‘প্রাচীন সুমেরীয়দের সৃষ্ট লৌকিক উপাখ্যান, যেখানে সাধারণ নিয়মকে আদিম বিভ্রান্তির মাধ্যমে ভেলকিবাজিতে রূপান্তরিত করে বাজির দ্বারা, স্থলভাগকে জল থেকে আলাদা করা হয়েছে, যার দ্বারা প্রথম ঔপনিবেশিকরা উপনিবেশের উপর বিশাল কর্মের ভার আরোপ করে।’২৬ প্রফেসর চিলডে বড়ো জোর বলতে পারেন Ñ উপাখ্যান লেখকেরা বাস্তব জীবনে ঐ রকম কিছু দেখেছেন যা তারা উপাখ্যানগুলোতে বর্ণনা করেছেন, এবং যদি তারা এটা না দেখে থাকেন, তা হলে এসব সংগ্রহের বিশাল ভাণ্ডার তারা সংরক্ষণ করলেন কীভাবে? এরকম বাগধারা আমার কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে হয়; স্মৃতি মানুষের হাতে থাকা দখল স্বত্ব পাওয়া সম্পদের মতোই, আমি ততটুকুই দিতে পারি যতটুকু আমার হাতে আছে, স্মৃতির বেলায়ও তাই; আমি ততটুকই দিতে পারি যতটুকু আমার স্মৃতিতে আছে. কিন্তু আমার মৃত্যুর সাথে আমার স্মৃতিরও মৃত্যু ঘটে। ‘ফোক-স্মৃতি’ এবং ‘রেস-স্মৃতি’ এমন শব্ধবন্ধ এই রকম ধারণাই দেয় যে প্রত্যেকটি অশিক্ষিত সমাজেই আমাদের সরকারি মহাফেজখানার মতো একটা কিছুর অস্তিত্ব আছে,যা এমন একটা অস্পষ্ট ধারণা দেয় যে, প্রত্যেকটি অলিখিত ঐতিহ্যই সচেতন ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রত্যেকটি প্রজন্মে অন্তত একবার বিস্তার লাভ করে।

৩১
আমার কাছে মনে হয় প্রফেসর হকার্টও (Hocart) একই ভুল করেন, যখন তিনি বলেন, ‘মূল সত্তার রূপান্তর আমার অভিজ্ঞতায় মনে হয়ে মানুষের যত রকম স্মৃতি থাকতে পারে তার মধ্যে সবচেয়ে কষ্টকর স্মৃতি।২৭ যদি বিদেশিরা আসে এবং স্থায়ী আবাস গড়ে তা সে যেভাবেই হোক, শান্তির মাধ্যমেই হোক বা অন্যভাবে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমেই হোক, অন্যদের মতো তারা স্মরণে রাখবে যে এটা তেমন কিছুই না। এমনকি যুগ যুগ ধরে জঙ্গলের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী অনিশ্চিত অস্তিত্বের গেঁয়ো মানুষও স্মরণ করে যে, বহুদিন পূর্বে হেমলেটপরবর্তী লোকজনও সাতজন রাজকুমারের অধীনে সাগরের ওপার থেকে এসেছিলো; যদিও সকল প্রকার ভাষাগত এবং প্রথাগত পার্থক্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’ এটা দেখানো খুব সহজ যে, এরকম দেশ ত্যাগ যখন সত্যি সত্যিই ঘটেছিলো তখন এগুলো কোনো পৌরাণিক কাহিনি ছিলো না; কিন্তু খুব দ্রুতই মানুষ তা ভুলে গেছে। নবম এবং দশম শতাব্দীতে বহু সহস্র ‘ডেনিস’ ইয়র্কশ্যায়ার (Yorkshire), লিনকনশ্যায়ার (Lincolnshire) এবং উত্তর ইংল্যান্ডের অন্যান্য দেশে স্থায়ী আবাস গড়ে। আর এজন্য অবশ্যম্ভাবী রূপেই ঐ সমস্ত দেশের ঐতিহ্যে ব্যাপকভাবে ডেনিস উপকরণ বিস্তার লাভ করে, যদিও এখন সেগুলোকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা খুবই দুরূহ, এখনো তারা ডেনিসদেরকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে — যারা লুট করতেই এসেছিলো এবং লুট শেষে পাল তুলে পালিয়ে গেছে। একাদশ শতাব্দীতে ল্যানকাশ্যায়ার (Lancashire) ও কামবারল্যান্ড (Cumberland) এর বড়ো একটি অংশে নরওয়েজিয়ানরা আবাস স্থাপন করেছিলো, এবং ঐ সমস্ত এলাকায় দীর্ঘদিন নরওয়েজিয়ান ভাষা প্রচলিত ছিলো, যদিও এই ঘটনা এখন কেবলমাত্র ইতিহাসের ছাত্ররাই জানে। ষোড়শ শতাব্দীতে বিশাল সংখ্যার প্রোটেস্ট্যান্ট ফ্লেমিংরা (Protestant Flemings) দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আবাস গড়ে তারা তাদের নামের ইংরেজিকরণ করে এবং দুুই প্রজন্মের মধ্যেই তারা মূল জনধারার সাথে মিশে যায়।

৩২
অত্যন্ত দ্রুততার সাথে যে সমস্ত ঐতিহাসিক উপকরণ বা প্রমাণাদি বিস্মৃত হয়ে গেছে, তার থেকে বোঝা যায় ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে যা কিছু স্মরণ করা হয় তার ইতিহাস হিসেবে বিবেচিত হবার সম্ভাবনা কতখানি অপ্রতুল! এখন আমি বিভিন্ন প্রকার সত্যিকার এবং তথাকথিত ঐতিহ্য অনুসন্ধান করে দেখাবো যে, যেকোনো ভাবেই পরীক্ষা করা হোক না কেনো এগুলোর ইতিহাস হবার অযোগ্যতা অত্যন্ত স্বচ্ছ রূপেই ফুটে উঠে।

 

তথ্যসূত্র ও টীকা

17.Cambridge Ancient History, vol, i, p. 218 (Raglan’s note)

  1. Herodotus (i.e., Herodotus : c. 484-c, 425 B.C. ; Greek historian), History, tr. H. Cary (London, 1872), ii, p. 4 (Raglan’s note).
  2. R. W. Chambers, op. cit., p. 202 (Raglan’s note).]
  3. Tristram : famous lover in the cycle of Arthurian, and even earlier, legends. Sir Bors : Knight in the cycle of Arthurian legends. Bosworth : battle between Richard III and the Earl of Richmond (Henry VII) at Bosworth Field, a rural district in Leicestershire, central England, in which Richard was defeated and killed; last battle of the Wars of the Roses (August 22, 1485).
  4. Arthur” : King Arthur, legendary British King. E. K. Chambers, Arthur of Britain, pp. 193-4 (Raglan’s note).
  5. A.van Gennep, op. cit., p. 164, fixes upon 200 years, but makes a number of exceptions (Raglan’s note).

23. H. M. Chadwick, The Heroic Age, P. 273 (Raglan’s note).

  1. 24. Journal of the Royal Anthropological Institute,1933, p. 295 (Raglan’s note). 25. Myth and Ritual, ed. S. H. Hooke, p. 189 (Raglan’s note).

26. V.G. Childe, The Most Ancient East, p. 124 (Raglan’s note).

  1. The Progress of Man, 1929, p. 102 (Raglan’s note)]

(সমাপ্ত)

১৩.০৭.২০২০
রাত : ১১:০২ মিনিট
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here