মহর্ষি মনোমোহন দত্ত একজন মরমি সাধক ও কবি। তিনি বাংলার লোকায়ত ধারায় এক ক্ষণজম্মা, ব্যতিক্রমী লোককবি ও ঋষি, যিনি তাঁর স্বল্পায়ু জীবনসীমার মধ্যেই রেখে গেছেন মানবমুক্তির মর্মবাণী। তিনি ধর্ম-সাধনার সমান্তরালে এমন ধর্ম-তাত্ত্বিক সংগীত রচনা করে গেছেন, যেগুলো তাত্ত্বিকতার গণ্ডি পেরিয়ে সমকালীন আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় তথা জীবন ও সমাজে ক্রিয়াশীল নানা সংকট নিরসনে মানবমনে ক্রমাগত রসদ জোগায় । কারণ তাঁর গান ও জীবনদর্শন অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদের অনন্য দলিল। সকল প্রকার ধর্মীয়-গোঁড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, কুপ্রথা এবং ধর্ম-জাতি-ভেদের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ‘সর্বধর্ম সমন্বয়ের’ সাধনা করেছিলে, যার মূলমন্ত্র হলো সকল প্রকার বিভেদ ভুলে বিশ্ব-ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নয়, শান্তিময় সমাজ ও আনন্দময় পৃথিবী নির্মাণই এই ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ সাধনার আন্তরপ্রেরণার উৎস।
মহান সাধক ও ‘মলয়া’ সংগীতের প্রবক্তা মহর্ষি মনোমোহন দত্ত ১২৮৪ বঙ্গাব্দ, ১০ই মাঘ (১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ ) তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সাতমোড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ৩১ বৎসর ৭ মাস বেঁচেছিলেন। সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী এই মহান সাধু মোট ১৩টি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত মলয়া সঙ্গীত বাংলা লোকগানের ধারায় ভাবসংগীত হিসেবে অমূল্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। মনোমোহন ও তাঁর মলয়া সঙ্গীত সম্পর্কিত সম্যক ধারণা লাভ করা এ কারণে জরুরি যে, তাঁর গানের মধ্যে রয়েছে বাঙালির হাজার বছরের প্রাণের ঐশ্বর্য ও স্বাধীন সহজিয়া সাধনার অনুসরণ; বাঙালি যে লৌকিক ধর্ম-সাধনার বলে মানুষে মানুষে সম্প্রতি ও ঐক্য নির্মাণ করে, অবলীলায় অগ্রাহ্য করে শাস্ত্র-শাসন ও আরোপিত বিধি-নিষেধ। যাই হোক ‘মলয়া’ সঙ্গীত ও তাঁর ভাববস্তু বিশ্লেষণে প্রয়াসী হয়েছেন বাংলাদেশের অনেক গুণিজন। ‘মলয়া’ সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন :
মনোমোহন দত্ত সাধক পুরুষ ছিলেন এবং ভাবসঙ্গীতের রচয়িতা। ভাবুক ও কবি হিসাবে তিনি তাঁর জীবৎকালেই খ্যাতিমান হয়েছিলেন, অনুসারী শিষ্যবৃন্দ ও ছিলেন অনেক। তাঁর লেখা সাধন গীতি বাণীর আন্তরমাধুরীতে লালনসঙ্গীতের সগোত্র, এবং যে অধ্যাত্মচিন্তার প্রকাশ সেখানে ঘটেছে তা আমাদের লোকসাহিত্যেরই সিদ্ধরস। তিনি আমাদের এক অসামান্য লোককবি রূপে সঙ্গতভাবেই পরিগণিত হয়ে আসছেন।১
তবে তাঁর গান ‘লালন সঙ্গীতের সগোত্র’ হয়েও বিষয়-বৈচিত্র্যে ও শাস্ত্রীয় সুর-মাধুর্যে বাংলাদেশের যে-কোনো রচয়িতার লোকগান তথা ভাবসংগীত থেকে আলাদা এবং উঁচু মানের। কারণ, মনোমোহন রচিত সব গানের সুর এবং তাল নির্ধারণ করেন এই উপমহাদেশের অন্যতম সংগীতজ্ঞ ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁ। যিনি মহর্ষির অন্যতম শিষ্য ছিলেন। ফকির আফতাবউদ্দীন খাঁয়ের মতো সঙ্গীতজ্ঞের সুর করা বলে এই গানগুলোতে শাস্ত্রীয় ও লোকায়ত সুরের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে — যা শ্রোতাদের মনে সহজেই এক ঐন্দ্রজালিক ভাবলোক তৈরি করে।
উল্লেখ্য, ফকির আফতাবউদ্দীন খাঁ ছিলেন সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর অগ্রজ এবং যিনি আলাউদ্দীন খাঁর মতে, তাঁর চেয়েও বড় মাপের সংগীতজ্ঞ। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ বলতেন, সংগীতে আমাদের যা-কিছু অর্জন, তা দাদার গুরুর আর্শীবাদেই প্রাপ্ত। লক্ষণীয় মনোমোহন এবং আফতাবউদ্দীন খাঁ ছিলেন হরিহর আত্মা। ‘মলয়া সঙ্গীত’কে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ফকির আফতাবউদ্দীন খাঁর ভূমিকা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। মনোমোহনের আরেকজন প্রিয় শিষ্য ছিলেন লবচন্দ্রপাল। যিনি পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন।
‘মলয়া’ সংগীতের নামকরণ নিয়ে সাধারণ্যে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত। অনেকেই মনে করেন, মনোমোহনের আদ্যক্ষর ‘ম’ তাঁর প্রিয়শিষ্য লবচন্দ্র পালের ‘ল’ ও আফতাবউদ্দীনের ‘আ’-যোগে ‘মলয়া’ নামকরণ হয়েছে। কিন্তু মনোমোহন ভাবুক, সাধক, তাই নামকরণে ভিন্ন তাৎপর্য থাকা স্বাভাবিক। ‘মলয়া’ শব্দের আভিধানিক তাৎপর্য হচ্ছে বসন্তের মলয়-সমীরণ। প্রাণহীন বিবর্ণ শীতের পর বসন্তের মলয় হিলোল যেমন প্রকৃতিতে নতুন জীবনের সঞ্চার করে মলয়ার সঞ্চিত ভাব ও ভাবুকের চিত্তে তেমনি জাগাবে আনন্দের অপূর্ব শিহরণ। ‘মলয়া’ একটি সংগীত সংকলন। এটি দুখণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে ২৮৭টি এবং দ্বিতীয় খণ্ডে ১৩৯টি গান, সুর ও তাল উল্লেখপূর্বক গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।
মনোমোহনের গানে বাউল প্রভাব থাকলেও তাঁর মধ্যে বৈষ্ণব-প্রেমবাদ এবং সুফিবাদের প্রভাব প্রবলভাবে এসেছে। সুফিধর্মকে Islamic Mysticism বা ইসলামীয় মরমিয়াবাদ বা অতীন্দ্রিয়বাদ বলা হয়, যেখানে জীবাত্মা বা সৃষ্টির একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, পরমাত্মা বা স্রষ্টার অস্তিত্বের সাথে লীন হওয়া। এই ভাবধারা মূলত হৃদয়াবেগজাত। বস্তুবাদী অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি অসম্ভব। কেননা প্রেমই ঈশ্বর ও মানুষের পরিপূর্ণ মিলনের সেতু। মনোমোহনের গানে এই সুফিবাদী ভাবনা চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
( রাগিণী : কালেংড়া — তাল কাহারবা )
আদমখোদা মইত্ কহজি,
নূরছে আদম বানায়া, একদম জোদা নেহি।
ধরবে যদি মাসকে
ডুরি লাগাও আশেকে
( হ’লে ) দিল দেওয়ানা, ফানাফিলা, রাজি হবে আলাজী।
তিন্ তিন্ রোয়ে যিন্ পায়া
হাসি খেলনা মিলে পিয়া
মনোমোহন কয় দিল দরিয়া, সিঁচলে পাবি সাঁই দরদি।২
সুফিবাদী এই সাধনার পথে সাধক যেনো স্রষ্টার সুষ্পষ্ট আহ্বান শোনার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি তো স্রষ্টারই সান্নিধ্যে গিয়ে, তাঁকে প্রেম দিয়ে জয় করে তাঁর অস্তিত্বে লীন হয়ে সার্থক হতে চান। কিন্তু জীবাত্মার এই প্রেমের আকুতিতে পরমাত্মা যখন নির্লিপ্ত থাকেন তখন প্রেমিক মন আত্মজিজ্ঞাসায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কখনো কখনো স্রষ্টাকে সরাসরি প্রশ্ন ছোঁড়েন তাঁর সৃষ্টি।
(রাগিনী : মনোহরসাই — তাল-লোফা )
তোর সনে মোর আছে কি সম্বন্ধ।
তোমায় আমায় আজ দু’জনায় লাগল বিষম দ্বন্দ্ব।
তুমি আমি জগত জোড়া, আমি কি আর তোমায় ছাড়া,
ডাকলে কেন পাইনা সাড়া, কোন কলে রয়েছ বন্ধ।
…
চোখ বেন্ধে কও দেখ চেয়ে, সুর নাই বল শুনাও গেয়ে,
সাধ্য ছাড়া সাধ লুকায়ে, ঘটাইতেছে যত মন্দ
মনোমোহন কয় কি সম্বন্ধ, আমি ফুল তার তুমি গন্ধ,
একাক্ষর অনেক ছন্দ, অচ্ছিদ্র, বিষম রন্ধ্র।৩
মনোমোহন ছিলেন আত্মতত্ত্বজ্ঞ সাধক। যোগসাধনার গূঢ় ও গুহ্য তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। সমবোধকেই যোগ বলা হয়। গুরু ও শিষ্যের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না। এই সাধনা একাত্মবোধের সাধনা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু ব্রহ্মকে লাভ নয়, ব্রহ্ম হয়ে যাওয়া। সুফিবাদের ‘আনাল হক’ এবং ‘আমি ব্রহ্ম হয়েছি’ সমার্থক। তাইতো মনোমোহন অকুণ্ঠচিত্তে গাইতে পারেন :
(রাগিনী : খাম্বাজ, তাল-কাওয়ালি )
চাইনা বেহেস্ত, চাইনা দোজখ,
আমি চাই শুধু তোমারে।
আমি কে তুমি কে ? তুমি কে আমি কে ?
প্রেম কর সদা অন্তরে।
আমারে বানাইয়া কোথায় আছ তুমি,
কোথা হ’তে এলেম কোথা যাব আমি,
আমি তুমি মাঝে তফাৎ কিবা আছে
রফা করে দাও একবারে।৪
বাংলাদেশের অনেক প্রতিথযশা গবেষক মনোমোহনের গানের মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর গানের ভাব, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি, অপূর্ব সুরলালিত্যে অন্যান্য গানের তুলনায় নিঃসন্দেহে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। অবশ্য লোকায়ত গানের ধারায় প্রচলিত অনেক মারফতি গানের সাথে মনোমোহনের রচিত গানের ভাবগত সাদৃশ্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এমনটি খুবই স্বাভাবিক। কেননা অধ্যাত্মতত্ত্বমূলক গানের ভাষা, ভাব ও বক্তব্য প্রায় ক্ষেত্রেই এক ধরনের হয়ে থাকে। এটি লোকগানের প্রায় সাধারণ বৈশিষ্ট্যও বটে। প্রসঙ্গক্রমে মনোমোহনের অনেক গানের সাথে লালন শাহের গানের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন : মনোমোহন দত্তের
(রাগিনী : মনোহরসাই, তাল-একতালা )
অচেনা এক পাখি আমার, খাঁচার ভিতর করে খেলা।
ধরতে পারলে মনবেড়িতে, বেঁধে ফেলতাম এই বেলা।৫
গানটির সাথে লালন শাহের বিখ্যাত ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ গানের আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়। ‘পাখি’ আমাদের বাংলার বাউল, ঋষি ও উপাসক সম্প্রদায়ের কাছে খুব প্রিয় একটি রূপক; কেননা ‘পাখি’ মানে ‘আত্মা’র তাৎপর্যে আধ্যাত্মিক সাধকদের কাছে গ্রহণযোগ্য। ফলে লালন ফকিরের বেশ কয়েকটি গানে যেমন ‘পাখি’ রূপক গভীর অর্থে উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি মনোমোহনের সংগীতেও ‘পাখি’ গভীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে ভাবনায় কড়া নাড়ে। যেমন : মনোমোহন দত্তের
(রাগিনী : ঝিঁঝিট খাম্বাজ, তাল : একতালা )
পোষ মানে না জঙ্গলা পাখি
(সে যে ) এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় আমাদের দিয়া ফাঁকি
পাখি যখন লয়না পড়া,
এবার বুঝি ডুবল ভরা,
মনোমোহন ভেবে সারা, সদায় ঝরে দু’আঁখি।৬
অথবা
(রাগিনী : খাম্বাজ, তাল : একতালা)
হ্যারে মন হরবোলা পাখি।
হরি বল্ বোল্ না বলিয়া (কেবল) আবোল তাবোল বলতে
যে বোলে নাই মূলেই রস, তাতেই মন হয়েছে বশ;
সঙ্গে ফিরে আর দশ জন, আমার সঙ্গে কেউ নাই দেখি।৭
কোনো রকম সংকীর্ণতা দ্বারা আড়ষ্ট ছিলেন না মনোমোহন দত্ত। কারণ মহারাজ আনন্দ স্বামীর (তাঁর গুরু ) প্রদর্শিত পথই ছিলো তাঁর পথ; আর সে পথ সর্বধর্ম সমন্বয়যোগ। প্রত্যেক ধর্মেই এমন কতিপয় নীতিমালা রয়েছে, যা সকল ধর্মমত ও পথের অনুসারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য। গ্রহণযোগ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে উদার মানবতাবাদ। মনোমোহনের জীবনাচরণে, মন ও মননে, কর্মে ও সাধনায় মানবতাবাদ ছিলো প্রবল। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা নয়, প্রাণের বা আত্মার উদ্বোধনই তাঁর কাছে বড় কথা। মনোমোহন তাই হিন্দু বা মুসলমান কোনোটিকেই এককভাবে গ্রহণ বা বর্জন করছেন না, বরং ধর্ম-জাতি-ভেদের ঊর্ধ্বে উঠে আত্মজ্ঞান লাভে প্রয়াসী হয়েছেন। যেখানে লালন ফকির ‘জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা’ গাইছেন সেখানে আমাদের মনোমোহন গেয়েছেন :
(রাগিনী: খাম্বাজ, তাল : মধ্যমান )
কও দেখি মন আমার কাছে, তুমি হিন্দু না মুসলমান
আলা না হরি তোর ঠাকুর বটেরে, তুই কে তোর মনিব কেরে করবে
ইনসান।
তুমি আমি যত কায়া আছে, কে বিরাজে বল এসব কায়ার মাঝে,
প্রাণে প্রাণে টানে টানে জাত বিচার দেখি প্রমান।৮
সামাজিক লোক-নিন্দা সহ্য করে, ‘একঘরে’ করে রাখার হুমকিতে ও আত্মতত্ত্বজ্ঞানী মনোমোহন বিচলিত হননি। আপনবিশ্বাসে গেয়ে গেলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনাদীপ্ত এ সব গান। এক্ষেত্রে করুণাময় গোস্বামী তাঁর সংগীত প্রসঙ্গে বলেন :
সাধারণ অর্থে এসব গান নয়। মীরার ভজনের মত কবীরের দোঁহার মত, দাদু, রবিদাস প্রমুখের মরমী গানের মত দিব্য প্রেরণায় রচিত মনোমোহনগীতি। প্রেম, বিচ্ছেদে, বিষাদে, পুলকের উপাদানে রচিত এসব গানের ভেতর ধ্যানমগ্ন দিব্যানুভূতি প্রকাশিত হয়েছে, যা কখনো সহজ, কখনো রূপকের আবরণে প্রচ্ছন্ন।৯
বাউল মতবাদ ও যোগ-সাধনায় দেহই হচ্ছে মূলকথা। বাউল ও যোগীরা মনে করেন যা আছে ভাণ্ডে তা আছে ব্রহ্মাণ্ডে। অর্থাৎ এই মানবদেহের মধ্যেই রয়েছে সবকিছু। কাজেই দেহের বাইরে কিছু নেই। দেহনির্ভর এই সাধনায় কামাচারের স্থান আছে। কামের মধ্য দিয়েই প্রেমে উন্নীত হতে হবে। কামকে এড়িয়ে কিংবা অস্বীকার করে নয়। মহর্ষি মনোমোহন দত্ত তাঁর সংগীতে কাম-প্রবণতাকে সাধনতত্ত্বের পরিপন্থী বলে মনে করেছেন। এই কামচেতনার স্বীকৃতি মনোমোহনের সংগীতে কোথাও নেই। মনোমোহন কামের এই সর্বগ্রাসী প্রভাব এড়িয়ে চলার সাধনাই করেছেন। কিন্তু লালন শাহের ‘শুদ্ধ প্রেম সাধনে যদি কাম-রতিতে রাখলে কোথা’ গানটিতে কামকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু মনোমোহন কামিনী-কাঞ্চনকে দূরে রাখতে চেয়েছেন । অস্বীকার করেননি। তবে কামচেতনা কখনো তাঁর সাধনার অন্তরায় বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন :
(রাগিনী : খাম্বাজ, তাল : ধুংরী)
আমি কেমন করে বাধ্য করি মন-মত্ত কবিরে
ভাবে ঘরে আনতে তারে, অভাবে সংগ্রাম করি।১০
অথবা
কাম-কামিনী পাখা ভরে
স্বকাম হাওয়াতে উড়ে।
চলে যায় দিগদিগন্তরে, ফিরে চায় না যদি ডাকি।
পোষ মানে না জঙ্গলা পাখি।১১
মানুষের মন ও স্বভাব বিচিত্র-প্রবণতায় আচ্ছন্ন। মনের ভাব-গতিকে বশে আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়। আর সাধন-সিদ্ধি লাভের পূর্বশর্ত যেনো স্বভাব গঠন। দেহ ও মনের উপর প্রভাববিস্তারকারী ষড়রিপুর প্ররোচনা থেকে মুক্তি চায় এ সকল সাধক-কবিগণ। মনোমোহন দত্তের তাই আক্ষেপ :
(রাগিনী : প্রসাদী, তাল : কাওয়ালি)
পারলেম নারে স্বভাব বানা’তে
সন্ধ্যা পূজায় কি হবে তায়,
না থাকলে মন আপন জোতে।
…
পাজী মন কথা শুনেনা,
চোখ থুঁয়ে হয়েছে কানা
ঘুরে ফিরে তা না না না
আনা গোনা দিনে রাতে।১২
ষড়রিপুর এই তাড়নায় প্রতি পদক্ষেপেই তিনি বিভ্রান্ত। সংকটময় পৃথিবীর কর্ম কোলাহল তাঁকে সর্বদাই বিব্রত করছে। তাই শত কন্টকাকীর্ণ পথ ছেড়ে তিনি যেনো মসৃণপথে বিশ্বনিয়ন্তাকে সহজেই পেতে পারেন তার জন্য ব্যাকুল চিত্ত তাঁর :
(রাগিনী : লুম্ খাম্বাজ, তাল : কাওয়ালি )
তোমার কাছে যেতে প্রভু দাও আমারে পথ করে,
চলিতে পারি না আর, কন্টক রয়েছে ঘিরে।
কাম ক্রোধ লোভ আদি, ঘৃণা লজ্জা ভয় ইত্যাদি
অন্ন চিন্তা নিরবধি হল বাদি একেবারে।১৩
মনোমোহন দত্ত ( ১৮৭৭-১৯০৮) রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। সেই সময়ের রক্ষণশীল সমাজ ও সমাজপতিদের অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে মানবমুক্তির যে-গান তিনি গাইলেন তা নিঃসন্দেহে একজন সমাজ-সংস্কারকের কাজ। সকল ধর্মের অবিসংবাদিত বিশ্বাস-জাত একেশ্বরের ধারণাকে কাজ লাগিয়ে ‘দয়াময়’ নামের উপাসনা করলেন। তবে ‘দয়াময়’-রূপী ঈশ্বরের সাধনার কেন্দ্রে তিনি ঠাঁই দিলেন মানুষকে। মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজে পান ‘অমূল্য ধন’ কিংবা ‘অরূপ রতন’ । তাঁর ভাষায় :
(রাগিনী : মনোহরসাই, তাল : একতালা )
মানুষ হয়ে মানুষ লয়ে করগে যা মানুষলীলা,
ধরবি যদি সেই মানুষে, খুলে দে মানসের তালা।
মানুষে মানুষ আছে, ধরগে মানুষ মান্সের কাছে
মানুষ মানুষ পেয়েছে, বৃন্দাবনে ব্রজবালা।
পাইলে মানুষের সঙ্গ, উথলিবে প্রেমতরঙ্গ,
সাক্ষী আছে শ্রীগৌরাঙ্গ, কিলাসেতে পাগল ভোলা
…
মনোমোহন দিশেহারা, হ’ল না তার মানুষ ধরা,
আপ্তাবদ্দীন দিচ্ছে সাড়া, যোগ দিতেছে যোগের চেলা।১৪
উল্লিখিত গানটিতে বাউল দর্শনের সাথে বৈষ্ণব প্রেমবাদের শিল্পিত সংশ্লেষণাত্মক রূপটি পাঠক-শ্রোতাকে বিস্মিত ও বিমোহিত করে। তাঁর অনেক গানেই বাউল-বৈষ্ণব-সুফি মতাদর্শের সমন্বয়ী রূপের ভাববস্তু লক্ষণীয় এবং একই সঙ্গে এই ত্রি-ধারার নান্দনিক প্রকাশ তাঁকে অন্যান্য লোককবি ও সাধকদের থেকে স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল করেছে। বাউলদর্শনে গুরুবাদ খুব তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বাংলার যেকোনো মরমি উপাসক সম্প্রদায়ের কাছেই ‘গুরুভক্তি’ সর্বাগ্রে। কেননা এই গুরুই তাঁর শিষ্য তথা মানুষকে সৃষ্টিতত্ত্বের নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের পথ বাতলে দেন। তিনি নির্দেশ করে দেন শিষ্যের পারমার্থিক লাভালাভ এবং জীবনের অন্তর্নিহিত মানে। ফলে গুরুভজন হয়ে উঠে মহিমান্বিত। লালন শাহের ‘সর্বসাধন সিদ্ধি হয় তার মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’ এবং ‘কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে এ গায়’ প্রভৃতি গানে গুরুভক্তির নিদর্শন ও তাগিদ মেলে। লালন শাহের গুরু ছিলেন ‘সিরাজসাঁই।’ তেমনি মনোমোহনের ছিলেন ‘আনন্দস্বামী’। ফলে অবলীলায় মনোমোহনের গানে গুরুর বহুমাত্রিক গুরুত্ব ও ভূমিকা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন :
(রাগিনী : পিলু, তাল-ঝাঁপ )
গুরু কল্পতরু মূলে —
আশ্রয় নিয়ে বসে থাক, ও মন আমার কতুহলে।
গুরু নিত্য গুরু সত্য গুরু হয় পরমতত্ত¡,
শ্রীপদে মজায়ে চিত্ত, ভাব নিত্য প্রাণ কুলে।১৫
গুরু-সম্পর্কিত এমন আরো অনেক অসাধারণ সংগীত রচনা করেছেন এই সাধক, যা ভাব-ভাষা, ছন্দ এবং তাল-লয়ে অতি উঁচু মানের। যেমন :
(রাগিনী : সাহেনা, তাল-খেমটা)
কইব কি তার প্রেমের কথা কইতে না যুয়ায়।
অমূল্য ধন গুরুর চরণ, কাঙ্গালে ল’য়ে খেলায়।
রাজা বাদশা পায় না তারে, সামান্য ধনের বিকারে,
কাঙ্গালে সে ধন তুচ্ছ ক’রে সদানন্দে দিন কাটায়। ১৬
লীলাময় স্রষ্টার স্বরূপদর্শনে জীবাত্মা আত্মহারা হয়ে ওঠে। লীলারহস্যের এই Mysticism ভাব মনোমোহনের গানে এক অতীন্দ্রিয় ভাবলোক নির্মাণ করে। কখনো তাই সেই স্রষ্টার রূপ অতীন্দ্রিয় সত্তায় প্রত্যক্ষ করে মনোমোহন গেয়ে ওঠেন :
(রাগিনী : ভৈররী মালকোষ, তাল : লোফা)
নয়নটানে, টানে গো অই রূপের পানে।
আমার মন মিশেছে যাহার সনে।১৭
স্রষ্টার ধ্যানে নিমগ্ন সাধক যেনো ধরতে পেরেও হাতছাড়া করে ফেলেন তাঁর পরম আরাধ্যকে। তাইতো প্রেমিক মন আকুল হয়ে উঠে ব্যাকুল আবেগে। স্রষ্টা যখন তাঁকে ডাকে সন্তর্পনে, তখন তিনি অন্তরে অনুভব করেন এই অসাধারণ অভিব্যক্তি
( রাগিনী : সুরট মলার, তাল : যদ্ )
মন মাঝে যেন কার, ডাক্ শুনা যায়।
কে যেন আমারে, অতি সাধ করে,
হাত দু’খানা ধরে, কাছে টেনে নিতে চায়।১৮
উল্লিখিত গানটি লালন ফকিরের এবং রবীন্দ্রনাথের দু’একটি গানের সমান্তরাল ভাবধারার। শুধু তাই নয়, এই গানটি নিয়ে একটি কিংবদন্তি আছে, যা প্রকৃত অর্থেই এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ফকির আফতাব উদ্দীন খাঁ একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এই গানটি শুনিয়েছিলেন জোড়াসাঁকুর ঠাকুর বাড়িতে গিয়ে। গানটি শোনার পর রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন এবং সাধককে দেখতে চাইলেন। রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কবি কল্পনা করেন, আর সাধক চোখে দেখেন।’১৯ স্রষ্টাকে এদিক-ওদিক সন্ধান করার প্রয়োজন নেই, আমাদের হৃদয়েই তাঁর বসবাস। মনপ্রাণ দিয়ে খুঁজতে জানলে মনের মাঝেই তাঁর অস্তিত্ব উপলব্ধি সম্ভব। মনোমোহন তাই আত্মানুসন্ধানী হয়ে ওঠেন।
স্রষ্টার স্বরূপ নিয়ে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সাধক-সন্ন্যাসীদের মধ্যে বিতর্ক-মতানৈক্য ছিল। ধর্মীয় শাস্ত্রেও এ বিষয়ে বিভিন্নতা দেখা যায়। সাধক মনোমোহনও এ বিভ্রান্তি এড়াতে পারেন না। এ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তাঁর মনেও ক্রিয়াশীল । যেমন :
(রাগিনী : পিলু, তাল : যৎ)
হরি তোমায় জানতে গিয়ে, পড়েছি এক বিষম গোলে।
আসল কথার ঠিক পাইনা তার, শুনি কেবল যে যা’বলে।
পুরানে কয় এরূপ সেরূপ, কে জানে তার কিবা কোন রূপ,
বেদান্তে কয় অরূপ স্বরূপ, ঘটে পটে সর্বস্থলে।২০
সৃষ্টিতত্ত্বের নিগূঢ় রহস্যের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তিনি যেনো স্থিতিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েও পিছলে পড়েন। স্রষ্টাও যেন তাঁকে নিয়ে, তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে নিয়ে শিশুতোষ অবুঝ খেলায় মত্ত। উলেখ্য, কাজী নজরুল ইসলাম স্রষ্টার এই উদাস, খেয়ালি মনোভাব নিয়ে লিখেছেন ‘খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে’-শীর্ষক গানটি। কিন্তু অবাক লাগে, যখন দেখি নজরুলের বহুকাল পূর্বে মনোমোহন দত্ত লেখেন স্রষ্টার খেয়াল ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে :
(রাগিনী : খাম্বাজ, তাল- কাওয়ালি )
দেখে আমি তাজ্জব হয়েছি
তোমার কর্ম কেবল আর কিছু নয়, আঁকাআঁকি মুছামুছি
শিশুর মতন কলম লয়ে নানা রঙের কালি দিয়ে,
এ ব্রহ্মান্ড কাগজ পেয়ে লেখতেছ সব ভোজের বাজী।২১
আবার তিনি স্রষ্টার স্বরূপকে যথাযথভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হন। স্রষ্টার স্নিগ্ধ মায়াময় মূর্তি যখন তাঁর অন্তরেই এসে মূর্তিমান হয়ে উঠে এবং তাঁকে আশ্বস্ত করে, তখন তিনি আর আরাধ্যকে পেতে তীর্থে যাওয়াকে নিরর্থক মনে করেন। তিনি গাইলেন :
(রাগিনী : সাহেনা, তাল-আড়া)
কাজ কিরে মন গয়া গঙ্গা, যেয়ে কুরুক্ষেত্র কাশী
প্রাণের ভিতর প্রাণ যদি মোর, প্রেমে বাঁজায় ভাবের বাঁশী।২২
মনোমোহনের গানে নানা বিষয়ও ভাবের শৈল্পিক প্রয়োগ ঘটেছে। সমকালীন সমাজ ও ধর্মাচারের বাইরে ভিন্নমত ও দর্শন প্রকাশ করলে মনোমোহনকে অনেক লাঞ্ছনা ও লোকনিন্দা সহ্য করতে হয়। তবু এই সত্যের স্বরূপসন্ধানী এই সাধক আত্মশক্তির বলে তাঁর নির্দিষ্ট পথে থেকে মানবমুক্তির সাধনায় সদা নিয়োজিত রইলেন। কেউ কেউ তাঁকে পাগল বলেও বিদ্রূপ করলেন। তিনি তাতে ভ্রূক্ষেপ করলেন না, বরং সমাজে পীরালি-ফকিরি সাধনা নামে যতসব ভন্ডামি প্রচলিত, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন, যেখানে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের অগ্রাহ্য করা হয়েছে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে এবং সাধনার পথ যে অনায়াসলব্ধ নয়, সুকঠিন, তা নির্দেশ করলেন। যেমন :
(রাগিনী : বসন্ত, তাল : যদ্ )
ফকিরি কি গাছের গোটা,
ঢেকি যদি স্বর্গে যাইত বারা বান্ত তবে কেটা।২৩
মানবজীবনে আত্মানুসন্ধান খুবই জরুরি একটি বিষয়। সেই প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিক সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’ বক্তব্যেরই যেন আধ্যাত্মিক অনুসরণ চলেছে বাংলার মরমি সাধকদের সাধনায়। মনোমোহনের মধ্যেও এই আত্মজ্ঞান লাভের প্রয়াস সর্বাধিক। সৃষ্টি ও স্রষ্টার লীলা-রহস্যে তন্ময় হয়ে তিনি ভেবেছেন ‘কে আমি ?’, কোথা থেকে তিনি এলেন ! কোথায় যাবেন পুনরায় ? এ রকম বিচিত্র প্রশ্ন ও ভাবের উত্তর খুঁজেন এবং এই অস্থিরতার অবসানে স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। মনোমোহনের ভাষায় :
(রাগিনী : খাম্বাজ, তাল : কাওয়ালি)
…
কই তুমি কই কারে বা কই, যারে কই সে শুনেবা কই
আমি তোমার হই বা না হই, তুমি আমার ঠিক বুঝেছি।২৪
এ কথা অপ্রিয় হলেও ঠিক যে, জীবাত্মার এই প্রেম একপাক্ষিক। পরমাত্মা, জীবাত্মার এই ব্যাকুল আহ্বানে সাড়া দিলেও প্রেমিক তাকে ডাকেন, আবার সাড়া না দিলেও ডাকেন। উল্লেখ্য, পরমাত্মার সাড়া দেওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি-জাত। ভাবুক মন প্রবল অনুভূতি ও উপলব্ধির সংবেদনশীল সক্ষমতায় তাঁর অস্তিত্ব টের পান বলে মনে করেন, কিন্তু স্রষ্টা বা পরমাত্মা এই আহ্বানে নিরুত্তর থাকেন। তাঁর এই নির্লিপ্ত আচরণে প্রেমিক মনে অধিক আকুতি জন্মায়। তবে এই ভাব-সম্পদ বাঙালির প্রাণের ধন, প্রাণের ঐশ্বর্য। আমাদের মহর্ষি মনোমোহন দত্ত এমনই একজন ভাবুক কবি, ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারক, মানবমুক্তির দূত, বাংলার আরেক জন লালন ফকির। তাঁর বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি-ভাণ্ডারের অনেক বিষয় নিয়ে লিখবার ইচ্ছা থাকলেও প্রবন্ধটি অতি দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কায়, অনিচ্ছাকৃত সংক্ষেপনের তাগিদ অনুভব করছি। তবে শেষ করার পূর্বে ড. সনজীদা খাতুনের মূল্যায়নটির উদ্ধৃতি জরুরি বিবেচনা করছি :
মলয়ার বাণী এবং সুরের মধ্যে যে সমন্বয়, তা বিশেষভাবে আমাদের আকর্ষণ করে। জ্ঞানচর্চা পথ কেবল বুদ্ধির চর্চা নয়, তা বোধের চর্চাও। সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে যে সাধনা, তা সেই সাধনার বোধের চর্চায়ই নির্দেশ করে। … মনোমোহন দত্তের দুটি দিক আমাকে আকর্ষণ করেছে। এক. মহর্ষির অসা¤প্রদায়িক বোধের দিক, দুই, বোধের চর্চার দিক। ২৫
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মনোমোহনের গান, বাংলার যেকোনো লোকায়ত গানের চেয়ে ভাব-ভাষা-ছন্দ এবং শাস্ত্রীয় সুরলয়ে সমৃদ্ধতর। বাংলাদেশ ও কলকাতার অনেক নামীদামী শিল্পীই ‘মলয়া’ গেয়েছেন; কিন্তু নবীনগর উপজেলার সাতমোড়া আনন্দ আশ্রমের শিল্পীদের মতো এমনটি কেউ গাইতে পারেন না। আফতাব উদ্দীন খাঁর সেই ঢংটা যেন খানিকটা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা । এক সময় টেলিভিশন, বেতারে ‘মলয়া’ নিয়মিত প্রচারিত হতো। অধুনা তা হয়না। লোকায়ত সংস্কৃতির এমন ক্ষয়িষ্ণু মুহূর্তে মহর্ষির ‘মলয়া’-র চর্চা ও লালন. শেকড়চ্যূত নাগরিক মনকে কিছুটা হলেও দেবে মানবমুক্তির ইশারা ও স্বস্তি।
তথ্যসূত্র
১. সুকুমার বিশ্বাস, মনোমোহন দত্ত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ-২
২. মনোমোহন দত্ত, মলয়া, আনন্দ আশ্রম সাতমোড়া, ২০০৬, পৃ-১৪
৩. প্রাগুক্ত, পৃ-১৩২
৪. মনোমোহন দত্ত, মলয়া, ২ খণ্ড, আনন্দ আশ্রম সাতমোড়া, ২০০১, পৃ-৫৩
৫. মনোমোহন দত্ত, মলয়া, আনন্দ আশ্রম সাতমোড়া, ২০০৬, পৃ-১২২
৬. প্রাগুক্ত, পৃ-৩৬
৭. প্রাগুক্ত, পৃ-৩৭
৮. প্রাগুক্ত, পৃ-১৪৪
৯. সুকুমার বিশ্বাস, মনোমোহন দত্ত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ-৭০
১০. মনোমোহন দত্ত, মলয়া, আনন্দ আশ্রম সাতমোড়া, ২০০৬, পৃ-৩৮
১১. প্রাগুক্ত, পৃ-৩৬
১২. মনোমোহন দত্ত, মলয়া, ২ খণ্ড, আনন্দ আশ্রম সাতমোড়া, ২০০১, পৃ-৬৮
১৩. মনোমোহন দত্ত, মলয়া, আনন্দ আশ্রম সাতমোড়া, ২০০৬, পৃ-৯২
১৪. প্রাগুক্ত, পৃ-১১১
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ-৫৬
১৬. প্রাগুক্ত, পৃ-১০৩
১৭. প্রাগুক্ত, পৃ-১৪৫
১৮. প্রাগুক্ত, পৃ-১১৪
১৯. সুকুমার বিশ্বাস, মনোমোহন দত্ত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ-৪২
২০. মনোমোহন দত্ত, মলয়া, আনন্দ আশ্রম সাতমোড়া, ২০০৬, পৃ-৬১
২১. প্রাগুক্ত, পৃ-১১৮
২২. প্রাগুক্ত, পৃ-৪৫
২৩. প্রাগুক্ত, পৃ-১৪৮
২৪. প্রাগুক্ত, পৃ-১১৮
২৫. সুকুমার বিশ্বাস, মনোমোহন দত্ত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ-৭২
স্যার, মহর্ষি মনোমোহন দত্তের মলয়া সংগীত নিয়ে এত সূক্ষ্ম ও চমৎকার আলোচনা আসলেই প্রশংসার দাবিদার। মলয়া সংগীতের যে নামকরণ এর প্রসঙ্গটি তাও খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।অতিদীর্ঘ একটি লেখা বলে হয়ত অনেকেই পড়তে চাইবে কিনা জানিনা।তবে বিষয়টি অনেক তথ্যবহুল ও উপকারী।আশা করি যারা মলয়া সংগীত কিংবা এর সাথে মনোমোহন এর যোগসূত্র নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করবে তাদের জন্য এই আর্টিক্যাল অনেক উপকারী হবে।
আপনার জন্য অনেক শুভ কামনা ও দোয়া।❤❤❤
নতুন জানলাম একজন সাধককে।
ধন্যবাদ, লোকগান-বিশেষজ্ঞ সাদী।
দোয়া রহিল দোস্ত। আগামীতে আরো এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আত্ম হৃদয় সাধক না হলে অপর সাধকের বিশ্লেষণ করা যায় না।চমৎকার বিশ্লেষণ।
আমার খুব ভালো লাগলো, একজন সাধক কে জানতে পারলাম।
আর পাশাপাশি ভালো লাগলো, আপনার এতো চমৎকার উপস্থাপনা। কতোটা জানলে এমন করে লিখা যায়….
মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম।
আপনার আরো লিখা পড়তে চাই।
মঙ্গল কামনা করি সর্বদা।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম। সত্যিই অসাধারণ।