প্রেমের তাজমহল

সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে

বিশ্ব-ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত তাজমহল নিয়ে মুম রহমানের এ লেখায় আছে ইতিহাস, কিংবদন্তি ও সাহিত্যের স্বাদ। ব্যক্তিক কল্পনা ও ইতিহাসবোধের সংমিশ্রণে লেখাটি তাজমহলকে জীবন্ত করে তুলেছে।

 

Did you ever

Build a castle in the air? Here is one,

Brought down to the earth, and fixed for

The wonder of ages; yet so loght it seems,

So airy, and when seen from a distance,

So like a fabric of mist and sunbeams…

That, even after you have touched it,

And climbed to the summit, you almost

Doubt its reality…

Bayrd Taylor (At the Taj, 1855)

এখন আমি প্রায় প্রতিদিনই তাজমহলে যাই, কখনো দিনে, কখনো রাতে, কখনো একা, কখনো প্রিয় সঙ্গীর হাত ধরে। তবে পুরো রাত নয়, পুরো দিনও নয়, আমাকে মুগ্ধ করে ভোরের ও সন্ধ্যার তাজমহল। রাত্রি শেষ হয়, দিনের শুরু হয়, তখন ভোর, তাজের মুখে আরেকটি নতুন রোদের আদর, তখন তাজ আহ্লাদী ঘুমকাতুরে গোলাপী বালিকাা। আবার দিন ফুরায়, রাত্রি নামার পায়তারা শুরু হয়, তখন সন্ধ্যা, তখন তাজের মুখে বিষণ্ণ বিদায়ী বেগুনি আভা। দিনে, রাত্রে, সন্ধ্যায়, ভোরে, শীতে, গ্রীষ্মে প্রতিদিনই প্রতিমুহূর্তে বদলে যায় তাজের রূপ। কখনো শীতের কুয়াশা চাদরে ঢাকা তাজমহল অবগুণ্ঠনের আড়াল থেকে দেখা রূপসী নববধূ, কখনো শরতের স্বচ্ছ আলোয় তাজমহল যেন বিশ্বসুন্দরীর হাসির ঝিলিক। কখনো গোধূলি আলোয় সে গোলাপরাঙা, চাঁদের আলোয় অপার্থিব নীল, মধ্যদিনে ঘিয়া রঙা, সকালে ধূসর হরিদ্রাভ। ভ্যানগগ তথা অন্যান্য ইম্প্রেসনিস্টরা যেমন একই দৃশ্য দিনের নানা আলোয় আাঁকার জন্য তুলি হাতে নিয়ে বসে থাকতেন অচিত্রকর আমি তেমন সারাদিন নানা আলোয় তাজের অকিঞ্চিতকর দর্শক হয়ে বসে থাকি। সুর জানি না, রেখা জানি না, ভাষা নাই, তবু তাজের গুণ গাই। কেননা আমি তাজের প্রেমিক, তাজমহলেই আমার নিত্য অভিসার।

 

কিন্তু মজার বিষয় হলো, তাজমহল আমি দেখিনি। মানে বাস্তবে দেখিনি, মুখোমুখি দেখিনি। ফটোগ্রাফে কিংবা সিনেমায় তাজমহল দেখেননি এমন মানুষ কি সত্যিই পৃথিবীতে আছে? আমার কৈশোর কালে তো হামেশাই দেখেছি রিকশার পেছনে, বেবিট্যাক্সির পেছনে তাজমহল আঁকা থাকতো। সাদা ধবধবে তাজমহলের কথা বইতে পড়েছি, সেই তাজমহলের কোথাও কোথাও মেয়েদের গালের মতো গোলাপি রুজ দেয়া থাকতো, কোথাও বা নীলাভ আভা থাকতো, হয়তো রাতের, জ্যোৎস্নার নীল। আমি এইসব দেখে, শুনে, পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি টুরিস্টের মতো করে তাজমহল দেখতে যাবো না। ভ্রমণসাহিত্যে বাংলা একাডেমির পুরস্কার পাওয়ার খায়েশ আমার নেই। অতএব তাজমহল দেখার তাড়াহুড়া নেই। আমি যখন তাজমহলে যাবো, অবশ্যই আমি সেখানে দিন দশেক, চাই কি একমাস থাকবো। পারলে আরো বেশি থাকতাম। হয়তো এক বছর। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক আর পারিবারিক কারণেই আমরা অনেক কিছু পারি না।

 

সবচেয়ে ভালো একটা কোন কাজ যদি জুটে যেতো। তবে আমি তাজমহলের চারপাশ দিয়ে, সত্যিই চারপাশ দিয়ে সমানে ঘুরঘুর করতাম। ওকে আবিষ্কার করতাম নানা রঙে রূপে। বৃষ্টিতে কেমন লাগে তাজমহল? চরম রোদে? শুনেছি দিল্লি আশেপাশেও নিষ্করুণ গরম। শীতের কুয়াশায় তাজমহল কেমন? আসলে সুন্দরকে দেখতে হয় নানা ঋতু, নানা সময়ে, নানা আবহাওয়ায়। যেমন আমি দেখেছি সেন্টমার্টিনকে। লোকে একদিনে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করে। আমার খুব হাসি পায়। সকাল ৯/১০টায় জাহাজ ছাড়ে টেকনাফ থেকে। সেন্টমার্টিন জেটিতে পৌঁছতেই দুপুর। নেমে হুড়মুড় করে কিছু একটা খেয়ে নেয়া। জেটির মুখ থেকেই হোটেলঅলাদের হাকডাকে বিভ্রান্ত হয়ে যে কোন একটা হোটেলে ঢুকে কিছু একটা খেয়ে নেয়া। তারপর দ্বীপের বাজার ঘুরে দেখা, কেউ কেউ হুমায়ূন আহমেদের বাড়িটা দেখে আসেন, আরেকটু এডভেঞ্চার-প্রেমী হলে স্পিডবোট ভাড়া করে ছেঁড়াদ্বীপ গিয়ে ২০/২৫ মিনিট কাটিয়ে আসেন। কারণ আবার ৩টার দিকে ফিরতে জাহাজ।

 

এই যে তিন/চারঘণ্টা — তা দিয়ে তো ডিমেও তা দেয়া যায় না, সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখা তো দূরের কথা। একটা জায়গায় কি স্রেফ একটা স্থান? প্রত্যেক জায়গার মানুষের চরিত্র আছে, খাওয়া-দাওয়ার ভঙ্গি আছে, আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য আছে — এসব দেখার সুযোগ সেন্টমার্টিনে হয়েছে আমার। সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, ঝড়, বৃষ্টি, তারাভরা আকাশ, তপ্ত দিন — প্রত্যেক রূপেই সেন্টমার্টিন আলাদা। তাজমহলকেও আমি এভাবে দেখতে চাই। তাই যখন যেতে চাই আয়োজন করে যেতে চাই। যেন অন্তত কয়েকটা দিন ওর কোলের কাছে থাকা যায়। তাজমহলের গন্ধ আবিষ্কার করা যায়, তার রঙ, রূপের সাথে সাথে। রঙ, রূপ, গন্ধের সঙ্গে তাজের স্পর্শ নিতে চাই, স্বাদ নিতে চাই আমি। ভালোবাসা তো তাই। সব ইন্দ্রিয় খুলে দেবে। যমুনা তীরের তাজমহলকে আমি ভালোবাসতে চাই। ‘যমুনা নদী পারে শুনিবে কে যেন ডাকে।’

 

ভালোবাসার জন্য কী করা যায় তার একটা বৈশ্বিক নমুনাই তাজমহল। সত্যি বলতে কি, ব্যক্তির ভালোবাসার মধ্যে এক ধরনের স্বার্থপরতা থাকে। কোন নারীকে যদি তেমন তীব্র করে ভালোবাসা যায় তখন তাকে ছাড়া আর সব কিছুই তো অর্থহীন মনে হয়। এ আমাদেরও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, এককভাবে কাউকে প্রবল ভালোবাসার অর্থ অধিকাংশ সময়ই সামগ্রিকভাবে অন্য সবাইকে উপেক্ষা করার প্রক্রিয়া। এ কথা শুধু নারী, পুরুষের প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে নয়, দেশপ্রেম কিংবা ধর্ম, রাজনীতির প্রেমেও প্রযোজ্য। তীব্র প্রেম একটা নেশার মতো আবেশ তৈরি করে। লোকে যে বলে, ভালোবাসা অন্ধ, সে কথা বড়ই ভুল। ভালোবাসা অন্ধ নয়, একচোখা। সে এক চোখা দৈত্যের মতো শুধু ভালোবাসার মানুষটিকেই দেখে। তবুও একচোখা ভালোবাসা বরাবরই তার নিজের গুণেই বড় এবং ধনী। এটা ঠিক, প্রকাশের ভাষা, ক্ষমতা, শৈল্পিক দক্ষতা সবার এক রকম নয় তবু ভালোবাসা অনেক বড় ব্যাপার। আর প্রেমিক যখন স্বয়ং মোগল সম্রাট তখন তার প্রকাশভঙ্গিটা যে কারো চেয়েই বিশাল। সম্রাট চাইলেই তার পুরো রাজত্ব বাজি ধরতে পারে প্রিয়তমার জন্যেই। প্রেম যদি অন্ধও হয় প্রলয় তো আর বন্ধ হয় না।

এমনি এক দুর্নিবার প্রেমের গল্প লিখেছেন মোগল সম্রাট শাহজাহান তার তাজমহল বানিয়ে। সেই বানানোর গল্প আজ কিংবদন্তি, কখনোবা পৌরাণিক কাহিনির মতো রহস্য-রোমাঞ্চে ভরপুর। কোন কোন লোককাহিনিতে শোনা যায়, তাজের মূল সৃষ্টিকর শিল্পীদের মেরে ফেলা হয়েছিলো, কারো চোখ তুলে নেয়া হয়েছিলো, কারো হাত কেটে ফেলা হয়েছিলো। এ সবই করা হয়েছিলো যাতে তাজমহলের সমতুল্য আর কোন কিছুই কখনো সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়। শাহজাহান তার প্রেমিকা-স্ত্রী মমতাজের স্মরণে যে মহল বানিয়ে ছিলেন পৃথিবীতে তা এক ও অনন্য হয়ে থাকবে এমন ইচ্ছাতেই এই সব নিষ্ঠুরতা। কিন্তু এই নিষ্ঠুরতার আড়ালেও রয়েছে একচ্ছত্র প্রেমিকের তীব্র আকুলতা। নিজের প্রেমকেই বড় করে দেখতে, দেখাতে চেয়েছেন শাহজাহান। একচোখা প্রেমিকের দানবিক শখ ও সাধ হয়তো তাজমহল।

 

সাধারণ কোনো অট্টালিকা হলে অন্য কথা, কিন্তু তাজমহলের মতো ভালোবাসার প্রাসাদ গড়ার জন্যই ২২ বছর ধরে ২০ হাজার কর্মীকে খাটানো জায়েজ মনে হয়। এর সঙ্গে যে বিপুল ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট তা লাঘব করতে রাজ্যকোষে হাত দেয়াই স্বাভাবিক। আর এই ভালোবাসার প্রাসাদ গড়তে অকুণ্ঠ চিত্তে শাহজাহান যা যা দরকার তা-ই করেছেন, কেননা তিনি মূলত এক একরোখা প্রেমিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তাজমহলকে ‘সময়ের গালে প্রেমের এক ফোঁটা অশ্রু সমুজ্জ্বল’ বলেন তখন শাহজাহানের ভালোবাসার তীব্রতার কথা সামান্য হলেও আমরা আন্দাজ করতে পারি। অন্তত জীবনে একবার তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণম্য রবীন্দ্রনাথ যে সবচেয়ে ধ্রুব সত্যটিই বলেছেন তা দেখতে চাই আমি। কিন্তু তাজমহল এখনও দাঁড়িয়ে আছে ‘আমার গানের ওপারে’। তা থাকুক। তবু তো আছে। একদিন দেখা হবে সেই আশাতে তো আমরা কতো কিছুর সাধনা করি। আমার তো ইচ্ছা আছে একবার এভারেস্টের পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াবো। অন্তত বেইসক্যাম্প থেকে পরাণ ভরে এভারেস্টের রঙ-রূপ দেখবো। কনকনে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে সূর্যের সোনামাখানো আঁচে বরফগুলোকে ঝিলমিল করতে দেখবো।

 

অনেকের মতোই আমি বাঙালি। আটকে আছি সংসারে, আয় উপার্জনে আর নানা অজুহাতে। কিন্তু তবু ভরসা রাখি ‘গানের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা’ সব কিছু একদিন দেখতে পারবো, ছুঁতে পারবো। নইলে আর পরমে বিশ্বাস রাখা কেন! যাক, শিবের গীত অনেক হয়ে যাচ্ছে বরং স্বপ্ন ও প্রেমের তাজমহলেই ফিরে আসি। সব প্রেমই মহান, কিন্তু ইতিহাস নয়। শাহজাহানের প্রেম ইতিহাস হয়ে আছে। উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেমকাহিনির জনক শাহজাহান। উর্দূ কবি আফসোস করে বলেছেন :

এক শাহনশাহ-নে দৌলৎ-কা সাহারা লেকর

হাম গরিবো-কী মুহব্বৎ কা উড়ায়া হৈ মজাক।

সোজা বাংলায় বলা যায়, এক শাহেনশাহ তার ধনসম্পদের সাহায্যে আমাদের মতো গরিবদের প্রেমকে উপহাস করেছেন। কিন্তু নাম-না-জানা এই শায়েরের প্রতি বিনীত থেকেও বলা যায়, দৌলত থাকলেই প্রেম দেখানো যায় না। মোগল সম্রাট তো আরও ছিলেন, শাহজাহানের চেয়ে ধনী লোকও পৃথিবীতে কম এলো গেলো না, কিন্তু তাজমহল আজও একটাই। আর সেটা বানিয়েছেন প্রেমিক শাহজাহান, ধনী শাহজাহান নন।

 

তাজ ঐশ্বর্য প্রকাশের বাহাদুরি নয়, শ্বেতমর্মরে লেখা শোকগাথাও বটে। স্ত্রীর জন্য বহু কবিতা লিখেছেন পাবলো নেরুদা। কিন্তু শাহজাহানের হাতে কবিতা ছিলো না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পাথরের স্মৃতিস্তম্ভে কবিতা লিখেছেন বিরহী কবি শাহজাহান। এই কবিতাই তাজমহল। এ এক প্রেমের কবিতা।

এ প্রেমের শুরু ১৬০৭ সালে। সুদর্শন তরুণ রাজকুমার খুররম এক মিনাবাজারে নিঁখুত পারস্য সুন্দরী আর্জুমান্দ বেগম বানুকে দেখেন। উল্লেখ্য শাহজাহানের আসল নাম ছিলো শাহাব-উদ-দীন, সম্রাট হওয়ার আগে তাকে রাজকুমার খুররম ডাকা হতো, আর সম্রাট হয়ে তিনি হলেন শাহজাহান। ১৬২৮ সালে তিনি সম্রাট হন। যাহোক, প্রাসাদের সংলগ্ন হারেমের কাছেই এই মিনাবাজারের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেই এক দোকানে দেখা হয় দুজনের। খুররম একটা কাচের দাম জানতে চাইলে, আর্জুমান্দ বানু মধুর স্বরে জানান, এটা কাচ নয়, হিরা এবং এর দাম দশ হাজার রুপি, যা দেয়ার সাধ্য তার নেই। খুররম এই দামেই হিরাটি কিনে ঘরে ফেরেন আর নিজের হৃদয়টি রেখে আসেন মিনাবাজারে, বিনামূল্যেই।

 

পরের দিনই খুররম তার বাবা সম্রাট জাহাঙ্গীরকে জানান, তিনি আর্জুমান্দকে বিয়ে করতে চান। প্রিয়তমা নূরজাহানের কথা স্মরণ করে সম্রাট জাহাঙ্গীর পুত্রকে সম্মতি জানান। কিন্তু তারপরও পাঁচ বছর পার হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় নানা কোন্দল আর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এদিকে রাজনৈতিক কারণেই পারস্যের রাজকন্যা কুয়ান্দারি বেগমকে বিয়ে করতে বাধ্য হন খুররম, ওরফে শাহজাহান। মুঘল সাম্রাজ্যে কুটক্যাচালের কথা কম-বেশি সবারই জানা।

 

অবশেষে ১৬১২ সালে, এই সব প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেকে খানিক ফুসরত পান শাহজাহান। দেখা হওয়ার পাঁচ বছর পর আর্জুমান্দ বানুকে বিয়ে করার সুযোগ পান শাহজাহান। বিয়ের পর আর্জুমান্দ বানুর নামকরণ করেন মমতাজ মহল। পার্সিয়ান ভাষায় মমতাজ মহল শব্দের অর্থ হলো মহলের শ্রেষ্ঠ জনা।  এই বিয়ের সময় সম্রাট শাহজাহানের বয়স ছিলো বিশ আর মমতাজের ১৯ বছর। এই বিয়ে যথার্থ সুখের হয়েছিলো। মমতাজের গুণগান করতো সবাই। রাজকবি বলেছিলেন, ‘তার সামনে চাঁদ লজ্জায় লুকিয়ে পড়ে।’ রাজকবির নাম আমি জানি না। আপনারা জানলে আমাকে জানাবেন। এখন তো জানানো কোন কঠিন কাজ নয়, ইমেইল, ফেসবুক ইত্যাদি তো আছেই।

 

দ্বিতীয় স্ত্রী হলেও মমতাজ হয়ে ওঠেন পঞ্চম মোগল সম্রাটের যথার্থ সঙ্গী। দানে, ধ্যানে, এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও তিনি সদা শাহজাহানের সঙ্গে থাকতেন। তাদের উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে চৌদ্দজন সন্তান ধারণ করেছিলেন মমতাজ (এরমধ্যে সাতজনই শিশুকালে মারা যায়)। আর শেষ সন্তান জন্ম দেয়ার সময় ১৬৩১ সালে মমতাজ মারা যান। তার মৃত্যু হয় যুদ্ধের ময়দানেই। আজকের দিনে আঁতকে ওঠারই কথা, কিন্তু তখনকার দিনে একাধিক বিয়ে করা, একগাদা সন্তান জন্ম দেয়া এবং তার মধ্যে বেশ কয়েকজনের মরে যাওয়াও কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এমনকি সন্তান জন্ম দিতে দিতে মরে যাওয়াও নয়। স্ত্রীকে যতোই ভালোবাসুক সম্রাট কিংবা ভিখারি, সন্তান জন্ম দেয়া থেকে রেহাই তো দিতে পারেন না? সেকালের কথা বলছি আর কি!

 

কথিত আছে যে, মৃত্যুশয্যায় ফিসফিস করে সম্রাটের কাছে চারটি অনুুরোধ করেছিলেন প্রিয় পত্নী মমতাজ। প্রথমেই তিনি চেয়েছিলেন যে তার নামে সম্রাট একটি সমাধি বানাবেন। তারপর তিনি সম্রাটকে পুনরায় বিয়ে করতে এবং সন্তানদের প্রতি নজর রাখতে অনুরোধ করেন। এবং সবশেষ অনুরোধ ছিলো, তার প্রত্যেক মৃত্যুবার্ষিকীতেই সম্রাট তার সমাধিতে যাবেন। মৃত্যু শয্যায় স্ত্রীকে দেয়া প্রথম দুটো অনুরোধ রাখতে পেরেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। শোনা যায়, মমতাজের মৃত্যু শোকে কয়েক মাসের মধ্যেই শাহজাহানের চুল-দাড়ি পেকে যায়। তার মৃত্যুর পর সম্রাট প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেন, প্রিয়তম স্ত্রীর স্মৃতি-স্মরণে এমন এক সমাধিসৌধ নির্মাণ করবেন তিনি যা জগতের সেরা। যমুনা তীরে সেই সেরা কারুকাজময় স্মৃতির মিনারের নামই তাজমহল। আজও তাজের কারুকাজ বিশ্বের বিস্ময়।

 

১৬৩১ সালে মমতাজের মৃত্যু হয়। ১৬৩২ সাল থেকে মোট ২২ বছর লেগেছে তাজমহলের কাজ শেষ হতে। ১৬৫৩ সালে তাজমহলের কাজ শেষ হয়। তখনকার হিসাবে এতে খরচ হয়েছিল তিন কোটি বিশ লাখ রুপি। এর প্রধান স্থপতি ছিলেন ইরানের ওস্তাদ ঈশা। তুর্কির ইসমাইল আফান্দি মূলভিত্তি নকশা করেছিলেন, মহলের উপরের সোনার কারুকাজের জন্যে লাহোর থেকে এসেছিলেন কাজিম খাঁ, মোজাইকের নকশা করেছিলেন দিল্লির চিরঞ্জি লাল, পারস্য থেকে আমানত খান এসেছিলেন ক্যালিওগ্রাফি করার জন্য আর মূল্যবান পাথর কাটার জন্য বেলুচিস্তান থেকে আনা হয়েছিল আমির আলীকে। এভাবে দিল্লি, কনৌজ, লাহোর, মুলতান থেকে তো বটেই বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেরা কারিগররা এসেছিলেন বাগদাদ, সিরাজ ও বুখারা থেকে। এরা সবাই মিলে শাহজাহানের স্বপ্নের তাজমহল বাস্তবের আদল দিয়েছিলেন। ১ হাজার হাতির পিঠে করে ভারত ও এশিয়ার নানা স্থান থেকে নির্মাণ সামগ্রী আনা হয়েছিল। বাগদাদ, শ্রীলঙ্কা, পাঞ্জাব, তিব্বত, আরব সাগর, চীন ও ইউরোপের নানা স্থান থেকে পৃথিবীর মূল্যবান সব রত্ন আনা হয়েছিল তাজমহল সাজাতে। মোট ২৮ রকমের মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তাজমহলকে সাজাতে।

মূল তাজমহলটি ঘেরাও করে আছে দূর্গের ঢঙে। চারিদিকের দেয়াল আর চারপ্রান্তের গম্বুজ চারটি লাল বালি পাথরে তৈরি। এর মাঝখানেই শ্বেতপাথরের তাজমহল। মূল গেটটি ঠিক যেন নব পরিণীতার ঘোমটা। এর ভেতর দিয়ে জড়োয়া তাজকে দেখা যায় এক নজর। প্রবেশকালেই তাজকে দর্শনার্থী দেখবেন এই খিলানের ভেতর দিয়ে। এই খিলানটা চারপাশের সবকিছুকে বাদ দিয়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সাদা তাজমহলকেই শুধু দেখাবে। আর প্রথম দর্শনে, খিলানাকার গেটের ভেতর দিয়ে দেখা মাত্রই তাজমহলের প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে দর্শনার্থী কিংবা পর্যটক। অনেকেই মনে করেন, তাজমহল এমন সুচারুভাবে তৈরি করা যাতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেখলে সুন্দর নারীকে বিভিন্নভাবে দেখা হয়ে যায়। গেট খুললে প্রথমেই চোখে পড়বে কৃত্রিম হ্রদ আর ছায়াঘেরা গাছের সারি। জলের আয়নায় তাজের প্রতিমুখ দেখে তাজের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মার্বেল পাথরের মেঝেতে পা ফেলেলেই অনন্ত শয়ানের শীতলতা মনে করিয়ে দেবে।

 

ভোরে গেলে নাকি দেখা যায় মার্বেলের ছোট ছোট তাজমহল নিয়ে বসে আছে দোকানিরা। চাইলে তাজের একটি মিনিয়েচার সংস্করণ কিনে আনা যায়। তবে আমি কিনবো না এটা নিশ্চিত। স্যুভিনিয়র বলতে আমি স্মৃতিকেই বুঝি। নিজের স্মৃতির উপর ভরসা কম বলে, লিখে রাখি যতোটা পারি। কিন্তু এইসব বাণিজ্যিক স্যুভিনিয়র আমাকে টানে না। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ফ্যাক্টরিতে তৈরি হওয়া পিচ্চি তাজমহল আমি অন্তত নানা জনের কাছে যা দেখেছি তাতে ভক্তি শ্রদ্ধা হয়নি কোনো। তাজমহল হোক, আইফেল টাওয়ার কিংবা স্ট্যাচু অব লিবার্টি — তাদের আকারটাই তো সমীহ জাগানিয়া। সে আকার ছেটে যে মিনিয়েচার করা হয় তাতে তার মহিমা খুঁজে পাওয়া বড়ই দুরূহ। তাজমহল যথার্থ অর্থেই প্রকাণ্ড। ৪২ একর জায়গায় জুড়ে তৈরি হয়েছে এই সমাধিক্ষেত্র। প্রধান যে গম্বুজ তার উচ্চতা ২৪০ ফুট, বাকি চারটি মিনারের উচ্চতা ১৩০ ফুট করে। এই চারটি মিনারকে মাটির  সঙ্গে একদম ৯০ ডিগ্রিতে খাড়া করে রাখা হয়নি, বরং একটু বাঁকা করে বসানো হয়েছে, যাতে কখনো ভূমিকম্প হলেও এই মিনারগুলো মূল সমাধির উপর না পড়ে। এতোই নিঁখুত এর স্থাপত্য চিন্তা। আর আকারের কথা তো জানলেনই। এখন প্রায় ২০ তলা দালানের চেয়েও উঁচু তাজমহলকে পাঁচ ছয় ইঞ্চির মিনিয়েচারে কতোটুকু চেনা যাবে? বরং আমি চাইবো বিকালে কি সন্ধ্যায় যখন পর্যটকের ভিড় বাড়বে তখনও তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলতে। নিজের এবং অন্যদেরও। তাজমহল দেখতে আসা ভিড়ের মানুষদের মুখ দেখতে পারা, তাদের মুখের অভিব্যক্তি তুলে রাখাও ইম্প্রেসনিস্ট পেইন্টারের কাজ হতে পারে। মোনালিসা, আইফেল টাওয়ার দেখতে গেলেও মানুষ একা ছবি তোলার সুযোগ কম পায়। কারণ ভিড় সদাই লেগে থাকে। যে সময় ভিড় হয় না সে সময়টা জেনে নিয়ে গেলে নিরিবিলিও দেখা যায় আরাধ্য প্রিয় বস্তু বা জায়গা বা মানুষকেও।

 

ধ্রুপদী স্থাপত্যকলার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামঞ্জস্য। মানে যাই থাকুক জোড়ায় জোড়ায় থাকবে। একটা পিলারের সঙ্গে আরেকটা পিলার সঙ্গতিপূর্ণ হতে। লালের সঙ্গে নীল, সাদার সঙ্গে কালো সাজানো থাকবে সামঞ্জস্যে। তবে তাজের সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থাপত্য কৌশলের মধ্যে একমাত্র বেমানান দিক হলো শাহজাহানের কবর। তাজমহলের স্বপ্নদ্রষ্টা শাহজাহান নিজেই আজ তাজমহলে বেমানান। এও এক ধ্রুপদী ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজেডি কিংবা আইরনির মূল কারণ হলো শাহজাহানের কবরটি মূল নকশায় ছিলো না। শাহজাহানের মৃত্যুর পর পুত্ররা মমতাজের পাশেই তাকে কবর দিয়ে দেয়। অথচ শাহজাহানের ইচ্ছা ছিল আরেকটা তাজমহল বানানোর। ঠিক মূল তাজের ছায়ার মতোই এই তাজমহলেই তার কবর হবে এমনটা চেয়েছিলেনে তিনি। তিনি চেয়েছিলেন যমুনার অন্য পারে তার সমাধিতে যে তাজমহল গড়ে উঠবে তা হবে কালো রঙের। সাদা আর কালো তাজমহলের মাঝখানে থাকবে একটি সেতু। এই সেতুর মধ্য দিয়ে তাদের অদৃশ্য ভালোবাসা যাতায়ত করবে। একটি মহল হবে আরেকটি মহলের প্রতিধ্বনি কিংবা প্রতিবিম্ব।

 

কিন্তু পুত্রদের বিবাদের কারণে শাহজাহানের সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। স্ত্রীকে দেয়া চারটি কথার মধ্যে দুটি তিনি রাখতে পারেননি। তার পুত্ররা রাজত্বের লোভে একে অপরের রক্তপিপাসী হয়ে উঠেছিল। অবাধ্য পুত্রদের তিনি সামলাতে পারেননি। দেখে রাখতে পারেননি মমতাজের সন্তানদের। শুধু তাই নয়, সম্রাট শাহজাহান বন্দি হয়েছিলেন রাজ্যলোভী পুত্রের আদেশেই। বন্দী সম্রাট কারাগারের গরাদ ভেদ করে তাজমহলকে দেখতে পেতেন, কিন্তু স্ত্রী মৃত্যুবার্ষিকীতে সেখানে যাওয়ার অনুমতিও পেতেন না।

 

তাজমহল শুধু একটি স্থাপত্য-কীর্তি নয়, নয় শুধু একটি সমাধি-সৌধ। ভালোবাসার এক অমূল্য সৌধ, শাহজাহানের শোকের মিনার আর নন্দন ও শিল্পের অনন্য উদাহরণ হলো তাজমহল। এই তাজমহল শিল্পে-সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলো। আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের কবিতায় তাজমহলকে পাই। ননসেন্স রাইম বা অর্থহীন ছড়ার লেখক এডওয়ার্ড লিয়র ১৮৪৭ সালে তাজমহল দেখে উল্লসিত হয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘এখন থেকে আমি পৃথিবীর অধিবাসীদের দুভাগে ভাগ করবো — তাজমহল দেখার দল আর তাজমহল না-দেখার দল।’ আফসোস, আমি এখনও দ্বিতীয় দলে আছি। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব থেকে জানতে পারি, ২০১৮ সাল নাগাদ প্রায় সাড়ে ছয়কোটি পর্যটক তাজমহল দর্শন করেছে। আহা, আমি এখনও পারিনি।

 

তবে সবাই যে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তাও কিন্তু নয়। যেমন আমার দুই প্রিয় লেখক অ্যালেক্স হেলি কিংবা রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর চোখে তাজমহল ভালো লাগেনি। তবুও জগতের অসংখ্য শিল্পী সাহিত্যিককে টেনেছে তাজমহল। আমার মনে হয়, তাজমহল যারা দেখেছে, উপলব্ধি করেছে, তারা এক জাতের লোক, আর তাজকে যারা দেখেনি বা দেখেও এর মাধুর্য বুঝতে পারেনি তারা আরেক জাতের লোক।

 

তাজমহল নিয়ে সাহিত্যের নমুনা সংগ্রহ পাওয়া যাবে পূর্ণেন্দু পত্রী’র লেখা ‘সাহিত্যের তাজমহল’ (প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড) শিরোনামের ছোট্ট বইটিতে। আমার প্রিয় ছোট্ট এই বই থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। এই উদ্ধৃতিগুলো দিয়েই লেখাটা শেষ করি —

একথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান

কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান।‘ ….

যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,

শুধু থাক

এক বিন্দু নয়নের জল

কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্বল

এ তাজমহল।

             ৭ সংখ্যক, বলাকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখেছ কি তার প্রাণ?

অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে সাজাহান।’

                     ‘নারী’, কাজী নজরুল ইসলাম

 

জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লী-লাহোর-ফতেহ্পুর,

যমুনা জলের পুরনো বাঁশীতে বেজেছে নবীন সুর?

নতুন প্রেমের রাগে

তাজমহলের অরুণিমা আজও উষার অরুণে জাগে।

                        হিন্দু-মুসলমান, জীবনানন্দ দাশ

 

তেজিয়ান সাজিহান দিল্লী অধিপতি

ভার্য্যা তাহার বসুমতি অতিরূপবতী,

তাহারি স্মরণ হেতু ভ’প সাজিহান

গৌরবে করিল তাজমহল নির্মাণ।

                         সুরধনী, দীনবন্ধু মিত্র

 

তীর্থ তুমি গো তাজ নিখিল প্রেমীর,

মরমীর হিয়ার আরাম,

অশ্রæ-সায়রে তুমি অমল-শরীর

কমল-কোরক অভিরাম!

তনু-সম্পুট তুমি চির-ধরনীর

মৃত্যু-বিজয় তব নাম।

                        – অভ্র আবীর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

 

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here