কিস্তি : ২
৪
ফিরতে ফিরতে প্রায়ই আটটার মত বেজে যায়। প্রতিদিনই মা’র এক কথা, কলেজ-টলেজে পরীক্ষা কেন দেই না। এখানে পরিশ্রম বেশি। যাওয়া আসার কী একটা অসুবিধা! তখন বলি, বিশ হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে কলেজের সাতহাজার টাকা দামের চাকরি করতে বলো! মা তখন বিড়বিড় করে। কী বলে মা’ই জানে!
চৌদ্দ প্রকার পরীক্ষার পালা চুকিয়ে শেষমেষ এক কলেজে চাকরি হয়েছিল আমার। সাতহাজার টাকা অফার করেছিল। বলেছিল, টিউশনির সুযোগ আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বলেছিলাম, পনের হাজার টাকার কমে সম্ভব নয়। মা কিনা এইসব কলেজের কথাই বলে। অবশ্য সব কলেজে যে আট-দশহাজার টাকা দেয়, তা না। কিছু ভালো কলেজও আছে। সেগুলোতে সার্কুলার দিলে অবশ্যই করব। মাকে নিশ্চিন্ত হতে বলি। মা তখন তার পরিচিত এর-তার বরাত দিয়ে বলে, কেন ও তো ভালোই বেতন পায়। ওমুক কলেজ, তমুক কলেজের নাম নেয়। একদিন দেখি এক সরকারি কলেজের নাম বলছে। আমি বললাম ওটাতে ঢুকতে হলে বিসিএস দিয়ে ঢুকতে হবে।
গরুর মাংস, ডাল আর বেগুন ভাজি। অসাধারণ খাবার। অফিস থেকে ফেরার পর বাসায় ঢুকে আমার প্রথম কাজ হল গোসল করা। শীতের দিন হলে গরম পানি। গোসল তবু করতেই হবে। গোসল করার পরই ক্ষুধা লেগে যায়। ততক্ষণে অবশ্য বেজেও যায় নয়টা-সাড়ে নয়টা।
রাতের খাবার সবাই একসঙ্গে খাবে। এই নিয়ম। সবাই বলতে আমরা দুই বোন। বাবা-মা-দাদি। ভার্সিটি বন্ধ থাকলে আমরা অবশ্য তিন বোন। বাবা-মা-দাদি। মোট ছয়জন। বোনদের মধ্যে আমি সবার বড়। মেজোটা মাওলানা ভাসানীতে পড়ে। সিপিএসে। ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সাইন্স। সবার ছোটো হিয়া। ও এবার এইচএসসি দেবে। আমাদের তিন বোনের নাম রাখা হয়েছে মিল রেখে। সব পরিবারেই যেমন দেখা যায়। ভাই-বোনদের নাম রাখা হয় মিল দিয়ে দিয়ে। আমি লায়লা ইয়াসমিন দিয়া। তারপর লায়লা মেহজাবিন রিয়া। তারপর লায়লা তাসমিন হিয়া। লায়লা আমার দাদির নাম। লায়লা বানু। দাদির নামের সঙ্গে মিল রেখে বাবা আমাদের বোনদের নাম রেখেছেন। স্কুলে পড়ার সময় এই লায়লা নামটার জন্য আমার কান্না আসত। সব স্যাররা আমাকে ডাকত লায়লা। আমি তো লায়লা নই। খুব বলতে ইচ্ছা করত যে, ‘আমি লায়লা নই। আমি দিয়া। লায়লা আমার দাদির নাম।’ অথচ লায়লা নামটা এখন খুব ভালো লাগে আমার। হয়তো দাদির নাম লায়লা বলেই ভালো লাগে। অফিসে শুধু পাটোয়ারীই আমাকে লায়লা ডাকে। বাকি সবার কাছে আমি দিয়া। সার্টিফিকেটে আমার দিয়া নামটাও যুক্ত আছে। একারণে সবাই লায়লা ডাকে না। আমাদের বোনদের সবারই ডাকনাম সার্টিফিকেটে যুক্ত করা।
‘মাংসে আজকে হলুদ একটু বেশি দিয়ে ফেলেছ।’
দাদি হাসতেছিল। বললো, ‘বুঝলি কেমনে যে, তোর মা রানছে?’
‘তুমার রান্না আমি চিনি।’
ডালটা দারুণ লাগছে। ক্ষুধার জন্য কিনা জানি না। মা-ও খুব ভালো রান্না করে। তবে দাদিই বেশিরভাগ রান্না করে। বাবা পছন্দ করে বলেই করে। মার কাজ দাদিকে অ্যাসিস্ট করা, আর বারবার এটা বলা যে, ‘আম্মা, আইন্যে যাইন। আমি দেকতাছি। আইন্যে গুসুল করুইন গা। নামাজের সুময় ওইয়া গেছে।’
ইদানিং মা-ই বেশি রান্না করতেছে। বছরখানেকের মধ্যে হঠাৎ করেই যেন দাদির বয়স অনেকটা বেড়ে গেল। শরীর ভেঙে পড়েছে। নামাজ পড়া আর আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করাই এখন তার কাজ। আমি থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় দাদা মারা গেছেন। বাবা পরে দাদিকে নিয়ে আসলো ঢাকায়। আমাদের দাদা-বাড়ি শেরপুর। শেরপুর বললে, লোকে জিজ্ঞাসা করে কোন শেরপুর? তখন বলতে হয় শেরপুর — মানে জামালপুর-শেরপুর। শেরপুর জেলা। দুই চাচা শেরপুরই থাকেন। ঈদে যাই। দাদিরও একটু হাওয়া বদলের ব্যাপার আছে।
আমাদের তিনবোনেরই জন্ম ঢাকায়। বাবা টঙ্গী সরকারি কলেজে রসায়ন বিভাগের ডেমোনস্ট্রেটর ছিলেন। এখন রিটায়ার্ড। আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকি, এটা আমাদেরই। ছোটোবেলা থেকেই দেখতাম, বাসায় প্রচুর ছাত্র আসতো প্রাইভেট পড়তে। বাবা পরিশ্রমও করতেন খুব। সেই ফজরের পর থেকে শুরু হত পড়ানো। টানা নয়টা পর্যন্ত। আবার বিকালে সেইম রুটিন। আসলে পরিশ্রম করতে করতেই বাবার মেজাজটা এত চড়া হয়ে গেছে। মেয়েদের সঙ্গে নাকি বাবাদের সম্পর্ক থাকে দারুণ। আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। কেবল হিয়ার সঙ্গেই বাবার রসায়নটা একদম আলাদা। এক্ষেত্রে অবশ্য বাবার চেয়ে হিয়ার ভূমিকাই বেশি। বাবার চড়া মেজাজকে সে পাত্তাই দেয় না। বাবা কুপোকাত। আমরা যা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। হিয়ার কাছে তা ডেইলি অ্যাকটিভিটিজের মত। আর হল দাদি। দাদির সঙ্গে বাবা যতই গজরগজর করুক। দাদি যা বলবে তাই। অবশ্য যতই দিন যাচ্ছে বাবার জন্য আমার কেমন মায়া লাগে। সারাটা জীবন বাবা ক্ষয় করেছেন আমাদের জন্য।
কিছু হাত খরচ রেখে বেতনের টাকাগুলো মা’কে দিয়ে দেই। কী করব এত টাকা দিয়ে! আমার ভালোও লাগে। এরকম বড় একটা ফ্যামিলি না থাকলে আমি নিশ্চিৎ বিষটিষ খাওয়ার চেষ্টা করতাম। এখানে বিষ খাওয়ার আড়াল কোথায়!
‘দাদি, তুমি কিন্তু ঠাস কইরা বুড়ি হইয়া যাইতাছো!’
দাদি হাসে। বলে, ‘এহন দিন অইল তগর। আমরা আইজ আছি কাইল নাই। এক ঠ্যাঙ গেছে গা কব্বরে!’
কথাটা নিশ্চিৎ বাবার পছন্দ হয় নাই। বাবা একটু ধমকের সুরেই বললো, ‘তুমি ওষুধ-টষুধ খাচ্ছো তো ঠিকমত!’ বাবার কণ্ঠে গোপন উৎকণ্ঠা।
মার নাম জাহানারা। জাহানারা বেগম। বাবা মো. আব্দুল ওয়াদুদ। ডাক নাম হেলাল। ইন্টারমিডিয়েটে কী একটা কবিতায় হেলাল শব্দটি ছিল। দাগ দিয়ে রেখেছিলাম। হেলাল মানে সূর্য।
কোনো কিছু লেখার চেয়ে ফেসবুকে আমার ছবিটবি দিতেই ভালো লাগে। এটাকে এত জ্ঞান ফলানোর জায়গা মনে করার কারণ নেই। কারো কারো পোস্ট দেখলে এমন মেজাজ খারাপ হয়! খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই! পারলে ফেসবুকে বসে উপন্যাস লেখে। এত বিশাল বিশাল পোস্ট। মনে হয় ফেসবুকিং ছাড়া সত্যিই এদের কোনো কাজ নেই। একেবারে দেশ-জাতি উদ্ধার করে একাকার অবস্থা! খুবই বিরক্তিরকর। ফেসবুকে ভালোর চেয়ে খারাপটাই বেশি। খুন-ধর্ষণ-ডাকাতি-দুর্নীতি-শ্লীলতাহানি-মৌলবাদ-আস্তিক-নাস্তিক-সংখ্যালঘু সব নেগেটিভ নিউজে ভরা। কিছু মানুষই আছে, তাদের কাজই হল বেছে বেছে নেগেটিভ নিউজ প্রচার করা। এত ইনসিকিউর ফিল হয় মাঝে মাঝে। যেদিন ফেসবুকে ঢোকার সময়ই পাই না, দিনটা সেদিন ভালো যায়। মনে হয়, আজকে কোনো নেগেটিভ কিছু ঘটেনি। বাসায় ঢুকে মানুষকে খুন করা হচ্ছে। এ কেমন দেশ! চারপাশে সব নেগেটিভ কথার রাজত্ব।
এক প্রিন্সিপালকে লাঞ্ছিত করেছে ছাত্রনেতারা। ফেসবুকে এই নিয়ে চলছে তোলপাড়। একেকজন যার যার মত করে ত্যানা প্যাঁচাচ্ছে। ত্যানা প্যাঁচানো চলছেই। কিছুদিন পরপর নতুন নতুন ইস্যু আসে। কিছুদিন আগের হট টপিক ছিল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ভ্যাট। রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন। কী যা তা অবস্থা! মাঝে মাঝে ভাবি আমরা এমন কেন! আমরা কি আমাদের দেশটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারি না!
জলী যে জামাটা পড়েছে, খুব সুন্দর। আড়ঙয়ের। সেদিন দেখেছি জামাটা। বুকের দিকে বেশি-কাজ-করা বলে কিনিনি। বুকের দিকে এত ভারি-কাজ আমার পছন্দ না। কেমন ফাঁপর লাগে। জলীকে অবশ্য মানিয়েছে। ফর্সা শরীরে বেগুনি রং মানায়। আমাকে মানায় অফ হোয়াইট বা হলুদ। হালকা চকলেট কালারটাও আমার সঙ্গে যায়। লাইক। কমেন্ট করতে ইচ্ছা হল না। এক প্রকার আনমনেই জলীর ওয়ালে ঢুকলাম আমি। রিলেশনশিপ সিঙ্গেল। তারপর ঢুকলাম মোজাম্মেলের ওয়ালে। তারও রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেল। একটা বেখাপ্পা প্রোফাইল পিক দিয়ে রেখেছে মোজাম্মেল। বাজে ছেলেদের মত ফিল্মি স্টাইলে কেমন দাঁত বের করা হাসি।
ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছি ‘বাজে ছেলে’। বাজে ছেলে। আসলে বাজে ছেলে কারা? কাদেরকে আমরা বাজে ছেলে বলবো? বাসে-টাসে চলাফেরার সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছি আমি। যে ছেলেগুলোকে বেশি উড়াধুড়া আর লাফাঙ্গা মনে হয়, তারাই দেখেছি খুব ভদ্র বিহেভ করে। নিরাপদ দূরত্ব রেখে বসে। কেউ কেউ অবশ্য চোখমুখে নায়ক মার্কা একটা ভাব আনার চেষ্টা করে। কেউ কেউ আবার পুরোই নেতিয়ে যায়। এত ভদ্র হয়ে যায়। উল্টা আচরণ করে বাপের বয়সী লোকগুলা। এমনভাবে বসে, পারলে যেন কোলে এসে বসতো। বারবার বলতে হয়, সরে বসেন। একদিন তো এক হারামজাদা আমার গায়ে হাত দিয়ে জানালা লাগাতে বলে। চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে দিয়েছি। চিৎকার করে বললাম, ‘আপনি আমার গায়ে হাত দিলেন কেন! অসভ্য লোক কোথাকার! আপনি সাবধানে বসেন! দেখে তো ভদ্রলোক মনে হয়!’ বাসের সবাই ক্ষেপে ওঠেছিল হারামজাদার ওপর। একেবারে বাসি মুড়ির মত চুপসে গিয়েছিল লোকটা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। হারামজাদার জন্য আমার একটুও খারাপ লাগেনি। পরে যতই সাধু সাজুক, তার অসভ্য চোখদুটো তো আমি দেখেছি! শোভনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির তখন তিনমাস চলে।
শোভন কি বাজে ছেলে? ও যদি বাজে ছেলে না হয়, তাহলে বাজে ছেলে কারা? কী ভালো মানুষের মত চেহারা তার! ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। অথচ কী করতে বাকি রেখেছে সে। মিরপুরে শোভনের বন্ধুর ফ্ল্যাটটার কথা আমি ভুলতে পারি না। এই একটা প্রসঙ্গই এখনো আমাকে জ্বরগ্রস্ত করে। এখনো নিজের উপর সমান ঘেন্না হয় আমার। আগেই হয়তো বলে কয়ে সব ঠিক করে রাখতো শোভন। ওখানকার কারো সঙ্গেই কখনোই দেখা হয়নি আমার। ওরা তার কেমন বন্ধু, আসলেই বন্ধু কিনা, আমি জানতাম না। এখনো আমার চোখে স্পষ্ট ভাসে। যেন গতকালেরই ঘটনা। বালিশের পাশে গেরুয়া মলাটের একটা বই। প্লেটোর রিপাবলিক। সরদার ফজলুল করিমের অনুবাদ। বইটা কড়া চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বিছানার পাশে, টেবিলের উপর, সারা ঘরসুদ্ধ কেবল বই আর বই। কে থাকে এই ঘরে, তাকে দেখার ইচ্ছে হতো আমার। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম শোভনকে, ‘উনি খুব পড়াশোনা করেন, তাই না! ঘরে শুধু বই আর বই!’ ক্ষেপে গিয়েছিল শোভন। স্যামুয়েল কোনিগের সমাজবিজ্ঞান বইটাও সেখানে দেখেছিলাম। রঙ্গলাল সেন না কার জানি অনুবাদ।
একুশে বইমেলায় আমরা যেতাম ঘুরতে। এত জ্ঞানের বইপত্র পড়ার অভ্যাস আমারও নেই। কিন্তু যারা পড়ে কেন জানি তাদের আমার ভালো লাগত। তাদের চোখে আমরা শিট পড়া ভালো রেজাল্টধারী। যে বইগুলো না-কিনলেই নয়, বাধ্য হয়ে আমরা নাকি শুধু তা-ই কিনি। কথা ঠিকই। অনেকে অবশ্য তা-ও কেনে না। ফটোকপি দিয়েই কাজ চালায়। নিজেই দেখেছি।
মেলায় গিয়ে মানুষের দেখাদেখি হলেও দু-একটা বই কিনতে ইচ্ছা করতো আমার। যে বই-ই কিনতে চাইতাম, শোভন বলতো, এটা না, ওটা না। এভাবে শেষমেষ কোনো বই-ই কেনা হতো না। বই কিনে অযথা টাকা খরচ করায় সে হয়তো রাজি ছিল না। তখন অবশ্য হাতে টাকাও থাকতো কম। সেই টাকায় পরে কিছু একটা খেয়ে টেয়ে নিতাম আমরা। আমি টাকা দিলে শোভন রাগ করতো। তাই জোর করে বিল দিতে ভালো লাগতো আমার।
চাকরি করতে করতে ব্যস্ত থাকতে থাকতে জীবনের ছন্দের সঙ্গে আবার মানিয়ে যাচ্ছি আমি। দাদির সঙ্গে গল্প করা হয় না অনেকদিন। ভাবছি এই শুক্রবার দাদির সঙ্গে কাটাবো। গিয়ে বলবো, চুলে তেল দিয়ে দাও। আর চুপচাপ তার সঙ্গ উপভোগ করবো। বাবা যদি সূর্য হয় তাহলে দাদি আমাদের কাছে একটা ছাতার মতো। বেশি রোদে দাদিই আমাদের ভরসা। অবশ্য সূর্যের তেজ কমে যাচ্ছে দিন দিন। বাবার জন্য খুব খারাপ লাগে আমার। অকারণে। কাউকে বলতে পারি না এ-কথা। কাকে বলবো? মনে হয় পরিবারের প্রতি আমার অন্যায়ের শেষ নেই। সবসময়ই মনে হয়। ভেতরে ভেতরে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কেউ না বললেও বুঝতে পারি। এই সময়টার কথা আগে ভাবলে মাথা নষ্ট হয়ে যেতো। এখন অবশ্য সেই ভার নেই। যে-কারো সঙ্গেই ঠাস করে বিয়ে হয়ে যাবে আমার। এটাই স্বাভাবিক। যে-কাউকেই বিয়ে করার জন্য আমাকে এখন রেডি থাকতে হবে। আমার কাছে সবাই এখন সমান। একটা আতঙ্কই কেবল বুকের মধ্যে গভীর একটা ছোবল দেয়। এমন বিশাল ক্ষত তৈরি করে, কোনোকিছু দিয়েই যা পূরণ করা সম্ভব নয়। সেই ক্ষতের সামনে থরথর করে কাঁপতে থাকে আমার বাবা। সেই ক্ষতের সামনে থরথর করে কাঁপতে থাকে আমার মা। সেই ক্ষতের সামনে থরথর করে কাঁপতে থাকে আমার দাদি।
বিশাল একটা সবুজ প্রান্তরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা খাল। খাল-পাড়ে মাঝবয়সী এক বটগাছ। ছবিতে যত অসাধারণ লাগছে বাস্তবে জায়গাটা এত সুন্দর নয়। গত ঈদে তোলা। আমার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে তুলেছিলাম ছবিটা। আমি নই, বিশাল প্রকৃতিই এই ছবির সাবজেক্ট। কী ক্যাপশন দেওয়া যায় ছবিটার? ‘শেরপুরে কোনো একদিন’ নাকি ‘জল আর সবুজের মাঝে’। ছবিটার ক্যাপশন দিলাম, ‘মানুষ নয়, প্রকৃতিই সুন্দর!’ অর্থাৎ এই ছবিটাকে নিয়ে, আমাকে নিয়ে, এই মুহূর্তে আমার মন সারা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে এই কথাটাই বলতে চায়।
এক ভদ্রলোক খুব ডিস্টার্ব করছে। মেসেঞ্জারে প্রায়ই নক করছেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন নানান কথা। আমিও মেপে মেপে উত্তর দিই। ভদ্রলোক চাকরি করেন প্রাণ আরএফএল কোম্পানিতে। কী জানি রিজিওনাল অফিসার। বিয়ের ধান্দায় আছেন। ভদ্রলোকের আগ্রহ – আগে প্রেম, তারপর বিয়ে। এরকম অনেকেই নক করে ইদানিং। কোথায় যেন সুড়সুড়ি মার্কা একটা মজা আছে। কেউ কেউ বাবার ফোন নাম্বার চায়। কথা বলতে চায় সরাসরি। প্রথম প্রথম বিষয়টা আমি সিরিয়াসলি নিতাম। অবশ্য আজাইড়া লোকদেরকে বাবার নাম্বার দেওয়ার মত গাধা আমি কোনোদিনই ছিলাম না। বাবার নাম্বার যে ম্যানেজ করতে পারবে না, সে আমাকে ম্যানেজ করবে কীভাবে! যারা নক করেন তারা যে সবাইকেই নক করেন, এই বুদ্ধিটা আমার অনেক পরে গিয়ে হয়েছে। কিছুদিন রিপ্লাই না দিলে, একসময় তাদের গদগদ প্রেম এমনিতেই হাওয়া হয়ে যায়। তবে এদের আমি অসম্মান করি না। শোভনকে ট্যাকেল দেওয়ার ক্ষেত্রে এদের সঙ্গ আমাকে হেল্পই করেছে।
বিশ মিনিটের মধ্যে একশো তেরোটা লাইক। তেইশটা লাভ। এগারোটা ওয়াও। একটা এঙ্গার এবং সঙ্গে সঙ্গে মেসেঞ্জারে টেক্সট : তুই এত সুন্দর ক্যান দোস্ত!
তবু ভদ্রভাষায় লিখেছে। গালি ছাড়া শিবানির কোনো বাক্য কমপ্লিট হয় না। ক্লাসমেট। দুই সন্তানের জননী এখন। আমার যৌনবিজ্ঞানের গুরু। গুরুর দায়িত্ব নিয়েছিল নিজেই।
মাস্টার্সে পড়ার সময়ই শিবানির বিয়ে হয়। ও ভেবেছিল, কেউ না-যাক, তার বিয়েতে আমি অন্তত যাবই। যাওয়া হয়নি। অনেকেই গিয়েছিল। আমিই যেতে পারিনি। শোভনের আপত্তির কারণেই যে যাওয়া হয়নি, কথাটা এখন অন্তত তাকে বলার সময় হয়েছে। অনেকদিন পরে কথা হচ্ছে তার সঙ্গে। কে কতভাবে কতকিছু নিয়ে যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। তবু তার কথা শেষ হয় না।
(চলবে)