ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ২

সূত্র : Literary Hub

নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান

 

আফ্রিকান সাহিত্যের ভাষা

 

চার
যেকোন ভাষারই দুই ধরনের চরিত্র থাকে। প্রথমত, এটি যোগাযোগের উপায়; দ্বিতীয়ত, ভাষা হলো সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ইংরেজির কথাই ধরা যাক। ব্রিটেন, সুইডেন, ডেনমার্ক তিন দেশেই ইংরেজি ভাষায় কথা বলা হয়। কিন্তু সুইডিশ ও ড্যানিশ মানুষের জন্য ইংরেজি হলো অ-স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মানুষের সাথে যোগাযোগের একটা উপায় মাত্র। এটি তাদের সংস্কৃতির ধারক-বাহক নয়। কিন্তু ব্রিটিশ, মূলত ইংল্যান্ডের মানুষের জন্য ইংরেজি যোগাযোগের উপায়ের সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারক-বাহকও। অথবা পূর্ব ও কেন্দ্রীয় আফ্রিকার ক্ষেত্রে সোয়াহিলি ভাষার কথাই ধরা যাক। যোগাযোগের উপায় বা হাতিয়ার হিসেবে এই ভাষা অনেকগুলো জাতিই ব্যবহার করে। কিন্তু এই ভাষাটি সেইসব জাতির অনেকেরই সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারক-বাহক নয়। কিন্তু কেনিয়া এবং তানজানিয়ার কিছু অংশে, এবং বিশেষ করে জানজিবারে যেসব মানুষের মাতৃভাষা সোয়াহিলি, সেসব জায়গায় এই ভাষা একই সাথে যোগাযোগের উপায় ও সংস্কৃতির ধারক।

 

যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষার তিন ধরনের উপাদান থাকে। প্রথমটি হলো তাই যাকে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন প্রকৃত জীবনের ভাষা।১৬ এক দিক থেকে এই উপাদানটি ভাষা বিষয়ে সাধারণ ধারণার সাথে খুবই সম্পর্কিত। মানুষের অপরাপর মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি ও তা যেভাবে এগিয়ে যায় ঠিক সেরকমই হলো ভাষার উদ্ভব ও ক্রমোন্নয়ন। অন্যদিকে শ্রমব্যবস্থায় ভাষার মাধ্যমেই মানুষের ভেতর প্রয়োজনীয় সংযোগ তৈরি হয় বা গড়ে ওঠে। যেমন একটি মনুষ্য সম্প্রদায় যারা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো জীবনমুখী সম্পদ উৎপাদন করে। শ্রম বিভাজনের মাধ্যমেই মানব সমাজ পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্প্রদায় হিসেবে তার ঐতিহাসিক চরিত্র তৈরি করে নেয়। এর ভেতর সবচেয়ে সরল বিভাজন দেখা যায় নারী-পুরুষ আর শিশু নিয়ে গঠিত পরিবারে। এর চেয়ে কিছুটা জটিল বিভাজন আমরা পাই একক শিকারী, ফলমূলের একক সংগ্রাহক কিংবা ধাতব পদার্থের শ্রমিকদের মতো উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলোতে। সবচেয়ে জটিল শ্রম বিভাজন দেখা যায় আধুনিক শিল্প-কারখানাগুলোতে, এখানে একটি শার্ট বা জুতো তৈরির পেছনে অনেকগুলো হাত ও মস্তিষ্ক কাজ করে যায়। উৎপাদন হলো পারস্পরিক সহযোগিতা, এক ধরনের যোগাযোগ, একটি ভাষা, মানুষের ভেতর সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ।

 

যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষার দ্বিতীয় উপাদান হলো বাকময়তা, যার মাধ্যমে প্রকৃত জীবনের ভাষা দৃশ্যমান হয়। ভাষার এসব বাচনিক চিহ্নাদির কারণেই প্রয়োজনীয় উৎপাদনে ব্যস্ত মনুূষের ভেতর যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং তার প্রতিফলনও ঘটে। এই বাচনিক চিহ্ন-ব্যবস্থার কারণেই আসলে উৎপাদন সম্ভব হয়।১৭ এই বাচনিক চিহ্নের দুনিয়া মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ঠিক সেই ভূমিকা পালন করে যা মানুষের হাত করে মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে। বিভিন্ন হাতিয়ার ও যন্ত্রের মাধ্যমে হাত দিয়েই মানুষ ও প্রকৃতির ভেতর সংযোগ তৈরি হয় ফলে তৈরি হয় প্রকৃত জীবনের ভাষা; আর বাচনিক শব্দসমূহের মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের সংযোগ ঘটে আর গঠিত হয় বাচনিক ভাষা।

 

লিখিত চিহ্ন হলো এর তৃতীয় উপাদান। লিখিত শব্দগুলো বাচনিক ভাষাকেই অনুকরণ ও দৃশ্যমান করে। মানব সমাজের ক্রমোন্নয়নের ইতিহাসে হাত ও বাচনিক চিহ্নের মাধ্যমে যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষা কম-বেশি একই সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছে। সেদিক থেকে এই লিখিত উপাদান অনেক পরের ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পালে থাকা পশুর সংখ্যা প্রকাশের জন্য রাখালদের দড়িতে গিটঠু থেকে শুরু করে কেনিয়ার আগিকুয়ু গিসান্দি গায়ক ও কবিদের হায়ারোগ্লিফিক্স হয়ে আজকের পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ ও ছবিসম্বলিত লিখন-ব্যবস্থা — লেখা হলো মূলত শব্দ ও দৃশ্যমান চিহ্নের উপস্থাপন।

সূত্র : Owlcation.com

অধিকাংশ সমাজেই নিজেদের উপস্থাপনের জন্য লিখিত ও বাচনিক ভাষা অভিন্ন। কাগজে লেখা যে কোন কিছুই কেউ একজন পড়তে পারে এবং যে কেউই এটা গ্রহণও করতে পারে যেহেতু তারা ঐ ভাষাতেই কথা বলে বড় হয়েছে। এরকম একটি সমাজের একটি শিশুর জীবনে যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষার এই তিনটি উপাদানের ভেতর দারুণ এক ঐকতান থাকে। তাই লিখিত ও বাচনিক প্রতীক ও চিহ্নের মাধ্যমে প্রকৃতি ও অন্য মানুষের সাথে তার যোগাযোগে দেখা যায় দ্বিগুণ মিথষ্ক্রিয়া ও প্রতিফলন। তার জীবনের অভিজ্ঞতা যে ভাষায় সঞ্চিত হয় তার সাথেই শিশুটির সংবেদনশীলতা তৈরি হয়।

 

কিন্তু আরও কথা আছে। মানুষের ভেতরে যোগাযোগই হলো সংস্কৃতির বিকশিত হওয়ার ভিত্তি ও পদ্ধতি। একই ধরনের পারিপার্শ্বিকতা, পরিবর্তনশীলতা, নির্দিষ্ট বিন্যাস, চাল, ছন্দ, অভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর বারবার প্রায় একই ধরনের কাজ করতে করতেই মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বাড়তে থাকে। এই অভিজ্ঞতাগুলোই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হয় আর এভাবেই প্রকৃতি ও নিজেদের ভেতর যেকোন কাজের উত্তরাধিকারসুলভ ভিত্তি হিসেবে সেগুলো কাজ করে। ধীর গতিতে মূল্যবোধগুলো একত্রিত হয়ে সময়ের সাথে সাথে আত্মপ্রমাণিত সত্যে পরিণত হয়, যার ফলে বিভিন্ন সম্পর্কের মানুষের ভেতর ঠিক ও ভুল, ভালো ও খারাপ, সুন্দর ও কুৎসিত, সাহসী ও ভীরু, উদার ও নীচ বিষয়ক ধারণা তৈরি হয়। সময়ের সাথে সাথে এই ধরনের জীবনচর্চা অন্যান্য জীবন চর্চার থেকে পার্থক্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর ফলে পার্থক্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সৃষ্টি হয়। সংস্কৃতির মাধ্যমেই তারা এসব ন্যায়, নীতি, নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক দর্শনগুলোকে ব্যবহার করে নিজেদের ভেতর নিজেদের এবং বিশ্বে নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারে। মূল্যবোধ হলো মানবজাতির নির্দিষ্ট সদস্য হিসেবে মানুষের পরিচয়ের ভিত্তি। ভাষাই এসব ধারণ করে। সংস্কৃতির ধারক হিসেবে ভাষা হলো ইতিহাসে মানুষের অভিজ্ঞতাসমূহের একটি যৌথ স্মৃতির রক্ষণাগার। সংস্কৃতির সাথে ঐ ভাষার পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব যে ভাষার মাধ্যমে ঐ সংস্কৃতির শুরু, বৃদ্ধি, রক্ষণাবেক্ষণ, সংযোগ এবং অবশ্যই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তর ঘটে।

 

সংস্কৃতির ধারক হিসেবেও ভাষার তিনটি উপাদান আছে। সংস্কৃতি হলো ইতিহাস থেকেই তৈরি যা পরবর্তী কালে ঐ ইতিহাসকেই প্রতিফলিত করে। অন্য কথায়, সংস্কৃতি হলো সম্পদ সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের নিয়ত সংগ্রামে মানুষের একে অপরের সাথে যোগাযোগের উপায় ও প্রতিফলন। কিন্তু সংস্কৃতি সেই ইতিহাসকে সরাসরি প্রতিফলিত করে না, অথবা করে থাকে প্রকৃতি ও প্রতিপালনের এসব চিত্রকল্প বা ছবি গঠনের মাধ্যমে। এর ফলে সংস্কৃতির ধারক হিসেবে ভাষার দ্বিতীয় উপাদান হলো একটি শিশুর মস্তিষ্কে চিত্রকল্প তৈরির উপায় হিসেবে কাজ করা। এসব চিত্রকল্প সঠিক বা ভুল, যাই হোক, প্রকৃতি ও প্রতিপালনের এসব সংগ্রামের সাথে যোগসূত্র তৈরির উপরই একক বা সমষ্টিগতভাবে মানুষ হিসেবে আমাদের ধারণা তৈরি করে দেয়। কিন্তু সৃজনশীলভাবে আমাদের বিশ্বের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা নির্ভর করে এসব চিত্রকল্প কীভাবে বাস্তবতার সাথে যুক্ত হয় বা হয় না, কীভাবে এসব আমাদের সংগ্রামের বাস্তবতাকে পষ্ট করে বা বিকৃত করে তার ওপর। এভাবে সংস্কৃতির ধারক হিসেবে ভাষা আমার সাথে আমার আমিত্বের ভেতর, আমার সাথে অন্যদের এবং আমার সাথে প্রকৃতির ভেতর সম্পর্ক তৈরি করে। ভাষা আমার একান্ত অস্তিত্বের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। আর এর ফলেই সংস্কৃতির ধারক হিসেবে ভাষার তৃতীয় উপাদান সামনে আসে। নির্দিষ্ট বাচনিক ও লিখিত ভাষার মাধ্যমে বিশ্ব ও বাস্তবতার এসব চিত্রকল্পকে সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়। অন্য কথায়, সবার উপলব্ধি করার মতো কথা বলার এবং শব্দকে সাজানোর ক্ষমতা সকল মানুষের জন্যই সত্য। ভাষার মাধ্যমেই এই সার্বজনীনতা অর্জিত হয়, যা শুধু মানুষের জন্যই সম্ভব। এটি প্রকৃতি ও অপরাপর মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের সার্বজনীনতাকে নির্দেশ করে। কিন্তু আওয়াজের নির্দিষ্টতা, শব্দ, বাক্য ও শব্দবন্ধে শব্দের ক্রমবিন্যাস এবং নির্দিষ্ট নিয়ম, পদ্ধতি ও তাদের ক্রমবিন্যাসের ফলে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষা পৃথক হয়। ফলে ভাষার মাধ্যমে একটি সংস্কৃতি সার্বজনীনতার দিকে নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট ইতিহাসের দিকে এগিয়ে যায়। একটি সংস্কৃতির ধারণ করা বিশ্বের চিত্রকল্প একটি নির্দিষ্ট ভাষায় লিখিত সাহিত্য ও ওরাটিউরের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে।

 

ফলে বলা যায় যে, যোগাযোগের উপায় ও সংস্কৃতি ধারক-বাহক হিসেবে ভাষা একে অপরের জন্য কাজ করে। যোগাযোগ সংস্কৃতি তৈরি করে, অন্যদিকে সংস্কৃতি হলো যোগাযোগেরই উপায়। ভাষা সংস্কৃতিকে বহন করে এবং সংস্কৃতি, বিশেষত ওরাটিউর ও সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের ভেতর ও বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে পুরো মূল্যবোধ তৈরি করে দেয়। মানুষের নিজেদের সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি তাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি, সম্পদের সামাজিক উৎপাদন এবং অন্যান্য সত্তা ও প্রকৃতির সাথে তাদের সম্পর্ক কেমন হবে তার ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে নির্দিষ্ট গঠন ও চরিত্র, নির্দিষ্ট ইতিহাস, বিশ্বের সাথে নির্দিষ্ট সম্পর্কপূর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে আমাদের থেকে ভাষাকে পৃথক করা অসম্ভব।

 

পাঁচ
তাহলে শিশুদের ওপর একটি ঔপনিবেশিক বিদেশি ভাষা আরোপের ফলে কী হয়েছিল?
উপনিবেশের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল মানুষের সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা। যা তারা উৎপাদন করে, যেভাবে উৎপাদন করে এবং যেভাবে বন্টন করে, সবকিছুর ওপর। অন্য কথায়, তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছিলো আমাদের প্রকৃত জীবনের ভাষার সকল অংশ। সামরিক অভিযান ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে সম্পদের সামাজিক উৎপাদনের ওপর ঔপনিবেশিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। কিন্তু কর্তৃত্ব আরোপের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল উপনিবেশিতদের মানসিক জগত বা মনোজগতের ওপর কর্তৃত্ব। এই কর্তৃত্ব আরোপ করতে হতো মানুষ যেভাবে নিজেদের ভেতর ও বিশ্বের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে, অর্থাৎ সংস্কৃতির ওপর। মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কখনো সম্পূর্ণ ও কার্যকর হয় না। মানুষের সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ হলো তাদের অন্যদের সাথে সম্পর্কস্থাপনের ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা।

 

ঔপনিবেশিকতার জন্যে এতে ছিল একই বিষয়ের দুইটি আলাদা রূপ। একদিকে ছিল মানুষের সংস্কৃতি, শিল্প, নাচ, ধর্ম, ইতিহাস, ভূগোল, শিক্ষা, ওরাটিউর ও সাহিত্যকে ধ্বংস করা অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা। অন্যদিকে ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির ভাষার সচেতন মানোন্নয়ন বা সেরূপ প্রচার। উপনিবেশিতদের মনোজগতে কর্তৃত্ব করার জন্য উপনিবেশিত মানুষের ভাষার ওপর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর ভাষার কর্তৃত্ব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র : আফ্রিকা সাফারি ম্যাগাজিন

যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষার কথাই ধরা যাক। স্থানীয় ভাষা দমন করে বাচনিক ও লিখিত ভাষা হিসেবে বিদেশি ভাষা আরোপের ফলে আফ্রিকান শিশুদের সাথে ভাষার তিনটি উপাদানের যে ঐকতান ছিল তাতে ভাঙন শুরু হয়ে যায়। যেহেতু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নেয়া ঐ নতুন ভাষাটি অন্য কোন জায়গার জীবনের প্রকৃত ভাষার প্রতিফলন ছিল, তাই এর দ্বারা বলে বা লিখে কখনোই উপনিবেশিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত জীবনের প্রতিফলন সম্ভব ছিল না। প্রযুক্তিকে কেন আমাদের সবসময় কিছুটা বহিরাগত, অর্থাৎ আমাদের নয় বরং তাদের বিষয় বলে মনে হয় তার কিছুটা ব্যাখ্যা হয়তো এখান থেকে বুঝতে পারা যায়। ‘মিজাইল’ শব্দের অর্থ আমি তখনই ঠিকমতো বুঝতে পেরেছিলাম যখন আমি গিকুয়ু ভাষায় এর সমার্থক শব্দটি যা হলো ‘এনগুরুকুহি’, তা জানতে পারি, এর আগে এ স¤পর্কে আমার বোঝাপড়া ছিল অন্যরকম। একজন উপনিবেশিত শিশুর জন্য পড়ালেখা পরিণত হয়েছিল মস্তিষ্কের কাজে, আবেগীয় অনুভূতি থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা নয়।

 

কিন্তু আরোপিত ঐ নতুন ভাষার পক্ষে বাচনিক ভাষা হিসেবে স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের চর্চাটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা অসম্ভব বলে তাদের কর্তৃত্ব আরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী এলাকা ছিল ভাষার লিখিত অংশটি, অর্থাৎ যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষার তৃতীয় উপাদানটি। একটি আফ্রিকান শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যম ছিল একটি বিদাশি ভাষা। সে যেসব বই পড়তো তার ভাষা ছিল বিদেশি। যে ভাষায় তার ধারণা তৈরি করে দেয়া হতো তা ছিল বিদেশি। তার ভেতর চিন্তা দৃশ্যমান হতো একটি বিদেশি ভাষায়। তাই একটি শিশুর বাড়িতে ব্যবহৃত বাচনিক বা কথ্য ভাষার সাথে তার বিদ্যালয়ে ব্যবহৃত লিখিত ভাষার (যা বিদ্যালয়ে ব্যবহৃত কথ্য ভাষাও ছিল) ভেতর কোন যোগাযোগ ছিল না। শিশুটির লিখিত বিশ্বের সাথে (যা ছিল তার বিদ্যালয়েরও ভাষা) তার নিজস্ব পরিবার ও সম্প্রদায়ের পরিবেশের সামান্যতম সম্পর্কও ছিল না। একজন উপনিবেশিত শিশুর জন্য যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষার তিনটি উপাদানের পারস্পরিক ঐকতান ভেঙে দেয়া হয়েছিল, এই ভাঙন ছিল অপরিবর্তনীয়। এর ফলে শিশুটি তার প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কিত অনুভূতিগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। একে আমরা বলতে পারি ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা আরো শক্তিশালী হয়েছিল তাদের দেয়া ইতিহাস, ভূগোল, সংগীত প্রভৃতির শিক্ষায়, যেখানে সবসময়ই বুর্জোয়া ইউরোপ থাকতো জগতের কেন্দ্র।

 

নিজস্ব পরিবেশ থেকে এই বিচ্ছেদ, ছাড়াছাড়ি কিংবা বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন ঔপনিবেশিক ভাষাকে সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে দেখা হয়।

যেহেতু সংস্কৃতি হলো মানুষের ইতিহাসেরই একটি বিষয়, যা আবার ঐ ইতিহাসকেই প্রতিফলিত করে, তাই এখন শিশুটি এমন একটি সংস্কৃতির মুখোমুখি হলো যা তার নিজস্ব বিশ্বের প্রেক্ষাপটে একেবারেই বহির্জগতের বিষয়। নিজেকে দেখার জন্য তাকে নিজের বাইরে এনে দাঁড় করানো হচ্ছিলো। বর্ণবাদ, শ্রেণি, লিঙ্গ এবং রাজনীতি নিয়ে বব ডিক্সনের শিশুদের জন্য একটি বইয়ের নাম হলো ক্যাচিং দেম ইয়াং। একজন উপনিবেশিত শিশুর জন্য ‘ক্যাচিং দেম ইয়াং’ ছিল লক্ষ্য হিসেবে আরো বেশি সত্য।১৮  বিশ্ব ও নিজের সম্পর্কে যেসব চিত্রকল্প এসময় তাদের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেয়া হতো তা থেকে বের হয়ে আসতে বছরের পর বছর লেগে যেত, যদি তা সম্ভব হতো আর কী!

 

সংস্কৃতি শুধুমাত্র বিভিন্ন চিত্রকল্প দিয়ে বিশ্বকে প্রতিফলিতই করে না, বরং এসব চিত্রকল্প দিয়ে একটি শিশুকে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্বকে দেখার জন্যেও তৈরি করে। এভাবেই একটি আরোপিত ভাষা দ্বারা উপনিবেশিত শিশুদের বিশ্ব দেখানো হচ্ছিলো আর দেখানো হচ্ছিলো সেই বিশ্বে তারা নিজেরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।

 

এবং যেহেতু এসব চিত্রকল্প ওরাটিউর ও সাহিত্যের মাধ্যমেই সরবরাহ করা হতো, তাই শিশুরা তাদের এই নতুন গ্রহণ করা ভাষার সাহিত্যে দেখানো বিশ্বকেই শুধুমাত্র দেখতে শুরু করলো। অন্য একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে নিজের বাইরে নিজেকে দেখার এই বিচ্ছিন্নতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হয়, আমদানি করা এসব সাহিত্যে শেক্সপিয়র, গ্যাটে, বালজাক, তলস্তয়, গোর্কি, ব্রেখট, শলোকভ, ডিকেন্সের শ্রেষ্ঠ মানবিক রচনাসমূহের যাই থাক-না-কেন, এসকল চিন্তারই দর্পণ ছিল ইউরোপে এবং ঐ ইউরোপীয় কেন্দ্র থেকেই তার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বাকি বিশ্বকে দেখা হতো।

 

কিন্তু ব্যাপারটি আরো খারাপ হলো যখন ঔপনিবেশিকদের লিখিত ভাষায় শিশুটি তার নিজস্ব বিশ্বকে প্রতিফলিত হতে দেখলো। তার নিজস্ব ভাষাকে আগেই তার কচি মনে নিম্নশ্রেণি, হেনস্থা, শারীরিক শাস্তি, ধীরবুদ্ধিসম্পন্ন, সরল নির্বুদ্ধিতা, বুদ্ধিহীন এবং বর্বরতার সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। এসব নেতিবাচকতাকে আরও শক্তিশালী করা হলো শিশুটিকে রাইডার হ্যাগার্ড কিংবা নিকোলাস মনসারাতের মতো প্রতিভাবান সব বর্ণবাদীর সাহিত্যের জগতে পরিচিত করার মাধ্যমে। পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টের মহান সব ব্যক্তি যেমন হিউম (‘‘…নিগ্রোরা প্রাকৃতিকভাবেই সাদাদের চেয়ে নিচু জাতের…”)১৯, থমাস জেফারসন (‘‘…শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক উভয় বৃত্তির দিকে থেকেই কালোরা সাদাদের চেয়ে নিকৃষ্ট…”)২০, অথবা হেগেল যিনি মনে করেন আত্মসচেতন ইতিহাস অনুযায়ী আফ্রিকা হলো শিশুতোষ ভূমির সাথে তুলনীয় যা এখনো বন্ধ খামের মতো রাতের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। হেগেলের এই বিবৃতি যা বলে, আফ্রিকান চরিত্রে এমন কিছুই নেই যা মানবিকতার সাথে ঐকতান তৈরি করে, সেটিই হলো আফ্রিকাকে ঔপনিবেশিক সাহিত্য পাঠে বাধ্য করে ঔপনিবেশিক শিশু হিসেবে উপস্থাপনের এহেন বর্ণবাদী চিত্রকল্পের প্রতিনিধি। এর ফলাফল হতে পারে ধ্বংসাত্মক।

 

উৎস ও টীকা

১৬. “The production of ideas, of conceptions, of consciousness, is at flirt directly interwoven with the material activity and the material intercourse of melt, the language of real life. Conceiving, thinking, tote mental intercourse of men, appear at this stage as the dire, efflux of their material behaviour. The same applies to mental production as expressed in the language of politics, laws, morality, religion, metaphysics, etc., of a people. Men are the producers of char conceptions, id eas etc. – real, active men, as they are conditioned by a definite development of their productive forces and of the intercourse corresponding to these, up to its furthest form.” মার্ক্স ও এঙ্গেলস, জার্মান ভাবাদর্শ, প্রথম খণ্ড, প্রকাশিত হয়েছিল ফয়েরবাখ: অপজিশন অব দ্য ম্যাটেরিয়ালিস্ট অ্যান্ড আইডিয়ালিস্ট আউটলুকস শিরোনামে, লন্ডন: ১৯৭৩, পৃ. ৮ — লেখক

১৭. আমাদের মৌখিক কথাবার্তা — অনুবাদক

১৮. অল্প বয়সে তাদের ধরে ফেলা — অনুবাদক

১৯. উদ্ধৃতি এরিক উইলিয়ামস, আ হিস্টোরি অব দ্য পিপল অব ত্রিনিদাদ অ্যন্ড টোবাগো, লন্ডন: ১৯৬৪, পৃ. ৩২ — লেখক

২০. এরিক উইলিয়ামস, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১ — লেখক

(চলবে)

1 COMMENT

  1. “ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড (১ম/২য়/৩য় অধ্যায়ের ১ম/২য় কিস্তি)”
    ধারাবাহিক লেখাগুলোতে শিরোনাম উপর্যুক্তভাবে দিলে বোধহয় ওয়েবসাইটটি আরও একটু পাঠকসুলভ হতো। লেখার ধারাবাহিকতা খুঁজতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here