বিদ্যাসাগর ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত আছে প্রচুর গল্প। অনেক মজার, হাস্যকর ও বিষাদের ঘটনা জানা যায় তাঁর জীবন থেকে। আজ তাঁর জন্মের দুইশো বছর উপলক্ষে টুকরো কিছু গল্প তুলে ধরছি আমরা।
মা যখন উন্মাদ
বিদ্যাসাগর যখন মায়ের গর্ভে তখন তাঁর মা ছিলেন উন্মাদ। কোনো চিকিৎসাই তাঁকে উন্মাদ দশা থেকে মুক্তি দেয় নি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের জন্মের পরপরই উন্মাদনা কেটে যায়। এই ঘটনা সেকালে বেশ বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল।
এঁড়ে বাছুর
ঈশ্বরচন্দ্র যেদিন জন্মগ্রহণ করেন সেদিন তাঁর বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে ছিলেন না। হাটে গিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের পিতামহ পুত্রকে খবর দিলেন, একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে। ঠাকুরদাস বাড়ি ফিরে প্রথমেই গোয়াল ঘরের দিকে ছুটলেন। ঠাকুরদাসের পিতা বললেন, ওদিকে নয়, এদিকে। এই বলে প্রসূতিঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। পিতামহের ভবিষ্যত-বাণী ছিল বিদ্যাসাগর একগুঁয়ে হবেন। পরবর্তী কালে বিদ্যাসাগরের বিবিধ কাজে তা প্রমাণিত হয়েছে। যে-কাজ তিনি আরম্ভ করতেন, তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত থামতেন না।
ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা
বিদ্যাসাগর মূলত এই নামেই লিখতেন। তাঁর বইয়ে লেখা থাকত : ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মণ। তাঁর পারিবারিক পদবি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। পিতামহ নাম রেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সে হিসেবে নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
দুরন্ত বিদ্যাসাগর
ছোটবেলায় বিদ্যাসাগর অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন। গ্রামের গৃহস্থের বাড়িতে মলমূত্র ত্যাগ করা ছিল তাঁর প্রাত্যহিক কাজ। দুষ্টুমি করার জন্য এসব করতেন। কেউ কাপড়চোপড় শুকাতে দিলে তিনি তাতে বিষ্ঠা লাগিয়ে দিতেন। ধান খেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কচি ধান চিবিয়ে খেতেন আর ধান নষ্ট করতেন। একবার যব খাবার সময় যবের শীষ গলায় আটকে মারা যাবার দশা হয়েছিল তাঁর।
পিতৃপ্রহার
বিদ্যাসাগর পিতার হাতে প্রচুর প্রহারের শিকার হয়েছেন। কলকাতায় যাবার পথে একবার বললেন, হেঁটেই যেতে পারবেন; সহায়তার জন্য কোনো লোকের দরকার পড়বে না। কিছুক্ষণ হেঁটেই বললেন যে, তিনি আর হাঁটতে পারবেন না। বাবা ক্ষিপ্ত হলেন। বুঝিয়ে শুনিয়ে বললেন, তরমুজ কিনে দেবেন। বিদ্যাসাগর তবুও হাঁটলেন না। শেষ পর্যন্ত বাবা বিদ্যাসাগরকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে বাধ্য হলেন। উপযুক্ত প্রহারেও কাজ হলো না। পিতৃপ্রহারের প্রধান কারণ ছিল বিদ্যাসাগরের দুরন্তপনা ও একরোখামি। দ্বিতীয় কারণ ছিল পরিশ্রম ও ক্লান্তির কারণে পড়ালেখার সময় ঘুমিয়ে পড়া। অবশ্য পড়ালেখার প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অবহেলা কোনোদিনই ছিল না।
চোখে তেল দেয়া
বিদ্যাসাগর প্রচুর পরিশ্রম করতেন। বাবার আয় রোজগার তেমন ছিল না। কলকাতায় রান্না-বান্না, ঘর সামলানোর কাজ বিদ্যাসাগর করতেন। রাতে পড়তে গিয়ে কখনো কখনো ঘুমিয়ে পড়তেন। বাবা যদি ফিরে দেখতেন বিদ্যাসাগর ঘুমাচ্ছেন, তখনই পিতা ঠাকুরদাস তাঁকে প্রহার উপহার দিতেন। সেজন্য বিদ্যাসাগর প্রদীপের তেল চোখে দিতেন, যাতে করে চোখের যন্ত্রণায় ঘুম না আসে। রাত জেগে প্রচুর পড়া পড়তেন।
ছাতা ও বিদ্যাসাগর
আকার-আকৃতিতে বিদ্যাসাগর বেশ ছোটখাটো মানুষ ছিলেন। গরমের দিনে ছাতা মাথায় হেঁটে গেলে মনে হতো ছাতা স্বয়ং হেঁটে যাচ্ছে; ছাতার তলায় কোনো মানুষ নেই।
যশুরে কই
শরীরের তুলনায় বিদ্যাসাগরের মাথা ছিল বেশ বড়। এজন্য ছেলেরা তাঁকে ‘‘যশুরে কই’’, মানে যশোরের বড় মাথাওয়ালা কই মাছ বলে খেপাত। বিদ্যাসাগর এতে খুবই রেগে যেতেন। কিন্তু রাগে কথা বলতে পারতেন না। কারণ ছেলেবেলায় তোতলা ছিলেন।
মাছের ঝোল, ঝোলের মাছ
বিদ্যাসাগরের বাবার আর্থিক অবস্থা ছিল খারাপ। কোনো দিন খাবার জুটত, কোনো দিন জুটত না। এমনও ঘটেছে যে, মাছের ঝোল রান্না করা হয়েছে। ঝোল দিয়ে এক বেলা খেয়ে অন্য বেলার জন্য মাছ রেখে দিতে হয়েছে। পরের দিনে ওই মাছ দিয়ে আবার ঝোল করে রেঁধে খেতে হয়েছে, আবার মাছ রেখে দেয়া হয়েছে।
বয়স কম তাই…
বিদ্যাসাগর ব্যাকরণ শ্রেণি থেকে সাহিত্য শ্রেণিতে উন্নীত হবেন। তখন তাঁর বয়স ১১। সেই শ্রেণির শিক্ষক বললেন, বয়স কম, নেয়া যাবে না। আপত্তি শুনে বিদ্যাসাগর বললেন, সাহিত্য বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়, নয়তো চিরদিনের জন্য বিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে হবে। বিদ্যাসাগরের অভিমানী কথা শুনে শিক্ষক জটিল সব প্রশ্ন করলেন। বিদ্যাসাগর যথার্থ জবাব দিয়ে অল্প বয়সেই সাহিত্য শ্রেণিতে উন্নীত হলেন।
তেলাপোকা খাওয়া
কলকাতায় যে বাড়িতে বিদ্যাসাগর এবং বাবা-ভাইরা থাকতেন সে বাড়ি ছিল নোংরা ময়লায় পরিপূর্ণ। কৃমি হেঁটে যেত। একদিন সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছেন। বিদ্যাসাগর তরকারির ভেতর দেখতে পেলেন একটা তেলাপোকা। এ কথা জানলে সবার খাওয়া নষ্ট হবে। আর তাই বিদ্যাসাগর কাউকে কিছু না বলে নির্বিকারভাবে তেলাপোকা চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন।
গ্রীষ্মাকালীন ছুটির উৎস
বাংলা অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন ছুটির ধারণাটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনিই এর প্রবর্তক। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে কলকাতায় স্বাভাবিক জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে উঠত। অল্পবয়সী শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ত। বিদ্যাসাগর তখন শিক্ষাদপ্তরকে অনুরোধ করে দুই মাসের জন্য ছুটি মনজুর করালেন। সে ছুটির রীতি আজও বাংলায় প্রচলিত।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ তখন ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয়মিশ্রিত সম্ভ্রমের চোখে তাকাতেন। কিন্তু তিনি মিশতে জানতেন। যথাসময়ে কলেজে পৌঁছুতে দেরি হবে বুঝে একবার বিদ্যাসাগর ঢুকে গেলেন ছাত্রাবাসে। একটা ভেজা কাপড় পরে মাথায় পানি ঢাললেন। গোসল সেরে ছাত্রদের সবার পাত থেকে এক মুঠো করে খাবার নিয়ে গল্পগুজব আর হাসিঠাট্টা করে তাড়াতাড়ি কলেজে চলে গেলেন এবং যথাসময়ে ক্লাসে ঢুকলেন। বিদ্যালয়ের ভেতর ও বাইরে বিদ্যাসাগর ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা।
মেথর বাড়িতে সেবা
একবার এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসে জানালেন তাঁর স্ত্রী কলেরায় আক্রান্ত। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। সেকালে ‘‘মেথর’’রা ছিল সামাজিকভাবে অস্পৃশ্য। বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ কলেরার ওষুধের বাকশো আর একটা মোড়া নিয়ে হাজির হলেন মেথরের বাড়িতে। সারা দিন কলেরা রোগির সেবা করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন।
নিজের বেলায় মোটা কাপড় পরের বেলায়…
বিদ্যাসাগর নিজে খুব সাদাসিধা চলতেন। পোশাক ছিল সাধারণ : ধুতি আর মোটা চাদর। কিন্তু বিধবাবিবাহের আয়োজনে তিনি সব সময় প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন এবং সাধারণত কন্যাপক্ষ অবলম্বন করতেন। কন্যাকে দামি বস্ত্র ও অলংকারে সুসজ্জিত করে বিবাহসভায় হাজির হতেন। এধরনের কাজে প্রচুর খরচের কারণে তাঁকে বহু ঋণের দায়ে পড়তে হয়েছিল।
রসিক বিদ্যাসাগর
একবার এক বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়ে শুনলেন সব কিছু আবার রান্না করে খাওয়াতে হবে। কোনো কারণে আগের খাবারগুলো ফেলে দিতে হবে। বিদ্যাসাগর নিমন্ত্রণকারীকে ডেকে বললেন, ভয় নেই, আবার আয়োজন কর। এই বলে তিনি বাকি সব অতিথিদের সঙ্গে দারুণ রঙ্গ-রসিকতায় মত্ত হলেন; কখন সময় পেরিয়ে গেলো, কেউ টেরই পেলেন না। মূলত বিদ্যাসাগর ছিলেন বাগ্মী, প্রচুর ঠাট্টা-রসিকতা করে কথা বলতে পারতেন। অবশ্য তাঁর বাইরের অবয়ব ও গাম্ভীর্য দেখে বোঝা মুশকিল ছিল যে, তিনিও হাস্য-রসিকতা জানেন।