ভবিষ্যৎ ও তারুণ্য

চলতি হাওয়ার পন্থী

মানব ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে তরুণেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারুণ্যের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য বিদ্রোহ ও বিপ্লব। মহাকালের অমর কবিতায় তারুণ্য যুগিয়েছে নতুন সুর। তাই যুগে যুগে তারুণ্যের বন্দনা করেছে মানুষ। দৃঢ় প্রত্যয় আর দ্রোহী চেতনার উৎস হল তারুণ্য। তরুণেরা অসম্ভবের অভিযাত্রী। তাদের আছে অফুরান প্রাণশক্তি আর সৃজনের উন্মাদনা। অসাধ্যকে সাধন করার, অজানাকে জানার, পুরনো সমাজকাঠামো ভেঙে নতুনভাবে গড়ার দুঃসাহস কেবল তরুণদেরই আছে। তরুণেরা নিজেদের সময়ে বসবাস করে। তারা বর্তমানের মধ্যে অতীতকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে ভবিষ্যতের দিকে দৃকপাত করে। ফলে তাদের মাঝে যুগ ও যুগোত্তরের স্বপ্ন ও সাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে। তরুণদের সোচ্চার ব্যক্তিত্ব ও দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে। তাদের উদ্যম ও কর্মযজ্ঞ জাতির মর্মমূল ছুঁয়ে যায়। আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি গণআন্দোলন ও লড়াই-সংগ্রামে বেগ ও আবেগ সঞ্চার করেছে তরুণেরা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তরুণরাই ছিল অগ্রপথিক।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে মানুষে-মানুষে, ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নানাদিক থেকে ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ইতিহাসের নানা পর্যায়ে বিদেশি শাসকেরা বাংলাকে শাসন করেছে। বাঙালি জাতি তার আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য নিজস্ব রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তুলতে পারেনি। ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো বাংলার গণমানুষ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রসত্তা নির্মাণের জন্য সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ এই অঞ্চলের চাষা-ভুষা, মুটে-মজুর ও মেহনতি জনতার সম্মিলিত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার কথা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে মানুষে-মানুষে, ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।’ কিন্তু বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ আমরা কায়েম করতে পারিনি। দারিদ্রের হার হ্রাস পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে অতি ধনীর সংখ্যা।

 

একদিকে জাতীয় আয়ের দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, অন্যদিকে বৃদ্ধি পেয়েছে বণ্টনবৈষম্য। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে বটে, তবে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেই উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না। মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে অঢেল পরিমাণ সম্পদ। বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম বেড়েই চলেছে। মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনও অপূর্ণই রয়ে গেছে। হরহামেশাই ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। মোদ্দা কথা হল, মানুষের প্রাথমিক সংগ্রামগুলো এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

 

বাংলাদেশের শোষিত, নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উত্থানে ও সমাজের আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমাদের বিকল্প উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তরুণদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ তারাই সমাজ রূপান্তরের কারিগর। সাম্প্রতিককালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। বিদ্যমান করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় তরুণদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশের ঔপনিবেশিক ধাঁচের প্রশাসনিক কাঠামোকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো একান্ত প্রয়োজন। আমাদের অর্থনীতির দুই প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকাংশই তরুণ। তাদের উন্নত কারিগরি ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া দেশে নতুন তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করতে হবে। গরিব কৃষকদের স্বার্থে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি সকল খাতে তরুণদের নেতৃত্বে নতুন মেরুকরণ ঘটিয়ে মানবমুক্তির লক্ষ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here