বঙ্গভঙ্গ-উত্তর পূর্ববঙ্গের নারীশিক্ষা : একটি পর্যালোচনা

পূর্ববঙ্গে নারীশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসকদের মাধ্যমে। এর পূর্বে বাংলার নারী সমাজ ধর্মীয় ও গার্হস্থ্যজীবন যাপনের লক্ষ্যে পারিবারিকভাবে শিক্ষা অর্জন করত। মিশনারিদের মাধ্যমে পুরো ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার সূত্রপাত হলেও তাতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত আকারে। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে।

 

পূর্ববঙ্গে মিশনারিরা নারীশিক্ষা প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও  তাতে রক্ষণশীল  হিন্দু  ও  মুসলিম  সমাজ তাতে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী ছিল না। পূর্ববঙ্গের অভিজাত পরিবার, অবস্থাপন্ন   কৃষক, ধনি ব্যবসায়ী   শ্রেণির  কোনো  মেয়েকেই শিক্ষা গ্রহণে পাঠানো হতো না। এ কারণে দেখা যায় মিশনারি বিদ্যালয়গুলোতে তখন বাগদী, বৈদ্য,বৈরাগীদের মত নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুমেয়ে এবং  রূপজীবী নারীদের কন্যারাই লেখাপড়া শিখত। এসব কন্যাশিশুদের নগদ অর্থ,বস্ত্র ও উপহারসামগ্রী দিয়ে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করার প্রচেষ্টা থাকলেও তাদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল খুবই কম।

পূর্ববঙ্গের ঢাকায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল  চার্লস লিওনার্দোর উদ্যোগে ১৮২৪ সালে।  একই সময়ে নারিন্দায় ৩০ জন বালিকা নিয়ে আর একটি বিদ্যালয় চালু হয়েছিল।

 

এছাড়া ঢাকার জিজ্ঞিরা,দয়াগঞ্জ,নারাণদিয়া,রামগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকার লক্ষীবাজারে ১৮৭৩ সালে ‘শুভ সাধিনী সভা’ নামক বয়স্ক নারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৮৭৮ সালে তদানীন্তন গভর্নর এ্যাশলে ইডেনের নাম অনুসারে ইডেন রাখা হয়। শীঘ্রই এটি জনপ্রিয়তা পায় এবং ১৮৮০ সালে এখানে মোট ভর্তিকৃত ছাত্রীসংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। সমসায়মিক কালে চট্টগ্রামে ডাঃ খাস্তগীর স্কুল ,মাদারবাড়ি স্কুল, ভুলুয়াদীঘি স্কুল, মুরাদপুর স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৯ সালে দিনাজপুরে একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ১৮৫৪ সালে একটি বাংলা স্কুল চালু করেন। ১৮৭৩ সালে কুমারখালির জনৈক বাবু রামলাল সাহার  উদ্যোগে   এখানেই চারুলতা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

এদিকে ১৮৭৩ সালে ময়মনসিংহ শহরে জমিদার রামবাবুর পৈতৃক নিবাসে আলেকজান্ডার ডাফ নামক ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎকিশোর আচার্য্য চৌধুরী  তাঁর মাতা বিদ্যাময়ী দেবীর নামানুসারে আর একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোপূর্বে মিশনারি ও ব্রাক্ষ্মসমাজের প্রচেষ্টায় আধুনিক নারীশিক্ষার যে সূত্রপাত হয়েছিল ময়মনসিংহের উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ তাতে সাড়া দিয়ে এ দু’টি প্রতিষ্ঠানে তাদের কন্যাদের শিক্ষাগ্রহণে প্রেরণ করেন।

 

ঢাকার ব্রাক্ষ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত দীননাথ সেন,অভয় দাস এবং কালীপ্রসন্ন ঘোষ ১৮৭০ সালে গেন্ডারিয়ায় “অন্তঃপুর স্ত্রীশিক্ষা সভা”প্রতিষ্ঠা করেন। এটির নির্মাণ ব্যয়ে তৎকালীন সরকার ১৫০ রূপি অনুমোদন করেছিল। কুমিল্লার জমিদার নওয়াব ফয়জুন্নেসা মুসলিম নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৮৭৩ সালে তিনি কুমিল্লায় মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা ছিল ভারত উপমহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়। এছাড়া ১৯০১ সালে তিনি তাঁর নিজ গ্রাম পশ্চিমগাঁওয়ে ‘বদরুন্নেসা’ নামক মধ্য ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন অভিজাত মুসলিম মেয়েরা এখানে ভর্তি হয়। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এতে করে এ অঞ্চলের মেয়েরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষা গ্রহনে সমর্থ হয়।

 

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গে নারীশিক্ষা আরও সম্প্রসারিত হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে গঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে সরকারি সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পায়। ফলে মুসলিম সমাজের উৎসাহ উদ্দীপনার ফলে এখানে নারীশিক্ষার সার্বিক উন্নতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here