আত্মীয়

“দুপুরে কী খাবে?’’ মায়ের এমন প্রশ্নে বরাবরই খুব বিরক্ত হয় শিহাব। কিন্তু বিরক্তিটা প্রকাশ করে না। মুখের ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে খুব ঠাণ্ডা স্বরে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়েই উত্তরটা দেয়, “যা রান্না করবা তাই’’।

 

ফরিদা, শিহাব যার একমাত্র সন্তান, মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত গৃহিণী, খাঁটি সংসারধর্ম পালন করাই যার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, দিনের অধিকাংশ সময়ই সে ব্যয় করে পাকঘরে। স্বামীর সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতার আর স্বভাবের ফরিদা। স্বামীর মনের সাথে তাই মন মিলিয়ে নিতে চায় রসনায়। তবু শিহাবের বাবা আমিনুলের সাথে ফরিদার, বা ফরিদার সাথে আমিনুলের দূরত্বটা কোথায় যেন থেকেই যায়। সেই দূরত্বের এপারে ওপারে হাজারো ধ্বনি-শব্দ শ্রাব্য-অশ্রাব্যের আসা-যাওয়ার এলোমেলো হাওয়া শিহাবকেও নাড়িয়ে দেয়, ভেতরটা ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে এতটুকু হয়ে যায় শিহাবের। উত্তর পেয়েও ফরিদা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ, ঘরের এটা-ওটা দেখে, বিছানার চাদরটা টেনে ঠিক করে, চেয়ারের উপর আছড়ে ফেলা শার্টটা ভাঁজ করতে করতে সুরেলা গলায় টানা টানাভাবে বলতে থাকে, “যেমন বাপ, তেমন ব্যাটা, অন্যের ছেলেদের দেখি না! বাজারটা-সদাইটা করে…।”

 

সব কথা কানেও যায় না শিহাবের। এসব সে রোজ শোনে, শুনে শুনে মুখস্থ। শিহাবের মনে হয়, খুব-খুব মনে হয়, মা-বাবা নিজেরা নিজেদের নিয়ে সুখী নয়, তাকে নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। শিহাব যখন ছোট ছিলো, মা গল্প বলে ঘুম পাড়াতো। কোনো কোনো দিন বাবাও গল্প শোনাতো। গল্প না শুনে শিহাব ঘুমোতেই পারতো না। বাবার গল্পগুলো ছিলো রোমাঞ্চকর, রাজা-মন্ত্রী, রাজপুত্র-কোটালপুত্রের গল্প। এক গরিব ব্রাহ্মণের গল্প বাবা খুব বলতো। সেই ব্রাহ্মণ তার ব্রাহ্মণী আর অকর্মণ্য ছেলেদের অত্যাচারে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। কীভাবে ব্রাহ্মণ সেই রাজ্যের রাজজ্যোতিষী হয়ে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে বাড়ি ফেরে সেই অংশটা ছিলো সবচে’ আকর্ষণীয়। কত কত রাতে শিহাব বাবার এই গল্প শোনার জন্য না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করেছে! কখন বাবা ঘুমোতে আসবে আর শিহাব বলবে, “বাবা, বামণের গল্পটা বলো না!”

 

মা শোনাতো টোনা-টুনির গল্প। কত গান যে জানে মা! সেসব শুনতে শুনতে ঘুমাতো শিহাব। কিন্তু বড় হতে হতে সব কেমন বদলে যেতে থাকলো। যখন সে বুঝতো না মা-বাবা দু’জন ভিন্ন জগতের মানুষ, তখন ওর ভালো লাগতো মা-বাবার সাথে অনেক অনেক গল্প করতে, খেলার গল্প, বন্ধুদের গল্প…ফুরোতেই চাইতো না সেসব গল্প। বাবা মন দিয়ে শুনতেন; মা হয়তো কথার মাঝে বাধ সেধে তেল-আটা-চালের শেষ হওয়ার বা পাশের বাড়ির গিন্নির বাচ্চা নষ্ট হওয়ার অথবা, অন্য কারো নতুন গয়না কেনার প্রসঙ্গটা অতি উৎসাহে তুলতে চাইতেন। বড় হতে হতে শিহাবও যেন বড় দূরে চলে গেছে ওদের কাছ থেকে। আমিনুল যতটা সময় পায়, তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বাছা বাছা কিছু উপদেশ বের করে আনে শিহাবের জন্য। প্রথম প্রথম শিহাব মেনে চলতো, আজকাল আমিনুলের ডাক পড়লে সিগারেটের জন্য ফুসফুসটা নিশপিশ করে। আমিনুলের সব কথাতেই চুপ করে থাকে, পেটের ভিতর গুড়গুড় করে, কান গরম হয়ে যায়। আমিনুলের কমন কথা, “সবার সাথে মিলেমিশে থাকবা, ঝগড়া করবা না, মারামারি করবা না, নেশাটেশার মধ্যে যাইও না আবার।”

 

এ বছর কলেজের গণ্ডি পেরিয়েছে শিহাব। নতুন নতুন সিগারেট খাওয়া শিখেছে, তাই নেশা করার কথায় তার কান লাল হয়ে যায়, কিন্তু, ঝগড়াঝাটির কথা শুনলে তার মাথা ঠিক থাকে না, সে যেচে কারো সাথে কখনো ঝগড়া করে না, তবে কারো উপর রাগ হলে মাথা ফাটিয়ে ফেলার ক্ষমতাও রাখে। আমিনুলের কথায় তার রাগ হয়, বাবা কেন পারে না মার সাথে মিলেমিশে থাকতে? শুধু ঝগড়া করে কেন? শিহাবের স্কুলের বন্ধু আরেফিন, প্রায়-ই আরেফিনের সাথে ওদের বাসায় যেতো শিহাব। আরেফিনের বাবা-মাকে দেখলেই বোঝা যায়, ওরা কত সুখী! আরেফিন বলে, ওর বাবা ওর বন্ধুর মতন, একেবারে ইয়ার-দোস্ত যাকে বলে। সব বন্ধুরা মিলে ওদের বাসায় কতদিন হৈ-চৈ করেছে ওরা! ওর বাবা-মা খুবই মিশুক! শিহাবের বাবা-মা কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে ওর বন্ধুদের সামনে? কেনো?- কিন্তু এসব প্রশ্ন করতে পারে না শিহাব। ফরিদাও ঠিক এমনি উপদেশ দিতে থাকে আর তুলনা-প্রতিতুলনায় ব্যস্ত করে তোলে শিহাবকে। ফরিদা এখনো বলে চলেছে, “মাথা ব্যথার দোহাই দিয়ে সাহেবের পড়াশোনা লাটে ওঠে। এই টিবির সামনে বসে থেকে থেকে চোকটা খাবে আর পড়ার সময় হলে ঘুমাবে…।”

 

শিহাব সনি টিভিতে ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখছিলো, বেশ মনোযোগ দিয়েই। ফরিদার একটানা বকবকানি ধীরে ধীরে তার চোখে মুখে বিরক্তি ফোটাতে থাকে। বাবার সাথেও মা এমনি করে। মাঝে মাঝে পরিস্থিতি এমন চরমে ওঠে যে, শিহাব নিজের ঘরে বসে শুনতে পায়। পাকঘরের ঝনঝনানির সাথে বাবার চাপা হিসহিসানি মিশে সাপের মতো এঁকেবেঁকে শব্দগুলো শিহাবকে আঘাত করে। ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে পারলে ভালো হতো মনে হয়। দিনের বেলা হলে বেড়িয়েই যায়, পরপর তিন-চারটা সিগারেট টেনে বাড়ি ফেরে। মাঝে মাঝে বাবা-মা দু’জনেই নিজেদের যুদ্ধবিরতি দিয়ে ওর উপরে চড়াও হয়। তখন সবকিছু সহ্যের বাইরে চলে যায় শিহাবের। ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত আতঙ্কে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে থাকে ওর। এপাশ-ওপাশ করে ভাবতে থাকে, ওর নিজের মা-বাবা, যাদের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক, অথচ কত দূরের মানুষ মনে হয় তাদের, যেন চেনে না, জানে না, বোঝে না! এমনকি আত্মীয়ও মনে হয় না তাদের!

 

পাকঘর থেকে বিড়বিড় করে ফরিদার মৃদু বকবকানি কানে আসে। শিহাব সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ‘ক্রাইম পেট্রোলে’ মনোযোগ দেয়। এপিসোডটা দারুণ লাগছে। এক লোক তার স্ত্রীকে খুন করে ছোটো ছোটো টুকরো করে বিশাল এক ডিপ ফ্রিজে তালা দিয়ে রেখেছে। আর বাচ্চাদের বলেছে, তাদের মা নানাবাড়ি গেছে। শিহাব ভাবে, ঠিক তার মা-বাবার মধ্যেও ভালোবাসা নেই বলেই তারা সারাক্ষণ এমন ঝগড়া করে, বা ঝগড়া করতেই যেন তারা অভ্যস্ত। ভাবতে ভাবতে শিহাব অজানা এক আতংকে কুঁকড়ে যায়। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বিছানা থেকে। কিন্তু এগোনোর সাহস হয় না। হৃৎপিণ্ডটা গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চায়। যতটা সম্ভব পায়ের উপর কম ভার রেখে শিহাব পাকঘরের প্রশস্ত করিডোরে ডিপ ফ্রিজটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা হাত ডালাটার দিকে বাড়াতেই ওখানে রাখা মা’র ফোনটা বেজে ওঠে। চমকে পিছিয়ে যায় শিহাব। ফোনটাকে মনে হয় একটা বোমা। শিহাব বিস্ফারিত চোখে চেয়েই থাকে। ফরিদা হাত ধুয়ে উঠে আসতে আসতে বলতে থাকে, “ফোনটা একটু ধরলে কি হয়? না হয় একটু এনে দাও…হ্যালো, স্লামালিকুম… কে? কী! কীভাবে?…” ভীত-বিহ্বল হয়ে শিহাবকে বলতে থাকে ফরিদা, “শিহাব! তোমার আব্বা হাসপাতালে… কেউ কিছু বলছে না…।” ফরিদার মুখটা ভয়ে ছোটো হয়ে যায়, “শিহাব, শিহাব…।” শিহাব যেন ডিপ ফ্রিজের ঠাণ্ডা থেকে হঠাৎই গরমে বেড়িয়ে আসে, এমনি একটা ঝাপটা লাগে ওর। “আমি রিকশা ডাকি, তুমি আসো।”, বলে বাইরে বেড়িয়ে যায় শিহাব।

 

হাসপাতালের করিডোরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে আমিনুলের দুই কলিগ, নাসির আহমেদ, আকরামউদ্দীন। আকরাম ফরিদাকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে আসে। ওরা কিছু জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু আকরাম নিজে থেকেই বলতে থাকে, “দুইজন একসঙ্গেই যাইতেছিলাম, আমি আগে রোড ক্রস করছি। আমিন সায়েব আসতে নিয়ে এক হুন্ডা এসে লাগায় দিছে, তবে ব্রেক করছিলো, তাই শুধু হাত-পায়ের উপর দিয়ে গেছে। ভাবি, টেনশন নিয়েন না, খালি ভাঙছে। বেশি ক্ষতি হয় নাই। এখনো অপারেশন থিয়েটারে আছে। টেনশন নিয়েন না। ঠিক হয়ে যাবে।”

 

নাসির নিঃশব্দেই আসে, তেমনি নিঃশব্দে শিহাবের হাতে তুলে দেয় আমিনুলের অফিস ব্যাগ, টিফিন ক্যারিয়ার, ঘড়ি আর মানিব্যাগ। মানিব্যাগটা একটু কাত হলে চকিতে শিহাবের চোখে পড়ে মানিব্যাগের ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিকে মোড়া জায়গাটিতে তাদের তিনজনের একটা ছোটো সাইজের সযত্ন-রক্ষিত ছবি। কোনো এক জন্মদিনে স্টুডিওতে তোলা, হাসি-হাসি মুখের পারিবারিক ছবি। শিহাব ফরিদার দিকে তাকায়। ফরিদা নিঃশব্দে কাঁদছে। শিহাবের হাত থেকে জিনিসগুলো নেয় ফরিদা, আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মানিব্যাগের ছবিটার দিয়ে তাকায়, তার চোখ আবার ঝাপসা হয়ে আসে।

 

হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় শিহাব। অস্থির একটা অনুভূতিতে শরীর তিরতির করে কাঁপতে থাকে। এই প্রথম ভালবাসা দেখতে পেলো শিহাব, বাবার রক্তমাখা মানিব্যাগে, আর মা’র নীরবতায়। রক্তের মধ্যে কেমন চঞ্চলতা জাগে শিহাবের, হঠাৎ খুব ভালবাসতে ইচ্ছে হয় বাবা-মাকে, ফুসফুসটা মনে হয় খালি হয়ে যায়, চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। সিগারেটের জন্য তাড়াতাড়ি পকেট হাতড়ায় শিহাব। একটা দুমড়ানো সিগারেট পকেট থেকে বের করে ঠিক চোখের সামনে ধরে। দু’সেকেন্ড। গাল বেয়ে দু’ফোটা নোনা পানি গড়াতেই, ঝাপসা চোখ ফরসা হয়ে যায়। শিহাব একবার পেছন ফিরে চায় অপারেশন থিয়েটারের দিকে, তারপর সিগারেটটা দুমড়ে-মুচড়ে শূন্যে ছুড়ে দেয়।

1 COMMENT

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here