বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একজন প্রত্নতাত্ত্বিক স্বাধীন সেন। তাঁর কাজের ধরন নিয়ে এই সাক্ষাৎকারেরই কথা হয়েছে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে। কিন্তু পড়ালেখার আগ্রহের এলাকা ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। প্রত্নতত্ত্বের বাইরের এলাকাতে উঁকি দিতে পছন্দ করেন। কবিতা, গান, সিনেমা, খেলা প্রভৃতি তাঁর প্রিয় বলেই জানি।
সহজিয়া. প্রত্নতত্ত্ব পড়তে এসেছিলেন কেন? পড়ালেখা নিয়ে কী পরিকল্পনা ছিল আপনার?
যে বয়সে মানুষ কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেবেন তা ঠিক করেন তখন তো এত পরিকল্পনা মাথায় থাকে না। আমার যতটুকু মনে আছে তাতে আমি কী পড়ব সেটা বিভিন্ন সময় পাল্টেছে অন্য অনেকেরই মতন। মুদি দোকানদার হওয়ার ইচ্ছা ছিল অপুর প্রভাবে। একসময় বুদ্ধদেব গুহ খুব পড়তাম। বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার ইচ্ছা তৈরি হয়েছিল নানান উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনি পড়ে। আমার বাবার সঙ্গে প্রতিদিন শুয়ে শুয়ে অনেক গল্প হতো। তবে ক্লাস সেভেন-এইটের দিকে দুটো বিষয়ে পড়ার আগ্রহ বিশেষ করে তৈরি হয়। একটা ছিল জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান। তখন দেশ পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলেন আমার দাদু। দেশে সমরজিৎ করসহ নানাজন বিজ্ঞান নিয়ে লিখতেন। আমি ও আমার বন্ধু সৌমিত্র সাহা মিথুনের পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহ তখন থেকে। ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ার পরে বৃত্তি নিয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে রাশিয়া চলে যায়। আমি থেকে যাই। আমাদের দেশে জ্যোতির্বিদ্যা পড়ার অবস্থা যে খুব একটা সুবিধার না সেটা টের পাই বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাটালগের সঙ্গে আমাদের এখানকার তুলনা করে। তখন তো আর সবকিছু বুঝি না। আর প্রত্নতত্ত্ব পড়ার ক্ষেত্রে আমার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল মাসুদ রানা। নিয়মিত মাসুদ রানা পড়ার কারণে প্রত্নতত্ত্ব পড়লে নানা জায়গায় ঘুরতে পারবো। অ্যাডভেঞ্চার আছে। এমন ধারণা তৈরি হয়। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ইতিহাসের মেক্সিকোয় নামে একটা বই পড়েছিলাম। বরিশালে বুলবুল ভাইয়ের বাসায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পড়তাম। এমন নানা কিছু মিলিয়ে এই বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু তখনো বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে পড়ানো হয় বলে জানতাম না। বরিশালে বসে সবকিছু জানা তো সম্ভবও না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইউনিটের ফর্ম জমা দেওয়ার দিন লাইনে দাঁড়িয়েছি। সামনের ছেলেটার হাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসপেকটাস দেখি। সেখানে আবিষ্কার করি যে, ওই বছর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্ব পড়ানো শুরু হবে। আমি জাহাঙ্গীরনগরে পরীক্ষা দেই। চান্সও পেয়ে যাই। তারপরে বরিশাল থেকে গাট্টি-বোচকা বেঁধে জাহাঙ্গীরনগরে এসে মওলানা ভাসানী হলে উঠে পড়ি। নতুন যাত্রা শুরু হয়। পড়ব আর ভালো ফলাফল করার চেষ্টা করবো। এমন ইচ্ছা ছাড়া অন্যা কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা যে ছিল তা এখন মনে করতে পারছি না। আমার বাবারও আমার এই পছন্দ নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না। মায়েরও ছিল না।
স্বাধীন সেন. পেশাগত ভিত্তি ‘‘দুর্বল’’ জেনেও প্রত্নতত্ত্ব পড়লেন। তখন ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা কী ছিল?
এর আগের প্রশ্নের উত্তরেই বলেছি যে, পেশাগত ভিত্তি সবল নাকি দুর্বল তা ভেবে প্রত্নতত্ত্ব পড়তে আসি নাই। আগ্রহ ও ভালোবাসার জায়গা থেকে এসেছি। যেভাবে বড় হয়েছি, যেভাবে আমার মাবাবা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন সেখান থেকে নতুন কোনো বিষয়ে পড়ার মতন সাহস ও স্বাধীনতা তৈরি হয়েছিল। বন্ধুদের প্রভাবও অনেক। হয়ত আমার সকল বন্ধু যার যার ইচ্ছা অনুসারে পড়তে ও পেশা নির্বাচন করতে পারে নাই। কিন্তু সকলেই বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহী ছিল। কেউ চারুকলায় পড়েছেন, কেউ সাংবাদিকতায়, কেউ বিজ্ঞানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তো পেশা ঠিক করা যায় না আমাদের দেশে। সেকালেও যেত না। একালেও যায় না। কোনো বিশেষ রুচির প্রভাববলয়ে না থেকে বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার অভ্যাস আর বিচিত্র বন্ধুত্ব একটা বড় প্রভাব রেখেছিল সম্ভবত গতানুগতিক ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনো লোভনীয় পেশার দিকে ধাবিত না হতে। যদিও উচ্চমাধ্যমিক অব্দি পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে ওগুলো পরীক্ষা দিতে পারতাম।
স. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কলা ও মানবিকীবিদ্যাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র মনে করা হয় না। বাজেট বরাদ্দকরণ ও গবেষণার ক্ষেত্রেও তেমন কানো বিদ্যায়তনিক তৎপরতা চোখে পড়ে না। এই দৃষ্টিভঙ্গির সুদূরপ্রসারী ফল সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
উত্তরটা একটু ভিন্নভাবে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি যতটুকু জানি তাতে দুনিয়াব্যপী এখন সমাজবিজ্ঞান আর মানবিকবিদ্যার অংশ হিসেবে বিবেচিত শাস্ত্রগুলোর দৈন্যদশা চলছে। এই দশার শুরু সম্ভবত পশ্চিমে ৮০-এর দশকের শেষ থেকে শুরু হয়েছে। নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এসব শাস্ত্র ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যতটা এগুলো ওই অর্থব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণাগুলোর বিষয়বস্তু নতুন নতুন এমন প্রসঙ্গ কেন্দ্রীক হয়ে উঠেছে যেগুলোর বাজার রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা নির্ণয়, সাহিত্যে প্রায়োগিক প্রসঙ্গ, ভাষাশিক্ষাগত প্রসঙ্গ, ইতিহাসে লোকরঞ্জনবাদী প্রসঙ্গ ইত্যাদি। অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সেসব প্রসঙ্গে গবেষণাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে যা দৃশ্যমান উন্নয়ন বাসনাকে উসকে দিতে পারে।
একইসঙ্গে, প্রকাশনা শিল্পও নির্ধারিত ছকে বাঁধা গবেষণা বা লেখাপত্র ছাপতে অধিকতর আগ্রহী। অধুনা যুক্ত হয়েছে আপানার প্রকাশিত লেখাকে মাপার সংখ্যাসূচক মানদণ্ড। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, সাইটেশন ইনডেক্স, বিভিন্ন মানদণ্ড অনুসারে আপনার পাণ্ডিত্যকে মাপা ও প্রকাশ করা হয়। সেই অনুসারে আপনার গবেষণার মান নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশেও এমন কর্মকাণ্ডকে ও উদ্যোগকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এমন প্রশ্নও করা যেতে পারে: আপনার প্রশ্নে উল্লিখিত শাস্ত্রগুলোতে বাংলাদেশে এমন কী কী গবেষণা গত এক বছরে হয়েছে যেগুলোতে আপনি নিবিড় গবেষণাপদ্ধতি, বিশদ সংশ্লেষ আর পরিপ্রেক্ষিতের নতুনতর মোকাবেলা শনাক্ত করতে পারবেন? আমার অনুমান আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন গবেষণার সংখ্যা খুবই স্বল্প সংখ্যাক হবে। ক্রমাগত কমে আসা অর্থলগ্নিকে মোকাবেলা করার একটা রাস্তা হলো অর্থলগ্নি হয় এমন ধরনের গবেষণার দিকে ঝুঁকে পড়া। আরেকটা কঠিন রাস্তা হলো, যতটুকু সুযোগ ও সুবিধা রয়েছে সেই অনুসারে নিষ্ঠ, নিবিড় ও নতুনতর পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার লড়াই অব্যহত রাখা।
অর্থলগ্নির প্রসঙ্গ থাকবেই। অধিপতিশীল ও প্রবল উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার তৎপরতা থাকবেই। এই প্রতিকূল দশার মধ্যেই পড়াশুনা, শিক্ষা ও গবেষণা করতে হবে। আপাতত অন্য কোনো উপায় আমার চোখে পড়ছে না। একইসঙ্গে, তথাকথিত বিখ্যাত বিদ্যায়তনিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে কিংবা প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে প্রকাশিত হলেও গবেষণা ও প্রকাশনাকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কোনটার মান কেমন? মান মাপার মানদণ্ডগুলো কী কী? গোটা প্রকৃয়াটির রাজনৈতিক অর্থনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।
আপনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বইপত্র পড়তে বললে, রেফারেন্স দিলে আপনি অজনপ্রিয়, ও কঠিন শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হবেন। ব্যবস্থাগতভাবেই সস্তা, জনপ্রিয় ও বাজারের সঙ্গে মানানসই হতে হবে আপানাকে। শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষার্থী হিসেবে। গবেষক হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অধুনা বিসিএস চাকুরির প্রতি শিক্ষার্থীদের সবিশেষ আগ্রহ আর শিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতাকে। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে সিভিল সার্ভিসের চাকরির প্রতি এই উপমহাদেশেল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিতদের আকর্ষণ বোধ তৈরি হয়েছে। তার নানান কারণ রয়েছে। কিন্তু ইদানিং যেভাবে প্রথম পর্ব থেকেই একজন শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিশেষ চাকরির প্রতি নজর দেন সেই প্রবণতাটি আমরা ৯০-এর দশকেও লক্ষ্য করি নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বিসিএস গাইড বই পড়ার জন্য ভোররাতে লাইন তৈরি করেন চাকরিকামীগণ।
স. অনেকেই মনে করে প্রত্নতত্ত্ব পড়ার দরকার নেই, ইতিহাস পড়ার দরকার নেই, সাহিত্য অদরকারি বিষয়, দর্শনের পেছনে খরচ করা অপব্যয়। নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নামে বিভাগ খোলা হয়েছে যেগুলোর অধিকাংশই নতুন জ্ঞান উৎপাদনে ব্যর্থ। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে, কলা ও মানবিকী বিদ্যার প্রতি নাক সিঁটকানো উদাসীনতা আছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
আগের প্রশ্নের উত্তরেই কিছু জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছি এই প্রশ্নের। আমার কিন্তু হরেদরে মনে হয় না যে, এসব বিষয়ে অর্থলগ্নি খুব কম হচ্ছে। অনেক গবেষণাতেই টাকা আসছে। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনের নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই পুঁজি বিনিয়োগ করছেন। সর্বজনীন ঔদাসিন্য বলতে কিছু বিরাজ করছে না বাংলাদেশে। নতুন জ্ঞান উৎপাদনে ব্যর্থতার দায়ভার কেবল টাকা ও সুবিধার অভাব বোধহয় না। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যেখানে আপনি নিয়মিত ক্লাস নিলেও আপনাকে পাগল বলা হবে। আপনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বইপত্র পড়তে বললে, রেফারেন্স দিলে আপনি অজনপ্রিয়, ও কঠিন শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হবেন। ব্যবস্থাগতভাবেই সস্তা, জনপ্রিয় ও বাজারের সঙ্গে মানানসই হতে হবে আপানাকে। শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষার্থী হিসেবে। গবেষক হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অধুনা বিসিএস চাকুরির প্রতি শিক্ষার্থীদের সবিশেষ আগ্রহ আর শিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতাকে। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে সিভিল সার্ভিসের চাকরির প্রতি এই উপমহাদেশেল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিতদের আকর্ষণ বোধ তৈরি হয়েছে। তার নানান কারণ রয়েছে। কিন্তু ইদানিং যেভাবে প্রথম পর্ব থেকেই একজন শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিশেষ চাকরির প্রতি নজর দেন সেই প্রবণতাটি আমরা ৯০-এর দশকেও লক্ষ্য করি নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বিসিএস গাইড বই পড়ার জন্য ভোররাতে লাইন তৈরি করেন চাকরিকামীগণ। ফলে যেটা ঘটেছে তা হলো অন্য কোনো ধরনের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পর্বর একজন শিক্ষার্থী দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে যে স্বপ্ন ও জীবনবোধের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কথা তাতো তারা পান না। ক্ষমতাশীন দলের দাপট দেখতে হয়, সিনিয়রদের র্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়, চারপাশে বিসিএস বাসনার প্লাবন দেখতে হয়, ফাঁকিবাজ অসৎ শিক্ষক দেখতে হয়। প্রতিক্রিয়ায় আপনি তৃতীয় বা চতুর্থ পর্বতেই একজন মৌলিক ও নিষ্ঠ গবেষণা বা পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবও সাংঘাতিক নেতিবাচকভাবেই পড়ছে সামগ্রিক পড়াশুনা ও গবেষণার উপরে।
সুতরাং আপনি যে ঔদাসীন্যের কথা বললেন সেই ঔদাসীন্য ও নাঁক সিটকানো প্রবণতাগুলো নতুন কিছু না। ইতিহাস বা দর্শন পড়তে চাইলে ৩০-৪০ বছর আগেও নিরুৎসাহিত করা হতো পরিবার থেকে, সমাজ থেকে। এখনও করা হয়। একসময় ডাক্তার, প্রকৌশলী হওয়া বা নিদেনপক্ষে ইংরেজিতে একখানা ডিগ্রি থাকাকে পেশাগতভাবে জরুরি বিবেচনা করা হতো। সেই দশারই বদল ঘটছে। কখনো সেটা ছিল বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায় কাজ, ব্যবসায় প্রশাসনে ডিগ্রি, বা পেশা হিসেবে সহজলভ্য কোনো বিষয়ে অধ্যয়ন করা বা কখনো অন্য কোনো বিষয়ে পড়া। শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পরে চাকরির কথা ভাববেন। সেটাই তো স্বাভাবিক। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্বতে পড়াশুনার হাল নিয়ে বরং ভাবা বেশি জরুরি। কারণ পড়াশুনার এই দশার পরে চাকরি ক্ষেত্রে বা পেশাগত ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যায় পড়ছেন। তাদের দক্ষতা ও সামর্থ এই ব্যবস্থা কিংবা প্রেসক্রিপশন হিসেবে বিভিন্ন সময়ে চালু করা ব্যবস্থার মধ্যে তৈরি হচ্ছে না। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচু স্তরের চাকরিগুলোর কত পদে বাংলাদেশিরা রয়েছেন, আর কত পদে বিদেশিরা রয়েছেন।
স. বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব চর্চা জরুরি কেন? অনেকে মনে করেন, বিজ্ঞানের পেছনে টাকা খরচ করলে তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায়। উন্নয়ন সহজ হয় ইত্যাদি…. আপনার কী মনে হয়?
এই প্রশ্নর কোনো সার্বজনীন ও সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর দেওয়া মুশকিল। প্রত্নতত্ত্ব একটি আন্তঃশাস্ত্রীয় বা শাস্ত্রান্তরী বিষয়। এখানে অনেক বিষয় পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আমরা কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়াই বা নিজেরা পড়ি ও গবেষণা করি সেটা প্রশ্ন হতে পারে। তেমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারলে প্রত্নতত্ত্বে পড়ে একজন শিক্ষার্থী ডিগ্রি লাভের পরে নানান পেশায় যুক্ত হতে পারেন। সেই সামর্থ্য ও দক্ষতা তার তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাগত কারণে আর আমাদের দায়বোধহীনতার কারণে সেই প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা কতটা আমরা তৈরি করতে পারছি সেটা বিবেচনার বিষয়। এখানে প্রত্নতত্ত্বকে অন্য শাস্ত্রগুলোর দশার মতনই বিবেচনা করতে হবে।
প্রত্নতত্ত্ব চর্চা সেই কারণেই জরুরি যে কারণে সাহিত্য পড়া জরুরি, দর্শন পড়া জরুরি, ভাত খাওয়া জরুরি, ঘুমানো জরুরি, গান শোনা জরুরি, সিনেমা দেখা জরুরি। কবিতা পড়া জরুরি। প্রতিদিন প্রাকৃতিক কর্ম করা জরুরি। আমার কাছে প্রত্নতত্ত্ব যাপনের বিষয়। আমার বেঁচে থাকার সঙ্গে বিজড়িত। নানাজন নানাভাবে প্রত্নতত্ত্বের গুরুত্বের কথা বলতে পারেন। দেশ ও জাতির জন্য অতীত ও ইতিহাস জানা কেন জরুরি তা নিয়ে কথা বলতে পারেন। ভবিষ্যৎ জানার ও নির্মাণের জন্য কেন অতীত জানা দরকার আর অতীত জানার জন্য প্রত্নতত্ত্ব পড়া জরুরি তা নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করতে পারেন। আমি সেই ভাবে প্রত্নতত্ত্ব পড়াকে জায়েজ করতে আগ্রহী না। তাহলে আপনি বৈষয়িক ও প্রায়োগিক সার্থকতার মানদণ্ডেই প্রত্নতত্ত্বকে বা অন্য যেকোনো শাস্ত্রের প্রতি আগ্রহকে মাপবেন। ঠিক এই কাজটিই তো বিদ্যায়তন বা হালের নব্য উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থা করে থাকে। আমি ওই ব্যবস্থার সমালোচনা করবো, আবার একই সঙ্গে আমি যে বিষয় পড়ি ও পড়াই সেই বিষয়কে ওই ব্যবস্থার শর্ত অনুসারে জায়েজ করার জন্য যুক্তিপ্রদান করবো – তাতো স্ববিরোধী হয়ে যাবে।
জমি, মানুষ, প্রকৃতি, যাপন ও তার নানা দিক যদি কেউ বুঝতে চায়, তাহলে ইতিহাস ছাড়া সেই বোঝাবুঝি ভ্রান্ত হতে বাধ্য। ক্রমাগত এই ভ্রান্তিগুলোর বিষচক্র থেকে মুক্তির জন্য প্রত্নতত্ত্বের পড়াশুনা ও জ্ঞান ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার মতন নগন্য একজন প্রত্নতত্ত্ববিদের ধারণা।
আমাদের দেশে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অতীত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনেক আলামতই খুব তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জলবায়ু-বৃষ্টি-ভূমিরূপ-নদী-নদীর ভাঙন-সঞ্চয়ন, বন্যা ইত্যাদি কারণে। অন্যদিকে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে গত ৪০-৫০ বছরে অনেক প্রত্নস্থান ও প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত মানবীয় কর্মকাণ্ডের কারণেও নষ্ট হয়েছে বা রূপান্তরিত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্নতাত্ত্বিক যেকোনো কাজ করার জন্য কঠোর ও নিবিড় মাঠকর্ম করা দরকার। আপনি সামান্য বেখেয়াল হলেও অনেক উপাত্ত আপনার নজর এড়িয়ে যাবে। পরে আর সেগুলো অবিকৃত দশায় খুঁজে পাওয়া নাও যেতে পারে। পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে জরিপ করার সময়, প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করার সময়, নথিভুক্ত করার সময় আর সর্বোপরি প্রতিবেদন লেখার সময় আমি বিশদ বা ডিটেলের প্রতি মনোযোগী থাকার চেষ্টা করি।
স. প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় কাজের ধাপগুলো কী? কীভাবে একটি স্থান খনন ও গবেষণার বিষয় থেকে প্রত্নস্থান হয়ে ওঠে?
গবেষণার ধাপ অনেকটাই সত্তাশ্রীত। তবে কিছু কাজ মাঠপ্রত্নতাত্ত্বিকদের করতেই হয়। নিবিড়ভাবে জরিপ করা, মানচিত্র তৈরি করা, মানুষ ও জমির সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা বিভিন্ন আলামতের উপরে ভিত্তি করে, ইত্যাদি। একভাবে বললে, খনন ও গবেষণার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই একটি স্থান প্রত্নস্থান হয়ে ওঠে। প্রত্নস্থান হিসেবে একটি স্থান বা প্রত্নবস্তু হিসেবে একটি বস্তুকে নির্মাণ করেন প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণা। এই প্রসঙ্গে নানা মজার গবেষণা ও প্রবন্ধও আছে। আমার কাজের অভিজ্ঞতা আর অন্যান্যদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু শিখেছি, তাতে প্রত্নতত্ত্বে সবচেয়ে সহজ হলো নিজের গবেষণার দরকার অনুসারে বা চাহিদামাফিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপাত্ত-তথ্য তৈরি করা তুলনামূলকভাবে সহজ। এমনকি বৈজ্ঞানিক কৌশল অনুসরণ করে লব্ধ উপাত্তর মাধ্যমেও আপনি এই কাজটি করতে পারবেন। যেহেতু অতীত নিয়ে আলাপ করা, অতীতের মানুষকে বোঝা প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম লক্ষ্য, যেহেতু প্রত্নতত্ত্বকে সংজ্ঞা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে অন্যান্য সকল শাস্ত্রের মতনই, সেহেতু পদ্ধতিগতভাবে প্রত্নতত্ত্ব চর্চাও স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে ভিন্ন হয়। অতীতের মানুষ প্রসঙ্গে বা মানুষের নানাবিধ তৎপরতা প্রসঙ্গে ‘নিশ্চিত’ করে সিদ্ধান্ত প্রদান করা সম্ভব না। প্রত্নতত্ত্বের পদ্ধতিগত ও চিন্তাগত বিভিন্ন আলাপে এই প্রসঙ্গগুলো অনেক আগে থেকেই তর্কবিতর্কর বিষয়। আমাদের দেশে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অতীত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অনেক আলামতই খুব তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জলবায়ু-বৃষ্টি-ভূমিরূপ-নদী-নদীর ভাঙন-সঞ্চয়ন, বন্যা ইত্যাদি কারণে। অন্যদিকে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে গত ৪০-৫০ বছরে অনেক প্রত্নস্থান ও প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত মানবীয় কর্মকাণ্ডের কারণেও নষ্ট হয়েছে বা রূপান্তরিত হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্নতাত্ত্বিক যেকোনো কাজ করার জন্য কঠোর ও নিবিড় মাঠকর্ম করা দরকার। আপনি সামান্য বেখেয়াল হলেও অনেক উপাত্ত আপনার নজর এড়িয়ে যাবে। পরে আর সেগুলো অবিকৃত দশায় খুঁজে পাওয়া নাও যেতে পারে। পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে জরিপ করার সময়, প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করার সময়, নথিভুক্ত করার সময় আর সর্বোপরি প্রতিবেদন লেখার সময় আমি বিশদ বা ডিটেলের প্রতি মনোযোগী থাকার চেষ্টা করি। যা যে পরিপ্রেক্ষিতে দেখছি-পাচ্ছি-পর্যবেক্ষণ করছি-সংগ্রহ করছি তা যতটা সাধ্যে কুলায় ততটাই বিশদভাবে নথিভুক্ত করার চেষ্টা করা দরকার বলে মনে করি। আপাতত অপ্রাসঙ্গিক মনে মনে হওয়া আলামতও ভবিষ্যৎে কারো গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রত্নতত্ত্বে মাঠে ও গবেষণাগারে কিংবা মহাফেজখানায় কাজ করার আগে থেকেই শুরু হয়। আপনি যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে আপনি কোনো একটি বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতে চান, কোনো একটি জায়গায় জরিপ বা খনন করতে চান, কোনো বিশেষ নথি নিয়ে গবেষণা করতে চান তখনই আপনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজ শুরু করে দেন। কাজ শুরুর সিদ্ধান্তই ব্যাখ্যামূলক। সবসময় অাদর্শ অনুসারে বা টেক্সটবুক অনুসারে পদ্ধতি অনুসরণ করা অসম্ভব। তাই আপনাকে আপনার গবেষণার পদ্ধতিকে পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে। সবশেষে, পদ্ধতেতে যতই বদল বা পরিবর্তন আনেন না কেন, অাপনাকে কাজের ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, শারীরিক শ্রম, গভীর মনোনিবেশ, ধৈর্য্য আর উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে সততা বজায় রাখা নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
স. জাতীয়তাবাদ ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আপনার কাজ আছে। এই দুইয়ের সম্পর্ক নিয়ে আপনার চিন্তাভাবনা জানতে চাই।
এটা মজা করে উত্তর দেই। প্রত্নতত্ত্ব এমন একটি শাস্ত্র যার পাটাতনই হচ্ছে পরিচয়ের রাজনীতি। একভাবে বলতে গেলে। আধুনিক একটি শাস্ত্র হিসেবে উদ্ভবের পর থেকেই শাস্ত্র হিসেবে প্রত্নতত্ত্বকে নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে বার বার পরিচয়ের রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে। আপনি প্রশ্ন করলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব কেন পড়বেন? বা প্রত্নতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা কী’। এই প্রশ্নের সবচাইতে গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনগ্রাহ্য প্রতিষ্ঠিত উত্তরগুলো বর্তমানের পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি না-করে দেওয়া সম্ভব না। ‘শিকড়ের সন্ধান করা’, ‘জাতির অতীত গৌরব জানা, সমৃদ্ধি জানা’ কিংবা ‘আমরা কোথা থেকে, কীভাবে এলাম তা জানা, জাতিরাষ্ট্রের প্রাচীনত্ব ও আত্মপরিচয়ের প্রাচীনত্ব খোঁজা – এমন সকল দায়দায়িত্ব না নিয়ে শাস্ত্র হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে না। বেশিরভাগ প্রবণতাতেই। জাতির পরিচয় ও গৌরব, ধর্ম পরিচয়ের গৌরব ও প্রাচীনত্ব কিংবা জাতিসত্তার ইতিহাসের গৌরব ও অর্জন ইত্যাদি অনুসন্ধানের দাবি করে প্রত্নতত্ত্বর প্রবল ধারাগুলো টিকে থাকে, প্রসারিত হয়, প্রতিষ্ঠা পায়। আপনি সমসাময়িক জীবনে, উন্নয়নে ও রাষ্ট্রে প্রত্নতত্ত্বকে প্রাসঙ্গিক করে তোলেনই আত্মপরিচয় ও জাতীয় পরিচয়ের উৎস এবং সমৃদ্ধি প্রমাণের প্রকল্পের মাধ্যমে।
স. আপনার পিএইচডি গবেষণার বিষয় কী ছিলো? গবেষণা-জিজ্ঞাসা সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনার প্রস্তাবিত মত কী?
আমি দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাংশ ও জয়পুরহাট জেলার কিয়দংশ নিয়ে পিএইচডি করেছি। অনেক সময়ও লেগেছে নানা প্রতিকূলতা এবং গবেষণার ধরনের কারণে। প্রায় নয় বছর লেগেছে থিসিস শেষ করতে । প্রথম ৩ বছর তো অর্থাভাবে মাঠের কোনো কাজ শুরুই করতে পারি নাই। আমার দুই গবেষণাতত্ত্বাবধায়ক – অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহছান ও অধ্যাপক জ্যাঁ ফ্রাঁসোয়া সালের সহযোগিতা এবং দেশে-বিদেশের বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতা ছাড়া আমি থিসিস শেষ করতে পারতাম না। আমার শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা ও যুক্ততা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আমি প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের পদ্ধতির বদলের ক্ষেত্রে কাজ করার, খননের পদ্ধতি ও নথিভুক্তকরণের পদ্ধতির ক্ষেত্রে বদল আনা আর জমির সঙ্গে মানুষের সংশ্লেষ ও বিজড়নকে বোঝার দিকে নজর দিয়েছিলাম। আমার সামনে বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অনুসরণ করার মতন উদাহরণযোগ্য কাজ খুব কমই ছিল। বাংলাদেশে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল নদীব্যবস্থা-জমির দশা-মানষের কর্মকাণ্ডকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে একটা রূপরেখা দাড়া করানোই প্রধান লক্ষ্য ছিল। এখনো ওই লক্ষ্যেই যতটুকু পারি কাজ করে যাচ্ছি।
স. যদি বলি, বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্বচর্চা মূলত জাতীয় ঐতিহ্য নির্মাণের মডেলেই কাজ করে যাচ্ছে, আপনার বক্তব্য কী হবে?
পুরোপুরি ঠিক হবে না। প্রবল চর্চার প্রবণতাটি অবশ্যই একটি অখণ্ড, অপরিবর্তনশীল কিংবা সমন্বয়বাদী রূপান্তরশীল জাতীয় ঐতিহ্যর মহাআখ্যানের মধ্যেই কাজ করছে। তাতে করে পদ্ধতি ও ধারণাগত প্রসঙ্গগুলো গৌন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের বিদ্যাচর্চার ঐতিহ্যগুলির সাপেক্ষে এবং এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্ত ও তার পরিপ্রেক্ষিতের সাপেক্ষে অতীত মানুষের যাপিত জীবন বোঝার চেষ্টা অবশ্যই প্রবল ধারাগুলোর মধ্যে পড়বে না। তবে আমরা একটি অখণ্ড, হাজার হাজার বছরের পুরানো, গৌরবোজ্জ্বল, বহুত্ববাদী মোটাদাগের জাতীয় ঐতিহ্যর নিরিখে বা পাটাতনে বা রূপরেখায় প্রত্নতত্ত্ব বিদ্যাটির অনুশীলন থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। আর দুনিয়ার সর্বত্র, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেভাবে পরিচয়বাদী রাজনীতি সহিংস ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছে তাতে বিকল্প আখ্যানগুলো তৈরি করার জন্য কাজ করাও জরুরি। একটা সমসত্ত্ব মানবগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশ খোঁজা, সেই গোষ্ঠীর সম্প্রদায়গত, আঞ্চলিক বা জাতীয় পরিচয়ের শ্রেষ্ঠত্ব খোঁজার প্রকল্প ও তৎপরতাগুলোকে প্রশ্ন করাও এখন অনেক বড় বৈপ্লবিক দায়। আমরা এখনো খুঁজছি পরিপ্রেক্ষিতের জন্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ও সেুগুলোর বিভিন্ন উত্তর।
স. জাতীয়তাবাদী ইতিহাস নির্মাণের বাইরে বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার বিকল্প কোনো ধারা আছে কি? এ-ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আগের প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা ধারণা পাবেন। যেমন এঅঞ্চলে নদী ও প্রতিবেশের প্রত্নতত্ত্ব চর্চা নিয়ে আমরা যতটুকু, সামন্য কাজই এখন অব্দি করেছি তা জাতীয়তাবাদী ইতিহাস উৎপাদনের প্রবল রূপরেখার বাইরে। ধর্মর প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন ও সমস্যগুলো চিহ্নিত করেছি সেগুলোও এই রূপরেখার বাইরে। ভালো জাতীয়তাবাদ আর মন্দ জাতীয়তাবাদের দ্বৈততা বলতে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। অনেক প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ঐতিহাসিক-প্রত্নতত্ত্ববিদ অনুমান করেন যে, জাতীয়তাবাদ মুক্তিদায়ী হতে পারে, ইতিবাচক হতে পারে। হয়ত পারে। তবে জাতীয়তাবাদ সারসত্তাগতভাবেই এককেন্দ্রীক, সমসত্ত্বকরণকারী, পুরুষতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার সকল সম্ভাবনা ধারণ করে। আপনি চাইলেও জাতীয়তাবাদের এই সারসত্তাগত বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিতে পারবেন না। তাই বিদ্যাগত ও প্রত্নতত্ত্ব-সমাজবিদ্যা-ইতিহাস-ভূবিজ্ঞানের যৌথতায় প্রতিনিয়ত পরিচয়বাদী, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা, চর্চা ও চিন্তাকে প্রশ্ন করতে থাকার চেষ্টা আমরা করি। কতটা পারি তা জানি না।
স. ‘‘এক্সচেইঞ্জ অফ নলেজ’’ — বাংলাদেশে এটি ঘটে না কেন? বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকরা বিজ্ঞানের বাইরে জ্ঞানের অপরাপর অঞ্চলে চোখ রাখতে চান না। আবার সাহিত্যের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকরা বিজ্ঞানের ভুবনে পা মাড়াতে চান না। সমাজবিজ্ঞান ও সাহিত্য অধ্যয়নের সম্পর্কও অনেকটা গৌণ হয়ে আছে। অথচ পুরনো সভ্যতার কথা ভেবে দেখেন, একজন প্লেটো, সক্রেটিসের আগ্রহের ক্ষেত্র কতো বিচিত্র পরিসরে…. এই বিষয়গুলো নিয়ে আপনি কী ভাবেন?
যদিও আমরা বহুশাস্ত্রীয়, আন্তঃশাস্ত্রীয় কিংবা অধুনা শাস্ত্রান্তরী নামক পদাবলি শুনতে থাকি, কিন্তু বাস্তবতা হলো কিছু কৌশল বা পদ্ধতির প্রয়োগ ছাড়া এক শাস্ত্রের সঙ্গে আরেক শাস্ত্রের কোনো ফলপ্রসু সংলাপের ক্ষেত্র আমাদের দেশে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়াতেই তৈরি হয় নাই। হালে কাজ করতে গিয়ে এই দশা হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। সকলের বহুশাস্ত্রীয় বা আন্তশাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসরণ করার দাবি করছেন। কারণ সেটা বাজারের চাহিদা। কিন্তু যিনি বিজ্ঞান করছেন তিনি বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্ব, বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও প্রযুক্তির ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না বক্তব্যে ও লেখালিখিতে। যিনি সমাজবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি প্রাক-ঔপনিবেশিক সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রতিবেশগত-অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে ভাসাভাসা ধারণা নিয়েই সন্তুষ্ট।
আইকন উৎপাদনে আমরা খুবই পারঙ্গম। যে টেক্সটুয়াল বা লিখিত উৎস নির্ভর ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করছেন, তিনি প্রত্নতত্ত্ব মাঠকর্মভিত্তিক উপাত্ত, পদ্ধতি ও চিন্তা নিয়ে আগ্রহী নন। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্যে আত্মতুষ্টি ও অন্য বিষয় বা পদ্ধতির প্রতি তাচ্ছিল্য করার ঐতিহ্য তৈরি করা হয়। যে রাজরাজার ইতিহাস বা নোটবই সুলভ ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ব পড়ছেন ও অনুশীলন করছেন, সামাজিক ইতিহাস লিখছেন বা পড়ছেন, তিনিও বৈজ্ঞানিক কৌশল প্রয়োগ করে প্রাপ্ত উপাত্ত ব্যবহার করছেন পদ্ধতিটির ধারণাগত দিকটি না বুঝেই। আমাদের এখানে যেহেতু শাস্ত্র হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস লেপ্টালেপ্টি করে বিকশিত হয়ে সেহেতু সংকটটা অনুমেয়। প্রাক-আধুনিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা গবেষকগণ প্রত্নতত্ত্বে তত্ত্বীয় ও পদ্ধতিগত পাটতনগুলো নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ধারণা রাখেন নাই। অনেক বিজ্ঞানবাদী প্রত্নতত্ত্ব অনুশীলনকারীগণই আবার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আলাপচারিতে আগ্রহী নন। প্রতিটি ক্ষেত্রের গবেষকগণ তার নিজের ক্ষেত্রে একমাত্র শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট মনে ধরে নেন। নাক-উঁচু একটা দম্ভ নিয়ে চলাফেরা করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক যে ঐতিহ্যর দাপট চলছে তাতে করে যতই শাস্ত্রগুলোর মধ্যে আদানপ্রদান বা সংলাপের কথা আমরা বলি না কেন, ফলপ্রসু ও কার্যকর যোগাযোগ তৈরি হওয়ার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নাই।
স. বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্বচর্চা ডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচে কোনো অভিনবত্ব দেখাতে পেরেছে? আপনার কী মত?
অভিনবত্ব দেখাতেই হবে এমন কোনো কারণ নাই। বরং অভিনবত্বের বাসনা বিপজ্জনক হতে পারে। আপনাকে তাড়িত করতে পারে বিরাট, প্রাচীনতম, একমাত্র, অনন্য কোনোকিছু আবিষ্কারে। প্রবল ধারার বাইরে গিয়ে পরিচালিত প্রত্নতত্ত্ব চর্চার কথা যদি বলেন তাহলে কিছু প্রচেষ্টা হচ্ছে। নদীব্যবস্থার প্রত্নতত্ত্ব, ভূমিরূপের প্রত্নতত্ত্ব, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্তের প্রকৃতি ও পরিপ্রেক্ষিতকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতি তৈরি করার। জানি না কতটা সফল হওয়া যাবে। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী।
স. যাঁরা প্রত্নতত্ত্ব পড়তে আসেন, তাঁদের পেশাগত ভবিষ্যত বিষয়ে আপনারা কী ভাবেন? নাকি, মনে করেন, নিজের খেয়ে যারা বনের মোষ তাড়াতে চায়, প্রত্নতত্ত্ব তাদের বিষয়?
শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি চাকরি খুঁজে দেওয়া আমার কাজ না। দেশের পেশার জগৎ অনুসারে আমার শিক্ষার্থীকে পথ দেখাতে হবে তাও আমি মনে করি না। তবে একজন চিন্তাশীল, প্রশ্নাতুর ও নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে পথ দেখানো, ভাবানোকে আমি শিক্ষক হিসেবে, প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে আমার দায়িত্ব বলে মনে করি। ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুসারে শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি। সফলভাবে করতে পারি সবসময় তা না। আমি মনে করি, এতে করে একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন পেশায় কাজ করতে সমর্থ হবে। আর একজন শিক্ষক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে আমি কামনা করতে থাকি যে, আমার শিক্ষার্থীরা যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পরে প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করতে পারেন। যদিও আমাদের দেশে, অন্যান্য বহু দেশের মতনই, পেশা হিসেবে প্রত্নতত্ত্বকে বেঁছে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয় নাই। আমরা চেষ্টা করে যেতে পারি।
স. বাংলাদেশের ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতত্ত্বের ভূমিকা কী? প্রত্নবস্তু, প্রত্নসম্পদ, প্রত্ন সংস্কৃতি — বাংলাদেশের কোন ধরনের সাংস্কৃতিক অতীতকে প্রতিষ্ঠিত করে? যদিও জানি যে, সমস্বরিক অতীত বলতে কিছু নেই। তবু জিজ্ঞেস করতে চাই : বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অতীতের বৈশিষ্ট্যগুলো কী?
এই প্রশ্নের জবার দেওয়া সবচাইতে কঠিন। একদিকে সংস্কৃতির কোনো গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিতে আমি আগ্রহী না। খুঁজতেও আগ্রহী না। আমি আগ্রহী অতীতে মানুষ ও তার যাপনের ধারাবাহিকতা ও ব্যত্যয়গুলো চিহ্নিত করতে, ও বুঝতে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অতীত প্রসঙ্গে কোনো বক্তব্য দেওয়ার মতন যোগ্যতা ও বিদ্যা আমার নাই।
স. প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
নদীর প্রত্নতত্ত্ব, জমির প্রত্নতত্ত্ব, মানুষের নানামুখী যাপনের ধরন ও প্রক্রিয়াগুলোকে বোঝার চেষ্টা করা প্রত্নতাত্ত্বিক উপাত্তের মাধ্যমে। প্রতিবেশের প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করার চেষ্টা করা। অন্যদিকে, হেরিটেজ, অতীত ও প্রত্নতত্ত্বকে চিন্তা ও রাজনীতি নিয়ে প্রত্যক্ষণগত বা এমপিরিকাল উপাত্ত ও গবেষণাভিত্তিক কাজ করা। ব্যক্তিগত কাজের চাইতে সামষ্টিক গবেষণার বেশি করে যুক্ত হওয়া। তাতে করে গবেষণার পদ্ধতিতে বহুত্ব বা বিবিধতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
আমাকে এমন ধরনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করাতে আমি একটু বিস্মিতই হয়েছি। কারণ আমি এমন কোনো বিরাট বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ হয়ে উঠি নাই। হওয়ার বাসনাও নাই। তবে মাঠেঘাটে কাজ করার চেষ্টা করতে থাকা প্রত্নতত্ত্বর একজন সামান্য শিক্ষার্থী হিসেব আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
স্বাধীন সেনের সঙ্গে সহজিয়ার অালাপচারতা ভালো লাগল।❤
চমৎকার দরকারী আলাপন।
চমৎকার! ভবিষ্যতে ” সহজিয়া” এর সহযাত্রী হবার আকাঙ্ক্ষা রইলো। নিরন্তর শুভকামন।
আলাপ ভালো লাগলো। স্বাধীন স্যারসহ জাতীয়বাদও বোঝা গেলো খানিকটা।
সহজিয়া অনেকে কিছুই সহজ করে খোলাসা করছে ইদানিং। শুভ কামনা সহজিয়ার জন্য।
ও হ্যাঁ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম পরিচয় উহ্য না রাখলে পাঠকের আগ্রহ আরও বাড়বে বলে মনে করি।
উনি কিন্তু বর্তমানে আমাদের শিক্ষক।