সমকালীন বিশ্বের ৫ জন ভাস্কর

ভাস্কর্য মূলত বস্তুর খেলা। বস্তুকে কেটে ছেটে গলিয়ে শিল্পবস্তুতে পরিণত করেন ভাস্কর। সঙ্গে থাকে তাঁর কল্পনার বিশাল পটভূমি। ভাস্কর্য বস্তুর হয়ে ওঠে বস্তুর শিল্পিত রূপ। বস্তু যেমন দখল করে থাকে দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা তেমনি ভাস্কর্য দখল করে নেয় বস্তুর তিন মাত্রা। এই শিল্পকে তাই বলা হয় ‘মেটেরিয়াল স্পেস’। প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে ভাস্কর্য নির্মাণের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ধর্মবোধ, শিল্পবোধ ও ক্ষমতাপ্রদর্শনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিল ভাস্কর্যকে।

ভাস্কর্য এক সময় ছিল প্রার্থনার বস্তু। পরম পূজনীয়। একালের ভাস্কর্য তা নয়। জনাকীর্ণ স্থানে, বাড়ির বসার ঘরে শোভা পাচ্ছে ভাস্কর্য। প্রকৃতির পটভূমিতে স্থাপন করা হচ্ছে ভাস্কর্য। যেতে যেতে কিছু দেখার মতো করে চলতি মানুষ দেখে নেয় বস্তুর রূপান্তরিত অবয়বকে। আদতে বস্তুটিকে দেখলে সংবেদনা তৈরি হয়। চিন্তার জানালাগুলো খুলে যায়। যেকোনো শিল্পের মতো ভাস্কর্য অনুভূতির অন্দরমহলে তোলে ঢেউ। ভেবে অবাক হতে হয় যে, একজন শিল্পী কতো ধরনের বস্তুকে বদলে দেন কল্পিত আর অসম্ভব হাতের স্পর্শে। পাথর, লোহা, ব্রোঞ্জ, স্টিল, রড, লবণ, চামড়া, কাপড় — কী নেই সেই তালিকায়!

জন গিবন
সমকালীন আইরিশ ভাস্কর জন গিবন যেমন ব্যবহার করেছেন পাইপ, রড, স্টিল, ঝালাই করা স্টিল, বোঞ্জ। নব্বইয়ের দশকে গিবন স্টিল দিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘কেইজ’ বা ‘খাঁচা শিরোনামের কিছু কাজ। তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে ছিল অন্তর্জগত বনাম বহির্জগত, শরীর বনাম আত্মার ধারণা। এছাড়া তিনি কাজ করেছেন প্রকৃতির বহুমুখিনতা বিষয়ে। একুশ শতকের প্রথম দশকে গিবন বেছে নিয়েছেন সায়েন্স-ফিকশন জাতীয় কল্পিত বিজ্ঞানবিশ্ব। জন গিবনের দর্শন, ‘কোনো কিছু নির্মাণ করা আসলে কোনো কাজ করা, আর কোনো কাজ করা মানে কোনো চিন্তা করা। আর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সকল উপাদান আছে চিন্তায়।’ কী চিন্তা দেয় খাঁচা? খাঁচার ভেতর অচিন পাখির? নাকি পাখির চারপাশে থাকা অচিন খাঁচার? গিবনের কাজ তাই স্পিরিচুয়ালিটির দিকে ধাবমান।

বিগিনিং, ১৯৯৫, জন গিবন                                                                                                   

জেমস সুর্লস
জেমস সুর্লস কাজ করেছেন কাঠ, ব্রোঞ্জ ও স্টিল দিয়ে। তাঁর কাজ আমাদের নিয়ে যায় প্রাচীন, বর্তমান ও ভবিষ্যতের দুনিয়ায়। সুর্লসের কাজের বিষয় : মানুষ ও পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্ক। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কী খুঁজছেন আপনি? জবাবে তিনি বলেন, আমি আমার ব্যক্তিকতাকে শিল্প থেকে আলাদা করতে পারি না। শিল্পের ভেতর দিয়ে সুর্লস আসলে নিজেকেই খোঁজেন। চমৎকার শিরোনাম তাঁর কাজের : This Place, Everywhere। হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনোখানে — এই অনুভূতি নয়। জেমস সুর্লস দেন ‘‘সবখানে’’ থাকার অনুভূতি। ‘‘প্যাশন’’ নামক কাজটির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, প্যাশন যেন একেকটা ফুল, একেকটা ঘূর্ণি। ফুলের তৈরি ঘূর্ণি আমাদের কল্পনার ঊর্ধ্বে। সুফিরা যেমন ঘূর্ণন ও ধ্যানের ভেতর দিয়ে নিজেকে খোঁজেন সুর্লস যেন তারই একটি মাত্রা দেখিয়েছেন ফুলের মতো সাজানো ঘূর্ণিগুলোতে।

প্যাশন, ২০১২, জেমস সুর্লস                                                                                                

আনা রিডিং
ব্রিটিশ ভাস্কর আনা রিডিং। পুরস্কার প্রাপ্ত এই শিল্পী জৈব ও অজৈব দুই ধরনের বস্তুকে কাজে লাগিয়েছেন শিল্পবস্তু তৈরিতে। যেমন ‘ফাউন্ড নামের একটি কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন কাঠ, ফেনা, নুড়ি পাথর, গ্লস, ঝিনুকের খোলস ইত্যাদি। এই কাজটিতে মনে হচ্ছে বস্তু যেন চিন্তিত। একটি অদ্ভুত ভাবুক চোখ মেলে তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে। দর্শকের শিউরে ওঠার কথা। কারণ আমরা মূলত বস্তুর জড়ত্বকে চিন্তার কেন্দ্রে রেখে বিশ্বকে ভাবি। রিডিং দেখাচ্ছেন জড় বস্তু যেন সচল এবং চিন্তিত। তাঁর কাজকে বলা যায় বস্তুর ভাবুকতা।

‘‘ফাউন্ড’’, ২০১২, আনা রিডিং                                                                                             

বেরলিন্দে দে ব্রুয়েকেরে
মানুষের যন্ত্রণা ও বাসনার শিল্পরূপ দান করেছেন বেরলিন্দে দে ব্রুয়েংকেরে। মোম, মেটাল, কাঠ, লবণ, লোহা, ব্রোঞ্জকে তিনি রূপান্তরিত করেছেন মানুষের মর্ম ও শরীরী যাতনার প্রকাশ রূপে। ২০০৮-এ তৈরি সৃষ্টি করা মার্থে নামক কাজে দেখা যাচ্ছে রক্তের আভা লেগে থাকা, ঝুলে পড়া জীর্ণশীর্ণ নারীর শরীর। মাথার দিকটায় ঝুলে আছে হাত এবং অন্যান্য অস্থি। দারুণ নাটকীয় ও বিভীষিকায় পূর্ণ তাঁর কাজ।

Aletheia নামের কাজ খুব সাড়া জাগিয়েছে। শব্দটির অর্থ ‘সত্য। মানুষের এক পিঠে বাসনা, অন্য পিঠে যাতনা Ñ এই সত্যের উপস্থাপনা ঘটেছে বেরলিন্দের কাজে। চামড়ার আড়তে দিয়ে তিনি দেখেছিলেন কসাইখানা থেকে নিয়ে এসে ছাড়ানো হয়েছে অজস্র চামড়া। ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। লবণ মাখানো হচ্ছে। মনে হচ্ছিল তিনি এক বিরাট যোনীর দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন তিনি যৌনভাবে দেখছেন সব। লোকেরা যখন চামড়ার গায়ে লবণ মাখাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল, এ যেন চরম পুলকের মুহূর্ত। তখনই তাঁর মনে এলো জীবন ও মৃত্যু, কামনা ও যাতনার প্রবল প্রভাব। মনে এলো মানুষের চূড়ান্ত আবেগের কথা Ñ যা কেবল পশুর কেবল পশুর সঙ্গে সম্পর্কিত করে না। তাঁর কাজ কাব্যিক নয়। বরং বাস্তবতার ভয়াবহ চিহ্নের সমষ্টি। তাই ত্বক, মাংস, লবণ, রক্ত মনে করিয়ে দেয় হিটলারের নাৎসি বাহিনির নির্মম নির্যাতনের কথা।

মার্থে, ২০০৮, বেরলিন্দে দে ব্রুয়েকেরে                                                                                                 

গুইলাউমে লেবলন
লেবলনের কাজকে সুনির্দিষ্ট স্বভাবের ভেতর আটকানো মুশকিল। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, বাস্তব ও পরাবাস্তবে ধূসর ও কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্টতা তাঁর কাজের বিষয়। আর তার সঙ্গে থাকে শক্তিশালী এবং মদির করে বস্তু। তাই তাঁর কাজ অনেক স্বপ্ন ও জাদুময়। শিল্পে তিনি ধরতে চান বস্তু ও বস্তুর প্রতিবেশের সম্পর্ক; এমন একটি ভাস্কর্যকেন্দ্রিক ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করতে চান যেন বস্তু ও পৃথিবীর সঙ্গে কাব্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন আমার কাজ প্রদর্শন করি, তখন আমি ওই স্থানে আমার কাজ দিয়ে একটা ল্যান্ডস্কেপ আঁকি, যাতে করে দর্শকরা সম্ভাবনাময় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কাজগুলোকে দেখতে ও বুঝতে পারে।’

লস্ট ফ্রেইন্ডস, ২০১৪, গুইলাউমে লেবলন

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here