এটা আমরা অনেকেই ভুল করি। মনে করি, শব্দের অর্থ আছে। শব্দের সংজ্ঞা হিসেবে শিখি, এক বা একাধিক বর্ণ মিলে যখন অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে শব্দ বলে। কিন্তু আদৌ কি শব্দের অর্থ আছে?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এই ভুল করেছেন। ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত ব্যাকরণ কৌমুদীতে লিখেছেন: ‘অর্থযুক্ত বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে শব্দ বলে।’ আরও আগে ১৮৩৩ সালে প্রকাশিত গৌড়ীয় ব্যাকরণে রামমোহন রায় লিখেছেন: ‘অর্থ বোধক শব্দকে পদ কহা যায়।’ রায় মহাশয় সরাসরি শব্দের সংজ্ঞা এড়িয়ে গেছেন। তবে তিনিও শব্দের সাথে অর্থের সম্পর্ক আছে বলে মনে করেছেন।
বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ডের নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে লেখা আছে: ‘এক বা একাধিক ধ্বনির অর্থবোধক সম্মিলনে শব্দ তৈরি হয়।’ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাঙ্গালা ব্যাকরণে (১৯৩৬) লিখেছেন: ‘অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ বলে।’ প্রায় সবাই শব্দের সাথে অর্থের সম্পর্ককে প্রধান করেছেন। ফলে এগুলো শব্দের যথাযথ সংজ্ঞা হয়নি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ দিক থেকে ভালো বলেছেন। ভাষা–প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে (১৯৩৯) লিখেছেন: ‘বিশেষ বা স্বতন্ত্র পদার্থ বা ভাবকে প্রকাশ করে, মানব-মুখ-নিঃসৃত এমন একটা ধ্বনিকে বা ধ্বনির সমষ্টিকে (কিংবা তদ্রূপ ধ্বনি বা ধ্বনি-সমষ্টির লিখিত রূপকে) শব্দ বলে।’
ধ্বনি বা বর্ণের সমন্বয়ে শব্দ তৈরি হয়, ঠিক আছে। কিন্তু শব্দের সাথে অর্থের সম্পর্ক নেই। প্লেটো তাঁর Cratylus সংলাপে লিখেছেন, ভাষার শব্দ হচ্ছে দ্যোতক। আর ওই শব্দ দিয়ে যে-বস্তুকে নির্দেশ করা হয় সেটি দ্যোতিত। যেমন, ‘কলম’ শব্দটি দ্যোতক। আর কলম বললে যে-বস্তুটি বোঝানো হয়, সেটি দ্যোতিত। দ্যোতক আর দ্যোতিতের সম্পর্কটি একেবারেই আরোপিত। অর্থাৎ ক-ল-ম মিলে আমরা কলম বললে সাধারণভাবে লেখার উপকরণ বুঝে থাকি। গো-লা-প মিলে গোলাপ বললে কোনো ফুলকে বুঝে নিই। আসলে ধ্বনিসমষ্টির বা শব্দের অর্থ নেই; ওই ধ্বনিসমষ্টি দিয়ে কোনো কিছুকে বুঝিয়ে থাকি মাত্র।
গোলাপকে আমরা গোলাপ বলি বলেই এর নাম ‘গোলাপ’। গোলাপের নামকরণ গরু করা হলে গোলাপকে আমরা ‘গরু’ বলেই ডাকতাম। এখন ‘গোলাপ’ উচ্চারণের সাথে সাথে যে ব্যাপারগুলো ঘটে, তখন ‘গরু’ উচ্চারণের সাথে সাথে সেই ব্যাপারগুলোই ঘটত। বস্তুর সাথে শব্দের সম্পর্ককে ‘সত্য’ বলে আমাদের মস্তিষ্ক স্বীকার করে নিয়েছে। ফলে একটি শব্দ কানে শোনার বা চোখে দেখার পর আমাদের মস্তিষ্ক এর একটি ছবি তৈরি করে। এমনকি কোনো রকম ছবি তৈরি না করেও একে বুঝে নিতে পারে। ভাষিক যোগাযোগের এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা। আমাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টিকে অর্থময় বলে মেনে নিয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে শিশু কিছু শব্দ শেখে। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো বস্তুর সঙ্গে সে পরিচিত হয় ধ্বনিসমষ্টির দ্বারা। যেমন, ‘টেবিল’ শব্দটি কানে শোনার সাথে সাথে সে দৃশ্যমান টেবিলের সাথেও পরিচিত হয়। এরপর সে যে-কোনো টেবিলকে ‘টেবিল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। কিছু উপাদান আবার দৃশ্যমান নয়; যেমন : অভিমান, বেদনা। আবার কিছু শব্দ কাজকে বোঝায়; যেমন : খাওয়া, বসা। সব ধরনের শব্দকেই মানুষ শিশুকাল থেকে দ্যোতক ও দ্যোতিতের সম্পর্কে সম্পর্কিত করতে শিখতে থাকে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধ্বনি বা বর্ণ অর্থহীন; আর ধ্বনিসমষ্টি বা বর্ণসমষ্টিও অর্থহীন। কোনো নির্দিষ্ট ভাষার মানুষ ধ্বনিসমষ্টির বা শব্দের একটি অর্থ ধরে নেয় মাত্র। মানুষের ধারণায় এক শব্দের একাধিক অর্থও থাকতে পারে। যেমন, ‘বাড়ি’ বলতে ঘর বোঝায়। ‘বাড়ি’ বলতে আঘাতও বোঝাতে পারে। আবার শব্দের যে অর্থ, তা বাক্যের পর্যায়ে গিয়ে পালটে যেতে পারে। ‘তার হাত ভেঙেছে’ বললে হাতের যে অর্থ হয়, ‘তার হাতে অনেক কাজ’ বললে হাতের আর সেই অর্থ থাকে না। বাক্যের পর্যায়ে গিয়ে হাতের আরও অনেক রকম অর্থ তৈরি হতে পারে। শেষ পর্যন্ত বাক্যের পর্যায়ে গিয়ে শব্দের অর্থ স্থিত হয়।