প্রথম কিস্তি
হঠাৎ করেই পিরিয়ড শুরু হল। এই এক ঝামেলা। হিসাবে আরও তিন-চার দিন পরে হওয়ার কথা। রাস্তা-ঘাটে শুরু হলে অবশ্য বিরক্তটা বেশি লাগে। অসুবিধা তেমন না। নিজের কাছেই কেমন গা ঘিনঘিন লাগে। বাইরে থাকলে সবসময় চেঞ্জটেঞ্জ করার পরিস্থিতিও থাকে না।
শ্যাম্পুর সঙ্গে আরও কী কী মিশিয়ে প্যাকেটের-দুধ বানিয়ে বিক্রি করছে। কী জঘন্য বিষয়! মানুষের মধ্যে এই ন্যুনতম ইথিক্সও যদি না-থাকে! তাহলে কীভাবে কী! কিছুদিন আগে একটা নিউজে দেখলাম, চীনে বাচ্চাদের গুঁড়া-দুধে ক্ষতিকর মেলামাইন পাওয়া গেছে। যারা জড়িত ছিল – সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি। এইরকম শাস্তিই হওয়া উচিত। নয়তো শিক্ষা হবে না। মানুষের খাবার-জিনিসে কীভাবে এসব বিষ মেশায় লোকগুলো! তরমুজের ভেতরে সিরিঞ্জ দিয়ে রঙ ঢুকায়। যাতে লাল দেখায়। এসব দেখলে কোনোকিছু মুখে দেওয়ার আর রুচি থাকে না। বাবা তো একরকম ফল কেনাই বাদ দিয়েছে। ফল কেন, এখন দেখছি কোনোকিছুই দুই-নম্বর হতে বাকি নেই।
প্যাড গতমাসেরই কয়েকটা থাকার কথা। তিনটা আছে। বাথরুমে ঢুকে প্রথমেই চোখ যায় আয়নায়। ক্লান্ত দেখাচ্ছে! খুব খুটিয়ে খুটিয়ে নিজেকে দেখতে আমার ভালো লাগে। সবসময়ই ভালো লাগে। চোখের নিচটা কি এখনো কালোই হয়ে আছে! খুব একটা বোঝা যায় না। বোঝা গেলে, মা বলত। এমনিতে আমি খুব ফর্সা না। ছেলে হলে শ্যামলা হতাম। মেয়ে বলে ফর্সা লাগে। ছোটোবেলা নাকি একটু কালোই ছিলাম। তবে মুখটা এখন কিন্তু ফর্সাই দেখায়। আবার মুখটা যেমন ফর্সা, গা-টা তেমন নয়।
তেলাপোকা-মারার-পাওডার দিয়ে রাখতে হবে। ক্ষুদি ক্ষুদি কয়েকটা তেলাপোকার বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। শুকনা সাদা টাইলসে ঘুরে বেড়াচ্ছে আপন মনে। পায়ের কাছে আসতেই জুতা দিয়ে পিষে দিলাম একটাকে। ইশ! এখন আবার পা-ধোও। শোঁ শোঁ করে বাথরুমের ফ্ল্যাশটা অল্প সময়েই পানি রিকোভার করে নিল। এই শোঁ শোঁ শব্দটা আমার ভালো লাগে না। অস্থির লাগে। এই একটা জিনিসই কেবল আমার অস্থিরতার দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে আমাকে। মনে হচ্ছে আয়নার আরও কাছে গিয়ে নিজেকে একটা চুমু দেই। অনেকক্ষণ ধরে চুমু দেই। মাঝে মাঝে ভাবি, এটা নিশ্চিৎ পাগলামি! আমারই কি কেবল এমন ইচ্ছা হয়! নাকি সব মেয়েরই! নিজেকে কার না ভালো লাগে। যদি ছেলে হতাম, আমার মতন একটা মেয়ের জন্য নিশ্চিৎ পাগল থাকতাম আমি।
তলপেটটা কি মোচড়াতে শুরু করল! কাল আবার অফিস। উঠতে হবে সকাল সকাল। বাজছে একটা চুয়ান্ন। ঘুমাতে ঘুমাতে বাজবে আড়াইটা। এভাবে রাতের ঘুমটা আসলে হয় না। সকালে উঠতে খুব কষ্ট হয়। টানা আট-নয় ঘণ্টা না-ঘুমালে কি পোষায়! এলার্ম দিয়ে রাখলাম সাড়ে ছয়টায় আর ছয়টা পঁয়তাল্লিশে।
ফোন ব্যবহার করার জন্যই কিনা জানি না, ঘুমাতে চাইলেও আর ঘুম আসে না। সেই বারোটা থেকে বিছানায়। ঘুম তো আসেই না পঙ্গপালের মত রাজ্যের যত চিন্তা আসে তেড়েফুঁড়ে। কী আশ্চর্য শোভন নামটা এখন কত পানসে আমার কাছে। একটা কথা আছে না! ‘টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার’। কথাটা আসলেই সত্যি। কার কথা এটা! জানি না। আচ্ছা, ও যদি ওর খালাতো বোনকে বিয়ে না-করত। বিয়েই না-করত। আমি কি এত সহজে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারতাম! ছাতার মাথা! আমি আসলে কিছুই গুছাইনি। পরিস্থিতিই আমাকে এমন শেইপ দিয়েছে। এখানে নিজের কৃতিত্ব বলে কিছু নেই। তবে এটা ঠিক তাকে ছাড়াই আমার চলবে এমন ভাবনা আমার পক্ষে ভাবা সম্ভব হত না। তাহলে ও কীভাবে তা ভাবতে পারল! কীভাবে ওর সেই খালাতো বোনকেই বিয়ে করল সে।
বছরখানেক যাবৎ এই একটা বিষয়ই বিভিন্নভাবে ভেবে চলেছি আমি। এই একটা বিষয়ই আমার চিন্তাকে দখল করে রেখেছে। একটা ঘটনাকে যে কতভাবে ভাবা যায়! একটা ঘটনা কত আগ্রাসীভাবেই যে একজনের সমগ্র অস্তিত্ব দখল করতে পারে! আমি আসলে যতটা না ভাবি, তারচেয়ে বেশি অনুভব করি। এখানকার একেকটা শব্দ আমার কাছে মাইলের পর মাইল দৈর্ঘ্য নিয়ে রচিত।
শোভনের নাম্বারটা এখনও আমার মুখস্ত। এটাই হয়তো এখনো খোলা রেখেছে। এই কিছুদিন আগেও মনে হত ফোন করি। ফোন করে চুপ করে থাকি। শুনি কী বলে! অথবা ফোন করে বলি, আমি দিয়া। ভাবিকে একটু দেয়া যাবে? তার বউকে তো ভাবিই ডাকা উচিত। আমার নাম্বারও তার নিশ্চয়ই মুখস্ত। হয়তো ধরবে না।
চব্বিশটা ঘণ্টা ধরে এইসব চিন্তা আমাকে বল্লমের মত বিদ্ধ করেছে। অসুস্থ ছিলাম টানা একমাস। মার ধারণা ছিল অনিয়ম করে করে এই অসুখ বাঁধিয়েছি। ভাগ্যিস এ-ব্যাপারে তারা কিছু জানত না। অল্পতেই চোখে পানি চলে আসতো আমার। মনে মনে অপরাধবোধে ভুগতাম। বাবা-মার প্রতি সত্যিই আমি অন্যায় করেছি।
আমাদের অ্যাফেয়ারের কথা বাসায় জানাতে চেয়েছিলাম। শোভন মানা করেছিল। বলেছিল, এখনও সময় আসেনি। তখন ভাবতে পারিনি যে, এই সময়টা কোনোদিনও আসবে না। একদিক থেকে ভালোই হয়েছিল না-জানিয়ে।
কাল-পরশু থেকেই প্রচুর ব্লিডিং হবে। এই সময়গুলা খুব বিরক্তির। বিশেষ করে কর্মস্থলে। চোখে অফিসের বাথরুমটার ছবি ভেসে ওঠল। ভেন্টিলেটরের ফোঁকরে সবসময়ই পেটমোটা একটা অলস টিকটিকি বসে থাকে। চোখগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসা। প্রথমদিকে ভয় লাগত। এখন কেমন ঘেন্না লাগে। দুয়েকদিন হিশহিশ শব্দ করে দেখেছি। নড়াচড়া করে না। মানুষের মত বড় বড় চোখ করে তাকায়। পাশেই মনে হয় প্রেসট্রেস কিছু একটা হবে। অবিরাম ঘর্ঘর আওয়াজ আসে। অফিসের বাথরুমের সঙ্গে এই ঘর্ঘর আওয়াজটা এক সূত্রে গাঁথা। বাথরুমটাই যেন এক ঘর্ঘর আওয়াজ করা যন্ত্র। খুব অস্বস্তি লাগে। অদ্ভুত একটা ফিলিংস হয় আমার। মনে হয় যেন সকলের সামনেই পায়জামা খুলছি। খুবই বাজে একটা ফিলিংস। বাথরুম থেকে বের হতেও সবসময়ই এই অস্বস্তিটা আমার হয়। যেন ভেতর থেকে কোনো কুকাম করে বেরোচ্ছি মাত্র।
ঘর অন্ধকার। তলপেটে কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। হালকা। ডোবার পচা পানিতে যেমন কামড়ানি হয়, অনেকটা সেরকম। এই হালকা ভাবটা আরও জোরালো হবে। তখন মনে হবে, কেউ যেন শক্ত মুঠি দিয়ে পিষে যাচ্ছে অনবরত। পিরিয়ডের শুরুর দিনটা কিছুদিন আগেও একটা স্বস্তিদায়ক বার্তা বয়ে আনতো। এটি ছিল হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সংকেত। বেশিদিন নয়। এইতো বছর-দেড়েক আগেই।
২
সকালে উঠতেই যা কষ্ট। একবার উঠে পড়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে ফেললেই ঝরঝরা। সবচেয়ে ভালো লাগে জীবনের এই কর্মমুখর উত্তাপ। আটটায় তো পুরোই দিন। অফিসগামী মানুষের ভিড়, ঠেলা-ধাক্কা এসব আমার ভালোই লাগে। ঢাকায় বড় হয়েছি, এজন্যও হতে পারে। সকালে জ্যাম তুলনামূলক কমই থাকে।
ড্রাইভারের সিটের বাঁ-পাশে বেঞ্চের মত একটা জায়গা। অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে সচরাচর আমি সেখানেই বসি। গাড়ি চালাচ্ছে অল্পবয়সী একটা ছোকরা। অল্পবয়সী বলতে আমার চেয়ে ছোটো। হাবেভাবে কিন্তু ঝুনা। চোখেমুখে কেমন একটা পোড়খাওয়া ভাব। নেশাটেশা করে হয়ত। দাঁতগুলো কালো। মুখের চামড়ায় খাটুনির ছাপ। ড্রাইভারদের আমি খুব সম্মানের চোখে দেখি। খুব ছোটোবেলা থেকেই। কারণ জানি না। বাসের ভেতরে আলাদা একটা জগৎ। ড্রাইভার হল সেই জগতের রাজা। সেখানে কেমন একটা স্বায়ত্তশাসন চলে। আর সেই ব্যবস্থার প্রধান নির্বাহী হলেন ড্রাইভার স্বয়ং। হেল্পারদেরকেও দেখেছি, এই অর্ডারটা খুব মেনে চলে।
কোনো এক অজানা কারণে বাসে আমি খুব নিস্পৃহ আচরণ করি। আগে থেকেই। হাফ ভাড়া দিয়ে বলতাম, স্টুডেন্ট। হেল্পার বেশি তেড়িবেড়ি করলে বলতাম, যান আপনার ড্রাইভারকে গিয়ে বলেন। ‘এই রুটে নিয়মিত যাতায়াত করি। ভাড়া বেশি চান কেন! নতুন লোক পাইছেন নাকি।’ কথাগুলো দেখতাম কাজে আসে। হেল্পার চুপ করে যেত। বলতো, আফা, আপনের কথাও ঠিক আছে। আমরাও নিয়া গেছি। কিন্তুক ভাড়া এহন বাড়ছে।
এসব কথা মনে হলে এখন হাসি পায়। লজ্জাও লাগে। কখনো সত্যিই ড্রাইভারকে ডেকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতাম, ড্রাইভার সাহেব এই দেখেন বেশি ভাড়া চাচ্ছে। ড্রাইভার বলতো, ‘এই বাদ দে। আফা, কি করবো কন! দিন-কাল খারাপ। ব্যবসা নাই। ভাড়া বাড়ছে।’ কারো কারো আচরণ থাকত খিটখিটা। মুখ অন্ধকার করে বলত, ভাড়া ঠিকই চাইছে। আমিও খুব স্বাভাবিকভাবে তখন ফুল ভাড়াটাই দিতাম।
পেপারওয়ালারা বাসে পেপার নিয়ে উঠলেই জানতে ইচ্ছা হয়, আজকের শিরোনাম কী? এমনিতে আমার পেপার পড়ার অভ্যাস খুব একটা নেই। রাতে টিভি দেখার সময় দিনের বাসি নিউজ নাড়াচাড়া করে দেখি। সেটাকে পেপার পড়া বলে না। মাঝে মাঝে ভাবি নিয়মিত পড়া শুরু করব। চাকরি-বাকরির পরীক্ষায় অন্তত কাজে লাগবে। সামনে ৩৮-বিসিএসের প্রিলি। ডেট পড়ে নাই এখনো। কী হবে কে জানে! এর আগে তিন-চারটা প্রিলি দিয়েছি। হয় নাই। এবারও হবে না। পড়াশুনাই তো হচ্ছে না। হবে কীভাবে! এখানে জয়েন করার পর সব পড়াশোনাই গেছে। আগে হয়নি এক কারণে। এখন আরেক কারণ।
‘আফা, বাম পাও দিয়া নামেন।’
এমনিতেও বাঁ-পা দিয়েই নামি। অভ্যাসবসতই। ডান-পা দিয়ে আসলে নামা যায় না।
আজিমপুর নেমে কিছুটা হাঁটলেই অফিস। এটা একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। গাইড বই ছাপে। মূলত এখানে আমি একজন গাইড বই লেখক। পদ এক্সিকিউটিভ অফিসার। বাজারের অন্যান্য গাইড স্টাডি করে মূল টেক্সট বইয়ের আলোকে উত্তর লেখাই আমাদের কাজ। এই পদে আমরা মোট সাত জন। দুই জন আছেন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। ম্যানেজার একজন : জনাব মো. মনিরুজ্জামান পাটোয়ারী। এই দশজন, আর দুই জন ফাই-ফরমাশ খাটে। একজন সামাদ, আরেকজন ডাবলু ভাই।
মালিকের নাম জানি না। কারও জানার আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না। শুনেছি উনার আরো ব্যবসা আছে। পাটোয়ারী তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তলে তলে অবশ্য আরো অনেক কথা চলে। আসলে নাকি দূর সম্পর্কের নয়। মালিকের সে বোনজামাই। ছাত্রাবস্থায় মালিকের বোনকে প্রাইভেট পড়াত। ইংরেজি পড়াত। দর্শনের ছাত্র হয়েও পরিচয় দিয়েছিল নাকি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের। নীলক্ষেত থেকে বানিয়ে নিয়েছিল একটা ভুয়া আইডি। এই নাকি ঘটনা। টেবিলের তলা দিয়ে নিয়মমাফিক হাঁটু ঠেলাঠেলির এই হল ভবিষ্যৎ। ফাঁক পেলেই গল্প জমায় মোজাম্মেল। তার ভাষার কোনো লাগাম নেই। ‘শালা মেয়ে পটানোয় ওস্তাদ। এমন পানিপড়া খাইয়েছিল। মেয়ে তো পাটোয়ারীকে ছাড়া বাঁচে না অবস্থা। বিষ খাবে-খাবে ভাব। হাতের কাছে বিষ না পেয়ে তেলাপোকা মারার চক খেয়েছিল তিনটা। গুড়া করে দুধের সঙ্গে খেয়েছিল। চিরকুটে নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছিলো পাটোয়ারীর নাম। মালিকেরা তিন ভাই। ভাবল কি করা যায়! চেয়েছিল পুরোনো গাড়ির লোহালক্করের সঙ্গে বেঁধে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে।’ আমরা হাসতে হাসতে মরি। কারো মনেই প্রশ্ন আসে না, মোজাম্মেল এসব কোত্থেকে জানে! বোঝাই যায়, কিছু কথা তার বানানো। বানানো হলেও সবগুলো কথাকেই কেমন সত্যি বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। মোজাম্মেলের কাছেই শোনা, পাটোয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র। কিন্তু দর্শনের দ তো সে জানেই না। রেফটাও নাকি আয়ত্ত করতে পারেনি।
স্টাফদের পাটোয়ারী সহ্যই করতে পারে না। মোজাম্মেলের মতে, মুখটা সবসময় খেঁকশিয়ালের মত খেঁকিয়ে রাখে। হাসিমুখে কোনোদিন কেউ তাকে কথা বলতে দেখেনি। অবশ্য মেয়ে স্টাফদের সঙ্গে তার ব্যবহারকে খারাপ বলা যায় না। তবে পাক্কা পেশাদারী আচরণ তার। তেমনি অফিসেরও কেউ দু’চোখে দেখতে পারে না তাকে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দুইজন। একজন তার সাক্ষাৎ চেলা সামাদ। দ্বিতীয়জন বিভাস দা। ‘সামাদ পাটোয়ারীর ঔরসজাত। তার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। প্রথম পক্ষে যেহেতু তার কোনো সন্তানাদি ছিল না। তাই বাসার কাজের মহিলাটাকে গোপনে বিয়ে করেছিল পাটোয়ারী। শুরুতে লুকিয়ে চুরিয়ে ভরণপোষণ দিলেও, প্রথম পক্ষের চাপে, পরে আর খোঁজ নিত না। এ নিয়ে দেন দরবারও কম পোহাতে হয়নি তাকে। পাড়ার মাস্তানদের একলাখ, ঢাকেশ্বরীর ওসিকে মিষ্টি খেতে গুণে গুণে দিয়েছিল আরেক লাখ আর দেনমোহরের দুই লাখ টাকা দিয়ে তবে খালাস পেয়েছে সে। আর শর্ত ছিল ছেলেটার একটা গতি করে দিতে হবে। বাপ বাপ করে শালা রাজি হয়েছিল।’ – মোজাম্মেলের ভাষায় – ‘সামাদ যদিও জানে না, এই পাটোয়ারীই তার বাপ। তবু বাপ-ছেলের রক্তের টান বলে কথা।’
বিভাস দা’কে নিয়ে মোজাম্মেলের কোনো গল্প নেই। তিনি আমাদেরই লোক বলে নন। মনে হয় মোজাম্মেল তাকে পছন্দ করে। কেন করে জানি না। আমার অবশ্য উনাকে পছন্দ না। শুরু থেকেই না। তিনি একটু কেমন জানি। সবকিছুর মধ্যে থেকেও নেই। এরকম সুবিধাবাদী লোক আমার একদম অপছন্দ। অবশ্য খুব একটা যে সুবিধা পান, তা-ও নয়। পাটোয়ারী সুবিধা দেওয়ার লোক না। বিভাস দা’ হয়তো সুবিধা নিতেও চায় না। মাঝে মাঝে তো বরং উল্টাই মনে হয়। মনে হয়, পাটোয়ারী তাকেই বেশি অপছন্দ করে। কিন্তু তিনি ভাবলেশহীন।
উনার এই সবকিছু উড়িয়ে দেওয়া স্বভাবটার জন্যই আমার গা জ্বলে। কিন্তু উনাকে শেখানোর চাকরি তো আমি নেইনি। আসলে কারো ওপর রাগ করার জন্য যে মেরুদ- লাগে বিভাস দা’র তা নেই। হয়তো এই জন্যই শুরু থেকেই তাকে আমার অপছন্দ।
আমাদের সাতজনের মধ্যে বিভাস দা’ই সিনিয়র। মোজাম্মেল, আমি আর নীলা নামের একজন মেয়ে একসঙ্গে জয়েন করি। আমরা তিনজনই ছিলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটির। একই সেশন। মোজাম্মেলকে তাই তুমি বলি। নীলার সঙ্গেও ভালো ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেছিল আমার। ৩৫তম বিসিএসে নীলার সমবায় ক্যাডারে হয়। পরে চাকরি ছেড়ে চলে যায়। এখানে অবশ্য কেউই বেশিদিন থাকে না। নীলা চলে যাওয়ার পর আরো চারজন জয়েন করে। দুইজন মেয়ে ও দুইজন ছেলে। মেয়ে দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। জেসমিন দি’ আর শান্তা আপু। ইমরান আর মাজহার ভাই জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির।
দুপুরের খাবার আমরা একসঙ্গেই খাই। খাবারের ব্যবস্থা অফিস থেকেই করে। বিভাস দা’ও সম্ভবত একত্রে খেতেই পছন্দ করেন। অন্যান্য ব্যাপারে উনার একটা উন্নাসিক ভাব থাকলেও খাওয়া-দাওয়ার পর্বে উনাকে বেশ স্বতঃস্ফূর্তই দেখা যায়। খাবার ও নামাজের বিরতির এই ঘণ্টাখানেক সময় কেমন চোখের পলকেই কেটে যায়। ভালোই লাগে।
৩
মোজাম্মেল ছেলেটা স্মার্ট। এখন পর্যন্ত তার একটাই দোষ। চাপা মারতে মারতে যেকোনো পর্যায়ে নেমে যায়। ভদ্রতার ধার ধারে না। যে-কারো কাহিনি তার জানা। তার ব্যাপারে আমি সাধু সাবধান। পার্সোনাল কিছু মোটেই শেয়ার করি না। তবু শোভনের বিষয়টা সে জানে। আমিই বলেছিলাম। বলেছিলাম। যতটুকু না-বললে আসলে হয় না। বলেছিলাম, ‘আগে একটা অ্যাফেয়ারের মত ছিল। এখন নেই। এই হালকা-পাতলা অ্যাফেয়ার আরকি। আমিই কন্টিনিউ করিনি। অ্যাটিচ্যুড পছন্দ হয়নি। এখন বোধহয় বিয়েও করে ফেলেছে’। আমি আমার মতন বলেছিলাম। মোজাম্মেল হয়তো তার মত করেই বুঝেছিল।
অফিস থেকে ফেরার পথে কি-এক প্রসঙ্গে একদিন বলছিল, ‘এই যুগে অ্যাফেয়ার মানেই সেক্সুয়াল রিলেশন। তা এক সপ্তাহের অ্যাফেয়ার হলেও।’ আমার বুকটা তখন ধক করে ওঠেছিল। কোনো কথা বলতে পারিনি দীর্ঘক্ষণ। কথা অবশ্য হচ্ছিল ভিন্ন কোনো বিষয়ে। পরে প্রসঙ্গ পাল্টে আমিই ভিন্ন আলাপ তুলি। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, আমার সম্পর্কে মোজাম্মেল কী ভাবে। আমাকে সে কেমন মেয়ে মনে করে!
আমার সঙ্গে সময় কাটাতে নিশ্চয় তার ভালো লাগে। তা না-বোঝার কিছু নেই। আমি বুঝতে পারি। তার কথাগুলো সবসময় কেমন কনভিন্সিং হয়। তার মানে আমাকে সে কনভিন্স করতে চায়। পছন্দ করে বলেই তো চায়। পছন্দ না করলে তো চাইতো না। তার সঙ্গে আমি মিশি অন্য কারণে। তার অ্যাফেয়ার আছে। তাদেরই ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়রের সঙ্গে। নাম জলী। ফেসবুকে আমার সঙ্গে আছে। কিউট একটা মেয়ে। ধনীর দুলালী টাইপ। একটু স্থূল এই যা। সুতরাং তার সঙ্গে আজাইড়া ঝামেলার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মোজাম্মেলের সঙ্গ আমার ভালো লাগে। সম্পর্কচর্চার ক্ষেত্রে সে খুবই স্মার্ট। উল্টাপাল্টা কিছু এখনো চোখে পড়েনি।
সম্পর্কটি নির্ভার বলেই হয়তো ভালো লাগে। কারো উপর কারো অধিকার নেই! কোনো অধিকার নেই! সেই অধিকার ফলানোর কোনো ব্যাপারও নেই। নেই কোনো এক্সপেকটেশন। এই ধরণের নির্ভার বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো তো ভালো হবেই। এই ভালোলাগার কথা তাকে বলিনি কখনো। বলার প্রশ্নই আসে না। ছেলেরা বুঝতে পারে কিনা জানি না। না বললেও মেয়েরা তা বুঝতে পারে।
বাইরে থেকে যে-কেউ দেখলে আমাদের কাপল মনে করা স্বাভাবিক। হোম-ইকোনমিক্সের গেট থেকে মোড়টা পার হতে গিয়ে একদিন হাত ধরল মোজাম্মেল। খুব স্বাভাবিকভাবে। প্রয়োজন ছিল বলেই ধরেছিল। গাড়ি আসতেছিল ডান পাশ থেকে। একে অপরের হাত ধরে দুটো গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমরা। যদিও পরে এ-নিয়ে কথা হয়নি কোনোদিন। হওয়ার দরকারও ছিল না।
মোজাম্মেলের কথার অনেকটা অংশ জুড়েই থাকে পাটোয়ারী। পাটোয়ারী অফিসের একমাত্র প্রকট চরিত্র। আমাদেরকে দিয়ে অতিরিক্ত খাটিয়ে নেয়াই যার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এর জন্য যে-কোনো কিছু সে করতে পারবে। অফিসে একটা বাজে পরিস্থিতি তার জন্যই বিরাজ করে। যে কাজটি আনন্দ নিয়ে করা যায় তার জন্য সে কাজটুকুই করতে হয় একরাশ বিরক্তি নিয়ে। বেতনের খোটা তো আছেই। মাসে বিশ থেকে বাইশ হাজার টাকা অবশ্য কম নয়। অবশ্য এজন্যই লোকে এই চাকরিটা করে। নয়তো, মোজাম্মেলের ভাষায়, পাটোয়ারীর মুখে জুতা মেরে চলে যেত সবাই।
শান্তা আপু আজকে নারকেল দিয়ে চিংড়ি রান্না করে নিয়ে এসেছিল। আটপিস চিংড়ি। নিয়ে এসেছে আমাদের সাতজনের কথা চিন্তা করেই। অফিসে আমাদের সাতজনেরই সমাজ। সিনিয়র এক্সিকিউটিভ দুইজন আলাদা বসেন। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। উনাদের কেন জানি, আমার কাছে, জীবনের ভারে ক্লান্ত মনে হয়। দুজনেই বেশ ভদ্রলোক। কাজের কথা ছাড়া কথাবার্তা কমই বলেন। দেখা হলেই হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করেন, ‘চাকরি-বাকরি কেমন লাগছে ইয়াং ম্যান!’ এই ইয়াং ম্যান-ম্যান করেন বলেই, উনাদের আমার, ওল্ড ম্যান মনে হয়। কেবল কারো জন্মদিনটিন থাকলে কেক কাটার সময় উনাদের দুইজনকে ডাকা হয়। হাসিমুখে আসেন। দুটো তালি দিয়ে চলে যান। প্রতিবার একই কথা থাকে উনাদের মুখে, ‘আগে জানলে তো একটা গিফট আনা যেত। এখন কী দেয়া যায়! বড়ই বিপদে পড়লাম তো!’ এই বলে সামাদকে দিয়ে পরে একটা কলম পাঠিয়ে দেন। যেন উনারা দুজন একজন মানুষই। নয়তো দুজনের স্বভাবই এত এক হয় কীভাবে!
‘আমি যে চিংড়ি খাই না আপু।’
‘আচ্ছা, তোরটা পাওনা থাকলো।’, এই কথা বলে বিভাস দা’কে দিলো দুই পিস। নিতে চাইলো না। একপ্রকার জোর করেই তুলে দিলো প্লেটে। আমি বসেছি শান্তা আপুর পাশেই। বিভাস দা’ বসেছিল অপর পাশে। টেবিলের এক পাশে ছেলেরা বসে। মেয়েরা বসে আরেক পাশে। অঘোষিত নিয়ম। দাঁড়িয়ে চিংড়ি তুলে দেওয়ার সময় খুব কাছ থেকে শান্তা আপুর নাভিটা আমার চোখে পড়ল। মেদযুক্ত সুন্দর ফর্সা পেট। নাভিটা সেখানে অবিকল এক গোলাপ কুঁড়ির মত মোচড় নিয়ে আছে। অথবা সেটিও খোসা ছাড়ানো ধবধবে এক জলজ্যান্ত চিংড়ি। আপুর শাড়ি থেকে ভুর ভুর করে পারফিউমের গন্ধ আসছিল। ফর এভার! আমার কেমন জানি ভালো লাগছিল না।
শান্তা আপু আর জেসমিনদি’ দুজনেই শাড়ি পড়ে আসেন। কদাচিৎ সালোয়ার কামিজ। দুজনেই বিবাহিত। হয়তো এজন্যই। কিন্তু বিয়ে হলেই যে সবাই শাড়ি পড়া শুরু করে তা নয়। ওকেশন ছাড়া ইদানিং আর কেউ শাড়ি পড়ে না। মেয়েদের জন্য শাড়ি অবশ্য অফিসিয়াল পোশাক। এজন্যও পড়তে পারেন। জেসমিন নাম শুনে যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু তিনি হিন্দু। জেসমিন সাহা। প্রথম প্রথম একটু অদ্ভুত শোনাত। উনার আরেকটা বিশেষ পরিচয় আছে। উনি কবি। উনার কবিনাম জেসমিন শুভ্রা। উনিই বলেছেন। এখানে অবশ্য উনার কবিতা-টবিতা নিয়ে কারো কোনো ইন্টারেস্ট আছে বলে মনে হয় না। হয়তো উনারও নেই। সারাক্ষণ কবিতা-কবিতা করেন না। কবি মার্কা ভাবও নেন না। এককথায়, উনি দুধভাত টাইপের। সবার সঙ্গেই ভালো খাতির। খুব প্রফেশনাল আচরণ করেন। ঘন করে সিঁদুর দিয়ে আসেন। টিপ পড়েন বড়সড়। জেসমিনদি’ কালো। কালো বলতে একদম কালো। কিন্তু অসাধারণ সুন্দরী তিনি। সাক্ষাৎ দেবী প্রতিমা। উনার মত সুন্দরী আমি দেখিনি। একজন কালো মানুষও যে এমন নজর কাড়া সুন্দরী হতে পারে, উনাকে না-দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। অথচ খুবই সাদাসিধা। তারপরও তার প্রতিটা সাধারণ ভঙ্গিমাই যেন নাচের একেকটি মুদ্রা।
শান্তা আপুর সুন্দর নাভিটাই কি আমার বিরক্ত হওয়ার একমাত্র কারণ! তার সৌন্দর্যে কি হিংসা হচ্ছিল আমার! বাথরুমে ঢুকে খুব মনোযোগ দিয়ে নাভিটা দেখলাম। সেখানটা এত ফর্সা না। আমি কি শুকিয়ে গেছি! হ্যাঁ, শুকিয়ে গেছি। ভেন্টিলেটরের ফোঁকর থেকে হা করে তাকিয়ে আছে টিকটিকিটা। ভেতরে সেঁধিয়ে আছে। মাথাটাই কেবল দেখা যাচ্ছে। পেপার দিয়ে মুড়িয়ে ব্যবহৃত প্যাডটা ঝুড়িতে ফেলে দিলাম। বাসা থেকে নিয়ে আসা পেপারটাতে কেমন একটা বাসামুখী আবেদন। মুখ থুবড়ে সেটা এখন পড়ে রইল ঝুড়িটাতে।
শান্তা আপু আর জেসমিন দি’বয়সে দুজনেই আমাদের সিনিয়র। ঢুকেছেন পরে। কে জানে কেন চাকরি করেন। চাকরি করার কত কারণই যে মানুষের থাকে! বিভাস দা’ উনাদের সমবয়সী। দু-এক সেশন আগে পরে হবে। বিভাস দা’র পার্সোনাল বিষয়ে কেউ তেমন কিছু জানে না। জানার আগ্রহও কারো নেই। মোজাম্মেলের কাছ থেকে যতটুকু জানা যায়। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স। বিয়ে-সাদি করেননি এখনো। মা মারা গেছেন তিন-চার বছর আগে। বাবাও নেই। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় মারা গিয়েছেন। এখন উনি আর উনার বড় বোন। বড়বোনই অভিভাবক। নাম শুনে যেমন জেসমিন দি’কে হিন্দু মনে হয় না। তেমনি বিভাস দা’কে হিন্দু মনে হলেও তিনি হিন্দু নন। পুরো নাম নিয়ামুল করিম বিভাস। অবশ্য উনাকে দেখেই হিন্দু হিন্দু লাগে। সবাই তাই ডাকে বিভাস দা’। শান্তা আপু আর জেসমিন দি’র সঙ্গে অল্পদিনেই উনার বেশ খাতির হয়ে গেছে। জেসমিন দি’র মধ্যে একটা সংসারী ভাব আছে। ভাব না, উনি আসলে পুরোদস্তুর একজন সংসারী মানুষই। ছেলে আছে একটা। থ্রি-তে পড়ে। পড়েছেন ঢাবির বাংলা বিভাগে। হাজব্যান্ড মোহাম্মদপুর লালমাটিয়া কলেজের লেকচারার। বিভাস দা’র সঙ্গে উনার মাখামাখির কারণটা আমি বুঝি না। শান্তা আপুর গদগদ ভাবটা বেশি থাকলেও জেসমিন দি’কেই উনার সঙ্গে বেশি দেখা যায়। ফাঁক পেলেই হল। কবিতা-টবিতা আরও কীসব নিয়ে দুজনে গুজুর-গাজুর গল্প জুড়ে দেবে। অন্য কারও উপস্থিতিতে, খুব চালাকির সঙ্গে, আস্তে আস্তে উনারা প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন। যাই ঘটুক, চা খেতে উনাদের একসঙ্গেই নিচে নামতে হবে। মাঝে মাঝে শান্তা আপুই বরং উপরে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়।
প্রায় প্রতিদিনই আমাকে বাসে তুলে দিয়ে তারপর বিদায় নেয় মোজাম্মেল। নীলক্ষেত পর্যন্ত আমরা হেঁটেই আসি। কোনোদিন বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারি। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বা নতুন কিছু আসছে-টাসছে নাকি, এসব খোঁজ করি। শুধু শুধু ঘুরতেও ভালো লাগে। নিউমার্কেটে ঢুকি। ফুটপাতে কাপড় দেখি। স্টুডেন্ট থাকতে ফুটপাত থেকেই আন্ডার গার্মেন্টস কিনতাম। এখন দোকান থেকে কিনি। খুব পছন্দ হয়ে গেলে অবশ্য ফুটপাত থেকেও কিনি। অফিসের ক্লান্তিকর কাজের বাইরে এই সময়টায় যা করি তাই ভালো লাগে।
বেশ ভিড়। জানালা ঘেঁষা কোনো সিট ফাঁকা নেই। বাঁ-পাশের দিকে একটা সিটে বসেছি। হাতের ডান দিকের সিট দুটিতে কাপল বসেছে একজোড়া। কেন জানি কাপলই মনে হল। ঢাকা শহরে কাপল ছাড়া আসলে একসঙ্গে কেউ বের হয় না। আমি আর মোজাম্মেলও এক অর্থে কাপল। জলী মেয়েটা ভালোই। তাকে নিয়ে কখনো আমার মাথাব্যথা হয়নি। পোস্ট দিলে লাইক দেই। ছবিতে কমেন্ট করি। ‘খুবই কিউট লাগছে আপু!’ পাশে একটা লাভ সিম্বল দেই। খুব যে ভালোবাসা ফিল করে দেই, তা নয়। কিন্তু তার প্রতি অবশ্যই শুভকামনা আছে আমার। সেটা ফিল করি আর না করি। এটা মিথ্যা না। এটা সত্যি। মোজাম্মেলকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। কখনো কখনো মোজাম্মেলকে খুব বেশি চুপচাপ লাগে। তেমন কিছু বলে না। পুরো রাস্তা চুপচাপ হেঁটে আসে। যদি জিজ্ঞাসা করি, ‘কিছু হয়েছে নাকি, আজকে যে এত চুপচাপ!’ খুবই চালাক ছেলে সে। এটা বলে না যে, ‘চুপচাপ কোথায়! এই তো কথা বলছি!’ বরং খুব চিন্তাশীল ভাব নিয়ে বলে, ‘একটা বিষয় নিয়ে কিছুদিন থেকে ভাবছি।’ এই বলে, তার সঙ্গে যায় না এমন একটা প্রসঙ্গের কথা তোলে। আমিও এমন ভাব করি, এমনভাবে তাল দেই, যেন তার কথা নিয়ে একবর্ণ অবিশ্বাস নেই আমার। অথচ তাকে আমি চিনি। বুঝতে পারি। জলীর সঙ্গে হয়তো ঝামেলা চলছে তার। এমনও অসম্ভব নয়, যদি হয়, সে ঝামেলা আমাকে নিয়েই।
ঠিক পাশের সিটেই একটা মেয়ে। কানে ইয়ারফোন। ডান কানের ইয়ারফোনটা হঠাৎ খুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপু এখন কোথায় আছি?’ কোনো দিকে না তাকিয়েই আমি বললাম, ‘আসাদ গেটের কাছাকাছি।’ বলতেই বলতেই তাকালাম বাইরে। আসাদ গেট যেতে তখনও অনেকখানি পথ বাকি।