বদলে যাওয়া গ্রাম : এথনোগ্রাফিক অভিজ্ঞতা

বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে অদ্যাবধি বহু গবেষক বাংলাদেশের গ্রাম ও গ্রামীণ সমাজকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রামের ধারণারও পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রাম সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজকাঠামো, সামাজিক স্তরায়ণ, গৃহস্থালি, জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মতো নানাবিধ বিষয় স্থান পায়। বিগত তিন দশকে গ্রামীণ সমাজ গবেষণায় প্রধান যে পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে ‘গ্রাম’কে ধ্রুপদী সমাজবিজ্ঞানীদরে মতো করে ‘isolated’ ও ‘bounded’ স্থান হিসেবে বিবেচনা না করে তাকে পারিপার্শ্বিকতার সাথে সম্পর্কিত করে দেখা।

১৯৮০র দশক ও তার পরবর্তী সময়ে নগর নৃবিজ্ঞানের বিস্তার গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্যকরণের সূচনা করে, যেখানে গ্রামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করা হয় কৃষির সাথে সম্পর্কিত করে আর পারিবার কাঠামোকে দেখা হয় যৌথতার প্রতীক হিসেবে। একই সাথে রাজনৈতিক কাঠামোকে ভূমির মালিকানা ও জাতি-বর্ণ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত করে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সর্বোপরি গ্রামের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করা হয় ‘informal’ হিসেবে। অপরদিকে শহরের সমাজকে চিত্রায়িত করা হয় শিল্পায়িত সমাজ হিসেবে যার পারিবারিক চরিত্র হচ্ছে একক পরিবার, রাজনৈতিক কাঠামো হচ্ছে জাতীয় রাজনীতি দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত আর মর্যাদার ধারণা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির আন্তঃসম্পর্কের মিশ্রণ দ্বারা নির্ধারিত।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর যে গবেষণাগুলোতে শ্রেণিবৈষম্য নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে সেগুলোতেও ভূমি মালিকানা প্রধান নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এমতাবস্থায় গ্রামীণ সমাজকাঠামোর পরিবর্তনশীলতা অনুসন্ধানের জন্য আমি প্রধানত তিনটি বিষয়কে সামনে নিয়ে গবেষণা কাজ শুরু করি; প্রথমত, গ্রাম ও শহরের সংজ্ঞায়ন- যেখানে গ্রাম বলতে ‘কৃষি নির্ভর সমাজব্যবস্থা’আর শহর বলতে ‘শিল্পব্যবস্থা’কে ব্যাখ্যা করে এমন ধ্রুপদী সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা সাহিত্যগুলো বিশ্লেষণ করে, সেই দ্বৈত ব্যবস্থার আলোকে পরিবর্তনশীল গ্রামীণ সমাজকাঠামোকে বুঝতে পারা সম্ভব কি না তা খতিয়ে দেখা। দ্বিতীয়ত, প্রচলিত এথনোগ্রাফিক গবেষণা সাহিত্যে যেভাবে গ্রাম বলতে ভূমি নির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা শ্রেণিকাঠামোকে চিহ্নিত করা হয়, তার দ্বারা গ্রামীণ শ্রেণিকাঠামোর বহুরূপতা প্রকাশ পায় কি না তার বিশ্লেষণ দাঁড় করা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের ‘গ্রামে’ ধারণা সমরূপ কিনা বা প্রচলিত গবেষণায় অঞ্চল ভেদে গ্রামের ধারণার ব্যতিক্রমতা বিশ্লেষিত হয় কিনা তার উত্তর খুঁজে বের করা। কৃষিৎ-বহির্ভূত পেশা, প্রযুক্তিয়ায়ন গ্রামীণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে কী ধরণের পরিবর্তন  ঘটায় তা পরবর্তী অংশগুলোতে আলোচিত হবে।

গ্রামীণ জনপদে প্রযুক্তির বহুমুখী বিস্তরণ

প্রযুক্তি ও ভৌগোলিক বিচিত্রতার কারণে প্রায়শই গ্রাম-শহরের বিবেচনায় জনমানুষের পরিচিতি ‘গ্রামীণ’ ও ‘শহুরে’ বাইনারির মধ্য দিয়ে বিভাজিত হলেও আশির দশকের পর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ভূমি মালিকানার ভিত্তিতে শ্রেণি বিভাজন করারর প্রয়াস গ্রাম গবেষণার গুরুত্বপূর্ন প্যারাডাইম হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু শুধু ভূমিমালিকানার ভিত্তিতে কি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৈচিত্রতা বোঝা সম্ভব? ২০০২ সালে গ্রাম সমাজ নিয়ে গবেষণার শুরুতেই আমি এই জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে গবেষণা কার্য শুরু করি। শহর থেকে গ্রামে গিয়ে মাঠ গবেষণার শুরুতেই আমি যে বিষয়টি অনুভব করতে শুরু করি তা হচ্ছে প্রযুক্তিয়ায়ন। গ্রামে আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার নিয়ে সেকেন্ডারি লিটারেচার অধ্যয়ন ও মানুষের বয়ান আমাকে গ্রাম-সমাজে প্রযুক্তির বিস্তার বুঝতে সহায়তা করে। ২০০৪ সালের আমার একাডেমিক গবেষণা রিপোর্টের আলোকে তার কিছু বিষয়বস্তু এখানে তুলে ধরছি।

ষাট ও সত্তরের দশক হতে কৃষি ক্ষেত্রে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর আবির্ভাবে সনাতনী কৃষি কাঠামোয় পরিবর্তন আসে, যা গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। যান্ত্রিক ও রাসায়নিক প্রযুক্তির বিস্তার শুধু কৃষি-পদ্ধতিরই পরিবর্তন আনে না, পারিবারিক কাঠামো, সমাজকাঠামো এমনকি গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থারও পরিবর্তন সাধন করে। পূর্বে মানবশ্রম বিশেষত গৃহের নারীশ্রম থেকে শুরু করে মাঠে পুরুষশ্রম যেখানে কৃষি উৎপাদনে মূখ্য ভূমিকা পালন করতো সেখানে প্রযুক্তির প্রভাব তার অনেকাংশেই প্রান্তিকীকৃত করে। বীজ, সার, কীটনাশক সংরক্ষণ ও তৈরিতে যেখানে গৃহের নারীর শ্রমের গুরুত্ব ছিল বর্তমানে প্রেক্ষাপট পাল্টে তা বাজারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করছে। কৃষি কাজ হতে বিযুক্ত জনগোষ্ঠী বেকারত্বের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে কেরামত আলী (৫০) বলেন :

এই গ্রামে কৃষিতে যে কাজে প্রায় ৩০০ মানুষ নিয়োজিত থাকতো এখন ট্রাক্টর, সেচের জন্য পাম্পের মতো মেশিন আসায় সেই কাজ ৫-১০ জন মানুষই শেষ করে ফেলে, ক্ষ্যাতে আর কাজ নাই। গ্রামের মানুষ বেকার হইয়া গেছে, কাজ করতে শহরে চইলা যাইতাছে।

এই প্রযুক্তির মালিকানা গ্রামের সামাজিক স্তরায়ণকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রযুক্তি ক্রয় করতে যে নগদ অর্থের প্রয়োজন তার ব্যয় গুটিকয়েক মানুষ সরবরাহ করতে পারে। ফলে ক্ষুদ্র কৃষক কৃষিকাজ থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়ছে। লিঙ্গীয় প্রেক্ষাপটও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত গৃহস্থালি এবং সামাজিক পরিসরে নারীর কাজ এখনো প্রবলভাবে ঘরের কাজের সাথে সম্পর্কিত। নারী গৃহস্থালির বাইরে কাজ করবে — এরূপ বিষয়কে সমাজ ভিন্ন চোখে দেখে। মূলত এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারীকে প্রযুক্তি পরিচালনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরাও প্রযুক্তি চালনার সাথে যুক্ত হতে চান না। এ প্রসঙ্গে দরূণ গ্রামের সাহেরা বেগম (৫২) এর বক্তব্য হচ্ছে :

…. আমরা মেশিন চালাইতে যামু কেন? মেশিন তো চালায় পোলা মানুষ। মেশিন চালাইতে মাঠে যাইতে হয়, এটা কি মেয়া মানুষ পারে? মেয়া মানুষ মেশিন চালাইলে লোকজন খারাপ কইবো। পোলা মানুষ চাষবাস করে মেশিনও চালাইবো তারাই।

মূলত ঘরের বাইরে গিয়ে প্রযুক্তি চালনার কাজ করলে মানুষ ‘খারাপ’ বলতে পারে — একথা চিন্তা করেই নারীরা প্রযুক্তি পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চান না। পর্দাপ্রথার কারণে নারী যেমন ঘরের বাইরে যায় না তেমনি মাঠে গিয়ে কৃষিকাজ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই গৃহস্থালির মত কৃষিক্ষেত্র অনেকটাই পুরুষের কর্তৃত্বাধীন; যেখানে সিদ্ধান্তগ্রহণ করার ক্ষমতা পুরুষের কাছে অর্পিত হয়। বাংলাদেশের গ্রামসমাজ গবেষণায় এই ‘ঘর’ ‘বাহির’ স্থানিক বিতর্ক গুরুত্বের সাথেই বিবেচিত হয় যাকে সারাহ সি হোয়াইট Seperate Spheres Models নামে আখ্যায়িত করেন। এই ‘ঘর’ ‘বাহির’ স্থানিক বিতর্কে নারীর স্থান ‘ঘর’ আর পুরুষের স্থান ‘বাহির’। হোয়াইট বলেন এ দুটি স্থানিক বাইনারির মধ্য দিয়ে গৃহস্থালির পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতা বোঝা সম্ভব নয়। এখানে ‘ঘর’ ‘বাহির’ শুধু স্থান নয় সাংস্কৃতিক মতাদর্শও বটে। সময়ের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক নানাবিধ প্রভাবে এই মতাদর্শেও পরিবর্তনও ঘটে। শুধু লিঙ্গীয় পরিসরে নয়, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে গ্রামীণ সমাজ নানামুখী পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। যেকোন স্থানের মতো গ্রামের চরিত্র ‘স্থির’ নয়; এর পরিবর্তনশীলতা বোঝাও জরুরি।

এবার এক যুগ পর গ্রাম সমাজে প্রযুক্তিয়ানের কিছু চিত্র আলাকপাত করা যাক । ২০১৫ তেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন ভৌগলিক পরিসরে তিনটি ভিন্ন গ্রামে তিনটি গবেষণা কাজে সম্পৃক্ত হই। প্রযুক্তির বিপনন, সম্প্রসারণ ব্যবস্থা গ্রামীণ মানুষের সামাজিক সম্পর্ককে নানা ভাবে প্রভাবিত করে। সার-কীটনাশক এর মতো প্রাত্যহিক কৃষি উপকরণ বিক্রির জন্য গ্রামেও নতুন বাজার ও বিজ্ঞাপন ব্যবস্থার প্রসার ঘটছে যা কয়েক দশক পূর্বেও ছিল অনুপস্থিত। ট্রাক্টর পাম্পের মতো মেশিনারিজ মেরামতের জন্য ছোট পরিসরে  শোরুম, মেরামত কেন্দ্রের আবির্ভাব ও তাদেও বিজ্ঞাপন কাঠামো গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে অনেকটাই নতুন সংযোজন। এক যুগ পরে মানুষের প্রযুক্তির ধারণা শুধু কৃষি প্রযুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রযুক্তিয়ানের প্রভাবে বাজারের সম্প্রসারণ শুধু কৃষি ক্ষেত্রেই নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষত মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার গ্রামীণ সমাজকাঠামোর বাজার ব্যবস্থায় নতুন সংযোজন। ফোন রিচার্জ এর দোকান, মোবাইল ফোনে গান ডাউনলোড যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে তেমনি নতুন নতুন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেরও সৃষ্টি করেছে। যুবক সম্প্রদায়ের কাছে ফেসবুক, YouTube-এর ব্যবহার খুব জনপ্রিয় হলেও স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর নিকট এর প্রাথমিক ব্যবহার দুরূহ কাজ। গবেষণা এলাকাতে বেশ কিছু দোকান দেখতে পেয়েছি যেখানে স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে অর্থের বিনিময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অ্যাপস ডাউনলোড করে দেয়া হয়। একটি দোকানের সাইনবোর্ডে লিখিত বিজ্ঞাপনের ভাষা এরূপ :

এখানে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সকল ধরনের গান ডাউনলোড করা হয়, ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। ১০ টাকার বিনিময়ে ফেসবুক ডাউনলোড করা হয়; ১০০ টাকার বিনিময়ে ফেসবুক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়; ফেসবুক প্রশিক্ষণ নিলে ডাউনলোড ফ্রি।

প্রযুক্তিয়ায়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা গ্রাম শহরের পার্থক্য হ্রাস করেছে। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য গবেষণা এলাকা টাঙ্গাইলের শিবপুর গ্রামকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। শিবপুর লিখিতভাবে এখনো ‘গ্রাম’ হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও ‘কৃষি-শিল্পে’র বিভাজিত সংজ্ঞার প্রেক্ষাপটে একে গ্রাম বলা যাবে কি না তা বিশদ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ঐতিহাসিকভাবে এই গ্রামের মানুষ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত থাকলেও নগরায়ণের প্রভাব এই স্থানটিকে আর গ্রাম ও শহরের বিভাজিত সংজ্ঞায়নে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

একটা বিষয় এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এ গ্রামের নতুন প্রজন্মের অনেকেই কৃষি পেশাকে ‘সম্মানজনক’ মনে করে না। এ কারণে কৃষি খাতের চেয়ে অকৃষিকাজের পেশাকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু সেতু স্থাপনের পরবর্তী সময়ে ভূমির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেককেই দেখা গিয়েছে তারা জমি বিক্রি করে শহরে গিয়ে দোকান ক্রয় করে ব্যবসায় নিয়োজিত হচ্ছে। শিবপুর গ্রামে এখন কৃষি কাজের ব্যাপকতা নেই। যদিও এখানে শিল্পায়নও হয়নি। জমি বিক্রি করে ব্যবসায়ের কারণে টাঙ্গাইল শহরে অভিবাসনের হারও বেড়ে গেছে। ভূমিহীন বা স্বল্প পরিবারের সন্তানেরা এলাকাগত পরিচিতির মাধ্যমে শহরের দোকানগুলোতে বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিয়োজিত হচ্ছে, যা স্থানীয়ভাবে ‘কর্মচারী’ পেশা হিসেবে পরিচিত।

এক্ষেত্রে যুবক সমাজের অনেকেই ধারণা পোষণ করে যে, কৃষি কাজে যে পরিমাণ শ্রম দিতে হয়, প্রযুক্তির জন্য নগদ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, ফসল বিক্রি করে সে পরিমাণ অর্থ আসে না, এমন কী অনেক ক্ষেত্রে আয় ব্যয় সমান। তাই তারা কৃষি কাজে অংশগ্রহণ না করে চাকুরিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, যেখানে মাস শেষে নগদ অর্থের নিশ্চয়তা থাকে। জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সেখানে কৃষি কাজ না করে জমি ভাড়া দিলেও ক্ষেত্র বিশেষে কৃষি কাজের চেয়ে অধিক উপার্জন সম্ভব হয়। আবার অনেক যুবককেই মোটরযান শ্রমিক বা মেকানিক হিসেবে কাজ করতে বা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা চালানোর কাজে নিয়োজিত হতে দেখা গেছে। স্বল্প শিক্ষিতদের অন্যান্য চাকুরি নিয়েও অভিবাসন এর প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। গবেষিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন ও বিদেশে (বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে) অভিবাসন প্রবণতা রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এই অভিবাসনের প্রভাব বহুমুখী। জ্ঞাতিসম্পর্ক, পরিবার কাঠামো হতে শুরু করে গ্রামের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথেও অভিবাসন নানা ভাবে সম্পর্কিত।

অভিবাসন ও গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা : কৃষি-বহির্ভূত পেশার বিস্তৃতি

বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজে পরিবার ও জ্ঞাতিসম্পর্কের পৃথকীকরণ, ভাঙন, বংশ প্রথা নির্ধারণ নিয়ে গবেষণা নৃবৈজ্ঞানিক জ্ঞানকাণ্ডের ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও অভিবাসন বিষয়ক সামাজিক গবেষণা অভিবাসনের কারন হিসেবে যৌথ পরিবার এর ভাঙ্গন, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভূমি নিয়ে দ্বন্দ্বকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে অভিবাসন গ্রামের যৌথ পরিবারের ভাঙ্গনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলেও তা আবার নতুন ধরনের সম্পর্কের জালে কীভাবে আবদ্ধ করে তা আমার গবেষণার ক্ষেত্রে একটা অনুসন্ধানের জায়গা ছিল। অভিবাসন গ্রামীণ যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন ঘটাচ্ছে এটা ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য এবং এটিও দৃশ্যমান যে, অভিবাসনের ফলে গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে মানুষজন একক পরিবারের মধ্যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

এটি সাধারণীকরণ মনে হলেও গবেষণা এলাকার বহু পরিবারের বাস্তবতা এই যে, স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোর যুবক জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের প্রধান উপায় হিসেবে শহরে গিয়ে গার্মেন্টসের চাকরিকেই প্রাধান্য দেয়। তবে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ অর্থাৎ মা-বাবা, দাদা-দাদিরা গ্রামেই বসবাস করে। বিবাহিত বা বিয়ের পর অভিবাসিত পুরুষরা কর্মক্ষেত্রের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পরিবার গঠন করে, যাকে একক পরিবার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বাসস্থানের ভিন্নতা থাকলেও এখানে ‘ভাঙ্গন’ বলাটা সবক্ষেত্রে মানানসই না। অভিবাসিত অনেকেই তার গ্রামের পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের মাসিক খরচও সরবরাহ করে থাকেন।

আবার এটাও দেখা গিয়েছে যে, অভিবাসিত সন্তানদের আপদকালীন সময়ে যোগান হিসেবে বাবা মায়ের গ্রামের সম্পত্তিও বিক্রি করে নিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশে অভিবাসনকারীদের মধ্যে এই প্রবণতা খুবই বেশি। রেমিটেন্সের প্রবাহ গ্রামের বাজার ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছে। গ্রামে বাসস্থানের জন্য যেমন দালান কোঠা তৈরি হচ্ছে ঠিক তেমনি সুপার মার্কেট এর মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে যেখানে কর্মরত আছে অভিবাসিতের ভাই বা অন্য কোন আত্মীয়। কিছুক্ষেত্রে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগের ব্যাপারটিও লক্ষ করা গিয়েছে। অভিবাসনকারীদের কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে দেখা গেছে। ট্রাক্টর বা পাম্প ক্রয় করে তা ভাড়া খাটানোর ব্যাপারটিও এখানে অনেকটাই প্রচলিত।

অপরদিকে নারীদের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মের সুযোগ তৈরি হওয়ায় নারীদের শহরে অভিবাসন সাম্প্রতিক দশকগুলোতে গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষত অস্বচ্ছল পরিবারের পুত্র সন্তানদের পাশাপাশি কন্যা সন্তানেরাও পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে ভূমিকা রাখে। গবেষণা এলাকার গ্রামগুলোতে যেখানে কন্যা সন্তানদের স্কুলে যাওয়াটাই স্বপ্নের ব্যাপার ছিল সেখানে গ্রামীণ অর্থনীতি পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের স্কুলে যাওয়ায় ভূমিকা রাখছে। নারীদের কর্মের জন্য শহরে অভিবাসন খুবই সাম্প্রতিক ঘটনা। এ প্রসঙ্গে একজন নারী বলেন :

শুরুর দিকে মোটামুটি ১০ বছর আগেও নারীদের বাইরে কাজ করাটা ‘সমাজ’ খারাপ দৃষ্টিতে দেখতো, যা এখন স্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। অস্বচ্ছল পরিবারে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার খরচ সরবরাহ করা পরিবারগুলোর জন্য বেশ কষ্টের ব্যাপার হলেও অভিবাসিত চাকুরিজীবী নারীরা নিজের বিয়ের খরচ নিজেরাই সংগ্রহ করছে।

শুধু গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনই নয়, গ্রামে শিল্পের বিকাশ, এনজিও কার্যক্রমের সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন দাপ্তরিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ফলে শহর থেকে গ্রামে অভিবাসনের বিষয়টি গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে। আনুপাতিকহারে শহর থেকে গ্রামে অভিবাসন সংখ্যায় কম হলেও তা গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা, বাজার কাঠামো এমনকি রাজনৈতিক কাঠামোতেও প্রভাব বিস্তার করে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের চারান গ্রামের একজন বলেন :

গ্রামে শিল্পায়ন ও এনজিও-এর বিকাশ হচ্ছে, শহর থেকে শিক্ষিত শ্রেণির মানুষকে গ্রামে এসে চাকরি করতে আসছে। তাদের ছেলে মেয়ে রা সরকারি স্কুলে যায়না, যার কারণে গ্রামে কিন্ডার স্কুল, ব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। যেখানে স্থানীয়রা নতুন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবন পরিচালিত করছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে অভিবাসন সার্বজনীন বিষয় হলেও ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক ও স্থানিক পরিসরে ভিন্ন ভিন্নভাবে ক্রিয়া করে। অভিবাসনের শুধু কর্মপরিধি, রেমিটেন্স বা অর্থনৈতিক বিষয়াবলি নয়; লিঙ্গীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগত বিষয়াবলিও বিদ্যমান। বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নারীদের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মের সুযোগ তৈরি হওয়ায় নারীদের শহরে অভিবাসন সাম্প্রতিক দশকে গ্রামীণ সমাজ-ব্যবস্থায় নতুন অভিজ্ঞতা। আবার চট্টগ্রামের গহীরা গ্রামে গবেষণাকালে দেখা গেছে যে, এই গ্রমের নারীরা সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধগত কারণে গার্মেন্টসে কাজ করা থেকে বিরত থাকে বা গ্রামের সমাজ-ব্যবস্থা নারীদের গার্মেন্টসে কাজ করার অনুমতি দেয়না। পর্দাপ্রথার কারণে বর্তমান গবেষণাকালেও নারীদের সাথে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হয়নি। গহীরার চট্টগ্রামে অভিবাসিত একজন নারী চট্টগ্রাম শহরে দীর্ঘক্ষণ সাক্ষাৎকার দিলেও পরবর্তী সময়ে তার সাথে গ্রামে দেখা হলেও তিনি গ্রামের মধ্যে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, “আমরা যখন গ্রামে আসি তখন গ্রামের কালচার মেনে চলি, এখানে পুরুষদের সাথে কথা বলি না।’’ এ গবেষণায় নারীদের চাকুরিগত বিষয়াবলির খোঁজখবর নেয়া হয়েছে গ্রামের পুরুষ সদস্যদের নিকট হতে। তাই বলা যায়, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অভিবাসন বাংলাদেশের গ্রামীণকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে যদিও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে এই গুরুত্বের স্বরূপ ভিন্ন।

অভিবাসন গ্রামের মানুষের মূল্যবোধকে অনেকটাই পরিবর্তন করেছে। এমূল্যবোধ শুধু আচরনগতই না গ্রামের কাঠামোগত অবস্থানকেও পরিবর্তিত করেছে। উল্লেখ্য যে, সাক্ষাৎকার গ্রহণের দিন তাদের পুরাতন বাড়ি ভেঙ্গে নতুন বাড়ি তৈরির কাজ চলছিল। তাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গবেষকের সামনে আসে। ঐ বাড়ির একজন সদস্য বলেন :

অভিবাসন আমাদের অনেক কিছুই পরিবর্তন করেছে। আমাদের যে নতুন বাড়িটি তৈরি হচ্ছে সেখানে শুধু ইটের গাঁথুনিই সংযোজিত হচ্ছে না, সেখানে রুচিবোধের পরিবর্তন আসছে। পূর্বের বাড়িগুলোর ডিজাইন ছিল পর্দার সাথে সম্পর্কিত। আমাদের গ্রামে আগের বাড়িগুলো লক্ষ করলে দেখবেন, বাড়ি শুরু হয় একটা মেহমান ঘর দিয়ে। বাইরে থেকে কেউ আসলে ঐ ঘরের পর আর ঢুকতে পারেন না। আর বাড়ির মহিলারা ঐ ঘরে আসেন না। এই ঘরের পর থাকে বাড়ির উঠান, তারপর থাকার ঘর ও রান্না ঘরসহ অন্যান্য ঘর। কিন্ত এখন এই ধারণা পরিবর্তন হচ্ছে। আধুনিক বাড়ি যা তৈরির পেছনে আমাদের রেমিটেন্সের প্রভাব আছে সেগুলোতে মেহমান ঘরের পরিবর্তে আমরা একই বিল্ডিঙে ড্রইং রুম বানাচ্ছি, রান্নাঘর থাকার ঘর, বাথরুম সবই একই সাথে। নারীদের আলাদা উঠানের ধারণা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে আর ড্রইং রুমে নারীরাও বসছেন।

উপরের বক্তব্যটি গ্রামের পর্দাপ্রথা ও মূল্যবোধের পরিবর্তনের সাথে অভিবাসনের যে সম্পর্ক সেটি বুঝতে সহায়তা করে। শুধু এই বাড়িটিই নয়, গ্রামে যে বাড়িগুলো নতুন করে তৈরি হচ্ছে তার প্রায় সবগুলোর কাঠামোই আধুনিক কাঠামোকে অনুসরণ করে তৈরি হচ্ছে, পূর্বের মতো নারীর পর্দাপ্রথাকে চিন্তা করে তৈরি করা হচ্ছে না।

অভিবাসনের এই বহুমুখী অভিজ্ঞতার আলোকে গ্রামীণ সমাজের মানুষ নতুন ধরনের সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে যুক্ত করছে। পূর্বে যেখানে গ্রামের অর্থনীতি, রাজনীতি ও মর্যাদার সাথে ভূমির মালিকানা প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করতো সেখানে বর্তমানে ভূমিহীন পরিবারের সন্তানও অভিবাসনের ফলে অর্থ জোগাড় করে গ্রামে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন ধরনের সামাজিক শ্রেণির সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। বিদেশ ফেরত অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি গ্রামে নিজেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করছে। শুধু অভিবাসন নয়; সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় রাজনীতির প্রভাব গ্রামীণ রাজনৈতিক কাঠামোকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। পূর্বে যেখানে গ্রামের অর্থনীতি, রাজনীতি ও মর্যাদার ক্ষেত্রে ভূমির মালিকানা প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে সেখানে বর্তমানে ভূমিহীন পরিবারের সন্তানও অভিবাসনের ফলে অর্থ জোগাড় করে তা গ্রামে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন ধরনের সামাজিক শ্রেণির সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামোর যোগসূত্র গ্রামীণ রাজনীতির চরিত্রকে বহুলাংশে পাল্টে ফেলছে।

তাই গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তনের স্বরূপ বুঝতে হলে কৃষিতে আধুনিকায়ন, অভিবাসন, ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয়ের আন্তঃসম্পর্ক নির্ণয় এবং উক্ত বিষয়গুলোর পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান জরুরি। গ্রাম ও শহরের সংজ্ঞায়নের ধ্রুপদী সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে গ্রামকে দেখা হয় কৃষিভিত্তিক সমাজ হিসেবে আর শহরকে দেখা হয় শিল্পভিত্তিক সমাজ হিসেবে — এ ধরনের সংজ্ঞায়ন গ্রাম ও শহরের পরিবর্তনশীলতার স্বরূপ বোঝবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। পূর্বের কৃষিভিত্তিক সমাজকাঠামোতেও শিল্পায়নের প্রভাবে বর্তমানে কৃষি এবং শিল্প পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে। একইসাথে গ্রামীণ সমাজের শ্রেণিকাঠামোকে শুধু ভূমির সাথে সম্পর্কিত করে দেখলেও গ্রামীণ শ্রেণিকাঠামোর বহুমাত্রিকতা প্রকাশ পায় না। অভিবাসন, কৃষির সাথে শিল্পের যোগাযোগ, আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ, এনজিও কার্যক্রমসহ কৃষি জমিতে ক্রমবর্ধমান শিল্প কারখানা স্থাপনের মত আন্তঃসম্পর্কিত বিষয়গুলো গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর সাথে সম্পর্কযুক্ত যা গ্রামীণ জনসমাজকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অভিযোজিত করে।

টীকা

১. শিরোনামে সারাসরি এথনোগ্রাফিক অভিজ্ঞতা বলার কারণ হচ্ছে গ্রাম ও কৃষক সমাজকেন্দ্রিক এই লেখাটি কোন গবেষণার পুরো রিপোর্ট নয়; একটি নির্দিষ্ট এলাকায় মাঠকর্মকৃত তথ্যের বিশ্লেষণও নয়; লেখকের প্রায় দেড় দশকে সম্পাদিত তিনটি গবেষণার এথনোগ্রাফিক তথ্য এবং অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ। মাঠকর্মের বিষয়বস্তু গ্রামীণ সমাজকাঠামো এবং কৃষক সমাজ হলেও প্রেক্ষাপট ও সময়কাল ভিন্ন। তাই এক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে বলা যায় ‘মাল্টিসাইটেড এথনোগ্রাফি’। জর্জ মার্কুসের ‘মাল্টিসাইটেড এথনোগ্রাফি’ ধারণার আালোকে বলা যায়, বিশ্বায়নের যুগে ‘স্পেস’ বা স্থান কোনভাবেই ‘স্থির’ বা ‘bounded’  নয়; বিশেষত গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার সাথে শিল্পায়নের দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরে বা বিদেশে অভিবাসন, অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর রেমিট্যান্স প্রবাহ, কৃষিতে বিদেশি প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানাবিধ বিষয় শহুরে সমাজ বা বহির্বিশ্বের সাথে গ্রামের মানুষকে যোগাযোগে সম্পৃক্ত করে। তাই গবেষণায় গ্রামকে ‘bounded’ স্পেস ও গ্রামের মানুষের চিন্তা/ ন্যারেটিভকে “গ্রামীণ ( শহুরে সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন)” হিসেবে না অনুধাবন করে তারা পারিপাশির্^কতার সাথে কিভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করে তার বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতাকে অনুসন্ধান করা হয়েছে।  স্থান ও শব্দের নির্দিষ্টতা থাকায় এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব হয়নি, তবে গবেষকের বিবেচনায় গ্রাম ও গ্রাম গবেষণার কিছু গুরুত্বপূর্ন প্যারাডাইম সংক্ষিপ্তকারে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

২. এই লেখাটিতে তিনটি গ্রাম গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্যের অংশবিশেষ ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০২-২০০৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার দরূণ একটি গ্রামে গবেষণাকর্মের মূল বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষিকাঠামোতে ‘আধুনিক প্রযুক্তি’র আগমন, সম্প্রসারণ ও সর্বোপরি ‘আধুনিক প্রযুক্তি’র প্রভাবে কৃষক সমাজের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও কৃষক সমাজ ‘আধুনিক প্রযুক্তি’র প্রতি কী রূপ সাড়া প্রদান করে তা বিশ্লেষণ করা দ্বিতীয় গবেষণা সময়কাল ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ, টাঙ্গাইল জেলার চারান গ্রাম। তৃতীয় গবেষণাটি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি “রিভিজিটিং এথনোগ্রাফিক’’ গবেষণা কাজ যা ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামের গহীরা গ্রামের শিকদারবাড়ী এলাকায় শুরু হয়েছে। তবে গবেষণাকর্মই গ্রম গবেষণা হলেও পদ্ধতিগতভাবে ছিল মাল্টিসাইটেড এথনোগ্রাফি।  গ্রাম আইসোলেটেড স্পেস নয়, এর যোগাযোগ, পরিবর্তনশীলতা বুঝবার জন্য গ্রামের বাইরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও ব্যাক্তিগত সাক্ষাৎকার ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক ও তথ্য বিশ্লেষিত হয়েছে।

৩. ছবিগুলো আইডিইগ্লোবাল ও গ্রামীণ টেলিকমের ওয়েবসাইট এবং দ্যা ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকা থেকে গৃহীত।

সম্পাদকীয় নোট : তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হলো না আগ্রহী পাঠক চাইলে গবেষকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সূত্র পেতে পারেন

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here