ফ্যাশন নিয়ে

‘‘ফ্যাশনটা হলো মুখোশ,স্টাইলটা হলো মুখশ্রী।’’ — ‘‘শেষের কবিতা’’য় অমিতের মতে যারা সাহিত্যের ওমরাও দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে স্টাইলটা তাদেরই। আর যারা আমলা দলের, দশের মন রাখা যাদের ব্যবসা ফ্যাশন তাদের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিতের মুখে ফ্যাশনের যে সংজ্ঞার্থ দিয়েছেন তাতে হঠাৎ করে মনে হয় ফ্যাশনে নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। কিন্তু ফ্যাশন যে ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়েও বাহ্যিক লুকে আলাদা একটি মাত্রা যোগ করে তা বুঝতে অসুবিধা হয়না। ফ্যাশন দেয় বৈচিত্র‍্য, সেটা যার যার স্টাইলে আলাদা করেও।

 

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে চলছে। আর এর সাথে সাথেই পরিবর্তন ঘটছে চলতি ফ্যাশনেরও। একটি যুগের ভাবধারাকে ফুটিয়ে তোলে ফ্যাশন। জীবন ধারনের স্টাইলে, আমাদের পোশাক পরিচ্ছদে, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সকল জিনিসেই রয়েছে ফ্যাশনের ছোঁয়া। সময়ের প্রয়োজনেই ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ফ্যাশন। আমাদের সাজ পোশাকে, আমাদের গৃহসজ্জায়, এমনকি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইসেও নান্দনিকতা ও রুচিশীলতার প্রতিফলনই ফ্যাশন আসলে।

 

ফ্যাশন হলো ট্রেন্ডের অনুসরণ, স্টাইল তৈরির উৎস। এটি এমন একটি ফর্ম যা বুঝতে গেলে পরিবর্তন, নতুনত্ব এবং উদ্ভাবন এই তিনটি বিষয় না বলতেই চলে আসে। সময়ের সাথে আমাদের রুচি,সাজ, পোশাক, চিন্তাচেতনার যে পরিবর্তন হয় তা প্রতিফলিত হয় হালের ফ্যাশনে। পুরোনোকে নতুনভাবে উপস্থাপন, এ দুটির সমন্বয় ফ্যাশনে অনন্য বিষয়। স্টাইলের বিভিন্ন রূপী অনুশীলনই নতুন নতুন ফ্যাশনের জন্ম দেয়।

 

এক যুগের যে ফ্যাশন ট্রেন্ডি ও স্মার্ট করে, সময়ের পরিবর্তনে সেটিই হয়ে যায় পরিত্যক্ত। আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পরিপুষ্ট ফ্যাশন। এটি মূলত পরিবর্তনশীল ফর্ম যা বস্তুগত সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যে সংস্কৃতিকে ধারন করে আছি তারই আয়না হলো ফ্যাশন।

চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপীয় পুঁজিবাদের অগ্রসরমান অবস্থায় ফ্যাশনে প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন শুরু হয়। ফ্যাশনে অতি গুরুত্বপূর্ণ পোশাক; এর সাথে বস্তুগত ও অবস্তুগত  অন্যান্য উপাদান ও ফ্যাশন তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ফ্যাশন নতুন ট্রেন্ডি পোশাক  উৎপাদনে এবং সেটি নিজের সংগ্রহে রাখার প্রবণতাকে উৎসাহিত করে। অর্থাৎ ফ্যাশনের  সমাজতত্ত্ব  ভোগ ও ক্রয় ইত্যাদির  সমাজত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত। ফ্যাশন  ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের  প্রতিনিধিত্ব করে। একটি যুগের ভাবধারা ও রুচির  সামঞ্জস্যে তৈরিকৃত পণ্য বা আচার যখন  অনেকের দ্বারা  গৃহীত হয়, তখনই তৈরি  হয় ফ্যাশন। আর তা হয়ে ওঠে অনেকের স্টাইল। অর্থাৎ  বলা যায় ফ্যাশন  হলো অনেকগুলো  নতুন স্টাইলের  সমাবেশ যা অনেকের  দ্বারা গৃহীত। ফ্যাশন  অনেকাংশেই ডিজাইনকৃত পণ্যের সাথে আমাদের সম্পর্কেই বোঝায়।

 

ফ্যাশন নতুন ট্রেন্ড তৈরির উৎস হিসাবে কাজ করে সমাজ। শ্রেণী ও লিঙ্গ, অঞ্চল ও রাষ্ট্রভেদে আলাদা আলাদা ফ্যাশন  তৈরি হতে পারে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উচ্চশ্রেণির  মানুষের যে ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ, জীবন  ধারনের স্টাইল  নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি তার থেকে আলাদা, ফ্যাশনে নিম্নশ্রেণি উচ্চশ্রেণির অনুকরণ  করতে চায়। আবার নিম্ন শ্রেণির উপাদান ও উপকরণকে উচ্চ শ্রেণি তার ফ্যাশনের অংশ করে তোলে। লোক-সংস্কৃতির অনেক উপাদানের সঙ্গে উচ্চ শ্রেণির সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নেই। অথচ কোনো একটি পোশাকের পরিকল্পনা, নকশায় দেখা যাচ্ছে লোক-সংস্কৃতির মোটিফ বা প্রতীকের ব্যবহার। ফ্যাশনের উৎস ও ধরন যেমনই হোক সেটি হতে হবে নতুন উদ্ভাবনীমূলক।

বিশ্বজুড়ে সময় ও সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন ফ্যাশন রয়েছে। ইউরোপে ফ্যাশনের ঊর্ধ্বগতি সভ্যতার  ক্রমোন্নতির সাথে সম্পর্কিত। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের পোশাকের ভিন্নতা দেখে তাদের  সামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের পোশাক দেখে তার সময়কার  চিন্তা, রুচি এবং  সমাজব্যবস্থা  সম্পর্কেও জানা যায়। ফ্যাশনের  ভিন্নতায় পোশাক  ও আনুষঙ্গিক  উপকরণে ট্র্যাডিশনাল, বোহেমিয়ান, ভিন্টেজ, সিলুয়েড প্রভৃতি ধারা রয়েছে।

রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক  এবং সাংস্কৃতিক  পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে ফ্যাশন। ফ্যাশনের  এ পরিবর্তন  ব্যাপকভাবে  নারী-পুরুষের  ভূমিকা, জীবনযাপনের স্টাইল, পারিবারিক  গঠন  সবকিছুকেই প্রভাবিত  করছে। ফ্যাশনে মডার্নিটির সাথে নির্দিষ্ট  যুগের ভাবধারা প্রকাশ  পাচ্ছে।

অনুষ্ঠানভেদে ব্যাক্তির  পোশাক  পরিবর্তিত হয়। অফিস ও ফরমাল জায়গাতে পশ্চিমা  সংস্কৃতির  ফরমাল  শার্ট, স্যুট পরার ফ্যাশন প্রচলিত। অন্যদিকে জমকালো অনুষ্ঠান, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বেছে নেয়া হয় ট্র্যাডিশনাল পোশাক। ফ্যাশনে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ মডার্নিটি প্রকাশের প্রচলিত  মাধ্যম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে  ফ্যাশন  প্রতীকী  মূল্য ধারণ করে। যেমন পয়লা বৈশাখের শাড়ি,পাঞ্জাবি, কুর্তিতে যে নকশা, পয়লা ফাল্গুনে ফুলের গয়না,বাসন্তী রঙের পোশাক, একুশে ফেব্রুয়ারিতে  শোক প্রকাশে কালো পোশাক পরিধান তা আমাদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী নারীদিবসে বেগুনি রঙের পোশাক আরেকটি উদাহরণ।

 

ফ্যাশনে বৈচিত্র্য আবশ্যক। যেমন বর্তমান যুগে ষাটের দশক কিংবা নব্বই দশকের সাজ পোশাকের প্রত্যাবর্তন। আবার পোশাকে রঙিন পুঁতি, ফিতে, কাঠ, কড়ির ব্যবহার এবং  বিখ্যাত শিল্পকর্মকে পরিধেয় বস্ত্রে ফুটিয়ে তুলে ফ্যাশনে বৈচিত্র্য আনা হচ্ছে। পুরোনো স্টাইল নতুন রূপে ফিরে আসার ট্রেন্ডও রয়েছে এক্ষেত্রে। ফ্যাশন নিরীক্ষাধর্মী শৈল্পিক খেলার মত যা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ডিজাইনার পণ্যের উৎপাদন এবং এসব পন্যের প্রতি ভোক্তার সহজাত চাহিদা তৈরি করছে।

ফ্যাশনে সেলিব্রিটি ইনফ্লুয়েন্স ভুমিকা রাখে। তবে সোশাল কালচারই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। করপোরেট ব্যক্তি এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে আভিজাত্য প্রকাশের স্পৃহা যতদিন থাকবে ততদিন নতুন নতুন ট্রেন্ড তৈরির চাহিদাও থাকবে। আরাম প্রদানকারী ও সিম্পল সাজ পোশাকের ফ্যাশন চিরন্তন। সময়ের ধারাবাহিকতায় এর ডিজাইনে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে তা বলা কঠিন। কিন্তু বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ এবং ডিজাইনাররা ক্রেতার আকাশ-ছোঁয়া চাহিদার সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে তাদের ডিজাইন কৌশলে যোগ করবেন নতুনত্ব। আমাদের পোশাক এবং আনুষঙ্গিক সকল জিনিসেই রুচিশীল ও সৌন্দর্য্যসচেতনতার এ অনুশীলন ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে এভাবেই নতুন নতুন ফ্যাশনরূপে আমাদের সামনে হাজির হতে থাকবে — সময়ের পরিক্রমার দিকে তাকিয়ে এ কথা বলাই যায়।

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here