“ছোট পাখি ছোট পাখি
সর্বনাশ হয়ে গেছে
পৃথিবীর পরে তোমার আমার
ভালোবাসার কেউ নেই কিছু নেই।
ও ছোট পাখি ছোটপাখি ভাঙচুর হয়ে গেছে
শিশুদের খেলনা,আমাদের দোলনা,
ডাক বাক্সের ঢাকনা
রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো নেই।
( সহজিয়া ব্যান্ডদলের গান)
ক
থানা পুলিশ কোট কাচারির বরাতে লক আপ শব্দের বাজার দর জারি থাকলেও ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো যাপনে লক আপ শব্দের মাহাত্ম্য কর্ণে প্রবেশ করলেও মর্মে প্রবেশ করে রাজ্যপাট বিস্তার করতে পারেনি। যেমন পেরেছে লক ডাউন। লক ডাউন এখন বৈশ্বিক উচ্চারিত স্বর। বন্দিদশার বিশ্বায়ন। এ এক পবিত্র বিচ্ছিন্নতার বিশ্বায়ন।কর্তাবাবুরা সব কিছুর বিশ্বায়ন চাইলেও বন্দিদশার বিশ্বায়ন চাইতে শুনিনি। ষোলকলা পূর্ণ হলোএবার।চলো হে কীর্তনীয়া দুই হাত উর্ধ্বে তুলে ধেই ধেই করে নাচি।
আহা!আহা! তা তা থৈ থৈ।
গোটা কয়েক সন্দেহজনক ব্যক্তির জন্য লক আপ হাজতবাস রিমান্ড ইত্যাদি ক্রিমিনাল শাস্ত্রে বলবৎ থাকলেও গোটা মানব সমাজের জন্য বন্দিদশার নজির আইন শাস্ত্রে নেই।দুই হাজার উনিশ গড়িয়ে বিশ থেকে গৃহে বন্দিদশার যে লক ডাউন এবার নাজেল হলো তার পূর্বাপর ইতিহাস নেই।ব্যক্তির দোষে লক আপ–তার কার্যকারণ উকিল মোক্তার পুলিশ আদালত করেন। নিদান দেন। ব্যক্তি দায়ী না সমাজ দায়ী তা নিয়ে কূটচালে কূটাভাষের বয়ান লেখা হতে পারে।
তা’বলে গোটা মানব সমাজবন্দি!!!! কত প্রাগ্রসর জন নায়কেরা ”সকলকে এক করিবার কত না সাধনা” করেছেন। কেউ পারল না। এবার আমরা বন্দিত্বের দিশা থেকে সকলেই এক ও একাকার। জয় পুঁজির খাসলতে কমিউনিজমের জয়। কিন্তু কোন দোষে বা গুণে মানবসমাজ গণবন্দি? জানা নেই; শত্রুও অজানা অচেনা– তবে আমরা সবাই এবার নন্দলাল। নন্দিত নন্দলাল।
“নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তাহারে কেরা,
সকলে বলিল,’ যাও নন্দ,করো না ভায়ের সেবা“
নন্দ বলিল ‘ ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই–
না হয় দিলাম– কিন্তু অভাগা দেশের হবে কি?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার,ভেবে দরকার চারিদিক।
তখন সকলে বলিল– হাঁ হাঁ হাঁ তা বটে ঠিক।“
সমাজের প্রয়োজনের সময় যে নন্দলাল শুধু নিজের জন্য নিজেকে নিয়ে বাঁচার জন্য গৃহবন্দি থেকে সুসময়ে (?) এলে সমাজ উদ্ধার করতে চাইত বলে সে বড়ো নিন্দিত ছিল সমাজে;
“নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি,
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়ি খানি”
সেই আমরাই এখন সবাই নন্দলাল। ঘরে আছি বলেই আজ আর নিন্দিত নই–নন্দিত। “ঘরে থাকলেই মুক্তিযোদ্ধা ঘরের বাইরে গেলেই রাজাকার।’’ সময়ের দাপটে নন্দলাল কখনো নন্দিত কখনো নিন্দিত!
কোন দোষে আমরা ঘরে বন্দি? বৈশ্বিক নজরবন্দি। কী লেখা আছে এফ আই আরে। নদী নালা সাগর বন নারী আদিবাসী তথা সমগ্র প্রকৃতি গিলে খাবার পুরুষতান্ত্রিকতা; নাকি পুঁজিতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ জমে থাকা বিষের জ্বালায় দগ্ধ প্রাণ ও প্রকৃতি নাকি রাজনীতির ভরকেন্দ্র পাল্টানোর লীলা?
তিনি নিজে খেলছেন? নাকি কেউ তাকে নিয়ে খেলছেন?
তিনি কি প্রাকৃতিক? পুঁজির রমরমা যুগে তো EIQ এর বাজার দরের পাল্লা ভারী; ভারী কৃত্রিমসত্তা।
প্রাকৃতিক ভাইরাস তো জীবনেরই অনুষঙ্গ। আছে ভ্যাকসিনও।
তিনি কি প্রাকৃতিক? নিষ্পাপ বাদুড়বাহিত? মানুষের দোষে ছড়ায় প্রাণে প্রাণে?
না, কোন দূর চীন অচিন উহানের কাঁচাবাজারে — নাকি তাঁর জন্ম গবেষণাগারে? টেস্টটিউব বেবির মতো তিনি ল্যাবপ্রসূতি মায়ের সন্তান?
জন্মেই রাক্ষস।
ডাকিনী যোগিনী।
প্রাণসংহারী—খুনে খুনে রক্তাভ ছিন্নমস্তার নিয়তি নিয়ে তিনি আবির্ভূতা?
কে জানে? সবকিছু আর কী স্থান ও কালে জানা যায়? প্রকৃতির শাস্ত্রে গুপ্ত হায়ারোগ্লিফিক আমরা পাঠ করে কি শুধু বিজ্ঞানের নামে কর্পোরেটদের হাতিয়ার হিসেবে বিজ্ঞান এখন ভাড়া খাটছে?
বিজ্ঞানের কল্যাণমুখশ্রী বুঝি বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী?
সমাজদেহ-মন যারা পাঠ করেন যে প্রাগ্রসরেরা তারাও কি ওভারলুক করে গেছেন এসব অনাচার?
কিছুই কী নেই?
‘সব কিছু নষ্টদের হাতে?’
গণ মানুষের মতো গণ-ওভারলুক?
তা তো হতে পারে না।
প্রাণ ও প্রকৃতির ঘরের সাথে মানুষের জীবন বাঁধা। জীবন তো আর একাকী বেঁচে থাকা নয়। জীবন তো এক সম্পর্কের নাম। একের সহিত অন্যের মিলবার ও মেলাবার বিজ্ঞান। সকলের সাথে ‘‘তাহার অবারিত যোগ আছে” — সেই যোগের নামই জীবন। অথচ ওভারলুকিং নিয়েই আমাদের নতুন নতুন শব্দের সাথে বসবাস শুরু। আমার পাঁচ বছরের সন্তানের ঠোঁটে নতুন উচ্চারিত শব্দ; তাও আবার ইংরেজি শব্দ — শুনতে ভালোই লাগে — বন্দিদশাই ইংলিশ মিডিয়ামের কাজ করছে; সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং। কোয়ারেনরটাইন। লক ডাউন। পিপিই। মাস্ক। হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
পত্রিকাঅলারা ব্র্যাকেটে বাংলা মানে করে দিলেও কে শুনছে? বিশ্বায়নের ডাকে দিশেহারা পাগলপাড়া নজরবন্দি গণমানুষ খেলছে বাঘবন্দি লীলাখেলা। লীলার শরীরে কত রূপ অপরূপ একমাত্র তিনিই জানেন।
নতুন বাঘ নতুন ভরকেন্দ্র গদিনশিন হলেই তবে হবে তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ।
খ
সনাতন পরিবারে চৈত্র সংক্রান্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। চৌদ্দ শাক কুড়িয়ে রান্না করে সকলের পাতে দেয়া চাই-ই। সবগুলো যে কুড়িয়ে পাওয়া যেতো তা নয় — বাবা কিছু বাজার থেকে কিনে আনতেন। তখনো চারদিকে পতিত জমিন। খোলা মাঠ। পুকুর পাড়েই বসত শুরু হয়নি। ব্যক্তি মালিকানাধীন থাকলেও যে কেউ এমন চাতাল থেকে শাক কুড়িয়ে আনতে যেতে পারতেন। আমি আর মা বের হতাম শাক কুড়োতে। খুব সকাল বেলায়।
আমরা তখন অন্যের মাটিতে ঘরদোর তুলে থাকি। ভাড়া নিতেন না রাধেশ্যাম। জেঠা বলতাম আমরা। তার বাড়ির পেছনটা জঙলায় ভরা। কী নেই সেখানে সাপ বেজি থেকে শুরু করে শেয়াল পর্যন্ত। প্রকাণ্ড তেঁতুল গাছ ঘন ঝোঁপ গাব গাছ — সাথে রূপকথার জ্বিন ভূত সন্ধ্যায় তো নামেই — ভর দুপুরে গাবের ডালে বসে পা ঝুলাতে ঝুলাতে ভূতের কাঁচা গাব পাকা গাবের গল্প শুনে শুনে শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে লোম। আমাদের ভূত দেখা না হলেও যাপনে থাকে জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে — কোন কিছুই যেন ফেলনা নয় অথবা সবকিছু এমনকি বাড়ির গেইটের উপর বেড়ে ওঠা বাগানবিলাসও জীবনের সাথে বাঁধা। ষাট ষাট বলাই ষাটের ধান দুব্বা জলের ছিটায় বালাই ষাট আমি যেমন পেতাম তেমনি ঘরের দাওয়ায় সামনে দুপায়ের ভর দিয়ে বসে থাকা কুকুর বিড়ালও পেতো — পেতো তেঁতুল গাছ গাবগাছ মায় ভূত জ্বিনও। সকলেই এক সুতায় বাঁধা জীবন। একেকজন একেক পজিশনে খেলছি মাত্র।
বড় এলাকা জুড়ে মজা ডোবা। কচুরিপানা ও শ্যাওলায় ঢাকা। সেখানে চৌদ্দশাক পাওয়া না গেলেও ৫/৭ প্রকার শাক প্রাপ্তি একটি সাধারণ ঘটনা। দুপুরের পাতে গরম ভাতের সাথে শাকের মাখামাখিতে নাকের ভেতর এক অদ্ভূত গন্ধ এসে লাগত। স্বাদও। নানা রঙের শাকের সাথে গরম ভাতের লোকমা। কী যে ভালো লাগত! আহা! কী বাহারি স্বাদ!
এখন সংক্রান্তি একদিকে গেছে কর্পোরেটের হাতে বকুল তলায় নাচ-গান সেমিনারে। নগরবাসীর বাঙালিয়ানার ষোলকলা দেখাতে। অন্যদিকে এই সংক্রান্তি শুধু একটি বিশেষ ধর্মের মানুষদের — সকলের নয় — এমন একটি সাম্প্রদায়িক বয়ন ও বয়ান বাংলাদেশে কী করে যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো!
অথচ সংক্রান্তি ধারণার সাথে আছে সকল সপ্রাণ সত্তার নাড়ির বন্ধন। জীবনের সক্ষমতার জ্ঞান ও আধি ব্যাধির থেকে নিরাময় হবার গণিত। এ তল্লাটে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন সংরক্ষণ বণ্টনের একমাত্র নারীদের কাছে গচ্ছিত পরম্পরায় প্রজ্ঞা। দেহের সুস্থতার গার্হস্থ্য চিকিৎসাপত্র সংসারে নারীই দিতেন। পুরুষতন্ত্র শুধু খনার জিভই কাটে নাই নারীর সকল ক্ষমতার জমিন থেকে উৎখাত করে মহলে সাজিয়ে রেখেছে মহিলা করে — হোক সে কাপড়ের বেড় কিংবা ঘরের চৌহদ্দি অথবা নানা কিসিমের আইন দিয়ে।
এক নারী থেকে আরেক নারীর কাছে বাহিত রীতিনীতি মূর্ত হয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি চৌদ্দশাক কুড়োবার রীতিতে দুপুরের পাতে তিতা খাবার ঐতিহ্যে। চৈত্র সংক্রান্তি ধর্মীয় লোকাচার নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি আশ্রিত জীবনাচার। ” আমার সুরক্ষা আমার হাতে” এমন কথা এখন আকছার শুনছি। শুনছি ইমিউনিটি বাড়াবার কথা। আধিব্যাধি হলেই ক্লিনিকে ধর্না দেবার যে রীতি এখন গড়ে উঠেছে — আমার কৃষি সমাজে তেমন ছিল না; ছিল মৌসুমী রোগের জন্য মৌসুমী শাক — ব্যবস্থাপত্র দিতেন নারীরাই।
এই জীবনাচার কৃষি কৃষক কৃষিক্ষেত্রে উর্বরতার সাথে সম্পর্কিত। জমির উর্বরতা ও জমির স্বাস্থ্যই গোলা ভরা ধানের পূর্বশর্ত। তেমনি দেহের সজীবতা রোগ প্রতিরোধ করবার সক্ষমতাই মানুষকে সরস করে সবশ করে থাকে।
একদিকে ফিজিক্যাল স্ট্রেংথ অপর দিকে মেনটাল স্ট্রেংথ — দুটিই মৌসুমী শাক-সবজি খাবারের উপর নির্ভরশীল। সন্তানের পাতে তিতা তুলে দেবার — হোক সে নিম কিংবা হেলেঞ্চা বা দণ্ডকলস — প্রবণতা মায়ের মজ্জাগত প্রজ্ঞা।
জীবনের বাইরে কোন সংক্রান্তি নেই। বকুলতলায় নেই। আমাদের জীবন বাঁধা প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে। আমরা কীটনাশক রাসায়িক সার ব্যবহারের ফলে ভুলে গেছি শাকের গন্ধ। অধিক লাভের লোভে পড়ে বিষ খাচ্ছি। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। ধর্না দিচ্ছি ড্রাগ কর্পোরেটের কাছে।
কোভিড ১৯-এর আগ্রাসনে খোলসা হয়ে গেছে দেশে দেশে উন্নয়নের গালগল্প। প্রাণ ও প্রকৃতিকে বিষাক্ত করে যে উন্নয়ন সে তো নিজেই নিজের মুত্যুকূপ খনন করেছে। যে কূপ খনন করেছে তারই আগে পতিত হবার কথা। হয়েছেও বটে। মানুষ নিজেকে কেন্দ্র রেখে যে রাজনীতির বাক্-বিস্তার করেছে তা যে কত বড় শুভঙ্করের ফাঁকি টের পাচ্ছে সকলে তিন ফুট দূরত্বে সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নজরদারির জীবনে। সারা পৃথিবী জুড়ে এক ভঙ্গুর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
বিপদে পড়লেই নাকি মানুষের আক্কেল ফেরে। সময় হয়েছে সেই প্রাণ ও প্রকৃতির যে সম্পর্কের সূত্রায়ন তার অনুসন্ধান করার। প্রকৃতির গণিত জানা বোঝা ও প্রকৃতির সাথে জীবনকে প্রবহমান করে দেবার সকল বাঁধা বিপত্তি দূর করা — হোক সে বাঁধা শারীরিক কিংবা মানসিক। বাঁধা শুধু নদীদেহে নয়, আছে ব্যক্তিদেহে আছে সমাজ দেহেও — এমনকি ব্যক্তিমনেও আছে সমাজমনেও আছে। সকল ধরনের বাঁধার অপসারণ প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য জরুরি”
প্রয়োজন মুক্তধারা
হোক লড়াই
অচলায়তন ভেঙে পড়ুক।বাঁধ ভেঙে পড়ুক।
“let the river run free”
“let the river run free”
গ
কুট্টি কালে অন্য সবার মতো আমিও ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ ঠাডা মুখস্ত করেছি। কিন্তু কালে কালে বন আর বন্যের কাছে নেই। ঠোঁটস্থের কাছ থেকে সরে বন এখন পুঁজির দাপটে পুঁজিতন্ত্রের অবারিত অর্থনৈতিক জোন। খাড়া বিনোদনকেন্দ্র। পিকনিক পিপাসু নাগরিকদের ইকোপার্ক ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেদিন মাদারীপুরের মধ্যখাগদী এলাকায় ‘বিষ খাওয়াইয়া’ হত্যা করা হলো ১৪/১৫ টি বানর। শত বছর ধরে এই বনকেন্দ্রিক স্থানে মানুষ ও বানর পাশাপাশি বাস করে আসছে। এই ছোট্ট বনের বন্যেরা আর সুন্দর থাকতে পারল না। হত্যা করা হলো। অপরাধ বান্দরের বাঁদরামি না। অপরাধ জাস্ট ‘পেটের জ্বালা’ — ”কোন নিষ্ঠুর মানবের দেওয়া বিষ মেশানো খাবার খেয়ে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু।”
পুরো সংবাদটি পড়ার আগে আসুন সমস্বরে গাই :
শুনে হে মানুষ ভাই
সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
খবরে প্রকাশ, “জঙ্গলে খাবার মেলে না,তাই লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বানরগুলো। মানুষের বাড়ি ঘরে ঢুকে উৎপাত করে খাবারের জন্য। এটুকুই তাদের অপরাধ, পেটের জ্বালা।” প্রতিনিধির বরাতে পত্রিকায় আরো প্রকাশ, “ছোট বড় ১৪/১৫টি বানর পড়ে আছে মাটির ওপর। চারপাশ ঘিরে মানুষের জটলা। বানরগুলো কোন কোনটার নাড়াচাড়া নেই। কোনটা খুব কষ্ট করে মাথা তোলার চেষ্টা করেও পারছে না। মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা, রক্ত।”
সবার ওপর মানুষ সত্য গাইতে গাইতে আবার মুখস্থ বলুন বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। সামনে পরীক্ষা। ভাবসম্প্রসারণ আসিলেও আসিতে পারে।
সঞ্জীব কর্তা এই বন্দিদশায় অবলা বানর হত্যার সংবাদ পড়ে আপনাকে মনে পড়ল। বন্যেরা কীভাবে সুন্দর থাকবে কর্তা? বন্যের বাঁদরামি করে তো পেট ভরে না। খাবারের সন্ধান চাই। সেটুকু তো আমি কেড়ে নিয়েছি। যে বনায়ন আমরা করেছি সে তো ধনিক শ্রেণির হাতে তুলে দেয়া বনায়ন। এখানে বনবিভাগ আছে। ফরেস্টার আছেন। সারি সারি আকাশমণি গজারি আছে — গাছের ছাল কেটে আছে গাছের ক্রমিক সংখ্যা।
মাইলের পর মাইল রাবার আর একাশিয়া গাছের বিস্তার। বেশ লায়েক বটে; দ্রুত বাড়ে। লাগাচ্ছি আর কাটছি — বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পকেট ভারি হয়। বন জুড়ে বিদেশি গাছের উপনিবেশ — হোক সে মধুপুর গড় কিংবা গারো পাহাড় — সবই একই চরিত্র। সামাজিক বনায়নের নামে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক মুনাফাখোর বনায়ন। বনবাসী বনের যে-জ্ঞান বংশ পরম্পরা ধরে রেখেছে সেই প্রাণ ও প্রকৃতির চিন্তাকে ধারণ করে সেই জ্ঞান আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। পারলে হয়তো এভাবে বানরদের মরতে হতো না। বন-বনায়নের সাথে মানুষ ও পশুপাখির মৈত্রিভাবের যে-বন্ধন নিয়ে উৎপাদান ও পুনরুৎপাদনের যে গণিত সেই গণিত আজকের সামাজিক বনায়নে নেই। বন-বনভূমির মানে করেছি শুধু অর্থনৈতিক জোন হিসেবে ভাড়া খাটার ভাড়াটে লিজের জমি হিসেবে। জরায়ু ভাড়া দেবার মতো করে বনপ্রান্তর ভাড়া খাটাচ্ছি। একদিকে ইকোপার্ক নামে অন্য দিকে ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন যাপনের মানুষগুলোকে ভূমি থেকে উৎখাত করে।
বনভূমির যে ব্যাকরণ ফরেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিখেছে সেখানে তিনি মানুষ বন–বনানী পশুপাখি ফুল–ফল নিয়ে যে সামগ্রিক বনবিদ্যা তা তিনি শেখন নি — বনবিদ্যা এমন এক সহজাত প্রজ্ঞা যা প্রান্তিকের প্রান্তিকে থাকা নৃগোষ্ঠির মানুষদের করায়ত্ত; তাদের কাছেই শিখতে হবে উচ্চভূমির সাথে কীভাবে সমন্বিত করেই যাপনের ঘর নির্মাণ করতে হয় — উঠানের পাটি তিনি জানানে বলে পাহাড়ধস তাদের মাথায় সহসা ভেঙে পড়ে না যেমনটি ফি–বছর বাঙালি সেটলারদের মাথায় ভেঙে পড়ছে।
আজকে যে বন সেখানে কোন পাখি নেই, নেই পাখিদের কলকাকলী। ঔষধি গাছ নেই, ফলদ গাছ নেই ; খালি দ্রুত টাকা আয় করবার “পয়সাগাছ।” লাগাও পয়সা ঘরে তোলো টাকা। সেখানে প্রাণীর খাদ্য-সংস্থান হলো কিনা দেখার দরকার নেই। বাস্তুসংস্থানের নীতি নৈতিকতার দরকার নেই।
বাংলাদেশের সকল শিক্ষার্থী তাদের বাল্যকালে আপনার বাক্য ঠাডা মুখস্থ করে ভাবসম্প্রসারণ শিখলে জীবনের ব্যবহারিক পরীক্ষায় লিখতে পারল না, সঞ্জীব কর্তা। বেহুদা গাদা-গাদা ভাব সম্প্রসারণ শিখলাম। জীবনে একটাও কমন পড়ল না—শিক্ষাকে নদীর ওপারে ফেলে এসেছি কর্তা।
পুঁজিই যন্ত্রী।
তিনি যেমন চালান তেমন আমি চলি।
“জীবের পতি পুঁজি জীবনের সার
এসেছি পুঁজিতে ভবে শ্রীচরণ তার। “
সব তাহার লীলে গো সব তার লীলে। ঠাডা মুখস্থ করা বিদ্যে দিয়া কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।পুঁজির গণিত ঠিকভাবে বুঝতে না পারলে বান্দরের গতিই আমাদের গতি।
বানরদের এমন নিষ্ঠুর হত্যা আমাকে খুব ব্যথিত করেছে। অবলা জীবের খাদ্যের সংস্থান আমরা নষ্ট করে দিয়েছি। কাজে কাজেই খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে হামলা। চোর চুরি করে দায়ী, কিন্তু যে-ব্যবস্থায় জীবকে চোরে পরিণত করল সেই ব্যবস্থাও সমপরিমাণ দায়ী। তাই তো মহাজন মহাজ্ঞানীরা বলে আসছেন। বানরের হামলা তাঁর প্রাপ্য অধিকার বঞ্চিত করার ফল। অবলা জীবের লোকালয়ে খাদ্য সংগ্রহের উৎপাত চোখে পড়ল — তাঁর খাদ্য উৎস যে আমি ধ্বংস করেছি সেটাই আমার চোখে ধরা পড়ল না।
প্রাণ ও প্রকৃতির এমন অবাধ ধ্বংসের ফলই তো আজকের কোভিড আক্রান্ত কম্পিত বিশ্ব। গুণকেরা বলছেন, “প্যানডেমিক কোভিড ১৯ শেকস দ্যা ওয়ার্ল্ড।’’ আরেকটু পিছনে গিয়ে রবীন্দ্রভাষা টুকলিফাই করে বলি ”…এতো বাহ্য লক্ষণমাত্র — মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার (পড়ুন, সমগ্র মানুষের) মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।”
ঘ
বলিউড তারকা আয়ুষ্মান খুরানা “সব অর্ধনির্মিত” নামে চমৎকার একটি কবিতা তাঁর টুইটারে আপলোড করেছেন। বানর হত্যায় মেতে উঠে মনে হলো সত্যি আমরা অর্ধর্নিমিত। সেমি বিল্ট। কোথায় সম্পূর্ণতা নেই, নেই পূর্ণ চরিত্র। সব কিছু নিয়ে সব কিছুর সাথে আমরা অর্ধনির্মিত।
এখানে কোন বন্ধু নেই,
নেই কোন বিশ্বস্ত চরিত্র
যা আছে সব অর্ধনির্মিত।
অর্ধনির্মিত দালাল কোঠা,
অর্ধনির্মিত বাচ্চাদের দুষ্টুমি
অর্ধনির্মিত জীবনের শর্ত
অর্ধনির্মিত জীবনের গঠন।
অর্ধনির্মিত প্রেমিকের ভালোবাসা
অর্ধনির্মিত জীবনের ভাবনা।
অর্ধনির্মিত আজকের এই দিন
না আছে রোদ না ছায়া।
লক্ষ্যে পৌছনোর জন্য পা অর্ধনির্মিত
অর্ধনির্মিত স্বাস্থ্য।
না দেখেছি কখনো রোগহীন শরীর
না দেখেছি কখনো জীবনের মায়া।
এখানে যুবকের যৌবন ও অর্ধনির্মিত।
রোজ এক অর্ধনির্মিত চাদরে শুয়ে অর্ধনির্মিত স্বপ্ন বুনি। “
আহা।
সবার উপর সানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
ঙ
“What happens if all humans die? “কোটি টাকার প্রশ্ন নয় — এটি মনুষ্য প্রজাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।
সেদিন সদগুরুর লেকচার শুনছিলাম শুয়ে শুয়ে , “if all the human beings die, the planet will flourish.” কী ভয়ঙ্কর কথারে বাবা!! আমি না থাকলেই পৃথিবী পল্লবিত হয়ে উঠবে? আমি না শ্রেষ্ঠ জীব? শ্রেষ্ঠকে বাদ দিয়েই the planet will flourish?
যে মা আমার পৌষের সংক্রান্তিতে বাস্তুপূজা করতে গিয়ে ষাট-ষাট বালাই ষাটের জয়ধ্বনি গেয়েছে সে কি শুধু আমার জন্য? গরু কুকুর বিড়াল মানুষ গাছ গৃহদেবতাকে জল ধান-দুব্বায় যে আচমন করতে করতে সবাইকে বালাই ষাট বলত সেই মৈত্রিভাবের গাঁটছড়ার আহ্বান সকলের জন্য সকলকে নিয়ে। তবে যে বলছে আমাকে ছাড়াই পৃথিবী পল্লবিত হয়ে উঠবে?
তবে আমি কি নিজেই বহন করছি কোন অদৃশ্য ভাইরাস — কোভিড -১৯-এর মতো? যেমনটি কোভিডের ভয়ে আমি এখন ‘ঘরে থাকি আর জীবন বাঁচাই ‘শ্লোগান নিয়ে বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছি কালের নন্দলালের মতো?’ শুধু নিজের নিজের নিজেকে নিয়ে বাঁচা?’
এ জীবনে মানুষের না। প্রকৃতির আড়াআড়ি খাড়াখাড়ি জীবনের একটি সুতামাত্র। শ্রেষ্ঠত্বের নয় সে কেন্দ্রের নয় এমনকি সে কেন্দ্র নয় বরং একে অপরের উপর নির্ভরশীল পরিধির সাথে জড়িয়ে ছড়িয়ে থাকা একটি সুতা।
সকলের সাথে তাঁর অবারিত যোগ আছে।মানুষ গাছপালা প্রাণী মিলেমিশে যে জীবন সে জীবনই আমার জীবন। সেখানে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নয় বরং We are connected everything else. সুতরাং ”please pay attention and see. এবং কান পেতে শুনি ষাট–ষাট বালাই ষাটের মায়ের আশীর্বাদ বাণী when the source of creation has given equal attention to ant and you who the hell are you to think an ant is a lowly creature and you are some super human?”
কোন নিক্তিতে মেপে মেপে ছোট বড় মাঝারি দিয়ে সাজিয়েছি ভুবন? প্রত্যকেই অনন্য– জীবন একটি টোটাল ফুটবল মাঠ; যে যার পজিশনে খেলে খেলে জীবনকে গড়ে তোলে লীলায়ের ছাঁচে। নৃত্যছন্দই জীবনছন্দ। আর যে স্বরে গীত হয় তাও ইউনিভার্স। এই প্রাণ ও প্রকৃতিই ”সর্বভূতস্থত্মানং সর্বভূতানি চাত্মণি ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শন।” করে করেই আজকে গাইতে হবে সকলকে “This is all you have to know never look up to anybody. and never look down on anybody.Everything has its value.”
প্রাণ ছুঁয়ে গেল। ধন্যবাদ জানাই প্রাণ ও প্রকৃতির কবি জ্যোতি পোদ্দার দাদাকে।
অসাধারণ লেখা, ভালো লাগলো। শুভ কামনা।