বিশ্বসাহিত্যের আন্তর্জাতিকতাবোধ আর পাশ্চাত্য একাডেমিয়ায় অনুবাদ সাহিত্যের প্রসারের হাত ধরে মূলত তুলনামূলক সাহিত্যের বিকাশ হওয়ায় এখনো পর্যন্ত পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক তুলনার চর্চার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। প্রাতিষ্ঠানিক গঠন পাওয়ার প্রাক্কালে তুলনামূলক সাহিত্যের উদ্দেশ্য ছিলো জাতীয় সাহিত্যের সীমানা বিনির্মাণ, জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা এবং বিশ্বের অন্য অঞ্চলের সাহিত্য ও মানুষের কাছে নিজ (তথা জাতীয়) সাহিত্যের উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি আর ভিনদেশী ভাষার সাহিত্যের সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিসরে সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ।
তুলনার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা ও ব্যপ্তির সুযোগ থাকলেও (যেমনঃ নিজ জাতির সাহিত্য, লেখক ও অনুশীলনের মাঝেও তুলনা সম্ভব) মূলত সাহিত্যের ভাষা ও জাতিগত সীমানা অতিক্রম করাই ছিলো তুলনামূলক সাহিত্যের মূল লক্ষ্য। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্য যেমন সাহিত্যকে সীমানার পরিমন্ডল হতে মুক্ত করে, ঠিক একইভাবে উপনিবেশী এই সূত্রপাতের ইতিহাস ও আমাদের অন্তর্নিহিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপনিবেশী মনোভাবের দরুণ এই সাহিত্যের চর্চায় ও তৈরি হয়েছে একধরণের আধিপত্য আর সাংস্কৃতিক কতৃত্বের প্রবণতা। আর তাই প্রথম বিশ্ব তুলনামূলক সাহিত্যকে যেভাবে দেখে এবং ধারণ করে তার বিপরীতে (অথবা সমান্তরালে) তৃতীয় বিশ্বের কোন জাতির লেখক, অনুবাদক ও গবেষকের কাছ হতে এক ভিন্নধরণের রাজনৈতিক সচেতনতা কাম্য। ভাষাগত প্রাধান্য আর উপনিবেশী কতৃত্বের ইতিহাসের দরুণ বিশ্বায়নের যে বহুজাতিকতার ধারণা তার সাথে “প্রান্তিক বিশ্ব” ও সাহিত্যের এই টানাপোড়েন স্বাভাবিক। আর সেকারণেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই জাতীয় সীমারেখা পার করার ধারণায় হতে হবে কৌশলী, থাকতে হবে এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আর প্রাধান্যের কাঠামোর বিষয়ে সতর্ক।
এই সমস্ত বিষয়কে মাথায় রেখে তুলনামূলক সাহিত্যের বিউপনিবেশীকরনের যে আলাপ তাতে এই জাতীয় সীমা অতিক্রম করে অন্য জাতির সাহিত্যের সাথে নিজের সংযোগকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা হয়। অর্থাৎ উপনিবেশী তুলনামূলক সাহিত্য জাতীয় সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের অন্তর্ভুক্তিকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে তুলনামূলক চর্চায় বেশি আগ্রহী। আর এইখানেই তুলনামূলক সাহিত্যে অথবা সংস্কৃতির চর্চায় বিউপনিবেশায়নের সুযোগ তৈরি হয়। যা লক্ষ্যনীয় তা হলো তুলনামূলক সাহিত্যের চর্চার কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত রয়েছে ইউরোপ। তত্ত্ব, সাহিত্যের তুলনার মূল কাঠামো আর যে সমস্ত লেখক ও তাদের সাহিত্যকর্মের প্রেক্ষিতের উপর জোর দিয়ে এই তুলনামূলক সাহিত্যের চর্চা চলে তার কেন্দ্রে রয়েছে একধরণের উপনিবেশী “হেজিমনিক” আচার।
তুলনামূলক সাহিত্য মিল আর অমিলের তুলনার বাইরে আরো যা করে তা হলো লেখক অথবা সাহিত্যের ধারার উপর অন্য লেখক অথবা ধারার প্রভাব পর্যালোচনা এই প্রভাব পর্যালোচনায়ও একধরণের ইউরোপকেন্দ্রিকতা এবং ভিনদেশী তথা ইউরোপীয় নন্দনতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্বকে কেন্দ্রে রেখে তুলনামূলক কাজের প্রবণতা হরহামেশাই লক্ষ্যণীয়। উত্তরাধুনিক সময়কালের “intertexuality”-র পাশাপাশি এই পাশ্চাত্যকেন্দ্রিকতার যে আচার তুলনামূলক সাহিত্য বহন করে চলছে তার বিপদ মূলত দুই : প্রথমত, এই প্রবণতা তুলনামূলক সাহিত্যের মূল দর্শনের সাথেই বিপরীতমূখী এবং এতে আন্তর্জাতিকতার পরিসর কমে আসে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলক সাহিত্য পুনরায় উপনিবেশীকরনের এক নতুন হাতিয়ার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয় যা অপ্রত্যক্ষভাবে প্রচার করে যেন পাশ্চাত্য বা ইউরোপের পরিমাপে তুলনা বা বিচার ছাড়া কোন সাহিত্যকর্মের নিজস্বতার জায়গা ও আন্তর্জাতিক পরিসরে অবস্থান করে নেয়ার সুযোগ নেই।
ইউরোপকেন্দ্রিকতার যে সীমাবদ্ধতা দিয়ে এই সাহিত্যের বিকাশ সেইখানে দাঁড়িয়ে সচেতন বিউপনিবেশায়নের পক্ষের গোষ্ঠীকে তাই লক্ষ্য রাখতে হবে তুলনামূলক সাহিত্য যেন কন্ঠ হয়ে দাঁড়ায় তৃতীয় বিশ্ব ও প্রান্তিক সাহিত্যের বৈশ্বিকীকরণের। ইউরোপের এই আধিপত্যবাদকে রুখে দাঁড়ানো তাই উত্তর-উপনিবেশী তুলনামূলক সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যেই উত্তর-উপনিবেশী তুলনামূলক সাহিত্যের চর্চাকারীরা উদ্বুদ্ধ হন এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার মতো প্রান্তিক অঞ্চলের সাহিত্যের মাঝে মিল এবং অমিলের সন্ধানে অথবা কেন্দ্রীয় সাহিত্যের সাথে এইসকল সাহিত্যের মিল-অমিল খোঁজায়। এই তুলনামূলক চর্চার মাধ্যমেই সন্ধান পাওয়া যেতে পারে কেন্দ্রে থাকা অন্যান্য সাহিত্যের প্রেক্ষিতে দলিত ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর নিজস্ব চেতনা ও শোষণের বয়ান এবং তাদের বিবর্তনের ইতিহাস।
এই তুলনার ভেতর দিয়ে উঠে আসতে পারে এই সমস্ত সাহিত্যের নিজস্ব ভাষাগত আর কল্পনাপ্রসূত যে তারল্য ও অনন্যতা রয়েছে তার বিশ্লেষণ। এই তুলনার চর্চার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে শোষন আর বঞ্চনার ইতিহাস এই কল্পনার মাত্রায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। কিভাবে এবং কেন কখনো জাদুবাস্তবতা হয়েছে তাদের বাস্তব হতে পলায়নপর অন্তরাত্মার আশ্রয়স্থল অথবা কখনো বাস্তবতাবাদ রুঢ় হয়ে ফুটে উঠেছে তাদের সাহিত্যকর্মে। তাই তুলনামূলক সাহিত্যের রাজনৈতিক আলাপের কেন্দ্রে তুলে আনতে হবে এই প্রান্তে থাকা বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাহিত্যকর্মকে। এই আলাপ হতে হবে বহুমূখী আর অন্তর্ভুক্তিকেন্দ্রিক। এর মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে আধিপত্যের বিপরীতে সাংস্কৃতিক সংহতি তথা সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের জায়গা, যা হবে সাহিত্যক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী যে কতৃত্ব রয়েছে তার বিপরীতে একধরণের সাম্যবাদী ও প্রতিবাদী রাজনৈতিক অবস্থান।
তার অর্থ এই নয় যে কেন্দ্রীয় সাহিত্য বা ইউরোপীয় সাহিত্যের সাথে প্রান্তিক সাহিত্যের তুলনা থেকে আমরা তৃতীয় বিশ্ববাসী বিরত থাকবো। বরং তুলনায় রত হতে হবে এই সমস্ত উপনিবেশী আচরণকে মাথায় রেখে আরো সচেতন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক তৎপরতার সাথে। আমলে নিতে হবে তুলনারত দুই সাহিত্যিক অথবা সাহিত্যকর্মের আদর্শগত, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান ও মননের তফাৎ। তুলনা হতে পারে এই সমস্ত তফাৎকে মাথায় রেখে। অর্থাৎ অবস্থানগত অমিল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরকে আমলে নিতে হবে তুলনার ক্ষেত্রে। সচেতন হতে হবে তুলনার এই অসমতা এবং আধিপত্যের আচার নিয়ে এবং বাড়াতে হবে তুলনামূলক কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় রসদের জোগাড়।
আমরা বিশ্বের এই তুলনামূলক অথবা সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের দৌড়ে এখনো বেশ পিছিয়ে। এই প্রসঙ্গের তাত্ত্বিক আলাপ, গবেষণাকর্ম, একাডেমিক আলোচনা ও অনুবাদ সাহিত্যের ধারার প্রসারের অভাব আমাদের অন্যতম দুর্বলতা। অনুবাদ সাহিত্যের অপ্রতুলতার দরুণ আমাদের তুলনা করার জন্য সহজলভ্য “টেক্সট” -এর ঘাটতি রয়েছে যা বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের সাহিত্যকে পৌছে দিতে পারে তুলনার উপকরণ হিসেবে। অনুবাদে যা কিছু হারায় বলে আমাদের অনুতাপ রয়ে যায়, তার অনেক কিছুই অথবা তা হতে ভিন্নতর কিছু খুঁজে পাওয়ার যে সুযোগ অনুবাদ ও তুলনামূলক সাহিত্যের সংযোগ আমাদের এনে দিতে পারে, বিশ্বায়নের পৃথিবীতে বসে তার সম্পূর্ন সুফল নেয়ার কোন বিকল্প নেই।
প্রশ্ন উঠতে পারে জাতীয় সাহিত্য নিয়ে বিশ্ব বা তুলনামূলক সাহিত্যের দরবারে ঢুকতে অনুবাদ তথা অন্য ভাষারই যদি সাহায্য নিতে হয় সেক্ষেত্রে বিউপনিবেশীকরণের দর্শনের সাথে তা বিপরীতমুখী কিনা? এক্ষেত্রে নগুগি ওয়া থিয়োংর বিউপেনিবেশায়নের তরিকাই সমাধান হতে পারে-ভাষাগত এই রূপান্তর তথা অনুবাদ হতে পারে আমাদের জন্য অন্য জাতি ও সমাজের সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের মাধ্যম। তাই তুলনামূলক সাহিত্যের বিউপনিবেশীকরনের নিমিত্তেই আমাদের অনুবাদ সাহিত্যে জোর দেয়ার বিকল্প নেই। এছাড়াও বিশ্বায়নের সুবাদে সাহিত্যের ইলেকট্রনিক আদান-প্রদানের সুযোগ তৈরি হওয়া হতে পারে তুলনামূলক সাহিত্যের জন্য সুবিধা নেয়ার এক নতুন সুযোগ।
দুঃখজনকভাবে এখন পর্যন্ত মুনীর চৌধুরীর লেখা “তুলনামূলক সমালোচনা” (১৯৬৯) নামের একমাত্র তুলনামূলক সাহিত্যের উপর গঠনমূলক আলাপের বই ও কেবলমাত্র একটি তুলনামূলক সাহিত্যের বিভাগ যার বয়সব্যপ্তি ও বেশিদিনের নয়, এই নিয়েই বাংলাদেশে এই শাখায় আগ্রহীদের এগোতে হচ্ছে, ফলত আমাদের তুলনামূলক সাহিত্য গবেষণার ধারাও কোন না কোনভাবে প্রবাহত হচ্ছে বিদেশী ডিগ্রী এবং গবেষণাকর্ম দ্বারা। এইখানে উল্লেখ্য যে এমন কি বিশ্বব্যপী তুলনামূলক সাহিত্যের যে ধারা, বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের অধীনে এর যে পড়াশোনার চর্চা তাতেও অনেক ক্ষেত্রেই ভাষাগত “সীমাবদ্ধতা”-র দরুণ অবহেলিত রয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে রচিত বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার। বিভিন্ন আধুনিক ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগে যে একাডেমিক চর্চা সেখানে এই ভিন্ন বিশ্বের (এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তৃতীয় বিশ্বের) সাহিত্য রয়ে যাচ্ছে অপঠিত ও অবহেলিত।
বিশ্ব সাহিত্য, জাতীয় সাহিত্য আর তুলনামূলক সাহিত্যে্র এই মেলবন্ধনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে যা মাথায় রাখা জরুরি তা হলো, “নিজ”কে পুরোপুরি জানতে যেই “অপর”-এর সন্ধান প্রয়োজন, তুলনামূলক সাহিত্য আমাদের দেখা করিয়ে দেয় সেই অপরের সাথে। তুলনামূলক সাহিত্যের উসিলায় এই বিশ্বায়নের নতুন জগতে নিজের ভিত শক্ত করতে তাই যা অত্যাবশ্যক তা হলো এই অন্তর্ভুক্তির প্রবণতা, নিজ তথা জাতীয় সাহিত্যের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে অপরকে জানা বোঝা এবং নিজের পূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার আবিষ্কার। নিজ ও অপর, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, কেন্দ্রিক ও প্রান্তিক অথবা প্রথম ও তৃতীয় বিশ্ব ইত্যাদি নানামাত্রার বিভাজন নিয়ে গড়ে ওঠা মজ্জাগত উপনিবেশী মননকে তাই বিউপনিবেশায়নের প্রচেষ্টা হতে পারে উত্তর-উপনিবেশী প্রান্তিক বিশ্বের জন্য তুলনামূলক সাহিত্যের রাজনৈতিক অবস্থান। আর এই “অপর” দিয়ে “নিজ” কে বোঝার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অন্য সময়, প্রেক্ষাপট আর স্থানের সাহিত্যের সাথে সংযোগের যে বহুমাত্রিকতার সুযোগ তুলনামূলক সাহিত্য তৈরি করে দেয় তার মাধ্যমেই কোন সাহিত্যকর্মের পক্ষে আরো সমুজ্জ্বল আর পূর্ণ হওয়া সম্ভব।
চমৎকার আলোচনা। গবেষককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।