তারুণ্য যে শক্তি, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা তাই শুরুর আলাপে নিয়ে এসেছি তরুণ ও তারুণ্যকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণ শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চাকরিপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার, আলাপের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি লিখিত হয়েছে।
‘আমরা চঞ্চল/ আমরা অদ্ভুত/ আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ গান লিখেছিলেন শত বর্ষ আগে। মূলত তারুণ্যই প্রাণ, তারুণ্যই শক্তি। রবি ঠাকুর আরও লিখেছিলেন, ‘ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা/ আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো কেমন আছে এ কালের তরুণেরা? কোন পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারুণ্য? যে তরুণ আজ হেসে খেলে গান গায় সে কী ভাবে? যে গায় না, সেইবা কী ভাবে? কেন সে বিষণ্ণ হয়? কী চায় সে? অস্পষ্ট আর ধূসর হয়ে ওঠে কি স্বপ্নগুলো? কিংবা কী স্বপ্ন তারা দেখে? এই সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমরা মুখোমুখি হয়েছি তরুণদের।
সঙ্গী যখন প্রযুক্তি
বেশির ভাগ তরুণের হাতেই আজ প্রযুক্তির উপকরণ; কারো হাতে মোবাইল, কেউবা ধরে আছেন ট্যাব। কেউবা ল্যাপটপে মাথা গুঁজে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ প্রযুক্তি আজ কাজ, পড়ালেখা, চাকরি, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এই সব প্রযুক্তি ছাড়া চলা বড় কঠিন। কারণ ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছাড়া পৃথিবীর সঙ্গেই আজ যোগাযোগ অসম্পূর্ণ লাগে। কিন্তু প্রযুক্তি আবার অনেকের কাছে ম্যানিয়ার মতো। তারা বেশি দিন একটি মোবাইল সেট বা ল্যাটটপ বা অন্যান্য গেজেট ব্যবহার করতে পারেন না। একে বলা হয় টেকনোম্যানিয়া। অনেক তরুণই এই ম্যানিয়ায় আক্রান্ত।
বই পড়ি, তবে
এমন একটা সময় ছিল যখন বই পড়া, উপহার দেয়া ও বিনিময় ছিল বন্ধুত্ব ও সামাজিক সম্পর্কের প্রধান মাধ্যম। নব্বই দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক অভ্যাস সচল ছিল। কিন্তু এই কালে মুদ্রিত বইয়ের প্রতি অনেকের আসক্তি বোধ করেন না। কারণ বইয়ের বিকল্প হয়ে উঠেছে ট্যাব বা মোবাইলের পিডিএফ বই। তার মানে, বই পড়া হচ্ছে; তবে প্রথাগত বইয়ের কাঠামোতে গড়ে ওঠা বই নয়। কী বই পড়ি? এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ বলেছেন, আত্ম-উন্নয়নমূলক বই, আত্মবিশ্বাস তৈরি করে এমন বই পড়তে ভালোবাসেন। কারো কাছে ভালো লাগে গল্প-উপন্যাস। কেউ পছন্দ করছেন লাইফ স্কিল বাড়ানোর মতো বই। বই বিক্রির বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এ ধরনের বইয়ের চাহিদাই লক্ষ করা যায়।
দিন কেটে যায়, আশায় আশায়
অনেক তরুণ বিষণ্ণতায় ভোগেন। নিজের চাওয়া পাওয়ার কথাগুলো কারো সঙ্গে ভাগ করেও নিতে চান না। নিজেকে গুটিয়ে নেন। কেউ কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ। হতাশার ও বিষণ্ণতার অনেকগুলো কারণ উঠে এসেছে। সেগুলোর ভেতর প্রধান কারণ ব্যক্তিগত। তাছাড়া পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিসরে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে হতাশ হন তরুণরা। সম্প্রতি বলিউডের বিখ্যাত এক অভিনেতার আত্মহত্যাও কাউকে কাউকে হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছে। অথচ সবাই চান হতাশা থেকে মুক্তি। প্রশ্ন : কীভাবে? কী চান তারা? বরং উল্টো প্রশ্নও অনেকে করেছেন কী নিয়ে আশাবাদী হবেন তারা?
‘‘হেইট পলিটিক্স’’
নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইলে অনেকে তরুণ লিখে থাকেন : হেইট পলিটিক্স। রাজনীতির আলাপেও ভীষণ অনুৎসাহী তাঁরা। কারণ হিসেবে অধিকাংশই উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক আদর্শবাদের অভাব এবং গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের অভাবকে। তাঁরা মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু কিংবা মণি সিংহের মতো নেতা খুঁজে পান না রাজনৈতিক আদর্শের জগতে। ভবিষ্যত নেতৃত্বের চিহ্ন খুঁজে পান না নতুন নেতৃত্বে। তাছাড়া রাজনীতিকে অনেকের কাছে দুর্নীতিকরণ, অর্থ উপার্জন এবং সম্পদ আত্মসাতের হাতিয়ার বলে মনে হয়। তাই রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন। মজার ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেক তরুণ রাজনীতির ভেতরমহল ঘুরে এসে চলে গেছেন রাজনীতির বিপক্ষে।
চাকরি চাই, চাকরি চাই
স্লোগানের মতো বুকের ভেতর বাজে : চাকরি চাই, চাকরি চাই; হয়তো স্বপ্নের ভেতরও বেজে ওঠে এই ধ্বনি। কিন্তু চাকরি কোথায়? কী চাকরি আছে চাকরির বাজারে? পর পর কয়েক বছর সিভিল সার্ভিস কমিশনে অংশ নিয়েও অনেকের পছন্দসই চাকরি হয়। প্রথম পছন্দ প্রশাসন, দ্বিতীয় পছন্দ পুলিশ, কাস্টমস বা ইনকাম ট্যাক্স। শিক্ষকতা পছন্দের তালিকার শেষ দিকে। এর কারণ হিসেবে তরুণরা মনে করেন, প্রথম পেশাগুলো সরাসরি ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে। বলা যায়, ওই পেশাগুলো ক্ষমতার সমার্থক। কিন্তু শিক্ষকতায় সে মজা নেই। অবশ্য এটাও তাঁরা মনে করেন যে, শিক্ষকতা জাতি গঠনে সহায়ক। এ পেশায়ও তরুণদের আসা উচিত। ভালো ফল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আসার ব্যাপারে অনেকে ইচ্ছুক থাকলেও সংশয় বোধ করেন নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে।
শেষ কথা
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এক সৌভাগ্যের কাল অতিবাহিত হচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো তরুণদের শক্তি ও মেধাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা। তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণদান হতে পারে বিরাট একটি পদক্ষেপ। কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে ঋণখেলাপি ও চোরা কারবারিদের হাতে। তরুণদের হাতে এই পরিমাণ টাকার সামান্য অংশ থাকলেই দেশের অবয়ব বদলে যেত। দুর্নীতি করার মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। রাষ্ট্রের উচিত এই প্রবণতার হাত থেকে তরুণদের রক্ষা করা। রক্ষা করার জন্যে চাই রাষ্ট্র ও সরকারের দুর্নীতিবিরোধী নিরপেক্ষ ও জোরালো পদক্ষেপ। তা না হলে ভবিষ্যতের তরুণরাও দুর্নীতিপরায়ণতার ছকে প্রবেশ করবে। তরুণদের জন্য চাই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ