পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগে বর্তমান মেক্সিকোর আলতামিরা গুহার ভেতরের দেয়ালে কারা কারা যেন এঁকে রেখেছিল বাইসন এবং মানুষের হাতের ছাপ। কেন তারা এমন করে রেখে গেল? কি কারণে হলো হায়ারোগ্লিফিক, সিন্ধুলিপি, বা কিউনিফর্মের উৎপত্তি? কিংবা চীনে কাগজ, মধ্যপ্রাচ্যে পার্চমেন্ট, ইউরোপে ছাপাখানা? আর ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব থেকে শুরু করে এই যে এখন অব্দি স্থির বা চলচ্চিত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইল, ভার্চুয়াল অথবা অগমেন্টেড রিয়েলিটি—আমরা আসলে কি চাই? এসকল দার্শনিক অনুসন্ধান আমাদের নিয়ে যায় যে উত্তরের দিকে, তাকে আমরা একাডেমিক ভাষায় যোগাযোগ (human communication) বলি। আরো সহজ করে নিলে, মানুষ আসলে গল্প বলতে চায়।
গত এক শতাব্দীতে মানুষে-মানুষে যোগাযোগের ধরণ (mode), উপায় (channel), এবং পদ্ধতিতে (method) যে পরিবর্তন এসেছে এবং এখনো হয়ে চলছে, তা অভূতপূর্ব, যেমনটি হয়নি এর আগের প্রায় দু’লক্ষ বছরেও। মাটির ঢেলার, বাকলের, কাগজের গল্প এখন ডিজিটাল স্ক্রিনে উঠে আসছে, কম প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে বই-খাতা-কলম-পত্রিকা-টেলিভিশন-রেডিও-ম্যাগাজিন কিংবা বুড়োদের থেকে শাস্ত্র শোনা। এই যে আমরা যাকে “গল্প” বা “গল্পবলা” বলছি, এটি আসলে কি? দুইভাবে একে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি। প্রথমত, যোগাযোগের যেকোনো উপাদানই (content) গল্প, একে আমরা সামাজিক উৎপাদ (social artefact) বলি; আর মানুষের যেকোনো যোগাযোগই গল্পবলা। সার্থক যোগাযোগের প্রধানতম শর্ত অর্থপূর্ণ তথ্যের (meaningful information) আদান-প্রদান। কোনো তথ্যকে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে গেলে এর একটা ছোট বা বড় শরীর (narrative body) থাকা লাগে, একটা প্রেক্ষাপট (context) থাকা লাগে, এবং খানিকটা গুরুত্ব (value) থাকা লাগে। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের “গল্পবলা” খানিকটা ভিন্ন জিনিস, “abduction” যেমন দর্শনে ঢুকলে এক অর্থ দেয় এবং মেডিকেল সাইন্সে দেয় আরেক অর্থ। সাহিত্যের গল্পে সাহিত্যিক অলংকার এবং নান্দনিকতা থাকা লাগে, এই গল্প এবং গল্পবলাকে মাপা হয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লিখিত ভাষায় এবং কিছুক্ষেত্রে মুখে-মুখে এই গল্প বলে গল্পকার। তো, সেই আলতামিরার গুহাচিত্র কিংবা মেসোপটেমিয়ার “এপিক অফ গিলগামেশ” থেকে শুরু করে মানুষের যে গল্প এবং গল্পবলার শুরু, তা ডিজিটাল যুগে কেমন চেহারা পেয়েছে জানা জরুরি।
ডিজিটাল গল্পবলা (digital storytelling) হলো ডিজিটাল স্পেসে বা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ বা গল্পবলা। বলে নেয়া ভালো, এই লেখায় “গল্পবলা” দিয়ে বৃহদার্থে যোগাযোগকে বুঝানো হয়েছে, এবং ডিজিটাল গল্পের জটিল তাত্ত্বিক আলাপে না গিয়ে বরং কেবলমাত্র এর কিছু সাধারণ ধারণার দিকে আলো ফেলা হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যম অফলাইন এবং অনলাইন যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্তত তিনটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। প্রথম পার্থক্য স্থান-কালের। ডিজিটাল স্পেসের কোনো শরীরী (tangible) অস্তিত্ব নেই যেমনটা রয়েছে বস্তুজগতের বই-খাতা-কলম-টেবিল-লাইব্রেরীর। এর ফলে ডিজিটাল স্পেসের গল্প বা গল্পবলা স্থানিক সীমাবদ্ধতা (spatial limitation) অনেকখানিই অতিক্রম করে যায়, যদিও এখানেও স্থানের হিসেব আছে কিন্তু তা প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন। ডিজিটাল তথ্যের একক বিট (bit) যা সংরক্ষণের ব্যবস্থা বস্তুজগতের লাইব্রেরী-খাতা-রেকর্ডারের চেয়ে আলাদা। যে কারণে ডিজিটাল টেক্সটকে সহজে স্বল্প স্থানে অধিকতর সুরক্ষিতাবস্থায় রাখা যায়। পকেটে অনায়াসে বহন করা এক হাজার মেগাবাইটের ডিজিটাল গল্পকে কাগজের গল্পে রূপান্তরিত করতে গেলে এক লাইব্রেরী সমান জায়গা প্রয়োজন পড়বে। দশটা বই দশ বছর সংরক্ষণ করতে গেলে তা পানি ও পোকামাকড় থেকে দূরে, ধুলোময়লা থেকে পরিষ্কার এবং আরো যা যা নষ্টকারক রয়েছে তা বাঁচিয়ে সাবধানে রাখা লাগে, কিন্তু সমপরিমাণ ডিজিটাল বই বা ই-বুককে স্বল্প ঝুঁকিতেই দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। উল্লেখ্য, এনালগ তথ্যকে ধ্বনি বা বর্ণের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়, আর ডিজিটাল তথ্যকে প্রকাশ করা হয় কোডের মাধ্যমে: বাইনারি ডিজিট (০ এবং ১) দিয়ে এবং HTML (Hyper Text Markup Language)-এর মাধ্যমে। একটি ওয়েবপেজে সাধারণত সময়ের উল্টোক্রমে (reverse order) কন্টেন্টগুলো সাজানো থাকে যা সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় তা সে যখনকারই হোক না কেন। খোঁজকরা এবং সংরক্ষণ-সুবিধার কল্যাণে ডিজিটাল স্পেসের গল্প সময়ের সীমাবদ্ধতাকেও ভালোভাবেই পেরিয়ে যায়। ডিজিটাল টেক্সট সহজে স্থানান্তর, পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনযোগ্য; অল্প খরচে স্বল্প সময়ে অধিকপরিমাণে পুনরুৎপাদন, বিনিময়, এবং প্রচারযোগ্য। ডিজিটাল স্পেসে কথা বলার জন্য মুখোমুখি (face-2-face) হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না বলে এটিতে একসাথে একইসময়ে বহু লোকের আলাপচারিতা সম্ভব হয়। এটি বড়ধরণের যোগাযোগবন্ধন (communication network) তৈরির জন্য সহায়ক।
যোগাযোগ বা গল্পবলার ক্ষেত্রে দুটো পক্ষ থাকে: গল্পকার (source) যে গল্প বলে, এবং শ্রোতা (receiver) যে গল্প শোনে। অফলাইন গল্পকার এবং শ্রোতাদের পদবী এবং দায়িত্ব অনেকাংশেই বদলে দিয়েছে ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমসমূহ। গল্পকার বা গল্পলেখক হয়ে উঠেছে উৎপাদক যারা ডিজিটাল কন্টেন্ট উৎপাদন করেন। এই উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে গেলে তাদেরকে ডিজিটাল টেকনোলজি সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে হয়, যেমনটা হতে হয় শ্রোতাকেও, এই উৎপাদিত ডিজিটাল সুবিধা/পণ্য ভোগ করতে চাইলে। সামাজিক মাধ্যম, ব্লগোস্ফিয়ার বা ওয়েবপেজে বলা ডিজিটাল গল্পের প্রধানত চার ধরণের কন্টেন্ট পাওয়া যায়: টেক্সট, ছবি, অডিও, এবং ভিডিও। সে হিসেবে ডিজিটাল গল্পকার একাধারে ফটোগ্রাফার/মেকার, ভিডিওগ্রাফার/মেকার, লেখক, গ্রাফিক্স ডিজাইনার। এসব কন্টেন্ট নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যেমন: ভিজিবিলিটি বা প্রাইভেসি সেটিংস, অডিয়েন্স নির্ধারণ। আবার ডিজিটাল স্পেসের সহজ ও বহুমুখী যোগাযোগের কারণে এবং অন্যের দেখাদেখি (mirror effect) যারা আগে পাঠক বা শ্রোতা ছিল তারাও ডিজিটাল উৎপাদক হয়ে উঠতে পারে। উল্লেখ্য, যারা উৎপাদক তারাই গ্রাহক বলে এদেরকে প্রোজিউমারও (prosumer = producer + consumer) বলা হয়ে থাকে। একই প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ধরণের কন্টেন্ট তৈরি এবং বিতরণের সুবিধা থাকায় মাল্টিমিডিয়া গল্পবলা (multimedia storytelling) ডিজিটাল গল্পবলাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। পাশাপাশি, হাইপারটেক্সট (hypertext) বাড়িয়েছে সংযুক্তির সুবিধা। এটি হলো যোগাযোগের একটি কন্টেন্টের সাথে প্রয়োজনানুসারে ভিন্ন ভিন্ন আরো কন্টেন্ট বা কন্টেন্টের উৎস লিংকের মাধ্যমে সংযুক্ত করা। এতে করে অল্প সময়ে অল্প কথায় অল্প জায়গায় ব্যাপক পরিমাণ তথ্যের সংযোগ ঘটানো সম্ভব হয়, যার ফলে যোগাযোগ আরো পরিপূর্ণ এবং অর্থবহ হয়ে ওঠে। এছাড়াও মেনশন এবং ট্যাগিং দিয়ে একইসাথে বহু মানুষকে এবং গল্পকে একত্রিত করা যায়। #হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সারা পৃথিবীব্যাপী একই চিন্তার একই কথা বলা মানুষগুলো একসাথে যুক্ত হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে, যে অনলাইন সম্মিলন কিনা বিভিন্ন অফলাইন আন্দোলনেও গড়াচ্ছে, যেমন: মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত, উত্তর আমেরিকায় #MeeToo, #BlackLivesMatter। আবার, সমমনা অনলাইনবাসীরা (netizen) নিজেদের মধ্যে ছোট-বড় গ্রুপ করে সেখানে দলীয় যোগাযোগ করে: বাংলাদেশে ফেসবুক যোগাযোগের উপর ভিত্তি করে প্রসার পাওয়া কোটা আন্দোলন এবং সড়ক আন্দোলন এর দুটো গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
যেহেতু ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারকারিরা সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত অর্থাৎ ডিজিটাল কন্টেন্ট উৎপাদক, সেক্ষেত্রে সহজাতভাবেই শ্রমের আলাপ চলে আসে, যে শ্রমকে ডিজিটাল শ্রম (digital labor) বলা হয়। কিন্তু এর বিনিময় মূল্য কি? এই শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদকেরা সাধারণত যা পায় তা হলো বিনোদন, নেটওয়ার্ক, তথ্য, এবং কিছুক্ষেত্রে অর্থ। কিন্তু ব্যাপক স্বেচ্ছা-ডিজিটাল-শ্রম উৎপাদক-ব্যক্তিটির জন্য তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বয়ে আনে না। বরং এটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা অর্জনের জন্য সহায়ক। একজন ব্যক্তি ডিজিটাল মিডিয়ায় যতো সময় কাটাবে, যতো যোগাযোগমুখী হবে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ততো লাভবান হবে। এজন্য সামাজিক মাধ্যমগুলো সাধারণত এমনভাবে ডিজাইনকৃত যা অনেকটা গোলকধাঁধার মতো: ঢোকা সহজ কিন্তু বেরিয়ে আসা কঠিন। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক (৯৪%), এবং এর ব্যবহারকারীদের উল্লেখযোগ্য অংশ দৈনিক তিন ঘন্টার বেশি বিনা বা অল্প লাভে এই প্ল্যাটফর্মে ব্যয় করে। এই বড় অংকের নিট শ্রমের যোগাযোগ আমাদের সত্যিকারার্থে কতোটুকু কাজে লাগছে তা ভাববার ব্যাপার।
দিনদিন ডিজিটাল যোগাযোগের ব্যাপ্তি অবশ্যই পুরোনো যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জন্য হুমকি। যেমন: বাংলাদেশে গত দশবছরে অনলাইন সংবাদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পত্রিকার সার্কুলেশন নেমে গেছে অর্ধেকেরও কম। উপরন্তু, করোনাভাইরাস মহামারীর সময় অধিকাংশ মানুষ দাবী করছে প্রিন্টের চাইতেও ডিজিটাল তথ্য তাদের জন্য বেশি উপকারী। এটি আগেকার যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জন্য এক ভয়ানক সংবাদ। আবার অন্যভাবে দেখলে, এটি ডিজিটাল যোগাযোগপ্রযুক্তির সাথে পুরোনোদের মিলিত হওয়ার একটা সুযোগও। ইতোমধ্যে আগের যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তাদের বাসা খুঁজে নিচ্ছে অনলাইনে: বই থেকে ই-বুক, সংবাদপত্র থেকে অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশন চ্যানেল থেকে অনলাইন টিভি, ডায়রি থেকে ব্লগ। একটি মুদ্রার যেমন দুটো বিপরীত পিঠ রয়েছে, তেমনি ডিজিটাল যোগাযোগের বিবিধ সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও রয়েছে। কিন্তু দিনশেষে ব্যক্তিমানুষই নির্ধারণ করবে কোনটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থেকে যাবে, আর কোনটি চলে যাবে জাদুঘরের দিকে।