ছেলেবেলার গাছেরা

“যতদিন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম ততদিন অসীম ‍মুগ্ধতা, বিস্ময় এবং অপরিণামদর্শিতা নিয়ে আমি অনন্য ছিলাম। বয়স্ক হবার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ অন্যান্যদের মতোই হয়ে গেছি।’

                                                                                       ‘‘অক্ষয় মালবেরি’’, মনীন্দ্র গুপ্ত

এই মুগ্ধতার বয়সটা অদ্ভুত! আগাগোড়া রঙে মোড়ানো! ছেলেবেলায় যা দেখে মানুষ মুগ্ধ হয় জীবনভর সেটা বয়ে বেড়ায়। সেই বস্তু, প্রকৃতি বা ভূগোল হয়ত বদলে যায় কিন্তু মানুষ অবিচ্যুত রঙে তাকে আগলে রাখে। কখনো কখনো নেড়ে চেড়ে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে হয়ত আরো খানিকটা রঙের আঁচড় মেখে সযত্নে সংরক্ষণ করে। ছেলেবেলা এমন একটা গহ্বর যাপিত জীবনের নাভিশ্বাস থেকে পালিয়ে যে গহ্বরে মানুষ লুকিয়ে পড়তে চায়।

 

আমারও ব্যতিক্রম নয়। তবে সমস্ত ছেলেবেলার গল্প ফেঁদে বসার অভিসন্ধি এ মুহূর্তে নেই। বলতে বসেছি কেবল গাছেদের গল্প- ছেলেবেলার গাছ। যাদের বেশিরভাগই হয়ত হারিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ হারিয়ে গিয়েছে স-বংশে। ছেলেবেলা যেমন কখনো মলিন হয় না একটা জীবন্ত অস্তিত্বের মতো বর্তমানের কাছেপিঠেই নিঃশব্দে হেঁটে চলে। সে গাছগুলোও তেমনি। মনে হয় এই তো দাঁড়িয়ে আছে দু-হাতের সীমায়। অথচ হাত বাড়ালে নাগাল মেলে না। অনেকটা হারিয়ে যাওয়া স্বজনের মতো। মনে হয় এই তো পাশেই, অথচ স্পর্শের অতীত!

 

বাবার চাকরিসূত্রে গাছগাছড়ায় ঘেরা স্কুল কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম। আমার মেজোবোনের চিরকাল মাথা ব্যথা রোগ। মানুষজন বলত আমাদের বাসাটা আগে ঘন জঙ্গল ছিল। পাশ দিয়ে গেলেই মানুষের মাথা ধরত। সেই সুবাদেই নাকি আমার বোনের মাথাধরা রোগ। সে যাই হোক অমন ঘন জঙ্গল দেখার সৌভাগ্য না হলেও আমাদের ভাঙাচোরা টিনের বাসাটা গাছগাছালি পরিবেষ্টিত ছিল। তাদের কথায় পরে আসছি। আগে বলি আমার সবচেয়ে প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছটার কথা।

 

আমাদের স্কুলটা বা স্কুল দুটো ছিল এল আকৃতির। হাই স্কুল আর প্রাইমারি স্কুল পাশাপাশি মাঠের উত্তর-পশ্চিম জুড়ে। প্রথমে হাই স্কুলের দোতলা দালান এরপর প্রাইমারি স্কুলের টিনশেড। আর তারপর বেঁকে গিয়ে আবার হাই স্কুলের একতলা একটা দালান। তার পাশে পরে আরেকটা দালান হয়েছিল। প্রাইমারির টিনশেড আর হাইস্কুলের একতলা দালান যে কোণটা তৈরি করেছিল সেখানেই গাঢ় ছায়া বিছিয়ে ছাতার মতো দাঁড়ানো ছিল কৃষ্ণচূড়া গাছটা। যখন ফুলের ঋতু নয় তখন সে সবুজ ছাউনির মতো মৌন ধ্যানে দাঁড়িয়ে থাকত। আর যখন ফুল ফুটত তখন তার আরেক রূপ। ফুল ফোটা ঋতুতে রোজ গিয়ে কৃষ্ণচূড়ার বিছিয়ে থাকা লাল পাপড়িতে বিনি সূতোর মালা গাঁথতাম আমি। এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই ৮/১০ বছরের আমাকে বিছিয়ে থাকা লাল কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ির ওপর বসে বুঁদ হয়ে মালা গাঁথতে দেখতে পাই। বছর দুই আগে একবার স্কুলে গিয়েছিলাম। গাছটা আর দেখতে পাইনি। অথচ আমার সঞ্চিত শৈশবে কী উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে এখনো বেঁচে আছে গাছটা!

শৈশব বলতেই আর যে গাছগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার পয়লাতেই বলতে হয় আমাদের বাসার উত্তরে স্কুলে যাবার রাস্তার পাশে দাঁড়ানো শিমুল গাছের কথা। বসন্ত এলে গাছটা লালে সাজত। এর ফুলও আমি প্রতিদিন কুড়াতাম। তবে সেটা মালা গাঁথবার জন্য নয়। শুকিয়ে জ্বালানি হতো শিমুল ফুল। ফুল ফুরিয়ে ফল হতো। অর্থাৎ তুলো ভরা শিমুল। উঠোনে বিছিয়ে রাখা হতো সেগুলো। তারপর খানিকটা শুকিয়ে উঠলে বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে ফাটিয়ে তুলো বের করা হতো। কখনো কখনো শুঁয়োপোকার মতো কিলবিলে এক পোকা বেরুতো। সে আমার জন্য বিভীষিকা। তবু তুলো বের করবার কাজাটা আমি ভালোবাসতাম। এখনো নাকে সেই তাজা তুলোর গন্ধ এসে লাগে।

 

স্কুলে যাবার রাস্তার মুখে, বাসার উত্তর-পশ্চিম কোণে মুখোমুখি দাঁড়ানো ছিল একটা কাঁঠাল আর একটা শিরীষ গাছ। শিরীষ গাছটা কেন যে কেটে ফেলেছিল মনে পড়ে না। শিরীষ ফুলের গন্ধ কেমন অন্য একটা পৃথিবীতে নিয়ে যেত। আর বীজগুলো খুলে খুলে কৌটোভর্তি করতাম। কৌটো ঝাঁকালে ঝনঝন করে বাজতো। এটাই কি খেলা ছিল? নাকি আরো কিছু খেলতাম? মনে নেই। শিরীষের মুখোমুখি যে কাঁঠাল গাছটা ছিল সেটা বেয়ে বেয়ে উঠেছিল একটা মধুমঞ্জরী। আহা কোনোভাবে যদি আবার তাকে পেতাম! কাঁঠাল গাছের শেকড়ের ফাঁকে ছিল আমার খেলার ঘর। দুদিকে ছড়িয়ে যাওয়া শেকড় ঘরের সীমানা। তার মাঝখানটাতে পুতুল আর ‘খেলাপাতি’ খেলতাম আমরা।

কাঁঠাল গাছটার কয়েক হাত দূরে আরো একটা গাছ ছিল। সম্ভবত আমরা একে ‘খারাজোরা’ নামে ডাকতাম। অন্য নাম জানা নেই। এর একটাই ব্যবহার্যতা আমাদের জানা ছিল। সেটা হলো এর গোটা দিয়ে আমরা বন্দুক ফোটাতাম। সরু বাঁশ কেটে বানানো বন্দুকে গোটাটা ঢোকানো হতো আরেকটা বাঁশ চিকন করে কাটা হতো সেটা দিয়ে গোটাটা ঠেলা দেয়ার জন্য। পট পট আওয়াজ করে গোটাগুলো বেরিয়ে যেত। এই গোটার আরেকটা বিকল্প ছিল কচুপাতা। তবে খারাজোরার গোটাই সুবিধাজনক ছিল। আর কখনো কোথাও এই গাছটার কোনো জাত ভাইয়ের সঙ্গেও আমার দেখা হয়নি।

 

উঠোনের উত্তরের ঘরটাকে বলতাম বাংলাঘর। এই নামকরণের ইতিবৃ্ত্ত আমার জানা নেই। বাংলাঘরের পিঠে ছিল একটা বাতাবিলেবু গাছ আর বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত লেবু গাছ। কতটা ঠিক করে আমার মনে পড়ে না। তবে মনে হয় সে অনেকখানি। এত লেবু আসত যে খেয়ে ফুরোতো না। নিচে পড়ে থাকত। বাধ্য হয়ে বেচতে হতো। এখনো ৩০/৪০ টাকা হালিতে লেবু কিনতে গেলে আমার খুব গায়ে লাগে। মনে হয়, আহা কত লেবু ঝরে পড়েছে গাছ থেকে!

লেবু গাছের কোণায় ছিল একটা শ্যাওড়া গাছ। এই গাছটা আজো আমার স্মৃতিত রহস্যময় হয়েই অটুট দার্ঢ্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর কথা মনে হলেই সন্ধ্যা কিংবা রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়াগাছের কথা মনে আসে। জানি না সেটা এখন আর আছে নাকি নেই।

 

এর ঠিক পেছনেই একটা ঝোপ । ঠিক ঝোপ বলা যায় কিনা জানি না। খুব ছোট এক টুকরো বনই মনে হতো আমার কাছে। এখনো মনে হয়। সেখানে এক সারি দেবদারু গাছ ছিল। ঠিক কতগুলো মনে নেই। আর ছিল বাঁশ। এখান থেকেই আমাদের বন্দুক বানানোর বাঁশের যোগান পেতাম। আর পাতা ঝরার দিনের দেবদারু গাছ সবচেয়ে উজ্জ্বল রং নিয়ে জেগে আছে আমার স্মৃতিতে। শৈশবের সেই ছোট্ট বনাংশটি হলুদ পাতার একটা পুরু আস্তরে ঢেকে যেত পাতা ঝরার দিনে। এখানকার আরেকটা গাছ ছিল আমার অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্র। ঠিক গাছ না, গাছের ফুল। সে গাব ফুল। কী যে অদ্ভুত গন্ধ গাবফুলের! মালা গাঁথতাম সে ফুলের।

 

আর চারটা গাছ ছিল যাদের সঙ্গে বা যাদের সগোত্রের সঙ্গে আমার সারাজীবনের আর দেখা হয়নি। একটা এই ক্ষুদ্র বনের দক্ষিণ প্রান্তে। যার ফলকে আমরা বলতাম ছাগল নাদা- লাল লাল মিষ্টি মিষ্টি ফল। এর প্রকৃত নাম কী আজো জানি না। আরেকটা হলো বল্লাগোটা। মাঝারি আকারের গাছ- শহরগামী সড়কের পাশে। এই বল্লাগোটা পেটে পেটে ধরত আঠা। যা দিয়ে আমরা ঘুড়ি বানাতাম। এরও কেতাবী নাম জানা নেই। এরই খানিকটা দূরে স্কুলমাঠের পাশে সড়কের ধারঘেষে ছিল একটা জামের গাছ। ‘তিতিজাম’ বোধকরি নাম। খুব ছোটো ছোটো, মিষ্টি খেতে। আর একট গাছ ছিল, হয়তো এখনো বিলুপ্ত নয় তবে আমি আর কোথাও পাইনি। আঞ্চলিক ভাষায় যার নাম ছিল- জিগা গাছ। এটাও আঠার উৎস। এর গা থেকে আঠা চুয়ে পড়ে জমাট বেঁধে থাকত। পোস্ট অফিসে দোয়াত-কালির পেটমোটা শিশিতে এই আঠাই ভরে রাখা হতো খামের মুখে লাগাবার জন্য।

 

রান্নাঘরের চালের ওপর একটা পেয়ারা গাছ ছিল। বাদুড় তাড়াতে তাতে টিনের ঘন্টি বাঁধা হতো। বারবাড়িতে একটা ছোটো বাগান ছিল। সেখানকার সবচেয়ে প্রিয় গাছটার কথা না বললেই না-একটা বেশ বড়ো আকারের গন্ধরাজ গাছ। যখন ফুল ফুটত পুরো গাছটা সাদা হয়ে যেত। গন্ধরাজ গাছের খুব অদ্ভুত একটা বর্ণনা পড়েছিলাম হুমায়ুন আজাদের শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা বইতে-জোৎস্না রাতের গন্ধরাজের কথা ছিল সেখানে। ছেলেবেলার গন্ধরাজটিকে জ্যোৎস্নারাতে দেখার স্মৃতি নেই। কিন্তু বইয়ের বর্ণণায় এতটাই মোহাবিষ্ট হয়েছিলাম যে আমিও একটা গল্পে এমন একটা দৃশ্য লিখেছিলাম।

 

ছোটো-বড়ো আরো অনেক গাছ স্মৃতি আর মায়ায় জড়িয়ে আছে ছেলেবেলার অংশ হয়ে। আসলে প্রত্যেকটি গাছই মায়াভরে উস্কানি দিয়ে বলে- আমার কথা বলো! স্কুলের পেছনে টপসিদের বাড়ির সফেদা গাছটারও কত স্মৃতি! সফেদা ভালোবাসতাম এমন না, তবুও একটা দুটো ভাগে জুটলে আলনার নিচে রাখা জরাজীর্ণ সুটকেসের ভেতর পুরোনো কাপড়ের দঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে রাখতাম। পাকত কি সে সফেদা নাকি পচেই যেত? পাকা সফেদা খাওয়ার কোনো স্মৃতি তো মনে পড়ে না!

একটা ঘাসের কথা বলে মুলতবি দিই। সম্প্রতি তার নাম জেনেছি-রানিঘাস। ফসলকাটা দিনে ক্ষেতজুড়ে বিছিয়ে থাকত। বেগুনি বেগুনি ফুল মাথা তুলে থাকত। আমরা এর ওপর গড়াগড়ি খেতাম। অনেকসময় এমন হয় আমি চোখ বন্ধ করে রানিঘাসের বেগুনিফুলের মায়াবী গন্ধটা অনুভব করার চেষ্টা করি। এই ঘাস এখনো এ পৃথিবীতে আছে। তবে সেরকম করে আমার সঙ্গে আর তাদের দেখা হয় না। শরীরে তাদের গন্ধ মেখে নেয়ার সুযোগ হয়নি কখনো আর। কেবল একটা ঘাস একবার তুলে এনে জীবনানন্দের বইয়ের ভেতর গুঁজে রেখেছিলাম। এখনো আছে।

 

ছেলেবেলার ‍বৃক্ষ, ঘাস, লতাগুল্মময় ছোট্ট সে অরণ্যে এখনো আমি দুর্গার মতো চড়ে বেড়াই। কখনো কখনো গল্পে বা কবিতায় তারা ঢুকে পড়ে। মাঝে মাঝে আমার ভেতর থেকে আরেকটা আমি ছুটে বেরিয়ে যেতে চায় সে সবুজ রাজ্যে। এখন তারা বদলে গেছে। সবাই নিশ্চিতভাবেই নেই। তবে স্মৃতি তাদেরকে অবিকৃত অবিকল বাঁচিয়ে রেখেছে। নিঃশ্বাস নেবার ছলে এখনো সেই ছেলেবেলায়, সেই গাছেদের কাছেই ছুটে যাই। গাবফুল কুঁড়িয়ে বসে যাই মালা গাঁথতে। সূর্যটা নতজানু হয়ে নাল্লাপাড়ার আড়ালে চলে যেতে থাকে। আমি রানিঘাসের গন্ধে ডুবে সারাজীবনের জন্য মুগ্ধতা সঞ্চয় করি। তারই সমান্তরালে নির্মিত হয় সবুজ হারানোর এক অনন্ত হাহাকারের ক্ষেত্রভূমি।

1 COMMENT

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here