আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
আজকের দিনে এসে আসলে কেমন আছে কবি বন্দে আলী মিয়ার সেই ছোট ছোট গ্রামগুলো? এখনো কি সবাই সবাইকে আপন ভেবে মিলেমিশে থাকে? সাঁঝ বাতির আলো ছোট্ট কুটিরগুলিতে প্রতি সন্ধ্যায় আরব্য রজনীর রূপকথা ডেকে আনে? শিশু কিশোরেরা বৃদ্ধা পিতামহীর কোলে শুয়ে রাক্ষস খোক্ষস আর রাজকন্যা আলোমতির গল্প শোনে? ভয় পেলে আঁকড়ে ধরে সেই বর্ষীয়সী নারীর রগ ওঠা হাতের আঙুল? কাজলা দিদির শোলক শুনে আজও মন কেমন করে কারো? কেউ কি অপু মতো রেলগাড়ি দেখে বিস্মিত হয় কিংবা দূর্গার মতো এর ওর গাছতলায় আম কুড়িয়ে বেড়ায়? হয়তো আজও গ্রামীণ সমাজে টিকে আছে সেই সব সারলতা। অল্পতেই মুগ্ধ হবার অসীম ক্ষমতা আর সম্প্রীতির সেই বন্ধন খোলস পাল্টালেও একদম হারিয়ে যায় নি। তবে বদলে গেছে তার চেনা সুর। নগর সভ্যতার যান্ত্রিক বাতাস বহু বছর ধরেই গ্রামগুলোকে দোলা দিচ্ছে, যে দোলা নীরবে পাল্টে দিয়েছে গ্রামীণ সমাজকাঠামোর অন্দরমহল।
করোনাকালের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যখন গ্রামে আসি তার পরের দিনই একটা গ্রাম্য সালিশে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিলো। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার মূলত ডাকতে এসেছিলেন আব্বাকে। কিন্তু হৃদরোগী হওয়ায় আমি কোনোভাবেই বাবাকে জনসমাগমে যেতে দিতে নারাজ। শেষে কৌশলী মেম্বার সাহেব বলে বসলেন, তাহলে তুমি চলো। তাঁকে হতাশ করে আমিও অনুরোধে ঢেঁকি গেলার ভাব ধরে রাজি হয়ে গেলাম। সালিশে বসে যা বুঝলাম গ্রামের এক নিরক্ষর কৃষকের মেয়ে ৪ বছর ধরে সংসার করছে জনৈক সমশের আলীর (ছদ্মনাম), তো এই সমশের আলী সম্প্রতি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিবাহ করে ফেলেছেন। প্রথম বউ কোনেসাভাবেই এই অন্যায় মেনে নিতে রাজি নয়। তাই দিয়েছে মামলা ঠুকে।
বিপদ বুঝে সমশের তার মুরুব্বিদের নিয়ে এসে মীমাংসা প্রার্থনা করছে। গ্রামের সকল মুরুব্বি, এমনকি মেয়ের মামা ও বাবা মীমাংসায় রাজি। সবার একটিই যুক্তি : সংসারটা যেন টিকে যায়। প্রথম স্ত্রী মামলা তুলে নিলে সমশের তাকে সসম্মানে বাড়ি নিয়ে গিয়ে মাথায় করে রাখবে। এমন একটা সিদ্ধান্ত চেয়ারম্যানের মুখ থেকে পড়তে না পড়তেই জমিলা (বিবাদী) ফস করে বলে ফেলল না! কেস সে তুলবে না! পুরো দরবারে নীরবতা। এতবড় বেয়াদব! পোড়খাওয়া চেয়ারম্যান একটু কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘মামলার খরচ জানো? বাপটারে গলায় দড়ি দেওয়াবা নাকি?’’ পাল্টা জবাব, ‘‘এই মামলার সব খরচ সরকারের, এনজিও আফায় কইছে।’’ এরপর আর কোন কথা চলে না। মেয়ে তার অধিকার এবং তা আদায়ের পথ সম্পর্কে পূর্ণরূপে সচেতন। সুতরাং গোজগোজ ফোসফোস ছাড়া এই পুরুষতান্ত্রিক মজলিসের আর কিছু করার নাই।
একযুগ আগেও এমন একটা ব্যাপার কল্পনা করা যেত না। দেখ-না-দেখ করে চোখের সামনে নিজের গ্রামটার সামাজিক কাঠামোর এত বড় ইতিবাচক পরিবর্তন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সত্যিই গ্রাম এখন আর আগের মতন নেই। খোলসের ভেতরে থেকেই নিজেকে সে পাল্টে নিচ্ছে। পরিবর্তনের এই গতিটা খুব শ্লথ, ভালোমত খেয়াল না করলে ধরাই পড়ে না।
গ্রামের হুরমুজ মিয়া, তৈয়ব আলীরা এখনো কৃষক। কিন্তু ধনী গেরস্থের বাড়িতে বেগার খাটার প্রয়োজন তাঁদের আর পড়ে না। একছেলে যদি গার্মেন্টেসে থাকে আরেক ছেলে প্রবাসী। ভাত কাপড়ের সেই দারুণ অভাবটা এখন আর নাই। আভাবের সাথেই যেন নাই হয়ে গেছে মাতব্বর, তালুকদার আর মেম্বার চেয়ারম্যানদের সেই দাপট। আমার অভিজ্ঞতা বলছে কৃষিকে লাভজনক খাতে পরিণত না করলে আগামী দেড় দশকের মধ্যেই গ্রামগুলো কৃষকশূন্য হয়ে পড়বে, ইতিমধ্যেই এই শূন্যতা কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী এই কৃষক সমাজ ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শিকার হয়েছে অপুষ্টি, রোগ-শোক আর নানা ধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বঞ্চনার। সেই আমলে হাতে গোনা কিছু কৃষকের সন্তান জজ, ব্যারিস্টার কিংবা ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হলেও গ্রাম ছাড়ার পর তারা আর গ্রামকে সেভাবে মনে রাখেন নি। সাজানো গোছানো অফিসে বসে মুছে ফেলতে চেয়েছে প্রজন্মান্তরে লেগে থাকা ধুলা-মাটির স্মৃতি। কিন্তু এখনকার পরিস্থতি অন্যরকম। ছেলে ইন্টার ফেল? সমস্যা নাই, পাঠিয়ে দাও সিঙ্গাপুর। কোনমতে মেট্রিক পাশ দিছে এবার? পাঠিয়ে দাও আশুলিয়া সাভার। খুঁটে খাওয়া শিখুক।
এভাবে যুব সমাজের একটা বড় অংশ কৃষিকাজ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় পাল্টে যাচ্ছে গ্রামের ভূরাজনৈতিক চিত্র। ফসল চাষ করে ক্রমাগত লোকসান গুণতে গুণতে সম্পন্ন গেরস্থের এখন ভেতরে ভেতরে কাঙাল দশা। অন্যদিকে স্বল্প হলেও বেতনের কাঁচা পয়সায় ক্রমশ স্বচ্ছল হয়ে উঠছে একসময়ের ভূমিহীনরা। মাত্র দুই দশকে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে জায়গা করে নিয়েছে টেলিভিশন। বিদ্যুত আর ক্যাবল টিভি চ্যানেলের সুবিধাও চলে এসেছে কয়েক বছর আগেই।
গ্রামের বউ-ঝিরা এখন আর বাড়ি বাড়ি জটলা পাকিয়ে এর ওর চর্চা করে না। বরং টিভিতে সিরিয়াস দেখে। হরেক রকম চ্যানেলের সুবাদে দেখে ফেলে সর্বশেষ খবর, এমনকি অতি আধুনিক রিয়ালেটি শো। এইসব দেখার ফলে শহুরে দর্শকদের চাইতে অনেক বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন গ্রামের দর্শকরা। কেননা তারা শুধু জাঁকজমকটাই দেখতে পান পর্দায়। প্রদীপের নিচের অন্ধকার খুঁজে দেখার সুযোগ তাদের হয় না। ফলত ভেতরে ভেতরে জন্ম নেয় তীব্র উচ্চাকাঙ্খা এবং তা পূরণ না হওয়ার হতাশা।
আগে গ্রামগঞ্জে নেশা বলতে ছিলো বিড়ি-সিগারেট, খুব বেশি হলে গাঁজা। সাধু ও গাতকরা নিয়মিত গাঁজা টানতেন। তবে এর বিস্তার ছিলো খুবই সমান্য। এখন উঠতি বয়সের অনেক ছেলে অবলীলায় ইয়াবা বা ডেক্সপোটেন খায়। ডেক্সপোটেন মূলত কাশির ওষুধ। একসাথে অনেকখানি খেয়ে ঝিমায়। খেলাধূলা ও অন্যান্য বাহ্যিক কার্যক্রমও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। যার একটা প্রধান কারণ স্মার্টফোন আসক্তি। তবে আশার কথা হচ্ছে এইসবের সাথে পাল্লা দিয়ে পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ৭/৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই বা ব্র্যাক লাইব্রেরি থেকে নেওয়া বইগুলো পড়ে একটা পাঠক প্রজন্মও গড়ে উঠছে প্রত্যন্ত এলাকায়। কারও কোনো প্রতক্ষ্য নির্দেশনা ছাড়াই।
এই সময়ে এসে গ্রামের রাজনীতির হালচালও বদলে গেছে রাতারাতি। গ্রাম্য রাজনীতি এখন আর গোষ্ঠী প্রভাব বা ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। ইউনিয়ন বোর্ড নির্বাচনেও মুখ্য বিবেচনা হয়ে পড়ে দলীয় প্রতীক ও মনোনয়ন। রেমিটেন্সের টাকা প্রদীপের দৈত্যের মত পাল্টে দিয়েছে গ্রামীণ অবকাঠামোর হালহকিকত। কাঁচা মাটির ঘর বা ছনের ছাউনির বদলে এখন যত্রতত্র সুদৃশ্য দালানের দেখা মেলে। তবে এত এত পরিবর্তনের পরেও আজও গ্রামগুলোতে যে শান্তির ফোয়ারা বয় তার প্রধান কারণ গ্রামের প্রকৃতি।
এখনো গ্রামের মাঠে মাঠে দখিনা বাতাস সেই একই রকম সম্মোহন সৃষ্টি করে। দিগন্ত জোড়া আকাশ ও বৃষ্টির চাদরে ঢাকা ছোট্ট নদীটি আজও রূপকথার জন্ম দেয়। যান্ত্রিক জীবন থেকে পালিয়ে সেই রূপকথার ভেতর হারিয়ে যেতে পরেন আপনিও। মায়ের মমতা দিয়ে গ্রাম্য প্রকৃতি আপনার ক্ষতগুলো সারিয়ে তুলবে। বাংলার এই ছোট ছোট গ্রামগুলোকে আমি তাই ইতিবাচক শক্তির আঁতুরঘর বলি। হোক ব্যক্তি বা রাষ্ট্র — যে ইতিবাচক শক্তিগুলো তাকে বাঁচিয়ে রাখে তার প্রায় সবটাই এইসব গ্রামের ধূলা-বালি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তাই গ্রামগুলোর নিষ্কলুষ অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখা বড্ড জরুরি।