ফুটবলের জাদুকর। ষোল বছর বয়সেই যিনি কিংবদন্তি এক ফুটবল তারকা। চারটি বিশ্বকাপে খেলেছেন, তিনটিতে জয়। তিনটি বিষয় তিনি ভালোবাসেন : পরিবার, ফুটবল আর জনগণ। এখন বয়স তাঁর আশি। শরীর জুড়ে অসুখের চিহ্ন। কারো সহায়তা ছাড়া হাঁটতে পারেন না। দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকা জানাচ্ছে, পেলে কিছু বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন। কারণ এক সময় যিনি দাপিয়ে বেড়াতেন, তাঁকে এখন ঠাঁই নিতে হয়েছে হুইল চেয়ারে। ২০১৪ সালে ‘‘হার্ভার্ড বিজনেজ রিভিউ’’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ছোট্ট ওই সাক্ষাৎকার পড়লেই বোঝা যায়, পেলে কেন পেলে? সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন রিভিউয়ের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক অ্যালিসন বেয়ার। সাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে দিলাম পাঠকদের জন্য।
অ্যালিসন বেয়ার : আপনি ছিলেন আপনার দলের একমাত্র তারকা। আপনি কি তাদের নেতা হিসেবেও ভাবতেন?
পেলে : আমি কখনোই নেতা হতে চাই নি। কিন্তু সকলেই আমার ইতিহাস জানে। তা এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই। সব আলো পড়েছিল আমার ওপর। আমি শুধু আমার সেরাটা আন্য খেলোয়াড়দের ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম, বলতে চেয়েছিলাম আমি যা ভাবছি তা আমার জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মাঠে আমাদের ভালো কোচ ছিল। তাদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল, আর তাই আমি কাজ করার স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তু কখনও কখনও মাঠ বেশ বড় দেখায়, একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। আর তাই কোনো না কোন বার্তা দিতে হত, দলকে সংগঠিত করতে হত। আর এভাবেই নেতা হওয়া।
কিন্তু আপনি কখনোই দলের প্রধান ছিলেন না।
না। প্রেস কনফারেন্সে প্রতিবেদকরা সব সময় আমাকে এই প্রশ্ন করতেন। আমি তাঁদের বলতাম, ‘‘শুনুন, আমার দলনেতা হবার দরকার নেই। আমাদের যদি দলনেতা হিসেবে একজন খেলোয়াড় থেকেই থাকে তাহলে একই খেলায় দুজন দলনেতা হয়ে ওঠে।’’
আপনি কীভাবে আপনার দলের সদস্যদের কোচ হিসেবে সহায়তা করতেন?
নিউ ইয়র্ক কসমসে আমার প্রথম বছরে অনেক তরুণ খেলোয়াড় ছিলেন। আমি জানি না তাঁরা আমাকে খুশি করার জন্য কিংবা পায়ে বল রাখতে ভয় পাওয়ার জন্য আমার কাছে বল ঠেলে দিত; কিন্তু আমি তাঁদের বলেছিলাম, ‘‘প্রতিটি বল আমার দিকে দিও না। আমাদের একটি টিম হিসেবে খেলতে হবে।’’
আপনি কেন কসমসে খেলার জন্য অবসরে গেলেন?
প্রথম বার আমি অবসরে গেলাম ১৯৭০-এ। ব্রাজিল সেবার বিশ্বকাপ জিতল। আমি সেই টুর্নামেন্টে সেরার খেলোয়াড় হয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তী বিশ্বকাপ বেশ দূরেই ছিল। আমি বললাম, না, আমি আর খেলছি না।’’ তারপর আমি বিভিন্ন ক্লাব থেকে ডাক পেলাম — রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, মিলান, বেয়ের্ন মিউনিখ। আমেরিকায় তখন খেলা কেবল সূচনার পথে। আমার বন্ধু ওয়ার্নার কমিউনিকেশনের প্রেসিডেন্ট সহায়তা চাইল। আমাকে আহ্বান জানালো। আমি বললাম ঠিক আছে। কারণ ইউরোপের খেলার চেয়ে এটা আলাদা ছিল। আমেরিকায় ফুটবলকে প্রেরণা জোগানোর ফিরে আসা।
আপনি যখন চূড়ান্তভাবে পেশাগতভাবে খেলা ছাড়লেন তখন মানিয়ে নিতে কেমন সমস্যা হয়েছিল?
প্রথম দুই বছর মাঠ ও ভিড়ের বাইরে থাকা ছিল কিছুটা কষ্টকর। আমি যখন বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতাম, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা হাসপাতালে খেলতাম, তখনও আমি ফুটবলকে খুব মিস করতাম। কারণ ফুটবল ছিল আমার সমগ্র জীবন। ঈশ্বর সহায়, আমি যথেষ্টই করেছিলাম, আমি মনে করি আমার ভালো সময়েই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম।
আপনি একটি অখ্যাত পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন এবং অল্প বয়সে সুনাম খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কীভাবে এই রূপান্তরের সঙ্গে খাপ খাওয়ালেন?
আমার একটি ভালো পরিবার ছিল, যখন যা কিছু সাহায্য সহযোগিতার দরকার পড়ত, তখনই তার সমর্থন জোগাত। আমি সব সময় ফুটবলের সঙ্গে ছিলাম, আমি যা ভালোবাসি। আমি সব সময় জনগণের সঙ্গে ছিলাম, আমি তাও ভালোবাসি। অবশ্যই আমার জীবনকে কিছুটা বদলাতে হয়েছিল। কিছুটা প্রাইভেসি হারিয়েছিলাম। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমার ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল।
অনেকেই খেলায় টাকার নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলে থাকেন। সেরা খেলোয়াড়দের অতো বেশি বেতন দেয়া উচিত?
হ্যাঁ, অবশ্যই। কারণ ফুটবল কোনো স্বাভাবিক পেশা নয় যে, আপনি আশি বছর বয়স পর্যন্ত তা চালিয়ে যেতে পারবেন। ভালো খেলোয়াড়, বিশ্বের সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়ও কেবল ৩৪-৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত খেলতে পারে। বড়জোর ৪০ পর্যন্ত। কিন্তু তারপর তো তাঁকে জীবনযাপন করতে হয়। সমস্যা হলো, টাকাটা খরচ হচ্ছে কীভাবে। এখন টিভি ও স্পন্সরের কল্যাণে কিছু দল ও খেলোয়াড় প্রচুর টাকা রোজগার করতে পারছে। কিন্তু অন্যরা কিছুই করতে পারছে না।
অনেক প্রতিষ্ঠানের হয়েই আপনি প্রতিনিধি বা দূত হিসেবে কাজ করেছেন। কী করে আপনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কোনটির হয়ে কাজ করবেন?
কোনো প্রতিষ্ঠান যখন আমাকে আহ্বান জানায়, প্রথমেই আমি ভাবি বাচ্চাদের কাছে এটা কী বার্তা দেবে। সিগারেট, মদ, বিয়ারের বিজ্ঞাপনের জন্য আমি প্রচুর প্রস্তাব পাই। অনেক কোচ ও খেলোয়াড় তা করেন। কিন্তু আমি কখনোই ওই সব ব্র্যান্ডের কাজ করতে যাচ্ছি না, কারণ তরুণ প্রজন্মের জন্য তা ভালো কিছু নয়।
আপনি একজন বিশ্বপরিব্রাজক হিসেবে যাত্রা আরম্ভ করেছেন। আমি কীভাবে বিশ্রাম নেন?
সাও পাওলো থেকে দূরে ছোট্ট একটা শহরে আমার একটা খামার আছে। আমাদের একটা লেক আছে, একটা নদী আছে, কৃষিজমি আছে, আর আছে একটা ঘোড়া। আমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি, আমি তখন সেখানে এক সপ্তাহ কাটাই। দারুণ লাগে।