উঁচু ভলিউমে বাজা গানের উৎস খুঁজতে রমেন্দ্র একবার তাকিয়েছিল চা’দোকানের ভেতরে বেড়া ঘেঁষে বসানো টিভি সেটের দিকে। টিভিতে কি একটা সিনেমা চলছে যেন। বেশ নাদুস-নুদুস এক নায়িকা ও রোগাপটকা গোছের এক নায়কের নাচগানে দর্শকেরা বিভোর। নায়িকার উন্মুক্ত ঢলঢলে নাভির গভীরতা ও নাচের নামে অনাবশ্যক চিৎ-কাৎ হওয়ার প্রচেষ্টায় গলাঢিলা জামার ফাঁক দিয়ে ঈষৎ-প্রদর্শিত বুকের খাঁজ সমেত মাংসপিণ্ডের হঠাৎ ঝলকানি ওকেও পেয়ে বসে। ও কিছুতেই আর চোখ ফেরাতে পারে না টিভির পর্দা থেকে। এমনকি দীর্ঘদিন স্ত্রীসঙ্গ বঞ্চিত শরীরও একটা শিহরণ টের পায় তলপেটের নীচে। ইদানিং গ্রামের প্রায় সব চা’দোকানেই কাস্টমার টানার উপলক্ষ্য হিসেবে আনা হয়েছে টেলিভিশন। চা পানের বিনিময়ে সেখানে সারাক্ষণ মুফতে সিনেমা দেখানো হয়। অবশ্য গ্রামের লোকেরা তাদের ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে সিনেমাকে এখনো বই বলেই ডাকে।
রমেন্দ্র দোকানে দাঁড়িয়েছে কতক্ষণ সে জানে না। হঠাৎ তাঁর অর্ধেকেরও কম বয়সী দোকানদার ছোকরাটা যখন তারই দেওয়া টিনের মগটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “ওই কাউরা’র পো, এই যে তর মগ নে, ধর।”দোকানদারের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় ও। টিভির দর্শকরাও যেন বিরক্ত হয়ে এ ওর দিকে তাকায়। কেমন একটা উসখুস অবজ্ঞার ঢেউ সবার মধ্যে বয়ে যায়। ভাবটা এমন, জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুর রৌদ্রে ও যেন সবার মাথার উপর থেকে মেঘের পাতলা ছাউনিটুকুও সরিয়ে নিয়েছে। দোকানদারের হাত থেকে চা ভর্তি মগটা নিতে রমেন্দ্র একপা এগুতেই গালভর্তি মেহেদিরাঙা দাড়িওয়ালা এক লোক শাসিয়ে বলে, “আমারে টাচ করিস না কৈল, ওযু কইরে আইছি। মাগরিব পইড়া বাড়ি যামু।”সকলের ছোঁয়া বাঁচিয়ে মগভর্তি চা নিয়ে ছাউনির দিকে রওনা দেয় সে। টিভির পর্দায় নাদুস-নুদুস নায়িকার রগরগে শরীর তাঁর আর দেখা হয় না।
অনেক আগেই বুকের বহতা জলে দুঃখময় পলি জমিয়ে মৃত হওয়া নোয়াই নদের দক্ষিণ কূল ঘেঁষা ফুল-ফসলে সমৃদ্ধ নন্দীগ্রামে রমেন্দ্ররা এসেছে আজ এক সপ্তাহ। বহু দখলে জীর্ণ শীর্ণ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী প্রমথনাথ নন্দীর পৈত্রিক ভিটাকে বামে রেখে ঠিক মধ্য মাঠে ছাউনি বানিয়েছে ওরা। সেখানে এই কার্তিকের পুরোটা মাস জুড়ে মাঠের সদ্য পানি নামা নরম জমিতে সারাদিন শুকরের পাল চড়ানো শেষে সন্ধ্যায় কোনমত মাথা গোঁজে ওরা। বর্ষার জলে ডোবা জমিতে গজানো ঘেচু-শালুকের মুথা ও গুগলি-শামুক খাইয়ে ওদের পালের প্রাণীগুলো দিন দিন হৃষ্টপুষ্ট করা রমেন্দ্র ও তাঁর দলের কায়পুত্রদের কাজ। মহাজনের দেওয়া খোরাকি ও পালের পশুগুলো নিয়ে মাঠের পর মাঠ ঘুরে বন-বাঁদার চষে অন্যের জমিতে কচু-ঘেচু, ঘাস-ফসলের মুথা খাওয়াতে খাওয়াতে এ গ্রামে এসেছে ওরা। এই পশুগুলো বিক্রয়ের উপযোগী হলে মহাজনের লোক এসে সেগুলো নিয়ে যাবে। তারপর কয়েকটি দিন বাড়িতে কাটিয়ে আবার নতুন পশুর পাল নিয়ে যাত্রা শুরু হবে ওদের। যেন সংসারের নিত্য অভাব অভিযোগের মত ওদের এ যাত্রার কোন শেষ নেই।
দেড় কুড়ি বছর বয়সের অভিজ্ঞতায় রমেন্দ্র জেনেছে এই সমাজ এমনকি ধর্মেও তাঁর অবস্থান সর্বনিম্নে। সে অন্ত্যজ, অচ্ছুত; হিন্দু-মুসলিম : উভয় সমাজেই। ধর্ম ও ধর্মাচার নিয়ে হিন্দু-মুসলিম যত ভেদাভেদই থাকুক না কেন অন্তত একটা বিষয়ে তাদের মিল; আর তা হচ্ছে কায়পুত্রদের অবজ্ঞা করা। নিম্নকায়স্থ পরিচয়ে সে যতই নিজেকে মহৎ করার চেষ্টা করুক না কেন কেবলমাত্র পেশার পরিচয়ের কারণেই তাঁর অবস্থান নিচুজাত শূদ্রেরও অনেক নিচে। তার হাতে লালিত পশু কেটে তৃপ্তিময় আহার হয়; তাদের অনুপস্থিতিতে নোংরা স্যাঁতসেতে গৃহে ততোধিক নোংরা বিছানায় স্ত্রী-কন্যার শরীর ঘেঁটে সুখ পাওয়া যায়। যত আপত্তি কেবল পরিচয়ে; একসাথে চলায়। ওদের মহাজনও এর ব্যতিক্রম নয়।
দেড় কুড়ি বছর বয়সের অভিজ্ঞতায় রমেন্দ্র জেনেছে এই সমাজ এমনকি ধর্মেও তাঁর অবস্থান সর্বনিম্নে। সে অন্ত্যজ, অচ্ছুত; হিন্দু-মুসলিম : উভয় সমাজেই। ধর্ম ও ধর্মাচার নিয়ে হিন্দু-মুসলিম যত ভেদাভেদই থাকুক না কেন অন্তত একটা বিষয়ে তাদের মিল; আর তা হচ্ছে কায়পুত্রদের অবজ্ঞা করা। নিম্নকায়স্থ পরিচয়ে সে যতই নিজেকে মহৎ করার চেষ্টা করুক না কেন কেবলমাত্র পেশার পরিচয়ের কারণেই তাঁর অবস্থান নিচুজাত শূদ্রেরও অনেক নিচে। তার হাতে লালিত পশু কেটে তৃপ্তিময় আহার হয়; তাদের অনুপস্থিতিতে নোংরা স্যাঁতসেতে গৃহে ততোধিক নোংরা বিছানায় স্ত্রী-কন্যার শরীর ঘেঁটে সুখ পাওয়া যায়। যত আপত্তি কেবল পরিচয়ে; একসাথে চলায়। ওদের মহাজনও এর ব্যতিক্রম নয়। গতবার যখন বেতন আনতে মহাজনের বাড়িতে গিয়েছিল রমেন্দ্র, বারান্দায় চেয়ারে বসে ছিল মহাজন। ওকে দেখে, “ ও তুই, দাড়া”বলে বারান্দা থেকে নেমে উঠানে এসে বেতন দিয়েছে কেশব সাহা যেন ও বারান্দায় উঠলেই অশুদ্ধ হবে বারান্দার গোটা মাটি। রমেন্দ্র মনে মনে গাল দেয় মহাজনকে, “শালা খবিস বুইড়া, জাউরা’র বাচ্চা জাউরা, শুয়োর রাহালের কামাই খাইতে পারো, শুয়োর বেঁচা টেকা খাইতে পারো; আর রাহালের ছোঁয়া লাইগলে তোমার গা টাঁটায় না?” তারপর মনে মনে ভেবেছে, “আবার যাইও পিতেমের বউয়ের কাছে, একবার ধরতি পারলি অয়, তোমার বিচি গালায় দিমুনি।”
দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাউনিতে এসে টিনের চুলায় তরকারি বসানো যোগেন বুড়ার সামনে চায়ের মগ নামিয়ে রমেন্দ্র বলে, “এই নেও। জন্মের চা খাও, এরপর হয় চা বানায়ে খাইবা, নাইলে নিজে যাইয়া চা আনবা। আমি আর পারমু না। টেকা দিয়া চা খামু আবার মানষের ঝাড়িও হুনমু এ্যার মইধ্যে আমি নাই।” যোগেন হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করে, “ক্যারে কী অইছে?” কোন উত্তর না দিয়ে ছাউনিতে গিয়ে সটান শুয়ে পরে রমেন্দ্র। চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে যোগেন ছাউনিতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করে, “মাথা গরম অইছে ক্যা অ্যাঁ? এই এলাকার মানুষ তো ভালোই। কী হইলো আবার? ”
‘‘তোমার তো সব জায়গাতে মানুষ ভালো,” রেগে উত্তর দেয় রমেন্দ্র, “হেই বছর পাবনাতেও তো ভালো মানুষ পাইছিলা না?” আর কোন কথা বাড়ায় না যোগেন, মুখের হাসি উবে গেছে তাঁর। মুখটা ভার করে ছাউনি থেকে বের হয় সে। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারে রমেন্দ্র। মানুষের দুর্ব্যবহার তাঁকে যতই পীড়া দিক না কেন, অমন বিশ্রী ব্যপারটা কোনমতেই তোলা উচিত হয়নি তাঁর। যোগেন তাঁর প্রয়াত বাবার একমাত্র কাকা। তাঁর মনে আঘাত দেওয়া মোটেই ভাল হয় নি তাঁর। মনের অজান্তেই ওর একটা হাত চলে যায় হাঁটুর নিচে; কাঁটা ক্ষতের কালশিটে গভীর দাগটায়।
সেবার রমেন্দ্রও ছিল যোগেন দাদুর দলে। সাতক্ষীরা থেকে পাল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওরা গিয়েছিল পাবনা। মতি মাওলানা তখন মন্ত্রী। তাঁর বাড়ি ঘেঁষা মাঠকে সবাই ডাকতো মন্ত্রীবাড়ির চক। সেই চকে পাল নিয়ে গিয়েছিল ওরা। উদ্দেশ্য পালের পশুগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে নগরবাড়ি দিয়ে মানিকগঞ্জ আসা। মাঠে প্রচুর খাবার মিলেছিল প্রাণীগুলোর। অল্পদিনেই বেশ ডাঙর হয়ে ওঠে প্রাণীগুলো। তারপর কৃষকরা মাঠে হালচাষ শুরু করলে পাল নিয়ে রওনা দেয় ওরা। মন্ত্রীবাড়ি গ্রামের রাস্তা দিয়ে আসার সময় কয়েকজন যুবক ও একজন মওলানা গোছের লোক পথ আগলায় যোগেনদের। হারাম প্রাণীর মলে রাস্তা নাপাক করার জন্য তুমুল গালিগালাজ করে যোগেনকে। যোগেন যতই কাকুতি মিনতি করে ক্ষমা চায়, তারা যেন ততই ফুসলে ওঠে। হঠাৎ করে রমেন্দ্র একজনের হাত স্পর্শ করে বলে, “ভাই, বাপের বয়সি মানুষটা, এত করে মাপ চাইছে; ছাইরে দ্যান।”অমনি মওলানা গোছের লোকটা রমেন্দ্রর হাতের লাঠিটি একটানে কেড়ে নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে, “কুত্তার বাচ্চার সাহস কত? শুয়োরয়ালার সাথে বাপের তুলনা করে? মার শালারে।”সাথে সাথেই কয়েকজন মিলে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করে রমেন্দ্রকে। সেই মারের একটি কালশিটে দাগ গভীর হয়ে এখনো রয়ে গেছে ওর পায়ে। সেদিন ওদের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করেছে যোগেন, রাস্তা নোংরা করার অপরাধে নিজে দশবার কান ধরে ওঠ-বস করে ও ওনাদের হাতে খরচা বাবদ নগদ পাঁচশ টাকা দিয়ে রমেন্দ্রকে মুক্ত করেছে সে। তারপর থেকে রমেন্দ্ররা আর কোনদিন পাবনা যায় নি পাল নিয়ে।
দুই
কারো কথার আওয়াজ পেয়ে ছাউনি থেকে বাইরে উঁকি দেয় রমেন্দ্র। দুজন উঠতি বয়সী যুবার সাথে কথা বলছে যোগেন। যোগেন যতই মাথা নেড়ে বারবার বলছে, “ভগমানের দোহাই আমারে এইসব কইরতে কইয়েন না।”ছেলেগুলোও যেন তত চেপে ধরছে ওকে। রমেন্দ্র জানে এটাও জীবনের আর এক রূপ। তাদের ছায়া গায়ে লাগলে, শরীরের ছোঁয়া লাগলে; যারা গোসল করে। এমনকি এক নৌকায় চড়া কিংবা এক পঙক্তিতে বসে যাদের চা পর্যন্ত খাওয়া যায় না। লোকচক্ষুর আড়ালে তাদের অনেকেই আসে তাদের ছাউনিতে। কেউ সমস্যা থেকে মুক্তির আশায়, কেউ স্বপ্ন পূরণের উদগ্র বাসনায়। দিনের বেলা পালের যে প্রাণীগুলোকে ঠিক রাখতে পাঁচ-সাতজন রাখাল ‘ হুম, হর হর হহররর হ্যাট… হুম’ বলে লাঠি হাতে ছুটতে ছুটতে গলদঘর্ম হতে হয়; সেই প্রাণীগুলোই রাতে কেমন শান্ত-সুবোধ হয়ে শুয়ে থাকে গা ঘেঁষা-ঘেষি করে। লোকের বিশ্বাস নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন তুকতাক বা জাদুমন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। তাই বশীকরণ তাবিজের আশায় উঠতি বয়সী ছেলে-ছোকড়ার দল ঘুরঘুর করে ওদের ছাউনি ঘিরে। আর মধ্য বা পড়তি বয়সীরা আসে মর্দামি শক্তির দাওয়াই নিতে।
তুকতাক প্রশ্নে সব সময় এমন ধোঁয়াশাময় উত্তর দেয় কায়পুত্ররা, যা প্রশ্নকারীর পক্ষে কখনোই বোঝা সম্ভব নয় এর প্রকৃত বিষয়। ফলে কারও কারও এক প্রকার ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধাও জুটে এদের কালেভদ্রে। বেশিরভাগ সময় নানা ছলে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কখনো সখনো অবহেলা ও অবজ্ঞায় জর্জরিত হয়ে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ কায়পুত্ররা তাদের যাযাবর জীবনের সুবিধা নিয়ে লোক ঠকায় নানা তুকতাক ও তাবিজের বিনিময়ে। তারপর গ্রামান্তরে যাওয়ার পথে হাসি ও নানা রসরঙ্গে মাতে মানুষের নির্বুদ্ধিতা ও অন্যায় লোভের পরিণতিতে নিজেদের লাভ বিবেচনা করে।
কার্তিকের আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আলোকিত দেশময়। ছাউনির বাইরে দাড়ালে আবছা আলোয় দেখা যায় দিগন্ত পর্যন্ত। এমনি মায়াময় রাতে গাঁজার নেশায় বুঁদ যোগেন বুড়োকে পেয়েছে গানের নেশায়। হেড়ে গলায় টেনে টেনে তত্ত্ব সঙ্গীত গাইছে সে,
‘‘উঠান মাটি ঠন ঠন ঠন ঠন, পিঁড়ি নিল স্রোতে
গঙ্গা মইরলো জল তিয়াসে, ব্রহ্মা মইল শীতে।”
রমেন্দ্র জানে এ সময় কথার ভূত সওয়ার হয় তাঁর দাদুর মুখে। তাঁর কাছে যাওয়া মানেই তাঁর কথার প্যাঁচে পরে হাঁ, হুঁ করে রাত কাবার করা। অবশ্য কোন আওয়াজ-উত্তর না করলেও কথা বলায় কোন অসুবিধা হয় না বুড়োর, কথার নৌকা তাঁর চলতেই থাকে। আর তাঁর কথা মানে-বহু শোনা সেই আদ্যিকালের একই শাস্ত্র-পুরাণ কাহিনিতে আবার নিজের কান ঝালাই করা, “জানস তো রমেন, আমরা নিজে গো নিম্ন কায়স্থ কইলেও মানুষ আমগো কাউরা কয়। মূলে কিন্তুক আমরা দুইড্যার কোনডাই ন্যা।”তারপর বুড়ো বলতেই থাকবে, “আমরা হইলাম কায়পুত্র। মাইনে, ব্রম্মার কায়া থেইকে সৃষ্টি হইছিল বইলা এই নাম। একবার ব্রম্মা সিদ্ধি খাইয়ে ধিয়্যানে বইছিল, আর অমনি পালের এক বুইড়া দাঁতাল জংলি যাইয়ে ফরিয়াদ জানায় তাঁর ঠাঁই, ‘ঠাহুর তুমি সব পিরানির রাহালি বানাইছো মানুষ দিয়া, কিন্তুক আমাগো রাহালি দেওনাই কেউরে। এ তোমার কেমন বিচার, অ্যাঁ?’ তহন ব্রম্মা তো পইলো এক ভিষম চিন্তায়; কেমনে কি করা যায়? ব্রম্মা ঠাহুর এরে জিগায়, হ্যারে কয়, কিন্তুক কেউই রাজি অয় না পালের রাহালি নিতে। হ্যাষে ব্রম্মা নিজেই এক উপায় বাইর কইরল। নিজের শরীল থেইক্যা এক চিমটি ছ্যাঁতা নিয়্যা বানাইল এক মানুষ। আর হ্যারে দিল পালের দেহা-শুনার দায়িত্ব। হেই মানুষ তো পালের দায়িত্ব পায়া মস্ত ব্যাজার। হত্যা দিয়া পড়ল একদম ব্রম্মা ঠাহুরের পায়। ঠাহুর তারে কইল, ‘তরে পালের রাহালি দিলাম বইল্যা ব্যাজার অইস না। মর্ত্তে তরে সব্বাই হেলা করলেও তুই স্বর্গে আমার সাথী হবি। জগতের মানুষ তর পালা জংলির মাংস ভক্ষণ কইরে শান্তি পাইবো, আর তুই স্বর্গে আমার লগে অপ্সরীর নিত্য দেইখ্যা মজা পাবি। তরে নিয়া তাগো মইদ্যে টানাটানি পড়বো, দেখিস।’ বুঝলি রমেন, আমরা হইলাম স্বয়ং ব্রম্মার কায়া দিয়া তৈয়ার। স্বর্গে যিদিন যাবি হে বুঝবি কায়পুত্র কী জিনিস।”এমন আরও অনেক ভাল ভাল কথা শুনিয়ে রমেন্দ্রকে সান্ত্বনা দিয়েছে যোগেন। কখনো কখনো এসব কথার বিশ্বাসে জন্ম, বংশ, গোত্রের প্রতি ভক্তিতে মন গদগদ হলেও পরক্ষণে আবার মানুষের ঘৃণা, অবহেলা আর অবজ্ঞায় যোগেনের দেওয়া স্বর্গনটির নৃত্যগীত ও তাদের প্রেম, প্রণয় আহ্বানের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায় রমেন্দ্রর বিষিয়ে ওঠা মন থেকে।
তিন
কার্তিক মাস প্রায় শেষ। জমিতে চাষ দেওয়া শুরু করেছে নন্দীগ্রামের কৃষকেরা। মাঘী সরিষা, মুগ, মটর, খেসারি বোনার মরসুম এখন। নন্দীগ্রাম ছাড়ার সময় হয়েছে যোগেনের দলের। গতকাল নিখিল খবর এনেছে দেড় মাইল পুবের ধামশ্বর গ্রামের দরবেশের চকে প্রচুর ঘেচু-শামুক ও শালুকের মুথা আছে। এমনকি দরবেশের দরগা থেকে বিঘা পঞ্চাশেক দূরে উঁচুমত ছাউনি বানানোর একটা জায়গাও দেখেছে ও। আজ সকাল সকাল পাল নিয়ে দরবেশের চকের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দেয় ওরা। রমেন্দ্ররা যতই তারস্বরে, ‘হুমমমমমম হর হররররর হট হট, হুররেএএএএ হট’বলে চিৎকার দেয় প্রাণীগুলো যেন ততই সোৎসাহে এদিক সেদিক দৌড়াতে আরম্ভ করে।
এমনিতেই সকলের মায়না নিয়ে বিপিন গ্রামে যাওয়ায় দলে লোক একজন কম তার উপর বিছানাপত্র কাঁধে নিয়ে পাল খেঁদিয়ে অন্যত্র যাত্রা; হিমশিম খাচ্ছে দলের সবাই। দেওয়ালে পলেস্তরা খসা নন্দী বাড়ির সামনে এসে বাঁধল আরেক বিপত্তি। হঠাৎ একদল ছেলে এসে দমাদম লাঠি পেঠা শুরু করে পালের প্রাণীদের। তাদের আচমকা আক্রমণে ঘোঁৎ ঘোঁৎ চিৎকার করে প্রাণীগুলো ছুটতে থাকে এদিক সেদিক। যোগেন ছেলেদের বোঝাতে চেষ্টা করে, “বাবারা অবলা জীবরে মাইরো না, জীবে অভিশাপ দিলে পাপ অইবো কিন্তুক।”তাতে ছেলেদের উৎসাহ কমে না বরং ওদের মধ্যে নেতা গোছের একজন চিৎকার দিয়ে বলে, “না রে, মিছা কতা। কিচ্ছু অইবো না। মারেক তুরা, আমাগো হুজুরে কইছে গিধর পিটাইলে বাতের ব্যারাম ভাল অয়।”তারপর আগের মতই বিপুল উৎসাহে প্রাণীগুলোকে মারতে থাকে ওরা। ছেলেদের তাড়া খেয়ে কয়েকটি দলছুট প্রাণী দৌড়ে ঢুকে নন্দী বাড়ির দখলদারের বাগানে। নরম মাটি পেয়ে বাগান তছনছ শুরু করে প্রাণীগুলো। রমেন্দ্র দৌড়ে গিয়ে প্রাণীগুলোকে পিটিয়ে বের করার চেষ্টা করতে করতেই বাড়ির দুইজন ষণ্ডামত লোক এসে দমাদম কিল-ঘুষি মারতে থাকে ওকে। যোগেন দৌড়ে আসে, ক্ষমা চায়। কিন্তু কিছুতেই মন গলে না ওদের। অবশেষে বাগানে পরে থাকা প্রাণীর মলে নাক ‘ছেঁচর’ দিয়ে মুক্তি মেলে রমেন্দ্রর।
সেদিনই পাল রাখালির কাজ ছাড়ে রমেন্দ্র। যোগেনের অনুরোধ, আকুতি, স্বর্গের লোভ মিশ্রিত ধর্মীয় সান্ত্বনা, এমনকি বিপিনের ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষার মিনতি; কোনকিছুই ফেরাতে পারে না ওকে, ওর সিদ্ধান্ত থেকে। নিজের জামা-লুঙ্গি গুছিয়ে ভর দুপুরেই দল ছাড়ে সে। বাসে যেতে যেতে আড়পাড়ায় মসজিদ নির্মাণের চাঁদা তোলা লোকের হাতে ভয়ে ভয়ে দশটা টাকা দিয়েও দেখেছে রমেন্দ্র। প্রায় প্রৌঢ় লোকটা হাত তুলে দোয়া করেছে ওকে, ‘এ দানের বিনিময়ে বংশানুক্রমে যেন বেহেশত বাস হয় রমেন্দ্রর।’এ অভিজ্ঞতা রমেন্দ্রর জন্য একেবারে নতুন। অবাক হয়ে নিজের মনে কত ভেবেছে রমেন্দ্র, ‘মানুষের জাত পরিচয়ই বুঝি সব! এই যে, সে এখন পালে নেই, তাঁর পরিচয়ও নেই। কেউ না চেনা পর্যন্ত কোন অসুবিধাও নেই তাঁর। তাঁর শুয়োর রাখালির টাকা হাতে নিতে আপত্তি নেই কোন রিকসা, টেম্পো, বাসের লোকের। এমনকি, মসজিদ নির্মাণের ইট, বালু, সিমেন্টও কেনা যায় তাঁর টাকায়। হোটেলে বসে খেলেও এখন কটূ কথা বলে না কেউ। যত আপত্তি শুধু তাঁর জাত জানলে।’
লঞ্চে পদ্মা-যমুনা পার হয়ে গোয়ালন্দ এসে উপস্থিত হয় রমেন্দ্র। নদী পারের এই ঘাটে তাঁরই মত একদল অচ্ছুৎদের বসবাস। তারাও প্রকাশ্যে অচ্ছুৎ, অপবিত্র। কিন্তু গোপনে ওরাই প্রণয়িনী মানুষের; উঁচু-নিচু উভয়েরই। ওদের তুষ্টিতে কত মিঠা কথা, কত মিছে ভালবাসা মানুষের, ঠিক যেন কায়পুত্রের তুকতাক তাবিজ মন্ত্র পাওয়ার মত। গলিতে ঢুকতেই অচেনা অনেকের সাথে চেনা-পরিচিত মদিনা, রাণি, ইলোরা, পূর্ণিমারা ওকে আহ্বান জানায় মদির কটাক্ষে। রঙচঙ মাখা মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে বলে, “আইসো নাগর, আমার ঘরে আইস্যা বসো; মজা পাইবা।’’
এখানে এলেই যেন যোগেনের বর্ণিত স্বর্গের দেখা পায় সে। পুণ্যর পরিবর্তে এখানকার পাথেয় টাকা। কেবল টাকার জোরেই পূর্ণিমা, মদিনারা স্বর্গের অপ্সরী হয় বিছানায়, নূপুরে নিক্বন তুলে সারারাত গায় কিন্নর গীত; শরীর শরীরে। স্বর্গে যোগেনের শুয়োর সেবার পুণ্যর মত, এখানেও শুয়োর রাখালের টাকার এত কদর! ভেবে অবাক হয় রমেন্দ্র। সারারাত পূর্ণিমার ঘরে কাটিয়ে সকালে বের হতে গেলে পূর্ণিমা বলে, “ তুমি দেহি হিঁদু।”কোন রকমে ঢোক গিলে রমেন্দ্র জিজ্ঞাসা করে, “ক্যান কী অইছে?” “কী আবার অইবো,’’ পূর্ণিমা বলে, আমিও হিঁদু, জাতে বামুন। তা তুমি কোন জাতের?” রমেন্দ্র ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়, “ আমরা কাউরা।” ওর অবস্থা দেখে পূর্ণিমা হাসতে হাসতে বলে, “ পয়সা দিয়্যা কাম করবা এত ডর কিসের? কত মুসলমান আসে আর তুমি তো জাতভাই। আমার ঘরে আবার আইসো, তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করুম।”তখন কোন জাত-ভেদ, বিধি-নিষেধহীন; এ স্বগর্কে হঠাৎই যোগেনের বর্ণনার স্বর্গের চেয়েও সুন্দর মনে হয় ওর। ধর্ম, জাত, পেশা; সবকিছুই অচল এখানে।
স্বর্গেও ক্লান্তি আছে; হয়তো নেই। কিন্তু দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় বসবাসকারী রমেন্দ্রর এ সুখ ভোগ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়না। দুদিনেই ট্যাঁক খালি করে রমেন্দ্র ভাবে, নিজের পরিচয় লুকিয়ে কোন একটা কাজ নেওয়া গেলে মন্দ হয় না। কিন্তু যদি পরিচয় প্রকাশ হয় কোনদিন? তারপর? পায়ের গভীর কালশিটে দাগটাতে দৃষ্টি পরে ওর। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওপারে পাটুরিয়া, বরংগাইল, ঘিওর, নন্দীগ্রাম পেরিয়ে দরবেশের চক। আর কানে বাজে, “হুমমমম হর হর হররর…হট।”
অনবদ্য ভাষায় অপূর্ব নির্মাণশৈলী, একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে পড়লাম। ধন্যবাদ রাজু অনার্য।
ভালো লেগেছে! দারুন লিখেছেন ভাই……….
ভালো লেগেছে এটা বলতে কার্পণ্যতা নেই।