১
বেনজামিন জন্মেছিলেন ১৮৯২ সালের ১৫ জুলাই জার্মানির এক সচ্ছল ইহুদি পরিবারে। তাঁর উচ্চ মধ্যবিত্ত পারিবারিক ইতিহাসের পরিচয় পাই গৃহে পড়াশোনার বন্দোবস্ত এবং পরিচারিকার তত্ত্বাবধানে বড় হওয়ার ইতিহাস থেকে। পরে ভর্তি হয়েছিলেন অভিজাত বোর্ডিং স্কুলে। সেখানে শিক্ষক হিসাবে পান গুস্তাভ ভিনেকেনকে। শিক্ষা ও তারুণ্য নিয়ে ভিনেকেনের ধ্যানধারণা বেনজামিনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তবে বেনজামিনের সুখের জীবন বেশিদিন টিকে নাই। জার্মানরা তখন বিশ্বযুদ্ধ আর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষে টালমাটাল সময় কাটাচ্ছিল। ফলে আর্থিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল নাজুক। তার উপর আবার ইহুদির ছেলে। নাজি জার্মানীতে ইহুদি ঘরের এক সৃষ্টিশীল তরুণের সংকট অনুমান করাও হয়ত আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বস্তুত তাঁর আটচল্লিশ বছরের জীবনের শেষ অর্ধেকটাই দারিদ্র্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাধাবিপত্তির জীবন। আর ওই সময়টাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও সংস্কৃতি-তাত্ত্বিকের একজন।
বেনজামিনের সাথে মার্কসীয় তরিকার প্রথম সাক্ষাৎ চিন-পরিচয় ঘটেছে বোধ হয় লুকাচের লেখা মারফত। তবে ওই সময়টায় আসলে মার্কসীয় চিন্তাভাবনার এমন প্রতাপ ছিল, বিশেষত রাশিয়ার বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে মার্কস এতটাই তাজা ছিলেন যে, বেনজামিনের কাছে এসব চিন্তা অচিন থাকার কোনো কারণ নাই। যাকে পরবর্তীকালে ক্রিটিকেল বা পর্যালোচনামূলক লেখালেখি বলা হবে, বেনজামিনের লেখা প্রায় প্রথম থেকেই তার সগোত্র। তাছাড়া ভিত্তিস্তরের যথেষ্ট খোঁজখবর ছাড়া উপরিকাঠামোর খোঁজখবর নেয়া যে খুব একটা কাজের হয় না, এ হুঁশও তাঁর লেখায় বরাবরই দেখা গেছে। মনের মিল থাকার কারণেই হয়ত পরের জীবনে তাঁর সাথে মার্কসপন্থিদের যোগাযোগটা বেশ ধারাবাহিকভাবেই হয়েছিল। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য লাটভীয় অভিনেত্রী বান্ধবী আসজা লাজিসের সাথে পরিচয়-প্রণয় ও রাশিয়া-ভ্রমণ, বার্টল্ট ব্রেখটের সাথে অন্তরঙ্গ বিনিময় এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সাথে কার্যকর যোগাযোগ। বলা যায়, বেনজামিনের জীবনের শেষ দেড় দশক কেটেছে মার্কসীয় চিন্তাভাবনার আঁচে। তাঁর হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখায় তার চিহ্ন চিরকালের মতো মুদ্রিত হয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা নিঃসন্দেহে ‘যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা’।
২
‘যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা’ প্রবন্ধে দুটি গুণের বিরল সমন্বয় ঘটেছে। একদিকে প্রবন্ধটিতে চিন্তার এমন নতুনত্ব আছে, যা তুরীয় সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনাপ্রতিভার এক মোক্ষম সাক্ষ্য বহন করে। অন্যদিকে, নন্দনতত্ত্ব নিয়ে ওই সময় পর্যন্ত বিকশিত জ্ঞানকাণ্ড পদ্ধতিমাফিক ব্যবহার করে এবং বক্তব্যের শৃঙ্খলা ও স্পষ্টতা রক্ষা করে বেনজামিন তাঁর অতি নতুন কথাগুলো মসৃণ ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। শুরুতে প্রস্তাবটা দিয়েছেন স্পষ্ট ভাষায়। তাতে মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের বৈপ্লবিক রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষাটা মোটেই গোপন করেননি। হানা আরেন্ট লিখেছিলেন, বেনজামিন বোধ হয় বিপুল মার্কসবাদী তাত্ত্বিকের মধ্যে খুবই আলাদা একজন; আর তাঁর আগ্রহ বিশেষভাবে কেন্দ্রীভূত ছিল উপরি-কাঠমোয়। এ এলাকায় মার্কস খুব সামান্যই মনোযোগ দিতে পেরেছিলেন, যদিও পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ মার্কসবাদী তাত্ত্বিকের বড় অংশ এ পরিসরেই কাজ করেছেন। আরেন্টের এ কথায় দ্বিমতের কোনো অবকাশ নাই। কিন্তু এটাও সত্য যে, অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের মতো ‘যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা’ প্রবন্ধেও বেনজামিন কোনো রাখঢাক না করেই মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বের চর্চাকারী হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। বলেছেন, মার্কস যেভাবে পুঁজির কম বিকশিত অবস্থার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অতি-বিকশিত অবস্থার দুর্দান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, সে তরিকা অনুসরণ করে উপরিকাঠামোর বিশেষত শিল্পকলার তত্ত্বায়ন খুবই সম্ভব, আর তা রাজনৈতিক কাজই বটে। তবু বিশ্লেষকদের অনেকেই-যে প্রবন্ধটির শুরু ও শেষের অংশ ছাড়া ‘মূল’ অংশে মার্কসবাদী তরিকা দেখেননি, তাতে তাঁদের বিশেষ দোষ দেয়া যায় না। বস্তুত, এ অংশগুলোতে মার্কস বা মার্কসবাদীদের দোহাই পাড়া হয়নি বললেই চলে। আমরা বলব, এর কারণ এই যে পুরনো মার্কসবাদী সিলসিলায় বেনজামিনের জন্য সহায়ক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। এমনকি লুকাচের মতো প্রভাবশালী শিল্পতাত্ত্বিকের কথা মনে রেখেও নিশ্চিন্তে দাবি করা যায়, ব্যবহৃত অনুমান, তত্ত্বকণিকা আর নন্দনতাত্ত্বিক উপাদানগুলো মোটের উপর বেনজামিনের নতুন আবিষ্কার।
প্রবন্ধের শুরুতেই বেনজামিন ‘পুনরুৎপাদিত শিল্পকলা’ বলে একটা বর্গ খুব গুছিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ বর্গই তাঁর পরের যাবতীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তি। তিনি দেখিয়েছেন, এক ধরনের শিল্পকলা যেমন আলোকচিত্র, পত্রিকায় ছাপানো ছবি, বই, ছাপচিত্র, রেকর্ড-করা গান, সিনেমা ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য এমন যে, এর কোনো একটি কপি ‘মূল’ কপি নয়। বরং প্রতিটিই আলাদাভাবে মূল বলে গণ্য হতে পারে। এটা, ধরা যাক, চিত্রকলার স্বভাবের বিপরীত। চিত্রকলারও প্রতিলিপি হতে পারে, এবং হয়ও। কিন্তু সেখানে মূল শিল্পকর্মের অনন্যতা এতই আলাদা থাকে যে প্রতিলিপি কখনোই তার নাগাল পায় না। এই দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্য থেকে বেনজামিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আধুনিক জমানা শিল্পের পুনরুৎপাদনের জমানা। পুরানা ধারণায় শিল্পকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার অনন্যতা ও প্রামাণিকতা। এই দুই বৈশিষ্ট্য শিল্পকর্মে সুদূর ‘মহিমা’র জন্ম দেয়; আর শিল্প উপভোগের ক্ষেত্রে ভক্তি তথা কাল্টকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। নতুন জমানায় এ পরিস্থিতির বৈপ্লবিক বদলের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এমন শিল্পকর্ম সম্ভবপর হয়েছে, পুনরুৎপাদনই যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর মধ্য দিয়ে আগের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য, যেমন মহিমা, অনন্যতা, প্রামাণিকতা ও আচারমূল্য, চিরতরে পাল্টে গেছে। সিনেমার মধ্যেই এসব নতুনত্বের চূড়ান্ত প্রতিফলন পাওয়া যায়।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্ক বদলে গেলে মানুষের বোধের ধারাও বদলে যায়। গুটেনবার্গ বিপ্লবের পর উপলব্ধির ধরন বদলে যাওয়া খুবই বিখ্যাত ব্যাপার। তবে বেনজামিন ছাপাখানার উদাহরণ এ মর্মে ব্যবহার করেননি। তিনি পুরানা উদাহরণ দিয়েছেন শেষ রোমান যুগ থেকে। আর বলেছেন, উনিশ শতকের শেষাংশে এর আরো ভালো মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে প্রথমত আলোকচিত্রের উদ্ভব এবং পরে সিনেমার কল্যাণে। উপলব্ধিগত এ পরিবর্তনের কথা বেনজামিন বলেছেন প্রবন্ধের শেষাংশে। তার আগে শিল্প-উপভোগের ধরন সম্পর্কে নতুন আলোকপাত করেছেন। বলেছেন, পরে শিল্প হিসাবে গণ্য হয়েছে, এমন অনেক কিছু আগে পূজা বা ধর্মীয় আচারের অংশ ছিল। এই আচারমূলকতা বা রিচ্যুয়ালিস্টিক অ্যাপ্রোচ শিল্পভোগে অন্যভাবে পরেও রয়ে গেছে। বিশেষত রেনেসাঁর কালে সৌন্দর্য উপলব্ধির নতুন কেতা চালু হয়, আর অন্তত তিনশ বছর ধরে তা রাজত্ব করে। এ ধারারই একটা চূড়ান্ত পরিণতি ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ মতবাদ। এ দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক বাস্তবের ভিত্তিকে নিজের অস্তিত্বের যুক্তি হিসাবে মানে না বলে এটা আসলে, বেনজামিনের চমকপ্রদ শনাক্তি, এক ধরনের ধর্মতত্ত্ব। তাহলে শিল্পভোগের একটা ধারায় শিল্পকে দেখা হয় এক দূরবর্তী ভক্তি ও মোহের দৃষ্টিতে, অনেকটা রিচ্যুয়ালের মতো করে। অন্য ধারায় প্রাধান্য দেয়া হয় প্রদর্শনযোগ্যতাকে। বহু মানুষের কাছে পৌঁছার ক্ষমতাকে। এই দ্বিতীয় ধারার প্রতিই বেনজামিনের আকর্ষণ। এর এক প্রধান কারণ, শিল্পসৃষ্টির আর উপভোগের এই কেতার রাজনৈতিক তাৎপর্য অপরিসীম।
শিল্পকর্মের দিকে ভক্তিভরে তাকানো আর নিজেদেরকে তুচ্ছ ভেবে উপভোগের বহু উপাদান অন্যের জন্য তুলে রাখা — এ দুয়ের মধ্যে একটা গভীর-গোপন সম্পর্ক আছে। আধুনিক জমানার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, ক্রমশ অধিক সংখ্যক মানুষের এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা। প্রত্যেকেই ব্যক্তি হিসাবে নিজের অধিকার বুঝে নিতে চায়; নিজের অবস্থানে থেকেই শিল্প উপভোগ করতে চায়। এ প্রবণতায় সায় দেয়া পুরানা শিল্পকলাগুলোর পক্ষে, যেমন চিত্রকলার পক্ষে, সম্ভব নয়। চিত্রকলার প্রদর্শন-পদ্ধতি এবং উপভোগের পদ্ধতি এমন যে, একসাথে বহু মানুষের নিবিষ্ট চিত্তে উপভোগের সুযোগ হয় না। এ সমস্যার সমাধান হতে পারত একমাত্র পুনরুৎপাদিত শিল্পকর্মকে ‘মূলে’র মর্যাদায় গ্রাহ্য করে। ফটোগ্রাফি সে পথ উন্মুক্ত করেছে, আর সিনেমায় তার চূড়ান্ত পরিণতি।
বিশদ পটভূমির পরে বেনজামিন সিনেমার নানা খুঁটিনাটি সামনে এনেছেন এবং অন্য বেশ কিছু শিল্পমাধ্যমের সাথে এর তুলনা করেছেন। তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ দুটো। একটি হল, সিনেমার প্রযুক্তি-নির্ভরতা। অন্যটি, মানুষের উপলব্ধির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সাথে সিনেমার তুমুল ঐক্য। প্রযুক্তি বেনজামিনের কাছে সব সময়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জীবনযাপনকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে বলেই, বেনজামিন মনে করেন, শিল্পসৃষ্টিতেও প্রযুক্তির অঙ্গীকার অনিবার্য। সিনেমা তাঁর কাছে এদিক থেকে মোক্ষম মাধ্যম, যেখানে প্রযুক্তির সর্বোত্তম সক্রিয়তায় শিল্প রচিত হয়। অন্যদিকে আধুনিক মানুষের উপলব্ধিগত বদলের সাপেক্ষে সিনেমার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য বেনজামিন দাদাবাদের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে, আধুনিক মানুষ মনের দিক থেকে বিস্রস্ত প্রকৃতির। কাজেই খুব তন্ময় হয়ে উপভোগ করতে হয় এমন শিল্পকলা তার জন্য বেশি উপযোগী নয়। দাদাবাদীরা কবিতায় শব্দের এবং চিত্রকলায় উপকরণের অজাচার করে মানুষের বিস্রস্ত মনকে আঘাতের মধ্য দিয়ে সক্রিয় করার তরিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু যে ফলের আশা তাদের অচেতনে ছিল, কবিতা বা চিত্রকলায় সে ফললাভের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। একমাত্র সিনেমার পর্দাতেই অনবরত ধেয়ে চলা দৃশ্যের ধারাবাহিক আঘাতে মানুষের নির্লিপ্ত মন সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এই গভীরতর অর্থেও সিনেমা বিশ শতকীয় শিল্পমাধ্যম।
৩
১৯৪০ সালে আমেরিকার উদ্দেশে ইউরোপ ছাড়ার এক প্রাণান্তকর চেষ্টায় ব্যর্থ হবার পরে বেনজামিন সম্ভবত আত্মহত্যা করেছিলেন। আটচল্লিশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে একটা দীর্ঘ সময় ধরে খুব বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করলেও তাঁর রচনাবলির পরিমাণ বিস্ময়করভাবে বিপুল। ক্রমশ ডিসিপ্লিনের দিক থেকে এসব রচনার বৈচিত্র্য এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই তত্ত্বীয় নতুনত্ব দুনিয়াজুড়ে সমাদৃত হতে থাকে। তাঁর সময়ের জার্মানি একদিকে সৃষ্টিশীল ও চিন্তাজগতের নানা তাৎপর্যপূর্ণ তৎপরতায় সজীব ছিল, অন্যদিকে রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। একজন ইহুদির সন্তান হিসাবে বেনজামিন শেষোক্ত জার্মানিকে অন্তত শেষ দুই দশক ধরে মোকাবেলা করেছেন চরম অস্তিত্বসংকটের বাস্তবতায়। এই সবগুলো দিকই বেনজামিনের তাবত লেখালেখির আভ্যন্তর প্রেরণা হিসাবে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছে। আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধটিও আগাগোড়া এসব লক্ষণের সাক্ষ্য বহন করছে।
অনেকগুলো ডিসিপ্লিনে তত্ত্বীয়-প্রায়োগিক দিক থেকে কালোত্তীর্ণ অবদান রাখলেও এ কথা হয়ত নিশ্চিন্তে বলা যাবে, প্রযুক্তি এবং আর্টফর্মের সম্পর্ক বেনজামিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এই এলাকায় তাঁর কাজ শুরু হয়েছে মূলত ‘লিটল হিস্ট্রি অব ফটোগ্রাফি’ (১৯৩১) প্রবন্ধ দিয়ে। পুরানা শিল্পরূপগুলোর সাথে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন শিল্পকলার বনিবনা হচ্ছে না — এই কথাও তিনি প্রথম সবিস্তার বলেছেন এই প্রবন্ধে। ‘যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা’ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে, বলা যায়, প্রকল্পটি চূড়ান্ত মূর্তি পেল। এ প্রকল্পের গোড়া পোঁতা আছে ফ্যাসিস্ট জার্মানিতে। আলোকিত জার্মানি-যে বীভৎস রাজনৈতিক পরিণতি ঠেকাতে পারল না, সে উদ্বেগ প্রবন্ধটির অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক ভিত্তি। শিল্পকলার উৎপাদন ও ভোগ জীবনের আর দশদিক থেকে বিচ্ছিন্ন তো নয়ই, বরং সামগ্রিক ঐক্য দিয়েই কেবল এর কার্যকর পর্যালোচনা সম্ভব — নব্য মার্কসবাদী ঘরানার এ তাত্ত্বিক ভিত্তি বেনজামিনের লেখালেখিতে খুবই প্রত্যক্ষ। সে চোখ দিয়ে তিনি সহজেই বুঝতে পেরেছেন, সৃষ্টিশীলতা, প্রতিভা, মহিমা-মাহাত্ম্য ইত্যাদি প্রচলিত নান্দনিক বর্গগুলো ফ্যাসিবাদের হাতের পুতুল হয়ে একদিকে ফ্যাসিবাদকেই শক্তি জোগাচ্ছে, অন্যদিকে জনগণকে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করে ভুল আবেগে বশীভূত করছে। বেনজামিনের নন্দনতাত্ত্বিক অভিযান আদতে এর বিপরীতমুখী যাত্রা।
এ কারণেই প্রযুক্তি তাঁর কাছে এত গুরুত্বপূূর্ণ। প্রযুক্তি যদি মানুষের বাস্তব জীবনের প্রধান নিয়ামক হয়েই থাকে, প্রযুক্তির পরিবর্তন যদি মানুষের প্রকৃত জীবনযাপনকে তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে বদলে দিয়েই থাকে, তাহলে শিল্পের উৎপাদন ও ভোগ কিছুতেই তার বাইরে থাকতে পারে না। বাইরে আসলে থাকেও নি। বেনজামিনের সমকালেই ভবিষ্যতবাদী আন্দোলন যান্ত্রিক বাস্তবতাকে শিল্পকর্মে স্বাগত জানানোর প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল। কিন্তু মারিনেত্তিদের পক্ষে জীবনযাপনের সামগ্রিকতার মধ্যে প্রযুক্তিকে অন্তরঙ্গ অঙ্গীকারে অঙ্গীভূত করে তার শৈল্পিক উৎসারণ কামনা করা সম্ভব ছিল না। কোনো বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কারণ, ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব লিবারেল ডিসকোর্সের পরম আরাধ্য, প্রতিভার জয়গান করা আর ‘অরা’ উৎপাদন করা তার অনিবার্য প্রক্রিয়া। ফলে মারিনেত্তি যে যুদ্ধের জয়গান করবেন, শিল্পকর্মে যুদ্ধের ‘নান্দনিকতা’ সঞ্চারিত করতে চাইবেন, তা তো বলাই বাহুল্য। এর মধ্য দিয়ে আসলে, বেনজামিন দেখিয়েছেন, নান্দনিকতা রাজনীতির স্থলাভিষিক্ত হয়। অন্যদিকে তাঁর নিজের লক্ষ্য প্রযুক্তির তাবত সুবিধা অঙ্গীকার করে খোদ নন্দনতত্ত্বকেই রাজনৈতিক করে তোলা।
আর এ লক্ষ্যের উৎস নতুন আরেক নন্দনতত্ত্বের প্রস্তাব নয়। বরং শিল্পকলায় প্রতিটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার তাত্ত্বিক ভিত্তি হাজির করা। সিনেমার ব্যাপারে বেনজামিনের আগ্রহের মূল কারণই এই যে, আগের শিল্পকলাগুলোতে এ ধরনের কোনো সুযোগই ছিল না। তিনি সচেতন ছিলেন, সিনেমায়ও তা হচ্ছে এমন নয়। কিন্তু দেখিয়েছেন, সিনেমায় তা সম্ভব। সিনেমায় সেই ‘মহিমা’ ধ্বংস হয়েছে; ব্যক্তিগত তন্ময়তার সুযোগ বিলুপ্ত হয়ে সামষ্টিক উপভোগের পথ পরিষ্কার হয়েছে। দর্শককে ভক্তিতে আকুল না করে সিনেমা, ক্রীড়ার মতোই, অংশগ্রহণমূলক সমঝদারি সম্ভবপর করেছে। জীবন এবং মুক্তি যাঁর লক্ষ্য, তাঁর জন্য এরচেয়ে রাজনৈতিক আর কী হতে পারে?
বেনজামিন খাঁটি জর্মন এবং ততোধিক ইউরোপীয়। আলোকায়নের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি, আর বিপজ্জনকভাবে ইউরোপকেন্দ্রিক। আসলে ইউরোপীয় মার্কসবাদ বলে যে বস্তু পরে পরিচিতি পেয়েছে, নন্দনতত্ত্বে বেনজামিনকে বলা যায় তার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এসব দিক থেকে ‘অন্যদের’ জন্য অস্বস্তির কিছু ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু এটাও সত্য, পশ্চিমা বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের যে কোনো নিক্তিতেই বেনজামিনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয়েছে ওই পটভূমির দৌলতেই। তার সাথে যুক্ত হয়েছে মানবমুক্তির আকুতি। আরোপণমূলকভাবে নয়, অন্তরঙ্গ তাত্ত্বিক কাঠামোতেই। এ বস্তু দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল হওয়ারই কথা। ‘যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা’ সেই বিরল সম্মিলনের সাক্ষ্য বহন করছে। এই প্রকল্প সম্ভবত সমকালীন রুশ তাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিনের উপন্যাসতত্ত্বের সাথেই কেবল তুলনাযোগ্য। বাখতিন ভাষা ও উপন্যাসকে অবলম্বন করে যে বিপ্লব করেছেন, বেনজামিন সমধর্মী কাজ করেছেন প্রযুক্তি ও সিনেমাকে অবলম্বন করে। ওই দুটোই বোধ হয় আজতক রাজনৈতিক নন্দনতত্ত্বের সর্বোত্তম প্রকাশ।
[সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘বিষয় সিনেমা : তিনটি অনূদিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থের ভূমিকা থেকে।]