এত রক্ত কেন?

তিনভাগ রক্ত ।। কবিতা ।। প্রকাশক : নাগরী ।। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ

১.
যখন জ্বর আসে আমার শরীরে, তখন মনে হয় কে যেন রক্তে গোলমরিচের ঝাঁঝ ছিটিয়ে দিয়েছে। আমার রক্ত ফুটতে থাকে।
খেয়াল করেছি এটা ছোটোবেলা থেকেই। রক্ত ফুটতে থাকে, আর আমার কেমন যেন লাগে। এটা একটা অভিজ্ঞতা আমার, জীবনভর।
বছরে একবার জ্বর তেড়ে আসে শরীরে, মনে আছে এই জ্বরই কতকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে আমার পরিকল্পনার। জ্বর আমাকে কাবু করে ঠিকই, তবে জ্বরের প্রতীক্ষায়ও থাকি সারা বছর। জ্বর এলে নিজেকে অনুভব করাও যায়।
জুলাই-ডিসেম্বর আমার জ্বরের মৌসুম। এই মরশুমে যে কোনও সময় এই মেরুভল্লুক তেড়ে আসতে পারে আমার জীবনে। আমি মনে মনে প্রস্তুতও থাকি। তখন শুয়ে থাকা যায়, অবসর পাওয়া যায়; না-পড়া বইগুলো পড়তে না পারলেও পাতা ওলটানো যায়।
গত বছরের আগস্ট মাসেই আমার অতিথি এলেন। আমি কাতর হয়ে পড়লাম। বিছানা থেকে আর উঠতে পারিনা।
এর আগে থেকেই আমি কাতর ছিলাম একটা বিষয় নিয়ে। সত্যি আমি কাতর ছিলাম আমি। অসহায় ছিলাম।
মাঝে মাঝে এমন হয়। মানুষের ইতিহাস যখন পড়ি তখন কাতর হয়ে থাকি।
দেখি মানুষের ইতিহাস মানেই রক্তপাতের ইতিহাস। সভ্যতার ইতিহাস মানেই হত্যাকাণ্ড আর মানুষকে স্বভূমি থেকে উৎখাতের ইতিহাস।
কিছু মানুষকে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হবে, কিছু মানুষ না বাঁচলেও চলবে। সুতরাং সুন্দরভাবে বাঁচবে, অপরপক্ষকে হত্যা করতে অসুবিধা নেই; বাস্তু থেকে উৎখাত করতেও কিছু যায় আসে না। এভাবেই হয়ে আসছে। এটা যখন ভাবি, মানুষী বিকল হয়ে বসে। আমি অসুস্থতা বোধ করি।
তখন, আগস্ট মাসের আগে থেইে, ইতিহাস নয়; বাস্তব আমাকে কুঁকড়ে দিয়েছিল। আমি আহত ছিলাম। আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমি হতাশ ছিলাম।
আমার শরীরে প্রবলভাবে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল; রক্তের উত্তাপ আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম জ্বর ছাড়াই।
নিপীড়ন আর মানুষের অসহায়ত্ব আমাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছিল। আমি কাতর ছিলাম।
অস্ফুট স্বরে অসহায় আমি বাতাসের কানে কানে বলছিলাম, এত রক্ত কেন?

 

২.
ঘটনা আর কিছুই নয়, কাশ্মীর।
তখনকার কাশ্মীরের অবস্থা সকলেই জানেন। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা আমি। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাসও সকলে জানা। সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই জানেন কাশ্মীরের ইতিহাস ঘৃণ্য স্বার্থ, হিংসা আর ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। তা বৃটিশভারত, ভারত, পাকিস্তান সকলের দিক থেকেই। শাসকগোষ্ঠী বলি, দখলদার বলি, সকলেই এরা সমান কাশ্মীর প্রশ্নে। ওরা সকলে চেয়েছে কাাশ্মীরের মাটি আর সম্পদ। উপভোগ করতে চায়না কাশ্মীরের সৌন্দর্য; কিংবা সবার ওপরে যা, কাশ্মীরের মানুষকে সম্মান করেনি কেউ।

বরং সকলেই কাশ্মীরের সম্পদকে লুট করেছে, মাটি আত্মসাৎ করেছে, মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, তরুণদের হত্যা করেছে। এভাবে চলছে কাশ্মীর। কাশ্মীরের আত্মা যে তার জনগণ তারা কী চায়, এটা জানতে সবাই নারাজ। বিশ্বমোড়লেরাও এই ব্যাপারে চুপ। কাশ্মীর শুধু ভারত-পাকিস্তানের ‘বাফার স্টেট’ নয়, পৃথিবীরও মনে হয়। রাজনীতি, হিংসা, স্বার্থ, আধিপত্য, জরবদখল, দমনপীড়ন ইত্যাদির অন্তরালে একটি জাতিগোষ্ঠীকে কিভাবে ধ্বংস হয়ে যাছে; তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্য সভ্যতা থেকে নির্মমভাবে বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে সেটাই যেন চোখে পড়ছেনা সভ্য মানুষের।
আমরা এটাকে বলছি এটি একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। অন্তত বিষয়টা যখন খোদ মানুষের জীবন নিয়ে।
বিষয়টা মানুষের অধিকার নিয়ে। ন্যায় ও ন্যায্যতা নিয়ে। কিন্তু অদ্ভুত আঁধার চারিদিকে ছেয়ে গেছে। ধর্ম আর রাষ্ট্র একাকার হয়ে যাচ্ছে। ছোটো স্বার্থে বড়ো স্বার্থে মুখে কুলুপ এটে বসে আছে রাষ্ট্রসংঘ; কেনা বৃদ্ধিজীবী। মুখস্থমানুষগুলো।

রাষ্ট্র রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র মানুষের জন্য। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ; কিন্তু মানুষ পৃথিবীর বাসিন্দা। নাগরিক ও মানুষ এক জিনিশ নয়। যে-রাষ্ট্র কাশ্মীরিদের দমনপীড়ন করছে; যারা এদের মদদ দিচ্ছে, তাদের রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন শুভ যে নয়, তা জানা কথা। একটি রাষ্ট্র তার নাগরিক-আইন তৈরি করবে এটা যেমন ঠিক; সে আইনে মানবিকতাও যে নিশ্চিত করতে হবে তাও সত্য। কিন্তু মানবিকতা কি, যেখানে কাশ্মীরের মানুষকে মানুষই ভাবা হয় না, হচ্ছে না। কারণ তারা কাশ্মীরি। মুসলমানও একটা বড়ো পরিচয়। ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সাহিত্য, ধর্ম সেটা তো দূরঅস্ত। বরং রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হলো, মানুষ নয়; কাশ্মীরের মাটি চাই। অর্থাৎ মানুষের চেয়ে মাটিই দামি। তখন থলের বিড়াল বেরিয়ে গেল।
তো সে-সময়টায় কাশ্মীরের নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছিল; কাশ্মীরের মানুষ ফুঁসে উঠছিল, আর তাদেরকে ঘর থেকেও বের হতে দিচ্ছিলনা রাষ্ট্রশক্তি, তারা রীতিমতো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। পূর্বে যে অবরোধ ছিল অদৃশ্য, এখন তা দৃশ্যমান হয়ে উঠল।
বিষয়টা আর সকলের মতো আমাকেও আহত করল, একজন মানুষ হিসেবে।
আর, ওইদিকে কাশ্মীরকে আমি জানি আরও ঘনিষ্টভাবে; জানি কাশ্মীরের মানুষকেও।

 

৩.
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে আমি কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলাম শিমুলকে সঙ্গে নিয়ে। যে-কাশ্মীরকে জানি ভূস্বর্গ হিসেবে; যে-কাশ্মীরের মানুষকে জানি পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষ হিসেবে তা বাস্তবে দেখা হলো আমার। নিছক ভ্রমণ নয়, কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে মিশেছিলাম ঘনিষ্টভাবেও। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা।
এর আগে থেকেই কাশ্মীরে বুঁদ ছিলাম আমি; কাশ্মীরের হৃদয়ের সঙ্গে যোগ ছিল আমার। সে-হৃদয় কাশ্মীরের সাহিত্য, কাশ্মীরের শিল্পকলা, কাশ্মীরের উপাখ্যান; সর্বোপরি কাশ্মীরের নানান জাতের গোলাপ। কাশ্মীর আমার হৃদয় হরণ করেছিল এসবেই।
আমরা ভ্রমণ শুরু করেছিলাম এক ভোরে জম্মু থেকে। যে-জম্মুর সঙ্গে কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জম্মুর প্রকৃতির সঙ্গেও কাশ্মীরের একটা যোগ আছে। বলতে গেলে জম্মুর পাহাড়, উপত্যকতা, নদী চষে আমরা কাশ্মীরে প্রবেশ করেছিলাম। জম্মু ও কাশ্মীরের মাঝখানের দীর্ঘ ট্যানেল পেরুলেই পৃথিবীর স্বর্গে পৌঁছানো যায়, পৌঁছেও ছিলাম।
কাশ্মীর সত্যিকারই স্বর্গবিশেষ। ভূস্বর্গ। অদ্ভুতরঙের আকাশ, নীল উপত্যকা, তুষারের স্রোত, সফেদ পর্বতচূড়া, খরস্রোতা নদী আমাকে পাগল করে তুলেছিল। আনন্দে আমি বারবার চিৎকার করে উঠেছিলাম। আমি উত্তেজিত ছিলাম।

এই উত্তেজনার ভেতরে একটা কান্না গুমড়ে উঠত। মনের ভেতর সারাক্ষণ প্রশ্ন জাগত, এই সুন্দর স্থানটিকে ওরা হিংসায় ভরে তুলছে কেন? বিদ্বেষ কি এতই জরুরি?
কাশ্মীর সুন্দর, কিন্তু এই সুন্দরকে কারা যেন রক্ত দিয়ে মুড়ে রেখেছে। তখনই আমি বিষণ্নবোধ করতাম।
সরারটা ভ্রমণজুড়ে ঝিলমের সবুজ পানি দেখলাম। আর সব পানির নহর। লম্বা দেবদারু, নীল পাইনগাছ, শুভ্র পাহাড়। আর মাঠের পর মাঠ জাফরানের খেত। কাশ্মীরের চেরির বাগান, আপেল বাগান। কাশ্মীর দেখা আর শেষ হয়না।
কিন্তু আমি এসবের ভেতরে দেখেছি মানুষের মলিন মুখ; তরুণীদের সন্ত্রস্ততা; যুবকদের পালিয়ে বেড়ানো; বৃদ্ধদের পথচাওয়া আর দীর্ঘশ্বাস।
কাশ্মীর ভ্রমণে পরিচিত হয়েছি নানাবয়েসের নারীপুরুষের সঙ্গে। কথা বলেছি। আতিথিয়েতাও গ্রহণ করেছি। শীতের কাপড় উপহার পেয়েছি।
সপ্তাহখানেক পর যখন জম্মুর উদ্দেশে গাড়িতে চাপি তখন মনটা নিদারুণ অবসাদে পেয়ে বসেছিল। কারণ কাশ্মীরের প্রকৃতি, ইতিহাস ও মানুষ আমাকে প্রবলভাবে চেপে ধরেছিল।

 

৪.
কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও গল্প করেছি বলে মনে পড়েনা তখন। আসলে, আমার ক্ষেত্রে যেমন হয়; সুন্দরের মুখোমুখি হলে আমি বিষণ্ন হয়ে যাই বরাবর। পাহাড় আমাকে বিষণ্ন করে, সমুদ্র করে, বনভূমি করে। কিন্তু কাশ্মীর আমাকে হতবাক করে দিয়েছিল। সত্যি হতবাক ছিলাম কিছুদিন।
কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় মনের ভেতরে কবিতার একটি পঙ্ক্তি ঘুরতে থাকে। তখন আমি ডেস্কটপে লিখতে শুরু করেছি।
আমি সান্ধ্য-চায়ের কথা ভুলে গিয়ে ঘোরের মাথায় কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলি। আমি সেই ঘোরে থাকি সপ্তাহ খানেক। লিখে ফেলি শতাধিক কবিতা। সেই কবিতাগুলো নিয়ে পরে সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী কাব্যটি প্রকাশিত হয় শুদ্ধস্বর থেকে।
বইটি লেখার পর আমার অতৃপ্তি রয়েই গেল। আমি যেন অন্য কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কী আর লিখতে পারতাম, আমি জানতে পারিনি।
তারপর দীর্ঘদিন কাশ্মীর নিয়ে কিছু ভাবা বা লেখা হয়নি।
সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকীর কবিতাগুলো আমি প্রায় সময়ই পড়ি; আমার ভালোও লাগে। কিন্তু নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
চোখে ভেসে ওঠে কাশ্মীরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপনা। আর স্মৃতিতে ভীড় করে কিছু মলিন মুখ। সুন্দর, কিন্তু মলিন।
আমরা হয়ত সিন্ধুর পাশ দিয়ে যাচ্ছি; একটি মেষপালক বালিকা হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। আপেলের মতো লাল মুখ; মার্বেলের মতো নীলদুটি চোখ।
অথবা, সন্তানহারা এক বৃদ্ধা, ছানিপড়া চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
অথবা, রাগী এক যুবক। মুখে দাড়ি, মাথায় পাগড়ি।
অথবা, এক টলটলে তরুণী, লম্বা আঙুলে পাহাড়ের রোদ লেগে আছে।
আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে জাফরান খেত।

 

৫.
কাশ্মীর নয়া-আইনে অবরুদ্ধ; হত্যা, ধর্ষণ, সহিংসতায় উপত্যকা নিষ্করুণ। সেই সময়প্রবাহে আমার শরীরে তেড়ে এসেছে মেরুভল্লুক। গোলমরিচের ঝাঁঝ দেওয়া জ্বর। আমি বিছানায় শুয়ে থাকি, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই না।
কিন্তু জ্বর আমাকে কাবু করতে পারে না। তারচেয়ে যেন অধিক কাতর কাশ্মীরের ঘটনায়। টেলিভিশনের পর্দায় আমি আগুন দেখি; তাককরা একে-৪৭ দেখি; সামরিক বুট দেখি; যুবকের রক্তাক্ত দেহ দেখি; শিশুর চোখের পানি দেখি। কাশ্মীরের ঘটনা পৃথিবীর সংবেদনশীল মানুষতে হতবাক করে দেয়। মানুষ শুধু টেলিভিশনে খবর দেখে; আর হতবাক হয়। আমিও হই। অন্যঅনেকের মতো আমার কিছু করার থাকে না।

রাজনৈতিক কূটচক্র আমাকে বরাবর আহত করে। ক্ষমতালিপ্সা ও হিংসা মানুষকে পশুস্তরে নিয়ে যায়; এ আমি দেখেছি মানবজাতির গোটা ইতিহাস চষে। ধর্মের রাজনীতি আর রাজনীতির ধর্মের মূল উদ্দেশ্য যে এক তা আর আমার বুঝতে বাকি নেই। ইতিহাসের শুধু পুনরাবৃত্তি হয়। শাসক বা নেতা একই চরিত্রে অভিনয় করে যান বারবার। সেটা বাইবেলের যুগে হোক; কিংবা মহাভারতের যুগে। তাই তো দেখি ঈশ্বর আব্রাহামকে বলছেন, ‘সারা তোমাকে যাহা বলিতেছে তাহা শুনো; ইসহাকের দ্বরাই তোমার বংশ প্রতিষ্ঠিত হইবে। আর ওই দাসীপুত্র হইতেও আমি এক জাতি উৎপন্ন করিব, কারণ সে তোমার বংশীয়।’ কেনা জানে ইসরায়েল অধিকৃত গাজা বা ফিলিস্তিনসংকটের মূলে এ কয়টি লাইনই যথেষ্ট! একইভাবে মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুন স্ববংশীয়দের বিনাশ করতে অস্বীকৃত হলে শ্রীকৃষ্ণরূপী ভগবান নিজেই বলছেন, ‘আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ (মহা) কাল; লোকসমূহ সংহার করতে এখানে প্রবৃত্ত আছি। প্রতি সৈন্যবাহিনীতে যে যোদ্ধাগণ অবস্থিত (আছে), তুমি বিনাও (তুমি না মারলেও) তারা সকলেই (কেউ) ভবিষ্যতে থাকবে না। অতএব তুমি ওঠ, যশলাভ কর, শত্রুদের জয় ক’রে সমৃদ্ধ রাজ্য ভোগ কর। এরা আমার দ্বারাই পূর্বে নিহত ( হয়েছে); হে সব্যসাচিন্, তুমি নিমিত্তমাত্র হও।’ অর্জুন জয়ী হয়েছিলেন। সে জয় অব্যাহত আছে।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিস্তিনে নতুন করে ইসরাইলি হামলায় অন্য অনেকের সঙ্গে বেশকিছু শিশুর মৃত্যু হয়। একটি শিশুর রক্তাক্ত দেহ ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে ঘুরতে থাকে। সেই শিশুর মুখটি আমাকে অস্থির করে তুলেছিল; অনেক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। মনে আছে সেই ঘটনার ছোবল থেকে ত্রাণ পেতে আমি এর কারণ অনুসন্ধান করেছিলাম। বাইবেল, ইঞ্জিল, যবুর, গীতা, কোরান প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থ বা কেতাব আমাকে নিশ্চিত করেছিল; এসব ঘটনা নতুন নয়। এটা পুনরাবৃত্তি মাত্র। কিন্তু আমি নিজেকে রক্ষা করব কীভাবে? এইসব ঘটনাবলি আমাকে বিপর্যয়ের দিকে টেলে দেয়। আমার মনে আছে আমি গাজা বা ফিলিস্তিনের শিশুদের সঙ্গে পরিজনের কবরের পাশে অনিদ্র থেকে ডুমুরের গোপন ইশারা কবিতার বইটি লিখেছিলাম।
আমার মানবিক বির্পয়ের দিনগুলোতে আমি না লিখে পারিনা। আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই আমাকে লিখতে হয়।

 

৬.
আমার শরীরের জ্বরের ঘোর, কাশ্মীরের সহিংস অমানবিকতার ঢেউয়ের পর ঢেউ। আমি যেন তলিয়ে যাই। আমি কুঁকড়ে যাই। যন্ত্রণায়, অস্থিরতায়।
আমি বিছানায় শুতে আর পারি না। কে আমাকে লেখার টেবিলে নিয়ে আসে। আমি ডেস্কটপ অন করি।
শিমুল কলেজে চলে গেছে, সকালেই ওর ক্লাশ। প্যারাসিটামল টেবিলে রেখে গেছে। জ্বর তাড়াব বলে। কিন্তু আমি তো পুড়ছি অন্য আরেক জ্বরে। এ জ্বর প্যারাসিটামলে যায় না। এ শুশ্রƒষা সহজে পায় না মানুষ।
কম্পিউটারের শাদা স্ক্রিনে কালো হরফে দ্রুত লেখা হয়ে ওঠে কয়েকটি পঙ্ক্তি, একটি কবিতা। তখন দুপুর। কবিতাটি এই :

আমরা যখন জম্মুতে নামলাম
আর শেয়ারে-ভাড়া টেক্সিতে আবিষ্কার করলাম
এক দিঘলদেহী কাশ্মীরি যুবককে
আমরা ভাবলাম, এ-নিশ্চয়ই র্টেররিস্ট!

আমি হামিদ শেখ! যুবাটি হাত বাড়িয়ে দিল
আমিও হাসলাম

সারাটা পথ আফসোস হল কেন যে
হ্যান্ডশেক করলাম!

আমার শরীরে গোলমরিচের ঝাঁঝ টগবগ করে ফুটছে। আমার মস্তিষ্কেও গোলমরিচের ঝাঁঝ ছিটিয়ে দিয়েছে। আমার ভিতরে হিংসা ফুসে উঠল, আমার ভেতরে পশু হানা দিল, আমার ভেতরে পাপ ভীড় করল।
কিন্তু আমি শুশ্রুষা চাই। প্রবল ঘোরে আমি দিন ও রাত কাটাই।
দুই দিন আর একরাত।
একটা বেদনার্ত মুহুর্তে, একটা অবেলায়, একটা ঘোরে মধ্যে লেখা হয়ে গেল ৬৬টি কবিতা। আকারে, ছোটো। কবিতা।
আর, এই কয়েকটি প্রহর আমি মানুষ হয়ে যাই। মানুষ হয়ে মানুষকে উপলব্ধি করি। মানুষের পাশে দাঁড়াই। কাশ্মীর ও আমি পরস্পরের রূপক হয়ে দাঁড়াই। হয়ে উঠি মানবসভ্যতার অদ্ভুত রূপক।
পুরো সময়টাজুড়ে রক্তে ভাসছিল দুনিয়া। মনে হয়েছিল পুরোটাই রক্তে মোড়ানো।
কবিতাগুলো লেখা-হয়ে-যাওয়ার পর মনে হলো, জ্বর নেমে গেছে; আমি এখন হাঁটতে পারি। চাইলে বেরও হতে পারি। বিশেষত সর্বশেষ রচনাটি :

কুরুক্ষেত্রের বিস্তার এখানেও

কুরু আর পাণ্ডবকুলের রক্তে এককালে
ভিজেছিল পৃথিবীর মুথাঘাস

আবারও মেদিনীযুদ্ধে পুড়ছে আকাশ
আর অতি কাছ-থেকে-ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ
হচ্ছে বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ ও শিশু

জাফরানের খেত ভিজে যাচ্ছে মানুষের রক্তে।

পাণ্ডুলিপির নাম দিলাম জাফরানের রং।
কিন্তু প্রকাশককে যখন পাণ্ডুলিপি মেইল করব; শেষবারের মতো চোখবুলানো শেষে ঝটপট বদলে ফেললাম নাম : তিনভাগ রক্ত।
কেউ অস্বীকার করবে?!
হামিদ শেখও রক্তমাংসের মানুষ; তবে অন্য এক নাম তার। হামিদ শেখের অস্তিত্বও আমি অস্বীকার করতে পারি না। পারব না।
কাশ্মীরিরা মানব প্রজাতির এটাও তো অস্বীকার করা যায় না। দানবও পারে না বলে আমার বিশ্বাস। লড়াইটা এখানেই।

7 মন্তব্যসমূহ

  1. রচনাটি পড়তেই বুঝতে পারি লেখার প্রতিটা অক্ষরে অক্ষরে দাউ দাউ করে পুড়ছে দেহ।আর মানবতার মস্তিষ্ক থেকে বেরুচ্ছে সেই আগুনের লেলিহান।মানুষের রক্তে ভাসছে গোটা পৃথিবী।তিন ভাগ’রক্তে ভিজে আছে কাশ্মীর,পিলিস্তিন,আফগানিস্তান,সিরিয়া,ইরাক সহ পৃথিবীর অনেক জায়গা।তাই দেকে কবি হৃদয়ে রক্ত জরছ।গোল মরিচের ঝাঁজে জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে।কবি লেখকরা পৃথিবীতে আছেন বলেই এমন মানবতার কান্নার ধ্বনি শুনতে পাই।শাসক শ্রেণীর স্বার্থের বলি এই অসহায় নারী,শিশু,আবাল,বৃদ্ধ।লুটেরা সম্পদের লোভে এই অসহায় মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে লুটে নেয় লাখো কোটি প্রাণ।কবির সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী পড়েই বুঝেছিলাম এটা মানবতার কান্না,প্রতিবাদ,প্রত্যোত্তর।ধন্যবাদ সসস্ত্র এই কলম যোদ্ধাকে।ধন্যবাদ কবি ও লেখক জফির সেতুকে। এমন লেখা আরও চাই।

  2. মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখাই শ্রেয়। মানবতাই শ্রেষ্ঠ সম্পদ, এটাই কবির মর্মবাণী।

  3. দু’চোখ বন্ধ করলেই নিজেকে কাশ্মীর আর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা কামী জনগণের একজন মনে হয়।

  4. সেতূদা ফজরের নামাজ শেষে শুয়েছিলাম। ভাবিনি জেগে এত সুন্দর আত্মিক একটি লেখা পড়তে পড়তে আজকের দিন শুরু করব। কিন্তু মোবাইল হাতে নিতেই আপন জনের ছবি স্কিনে। অন করলাম এবং নাম দেখ (তিন ভাগ রক্ত) দেখে মনে একটা দাগ কাটল। পড়তে শুরু করলাম ।শেষ হতে না হতে আত্মোপলব্ধিতে চোখের কোনা দিয়ে প্রকূতির নিয়মে জল আনাগোনা করছে। সত‍্যিই পৃথিবী রহস‍্যময়। ভালো থাকেন দাদা,ভালো থাকুক কাশ্মীরের মানুষ, ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল নির্যাতিত মানবকূল।

  5. আহা,কী নিদারুণ রক্তপাতের ইতিহাস! সত্যিই,আমরা যখন জীবনের কথা বলি,স্বার্থবাদীরা তখন ভিন্ন গল্প শোনায়!
    অসাধারণ একটি লেখা।প্রিয় লেখকে ধন্যবাদ।

  6. লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো।চমৎকার উপলব্ধিমিশ্রিত লেখা।সত্যিকারের মানবপ্রেম ও মানবতার ধ্বনিই উচ্চারিত হয়েছে।যা-শ্বাশ্বত।ধন্যবাদ,কবিবন্ধু-জফির সেতুকে।সত্যিই কেন এতো রক্ত??

  7. খুব চমৎকার লিখেছেন। মনে হলো, সব দেখতে পেলাম। “এই কয়েকটি প্রহর আমি মানুষ হয়ে যাই। মানুষ হয়ে মানুষকে উপলব্ধি করি। মানুষের পাশে দাঁড়াই। কাশ্মীর ও আমি পরস্পরের রূপক হয়ে দাঁড়াই। হয়ে উঠি মানবসভ্যতার অদ্ভুত রূপক।
    পুরো সময়টাজুড়ে রক্তে ভাসছিল দুনিয়া। মনে হয়েছিল পুরোটাই রক্তে মোড়ানো।”

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here