আমার ঘরের পাশ দিয়ে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটা শাঁ করে উড়ে গেলো। আমি জানি কোন বিশেষ মানুষের নিথর শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই সাদা রঙের গাড়ি। মোহন; এক অভিমানী নক্ষত্র। সূর্য ওঠার আগেও ধানমণ্ডি সাতাশ নম্বরে ছিল সে। আর এখন? কিছুদূর গিয়েই গাড়িটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে আছে। এই মহামারিকালে থেমে থাকা অ্যাম্বুলেন্স দেখেই লোকজন আতংকে ছুটে যাবে দূরে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মোহনের ক্ষেত্রে এর উল্টোটা হওয়ারই কথা ছিল। বর্তমানের অবস্থা এমন; যেন পৃথিবীতে মরে যাওয়ার মত আর কোন রোগ-বালাই নাই, সবই অচ্ছুৎ। আমি লাশটার সাজগোজ দেখেই ফিরেছি ঘরে। কাউকে জানানো হয়নি—এই মৃত মানুষটির জন্য শোক প্রদর্শনে কিছু আপনজন দরকার। আর বলেই বা কী হতো, সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে কাটা মাছের মত তড়পাতে তড়পাতে মরে গেলে একটা ব্যথাতুর অনুভূতি বয়ে বেড়ানোর মত কারণ ঘটতো। কত রথী-মহারথী মরলো মহামারি মড়কে সেখানেও নাম থাকবে না ওর, ভাবা যায়! নিজের ঘরে বসে ডিপ্রেশন জনিত জটিলতায় আত্মহত্যা করলেও কিছু মানুষ কনসার্ন হয়ে বেশ শোরগোল করতো মোহনের নামে। কিন্তু এখন? এই আয়োজনহীন মৃত্যুতে কী লাভ হবে তার? কিছুই না। মোহনের জন্য এমন মৃত্যু একেবারেই বেমানান। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় রুগ্ন মোহনকে এদেশের কোন ডাক্তার, নার্স এমনকি আমজনতাও চেহারায় চিনলো না। টিভি খুলে লোকজন তবে কাদের দেখে রোজ? মোহনের আত্মশ্লাঘা ভীষণ আঘাতে লুকিয়ে ফেলেছে তার পূর্বেকার নামধামসহ সকল পরিচয়। কী অদ্ভুত! কী নির্মম বাস্তব! এই কদিন কত জায়গায়ই না ঘুরলাম ওকে নিয়ে। এখানে ডাক্তার নেই তো ওখানে নেই স্টাফ। এম্বাসিতে নেই ভিসা আর পারমিট। আমার নিজের পরিচয়ে পর্যাপ্ত লোক ধরাধরি করে শেষপর্যন্ত সুরাহা যা হল তার নাম ব্লাড ট্রান্সফিউশন জনিত সমস্যায় এক উজ্জ্বল তারকার অকাল প্রয়াণ। যাক, আমার কী! আমি এখন রেস্ট নেব আরাম করে। অযথা সময় খরচ করতে তোয়ালে খোঁজার বাহানায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব অনেক্ষণ, আকাশ দেখব, গাড়ি দেখব, লকডাউনে মানুষের গাদাগাদি ভিড় দেখব, আরো যত কিছু আছে দেখার সব দেখব। ঘরের সাথে লাগোয়া এই প্যাসেজটা আমার বেশ পছন্দের। ছোটখালা মানুষটা ভালই শৌখিন। একটা মধুমঞ্জুরির লতা ঝুলিয়ে দিয়েছেন ডালপালাসমেত। নিচে পোটেড পার্পল, গোল্ডেন ব্লুম অর্কিডের অনেকগুলো টব সাজানো। সবই সুন্দর। কেবল ঝামেলা একটাই; সময় সময় সাদা রঙের মাঝখানের কাঞ্চন রংয়ের ঢেউ ঠিকরে বের হয়ে আমার মগজে আগুন ধরিয়ে দিতে ছুটে আসে ধেয়ে, আমি তখন সজোরে লাথি মারি ফুলের গায়। বুড়ো নখের লাল তরল চমৎকার কম্বিনেশন আমার ব্যর্থ আক্রোশ চিড়বিড়িয়ে বাড়িয়ে দেয় আরো অক্ষমতার অসুখ।
জানি, আমি কখনোই মোহন হতে পারবে না। কখনোই না। পায়ের নখে বরফ লাগিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিই—কিক মারা তো আমার কম্ম নয়। আমি কি মোহন? তাহলে এই উন্মাদ রাগ, অভিমানের অর্থ কী? এসবে কী হয় শেষে? মোহনের জীবনে যতবার বিপর্যয় এসেছিল সবটার পেছনে এই আত্মবিধ্বংসী স্বভাব। বাঘের মত হালুম হুলুম করেই অশান্তি ডাকতো সে। আপোষ ছিল না কোথাও। অবশ্য ওকে মানাতোও ওসবে। পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে কোন দুর্বল মুহূর্তেও দেখিনি কখনো ফিসফিস করে জপছে ঈশ্বর, মা বা কোন প্রেয়সীর নাম। ঘোর নাস্তিক নাকি ঘোর অমাতৃক-অপ্রেমী; কোনটা সে কে জানে! সরাসরি ফেডারেশন থেকে যেবার বহিষ্কার করা হলো সেবারের কথাই ধরা যাক। খেলার মাঠে পেছন থেকে রেফারির মাথা ভাঙতে বল ছুঁড়ে মেরেছিল মোহন। প্রিমিয়ার লীগে আরামবাগের হয়ে খেলতে নেমেছিল, রেফারি টানছিল আবাহনী লিমিটেড। ব্যাস লেগে গেলো। রেফারির এহেন আচরণের পেছনে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঘটনা আছে কী না তলিয়ে দেখলো না বোর্ড। মোহন টানা পাঁচমাস ডুব মেরে ছিল সেসময়। কাউকে একটা খবরও দেয়নি। তার নিজের লজ্জা তাকে একা বইতে হবে গোপনে; এই তার একমাত্র ‘যুক্তি’।
আচ্ছা মোহনের কি দর পড়ে গিয়েছিল সেসময়, নাকি মাঠে তার কোন বাবা বা বড়ভাই ছিল না পেছন থেকে টেনে তুলবার। ওর তো এখনও নেই কেউ। ইন্ডিয়ান সুপার কাপে কেরালার হয়ে খেলে পপুলার রেসপন্স নিয়ে যখন ফিরলো তখনই অনুমান করা উচিৎ ছিল মোহনের দিন আসছে দরপতনের। এখানে হিরো থেকে জিরোতে নামিয়ে দেয়া খুব কঠিন কিছু না। এমন না সে নিয়মিত কোকেন নিতো কিংবা ওর ব্যাগ তল্লাশি করলেই পাওয়া যেত ফেনসিডিলের বোতল! শেষকালে শোনা গেলো মোহন ঘন্টার পর ঘন্টা একা প্রাকটিস করতে চেয়েছিল বলেই লোকচক্ষুর অন্তরাল হয়েছিল। মোহন জানত, এই মাঠের কোলাহল আবার তাকে ডাকবেই। ওর বিশ্বাস সত্যি ছিল। ন্যাশনাল টিমের ম্যানেজার তাকে জানিয়েছে ফেডারেশন তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করবে কারণ দেশের ক্ষমতাসীন একটা ক্লাব এ বছর তাদের মিডফিল্ডে মোহনকে চাইছে।
বসার ঘরের টিভি ফুল ভলিউমে দিয়ে রেখেছি। সেখানে একঘেয়ে বেজে যাচ্ছে ‘লাইফবয়ের গান, তিরিশ টাকার রবির অফার আর করোনা আক্রান্ত রোগীর খবরাখবর’। মোহন মারা গেছে, এই খবরটা কি কোথাও বাজবে না আজ? আমার কেমন যেন লাগে, ঠিক পুরোটা রাগও না অভিমানও না। বুকের ভেতরে শূন্য-শূন্য একালাগা বোধ। মোহন অন্যরকম ছিল খুব। ও কখনো আমার সাথে গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বলের গল্প করেনি। পেলে-মারাদোনার লিজেন্ডারি কাহিনি নিয়ে পার করে দেয়নি চমৎকার দিনের অর্ধবেলা। সাম্প্রতিক খেলার হালচাল নিয়ে ওয়াজ করতে মানুষ মোহনের একদম পছন্দ ছিল না। ওকে দেখলে খেলোয়ার নয় দার্শনিক বা কবি মনে হওয়াটাই বেশি স্বাভাবিক। একবার শুধু খুব আগ্রহ নিয়ে ক্রিস্টোফার কেমের কথা বলেছিল। ট্যাকলিংয়ে নাকি খুব চমৎকার ছিল ওই নাইজেরিয়ান প্লেয়ার। লোকটার নিঃশব্দ মৃত্যু মোহনকে ব্যথিত করেছিল। করেছিল বিস্মিত।
নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় খেলতো লোকটা, বাংলাদেশেও নাকি এসেছিল কবার। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মোহামেডান দাপিয়ে বেড়ানো একজন প্লেয়ারের কেমন করে এমন স্বজন-বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ মৃত্যু হয়—এটাই ছিল তার জন্য দুঃখিত হওয়ার মূল কারণ। মোহন নিজের জন্য কখনো এমন মৃত্যু চায় না, বীরের মতো ধনে-জনে-মনে পরিপূর্ণ হয়ে মরতে চায় ও। মোহন বলতো ওর জন্য সবচেয়ে সুখকর মৃত্যু হবে যদি খেলার মাঠে খেলতে খেলতে মরে যাওয়া যায়। আর সেটা যদি হয় বিশ্বকাপের মাঠ তবে মরার পর ¯্রষ্টাকে অবশ্যই সে একটা স্পেশাল সেল্যুট দেবে, মস্তক নত করে করবে কুর্নিশ। লাল-সবুজ একটা পতাকায় সতীর্থরা তাকে আবেগে মুড়ে নিয়ে আসবে এই দেশের মাটিতে, সেই মহান মৃত্যু স্মরণ করে মাঝে মাঝেই তার চোখ ভিজে উঠত আবেগে!
ওর এইসব অসম্ভব-অলৌকিক ঘোরলাগা কল্পনায় আমি অভ্যস্ত ছিলাম। সময় সময় মোহন যেন হয়ে উঠতো এমনি কোন রূপকথার খেয়ালি রাজকুমার অথবা কোনো অন্ধকারে জ্বলে ওঠা জোনাকপাখি। ওর গল্পে কখনো কখনো মানুষেরা হারিয়ে যেতো। থাকতো স্বচ্ছ দীঘি, ফসলের মাঠ আর ডাহুকের গান। মোহন বলতো মৃত্যুর পর সে মাছ হতে চায়। রূপালি চকচকে ছোট্ট একটা চাঁদমাছ। বরফ শীতল পানি ওর ভীষণ প্রিয়।
ব্রাদার্স ইউনিয়নের আতিক ভাই ফোন দিয়েছেন। কী জানি তিনি কেমন করে জানলেন আজ আমার কারো ফোন প্রয়োজন? তিনি মনে হয় সর্বেশ্বর অন্তর্যামী। অথচ ঘরোয়া লীগে খেলতে গেলে এই লোকটার সাথেই মোহনের লাগতো খুব। মধ্যমাঠের রক্ষণভাগের পার্শ্বীয় আর কেন্দ্রীয় সেনাদের ভেতরকার জটিলতা আমি বুঝতাম না। শুধু দেখতাম আতিক ভাইয়ের সাথে কিছু হলে কেমন বিমর্ষ হয়ে যেতো মানুষটা। যাক, এখন আর হর্ষই কি, বিমর্ষই কি। আতিক ভায়ের প্রতি ওর নরম অনুভূতির কথা মনে করে আমার অস্থির লাগতে শুরু করে। এমন লাগছে কেন? মোহন তো মরে গিয়ে বেঁচেই গেলো। এখন আর তার কোনো ঈর্ষা নেই, প্রণয় নেই। বুড়োকাল পর্যন্ত বেঁচে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরার রিস্ক নেই। চার পাশের এত নাই নাই দেখার দায় নেই। মিডিয়ার চাপ নেই। ক্যারিয়ারের ভয় নেই। আহা, কী চির শান্তির অন্তিম প্রস্থান!
শেষবেলায় মোহনের প্রোপার ট্রিটমেন্ট হয়নিই বলা যায়। রক্ত জোগাড় করা যাচ্ছিল না একদম আর পেলেও প্রি ডোনেশন স্ক্রিনিং, রেডসেল কনসেনট্রেটের সাথে একই গ্রুপের প্লাজমা মেশানো হোলব্লাড প্রবলেম আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। চারপাশে এত অসহযোগী প্রতারক মানুষের দল! এদিক-সেদিক ছুটতে ছুটতে কতবার যে নিশপিশ করেছে আমার পায়ের পাতা—সেটুকু বোঝানোর মত কাউকে পাইনি কাছে। আমার নিজের ইন্টার্নশিপও শেষের দিকে। সিস্টেমের ভেতরকার জটিলতা যে বুঝি না তাও কিন্তু না। তবু মোহনকে এভাবে দেখে কত আর মাথা ঠান্ডা রাখা যায়। মোহন হয়তো বুঝেছিল সব। আমাকে আমার ফুলব্যাকে কোথাও আর ছুটতে দিল না। মাঠ ছেড়ে একেবারেই ঢুকে গেল অফসাইডে।
চোখ জ্বলছে। রাগ যাচ্ছে না। পা থেকে গায়ে এসে বাড়ছে কেবল। এই যে ও আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে অসুখী হবার অসুখ এর কোন মানে হয়। মনে হচ্ছে তার ঘামে ভেজা সাত নম্বর জার্সি আমাকেই টানতে হবে অনন্তকাল। কী সৌভাগ্য আমার! এতদিনে মোহন কিছু একটা দিল আমায়। নিজেকে লাকি সেভেন ভেবে চিয়ারআপ করতে ইচ্ছে করছে খুব। তার ধুলোয় আটকে থাকা ভারী মোজা আমার পায়ে সেটে আছে শক্ত হয়ে এর জন্য কাকে ধন্যবাদ দেব আমি। যাক, কী আর করা গিলে ফেলি সব, হজম করি আগের মতই অভিমান রাগের, অপমান, অপ্রাপ্তির মত সামুহিক অনুভূতি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে বারান্দা ছেড়ে কিচেনে যাই। একটু হাউ-মাউ করে কাঁদা অবশ্যই প্রয়োজন আমার। অস্থির লাগছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সবকিছু রেখে ঘরের পর্দা ফেলে একটু ঘুমিয়ে নেয়াটাই যৌক্তিক। নিজেকে পিটি পুওর উমেন ভেবে দুঃখ দুঃখ ভাব করাটা ঠিক হচ্ছে না একদম। বরং এভাবে হুট করে মরে যাওয়ার জন্য মোহনকে কঠিন থেকে কঠিনতর অভিশাপে ওর ইহলোক-পরলোক ছাড়খার করে দেয়া উচিৎ। যদিও ইহলোকে আর নেই কিছুই। পচনশীল আস্ত একটা নিষ্প্রাণ দেহ আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি এইটুকুই যা। মোহন যে আমার কে হয় এটা জানা গেলে আর একটু নিশ্চুপ থাকা যেত। মোহন আর আমার গণ্ডগোলের রসায়ন ওর কেরিয়ারের মতই প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বাটখারায় সব সময়ই অসমান ছিল। ওর পছন্দ ছিল শক্ত-পোক্ত এথলেট ঘরানার মেয়ে। আমার মতো তন্বী-শ্যামা-শিখরি-দশনা পক্ববিম্বাধরোষ্ঠীরা ওর বিরক্তিই বাড়াতো কেবল। সবটাকে তো আর ভাগ্যের দোষ বলাটা যায় না। আমার নিজের দায় কিছুটা। ওকে দেখলে সব সময় আমি উল্টে যেতাম। গোপন নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতো সবসময়। কত দীর্ঘ পথচলা দুজনের, তবু অচেনা এক মানুষ লাগতো ওকে সব সময়। সেই ফ্রক আর হাফপেন্টের গার্লস-বয়েজের সময় থেকে একসাথে আমরা। ও আসতো একটা সাইকেল নিয়ে। টুংটাং করে বাজাতো বেল, ঐ সর্বনাশা শব্দে তখনই তো বিগড়ে গিয়েছিল আমার বোধ-বুদ্ধির হিসেব।
একটা যৌথ সাদামাটা জীবনের ভবিষ্যত কল্পনায় কত কত ছটফট করেছি একা, মোহনকে বুঝতেও দেইনি। মোহন জানলে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দেবে এই শঙ্কা লজ্জার চেয়েও বেশি ছিল আতংকের। আমি জানালার কাচে নিজের মুখ দেখি, আমাকে কি চায়নি মোহন কখনো? কী জানি, ওর গাঢ় চোখের আবেদন সবটা তো আর কঠোর নয়। কত ঘটনায় কতবার বুক কেঁপেছে থরথর, তার মূল্যও তো কম নয়।
যেবার বাংলাদেশ এশিয়াকাপে রানার্স আপ হবার গৌরবে রৌপ্য পদক পেলো সেবার মোহনের জীবনে এক বিশেষ অধ্যায় রচিত হওয়া কথা ছিল, অথচ হয়ে গেলো আমার। মোহন অনুর্ধ্ব-২৩ এ চ্যাম্পিয়ন পাওয়া উঠতি প্লেয়ার হওয়া সত্তেও ম্যাচে যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু কাপে ল্যাং খেয়ে ঠ্যাং ভেঙে অনেকদিন পড়ে ছিল বিছানায়। আমি জানি ওইটুকু, শুধু ওইটুকু সময়ের বিনিময়ে আমি যতবার জন্ম নেব পৃথিবীতে ততবারই নিজেকে নিঃস্ব করে মোহনে বিলিয়ে দিতে পারব আত্মসুখ। আমার লজ্জিত বা অপমানিত হওয়ার ভয় এই অনুভূতির কাছে একেবারেই তুচ্ছ। যদিও মোহনকে আমার প্রেমিক না ভেবে বরং বন্ধু ভাবাটাই ওর জন্যে বেশি সুবিধের। তবুও বন্ধু বোধটা আসে না আমার। সেই কৈশোরকালেই প্রথম যেদিন দুম করে শুনলাম মোহন নীলফামারির টিম থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড করে এসেছে, আমার কেমন যে মন খারাপ হয়েছিল সেদিন কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। স্বপ্নভঙ্গের বিপর্যস্ত যন্ত্রণায় একা একা কেঁদেছি সারাদিন, হেঁটেছি কত পথ একা একা। দাঁতে দাঁত চেপে দেখেছি মোহনের উল্লসিত মুখ। মানুষটাকে কখনো আমার চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে হয়নি, তখনও না, এখনও না। ও কেন সকলের হবে, একা আমার হলে কীসের এত ক্ষতি পৃথিবীর।
ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচে মোহনকে যখন প্রথমবারের মত বিদেশের মাটিতে খেলতে যেতে হলো সেবারও আমার অবস্থা হলো দেখার মত। লাহোর তো খুব বেশি দূরের কিছু নয় তবু ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্ত করে মেরেছিলাম ওকে। এক কথা একশ বার একই স্বরে।
‘তুই দেশের বাইরে যাবি না মোহন’
‘কেন যাবো না, তুই কোন রসগোল্লা যে তোর কথা শুনতে হবে?’
‘আমি আমিত্তি, রসগোল্লা, চমচম কিছু না। তবু তুই যাবি না।’
‘হলেও সমস্যা নাই। তোকে ডিপফ্রিজে তুলে রেখে যাব। আমাকে যেতেই হবে।’
মোহন এমনই। ওর ভেতর মিথ্যে নেই, ভান নেই, খাদ নেই। প্রেমের মোহময় আবেশে প্রেমিকাকে ডুবিয়ে রাখার চাতুরি নেই। যতটুকু আছে ততটুকু সলিড বলেই মেনে নেয়া যায়। একটু বেশি মেধা, যথেষ্ট লাবন্য এবং হৃদয়ভরা আবেগ থাকলে একজন ভালো ‘আমি’ হওয়া যায় কিন্তু ‘মোহন’ হওয়া যায় না। যাক সেসব। একেবারে শেষের দিনগুলোতেও কি মোহন বদলেছিল? একদম না। অসুখটাকে সে খুব প্রেসটিজ ইস্যু হিসেবে দেখছিল। তার ভেতরে খুব বিশ্রী হীনন্মন্য বোধের জন্ম দিয়েছিল এই অসহায় করুণ শুয়ে থাকা সময়টায়। মোহন ভাবত এখানে খেলার মাঠে পা বা কোমর ভাঙার গৌরব নেই, ঝাঁক ঝাঁক ফ্যান-ফলোয়ারের অস্থির অপেক্ষা নেই। এখানে আছে বিশ্রী অসহায়ত্ব। এটাকে লোক দেখিয়ে বেড়ানোতে সিমপ্যাথেটিক আহা-উহু মার্কা শব্দই বাড়বে কেবল। লাভ কিছু হবে না। আমার রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ দেখে বিরক্তি বাড়তো ওর। মেয়েলি স্বভাবের জন্য বকতো খুব, অথচ ও বুঝতেই চাইতো না আমি তো আদতে একটা মেয়েই। মোহন বলতো ডাক্তারদের কলিজায় সোলেমানি মোহর লাগানো থাকে, দয়ামায়ারা সব ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায় ওই মোহরে, আর তোর কলিজায় শুধু নরম শিমুল তুলার ফ্যাতফ্যাতা অনুভূতির জঙ্গল।
‘তো জঙ্গল হলে কী করব, মরে যাব?’
‘যাওয়াই উচিৎ!’
মোহন আমার বাহু ঝাঁকিয়ে প্রবোধ দিত—‘কুল ম্যান কুল’
নাহ আমার আর কুল হওয়া হলো না। আমি ততক্ষণে জেনে গেছি মোহন এভাবেই মরবে। জীবনকে হেসে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে বলেই মৃত্যু তাকে ভালোবেসেছে। উল্কা হয়ে জন্মে যারা পতনের অপেক্ষায় জেগে থাকে তাদের জাতই আলাদা। আমার সাধ্য কি এমন কাউকে বাঁধি।
আমার হাতের চা শেষ। ট্রাভেল ব্যাগ গোছাতে হবে; অ্যাম্বুলেন্সটা আদাবর থামবে কিছুক্ষণ। ওখানে ওর বড় আপার বাসা। ওটাকেই ধরতে হবে, এত দূর জার্নিতে এখন আর নিজে ড্রাইভ করার এনার্জি নেই! শর্টকাট সমাধান ওর লাশের সাথে চলে যাওয়া! এতটা পথ যেতে হবে এটা ভেবে একটু কেমন কেমনও লাগে। যদিও এ বছর কোথাও যাওয়া হয়নি। এমনকি কোন ব্লাড ডোনেট ক্যাম্পেইন বা আই কেয়ার স্পেশাল কোর টিমের হয়ে এদিক-সেদিক কোথাও না। সাড়ে সাত সপ্তাহের মিসক্যারেজের ধকল এখনও শরীরে! এই অনাকাক্সিক্ষত বাচ্চাটা মোহন নিতে দেয়নি। মোহন বলতো ওসব বাচ্চাকাচ্চা ঘর সংসার, শাদি মোবারক আমাকে দিয়ে হবে না। প্রেম করতে এসেছিস করেছি। বারো বছর পর শকুন্তলার মতো অঙ্গুরীহস্তে পুত্র সমেত উপস্থিত হওয়ার ধান্দা করিস না। তোকে এমন দেখতে ভাল্লাগে না। যদি কখনো বাংলাদেশের জন্য গোল্ডকাপ নিয়ে আসতে পারি কথা দিলাম দেশের মাটিতে পা রেখেই তোকে আগে কবুল বলবো। তোর বাচ্চার কোঁকড়া চুলে বিনুনি করে মিরপুরের স্টেডিয়ামে বাঘ দেখাতে নিয়ে যাব।
হাহ্! ওর এসবে মাটির সাথে মিশে যাওয়া উচিৎ আমার, যাইনি। কী হবে গায়ে মেখে সব। ওকে তো আর বলিনি বিয়ে কর আমায় এক্ষুণি, এই সমাজে সিঙ্গেল মাদার হওয়া খুব কঠিন কিছু না হয়তো। আমার কি মনের জোর নেই যুদ্ধ করার। পেশি-বাহু নরম হলেই শিমুল তুলা হয়ে যায় কেউ? আমি দেখিয়ে দেব। নাহ, পারিনি দেখাতে। মোহন অসুখে পড়ল আর সবকিছু বদলে গেলো ম্যাজিকের মত। আমার আর ভালো লাগে না এসব ভাবতে, ক্লান্তি লাগে।
এতক্ষণে মোহনের মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছেছে সব জায়গায়। আতিক ভাইই করছে সব। মোহনের সমস্ত সতর্কতা সত্ত্বেও আতিক ভাই কেমন করে জানলো মোহনের এই অন্তর্জলী যাত্রা সেও এক বিস্ময়। মোহনের লাশ চলছে, গাড়িতে সব মিলে আমরা পাঁচজন। আমি আর মোহন ছাড়া আছেন ড্রাইভার সাহেব, পুলিশের এক হাবিলদার আর এই দুমূল্যের দিনেও একজন নার্স। সে কেন লাশের সাথে এসেছে এখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি। ব্রাদার্স, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারি, কিংস, আরামবাগ, ফরাসগঞ্জ এতদিন যাদের হয়ে যেখানে যেখানে খেলেছে সে সবাই ফোন দিচ্ছে তার সাইলেন্ট করা ফোনে। মিডিয়াতেও এখন পৌঁছে যাবে হয়তো। আমার ইচ্ছে হচ্ছে না কোন ফোন তুলে কারো সান্ত¡নাবাক্য শুনি। মোহন আর আমার কমপ্লিকেটেড রিলেশন কারোই অজানা নেই আর। মোহন এ দেশের বেঙ্গল টাইগার্সদের একজন, এত এত ফোন আসাই উচিৎ। আমি সংক্রান্ত স্ক্যান্ডালের বাইরে ওর অর্জনও কি কম? দক্ষিণ এশীয় গেমসে খেলেছে। দেশের বাইরের পেশাদার লীগেও খেলেছে বেশ কবার। করাচির পিপলস স্টেডিয়ামে ভুটানের বিপরীতে গোল দিয়ে হইচই ফেলেছিল মোহন। সাফে তার পারফর্মেন্স এতই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, দেশের বড় বড় পত্রিকার ফ্রন্টপেজেও চলে এসেছিল তার নাম। সেই মিডফিল্ডার এখন শুয়ে আছে এম্বুলেন্সের মধ্যমাঠে। আহা মোহন। কার উপর অভিমান ছিল তোর। কেন জানাসনি বোর্ডকে? এটা কি এক ধরনের আত্মহত্যা না? তোর লাল সবুজ পতাকাটা কই? একটু দিবি ছুঁয়ে দেখতে আমায়?
আমার খুব ইচ্ছে হয় ওর পাশে শুয়ে থাকি। মোহনের দাদা বাড়ির গল্প শুনেছিলাম একবার। খুব লোভ হয়েছিল যাওয়ার। এই তো আজ যাচ্ছি ওর সাথেই। ওদের উঠোনে গিয়েই একটা কাঁথা পাড়বো আমি, নকশী কাঁথা। খুব রোদ হলে উঠুনময় ছড়িয়ে দেব সিদ্ধ ধান, কাক তাড়াব। ঢেঁকি পাড় দেব, গরম গরম পিঠা বানাবো মাটির চুলোয়। যদিও জানি না ও গ্রামে এখন ওসব হয় কিনা। এখনতো সব গ্রামই কেমন শহর শহর! সবার বাসায়ই দেখি ডিস এন্টেনা, মাইক্রো ওভেন।
আচ্ছা, এখন কি পূর্ণিমা তিথি? মোহন বলেছিল ওদের গ্রামের বাড়িতে চাঁদের আলোয় পুকুর ভরা চকচকে মাছ থকথক করে। ফিসফিস করে কথাও বলে তারা। মধ্যরাতে বড় কোন চাঁদ উঠলে মনে হবে পুকুরটা ছুটে আসছে কোলের কাছে। মাছেরা ভেসে ওঠে হাতের তালুয়, তাদের গা থেকে টপটপ করে পড়ে পানি।
আমার পা ভেজা ভেজা লাগে। কফিন চুইয়ে পানি পড়ছে, বরফ গলা পানি। গরমে সেদ্ধ হওয়া ঝাঁঝালো চা-পাতা আর মানবশরীরের গন্ধে আমার কী যেন হয়ে যায়। হড় হড় করে বমি করে ফেলি কফিনের গায়েই। ড্রাইভার আচমকা ব্রেক কষে দেয়। আমার শরীর খারাপ কিনা জানতে চায়?
অদ্ভুত কথা আমার কেন শরীর খারাপ হবে। কে করবে খারাপ? গরম আবহাওয়া, নাকি সূর্যের আলো। ওরা কি ভাগ্যের কথা বলছে, নাকি সুপ্রিম গডের কথা? শুনেছি দুর্যোগ, মহামারী অসুখ বিসুখে তাদেরই হাত থাকে। এইসব লৌকিক-পারলৌকিক ব্যাপারগুলো আমার আরো একটু পরিষ্কার জানা উচিৎ। কিন্তু প্রশ্নটা করবো কাকে? ড্রাইভার, নার্স, নাকি হাবিলদারকে। আচ্ছা ওরা কি পারে না আমাকে মোহনের সাথে বেঁধে দিতে একসাথে। মোহন তো এখন মাছ হয়ে গেছে। আমিও ওর মত মাছ হয়ে যাব। পানিতে ভাসব। নাচতে নাচতে চলে যাব স্বর্গপুরি। দেবতাদের ধ্যানভঙ্গ করে জানতে চাইবো একটা মশার কামড়ে কেমন করে এত সম্ভাবনাময় একটা প্রাণ চলে যায় এভাবে। জীবনের এত আয়োজন, এত রং হুট করে মুছে দেয় কে? কার এত ঈর্ষা মানুষের বর্ণীল জীবনের প্রতি। একটা তুচ্ছ পতঙ্গ কী করে একটা বিষধর সাপের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, আমি জানতে চাইব। ওরা কি বলবে আমায় সব; কেন মোহন মরে গেলো এভাবে সামান্য ডেঙ্গু জ্বরে? কেন?
নার্স মেয়েটি এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে। এই প্রথম আমি কেঁদে উঠতে পারি ডাক ছেড়ে। মনে হয় আমার যত অভিযোগ অত অনুযোগ এই লাশবাহী গাড়ির ড্রাইভার, হাবিলদার আর নার্স বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মোহনের সাথে। আমি রাস্তার দুপাশে উন্নয়নের জোয়ার দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ফোরলেন স্ট্রিট, ওভার ব্রিজ, পাতাল রেল। দেয়ালে দেয়ালে এলক্লাসিকোর উন্মাদনা। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার গ্রাফিতি। বাসার ছাদ, রিকসা, ভ্যান, টংয়ের চায়ের দোকান, জার্সিতে এখনও বিশ্বকাপ। বিবর্ণ রঙজ¦লা হলুদ-নীলে পতপত করে উড়ছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। বিলবোর্ডে হাসছে মেসি, রোনালদো, বেকহামদের মুখ, সব আছে ঠিকঠাক কেবল আমার মোহনই নাই কোথাও। দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, ভেসে ভেসে যাই দূরে, এদিক হাতড়াই ওদিক হাতড়াই, বেহুলার মত প্রণয়ীর ঊন-শিথানে খুঁজি পুনর্জীবনের হাড়। ওই তো আর একটু এগুলেই সারিয়াকান্দি পায়রা দিঘির ঘাট।