ডিকলোনাইজিং দ্যা মাইন্ড ।। কিস্তি : ১

নগুগি ওয়া থিওঙ্গো সাহিত্য ও রাজনীতির দুনিয়ায় চেনা একটি নাম। তাঁর বিখ্যাত বই Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature (1986)। ঔপনিবেশিক রাজনীতি, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি বোঝার দারুণ প্রতিনিধি-পুস্তক এই বই। বইটি ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করবেন শিবলী নোমান। আজ প্রকাশিত হল বইটির প্রথম কিস্তি।

আফ্রিকান সাহিত্যের ভাষা

এক

যেসব সামাজিক বিষয়াদি আফ্রিকান সাহিত্যের ভাষাকে তৈরি করেছে সেগুলোকে বিবেচনা না করে এ বিষয়ে আলোচনা কোনভাবেই অর্থপূর্ণ হবে না। এটি একই সাথে এমন ইস্যু যা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে এবং একটি সমস্যা যা সমাধানও চাইছে।

 

একদিকে, ঔপনিবেশিক ও নব্য ঔপনিবেশিক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদ তার স্বার্থে প্রতিনিয়ত আফ্রিকানদের জোরপূর্বক কাজ করাচ্ছে এবং একই সাথে তার চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখছে যেন বাইবেল ও তলোয়ার হাতে রাখা প্রভুদের দেখানো পথই তাকে দেখতে দেয়া হয়। অন্য কথায়, সাম্রাজ্যবাদ এখনো আফ্রিকার অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু অন্যদিকে এবং এর বিপক্ষে রয়েছে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে মুক্ত করে প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বশাসনের জন্য আফ্রিকান মানুষের অন্তহীন সংগ্রাম। আত্মসংজ্ঞায়নের সকল উপায়ের উপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ইতিহাসে নিজেদের সৃজনশীল উদ্যোগগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য এটি একটি সদা-চলমান সংগ্রাম। নিজেদের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সাথে নিজেদের সম্পর্ক তৈরি করতে ও তা বুঝতে, এমনকি পুরো বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা তৈরিতেও খুবই কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হলো ভাষার পছন্দ ও নির্দিষ্ট ভাষার ব্যবহার। এ কারণেই, বিংশ শতাব্দীর আফ্রিকায় ভাষাই ছিল দুইটি বিবদমান সামাজিক শক্তির কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।

 

এই তর্কের শুরু বহু বছর আগে ১৮৮৪ সালে যখন বার্লিনে অবস্থিত ইউরোপিয়ান পুঁজিবাদী শক্তি মানুষ, সংস্কৃতি ও ভাষার বৈচিত্র্যে পূর্ণ আস্ত একটি মহাদেশকে বিভিন্ন উপনিবেশে পরিণত করেছিল । ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে মনে হয় যে আফ্রিকার ভাগ্যই এমন ছিল যে, তার ভাগ্য সবসময় নির্ধারিত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের মেট্রোপলিসগুলোর কনফারেন্স টেবিলে। স্বশাসিত গোষ্ঠী থেকে আফ্রিকার কলোনিতে পরিণত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বার্লিনে; পুনরায় একই সীমানার মাধ্যমে এর নব্য-উপনিবেশে পরিণত হওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে লন্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলস এবং লিসবনের ঐ টেবিলগুলোতেই। বার্লিনের আঁকা সেই ভাগ-বাটোয়ারা, যা এখনো বর্তমান, অবশ্যই ছিল অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক, সাথে সাংস্কৃতিকও; যদিও হাতে বাইবেল নিয়ে আসা কূটিনীতিকরা বলেন অন্য কথা। ১৮৮৪ সালে বার্লিনে দেখা গেলো আফ্রিকা ভাগ হয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বিভিন্ন ভাষার ভিত্তিতে। উপনিবেশ হিসেবে কিংবা এখন নব্য-উপনিবেশ হিসেবে আফ্রিকান দেশগুলো সবসময়ই সংজ্ঞায়িত হয়েছে ও নিজেদের সংজ্ঞায়িত করে এসেছে ইউরোপের ভাষার পরিপ্রেক্ষিতেই; যেমন ইংরেজিভাষী, ফরাসিভাষী অথবা পর্তুগিজভাষী আফ্রিকান রাষ্ট্রসমূহ ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, লেখকগণ যাদের কথা ছিল এই ধরনের ভাষাভিত্তিক পরিচয় থেকে তাদের মহাদেশকে বের করে নিয়ে আসা, তারা নিজেরাই নিজেদের এইসব সাম্রাজ্যবাদী ভাষাগুলো দিয়ে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এবং নিজেরাও নিজেদের সংজ্ঞায়িত করছেন। এমনকি তাদের সবচেয়ে র‌্যাডিক্যাল ও আফ্রিকাপন্থি অবস্থানে থেকেও তারা মনে করেন যে ইউরোপের ভাষাতেই আফ্রিকান সংস্কৃতির রেনেসাঁ নিহিত আছে।

আমারও এটি জানা উচিত ছিল!

 

দুই

১৯৬২ সালে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল উগান্ডার কাম্পালার মাকারেরে ইউনিভার্সিটি কলেজে আয়োজিত আফ্রিকান লেখকদের ঐতিহাসিক সম্মেলনে। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাইকে নিয়েই এখন বিশ্বব্যাপী অভিসন্দর্ভ লেখা হয়। এর শিরোনাম? ‘‘আ কনফারেন্স অব আফ্রিকান রাইটার্স অব ইংলিশ এক্সপ্রেশন।’’

 

আমি তখন মাকারেরেতে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বৈদেশিক একটি কলেজের ইংরেজির ছাত্র ছিলাম। আমার জন্য মূল আকর্ষণ ছিল চিনুয়া আচেবের সাথে দেখা হওয়ার কিছু বাস্তব সম্ভাবনা। তখন আমার সাথে ছিল ‘‘উইপ নট, চাইল্ড’’ উপন্যাসের অংশবিশেষের টাইপস্ক্রিপ্ট, আমি চাচ্ছিলাম আচেবে সেটা পড়ুক। এর আগের বছর আমি আমার উপন্যাস রচনার প্রথম প্রয়াস ‘‘দ্য রিভার বিটউইন’’ লেখা শেষ করেছিলাম। আর এই উপন্যাস নিয়ে অংশ নিয়েছিলাম ইস্ট আফ্রিকান লিটারেচার ব্যুরো আয়োজিত একটি রচনা প্রতিযোগিতায়। আমি পিটার আব্রাহামসের চর্চার সাথে তাল মিলিয়ে চলছিলাম যিনি লিখেছিলেন ‘‘পাথ অব থান্ডার’’ থেকে টেল ফ্রিডম, উপন্যাস এবং আত্মজৈবনিক রচনা; চলছিলাম চিনুয়া আচেবের সাথে যিনি ১৯৫৯ সালে প্রকাশ করেন ‘‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’’। অথবা ফরাসি কলোনিতে থাকা তাদের প্রতিমূর্তি যেমন ওয়ার সেংহর এবং ডেভিড ডিওপের প্রজন্মকে, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৯৪৭/৪৮ এর অ্যান্থলজি ডে লা ন্যুভেলা পয়সি নেগ্রে এট মালাগাছে ডে ল্যাঙ্গ্যু ফ্রসিয়াজ। তাঁরা সবাই লিখতেন ইউরোপিয়ান ভাষায়, আর অন্য সকল অংশগ্রহণকারীরাও তাই করতেন যারা এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে এসেছিলেন কা¤পালার মাকারেরে পাহাড়ে ১৯৬২ সালে।

শিরোনামের (আ কনফারেন্স অব আফ্রিকান রাইটার্স অফ ইংলিশ এক্সপ্রেশন) কারণে যারা আফ্রিকান ভাষায় লিখতেন তারা এমনিতেই বাদ পড়ে যান। এখন ১৯৮৬ সালে এসে আমি যখন নিজেকে প্রশ্ন করে পেছন ফিরে তাকাই, আমি দেখতে পাই কেমন অস্বাভাবিকত্ব ছিল বিষয়টিতে। আমি, একজন সাধারণ ছাত্র, মাত্র দুইটি প্রকাশিত ছোটগল্পের জোরে এই সম্মেলনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলাম। এই দুইটি ছোটগল্প হলো দ্য ফিগ ট্রি (মুগুমো) যা পেনপয়েন্ট নামের একটি ছাত্রদের সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় এবং অন্য গল্পটি হলো দ্য রিটার্ন, যা ট্রানজিশন নামের নতুন একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে সবচেয়ে বড় পূর্ব আফ্রিকান কবি শাবান রবার্ট, কিশওয়াহিলিতে  কবিতা ও গদ্য নিয়ে যার কৃতিত্বপূর্ণ কাজ ছিল কিংবা চিফ ফাগুনওয়া, ইয়োরুবা ভাষার বিখ্যাত নাইজেরিয়ান লেখক, কেউই এই সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য মনোনীত বা নির্বাচিত হন নি।

 

সম্মেলনে উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা এবং নাটকের মতো কাজগুলোর নির্যাস নিয়ে আলোচনা হয় যা ছিল ইংরেজিতে, বাদ পড়ে যায় এসব কাজের মূল অংশগুলো যা লেখা হয়েছিল সোয়াহিলি, জুলু, ইয়োরুবা, আরবি, আমহারিক এবং অন্যান্য আফ্রিকান ভাষায়। আফ্রিকান ভাষার লেখক ও সাহিত্যগুলোকে এই সম্মেলন থেকে বাদ দেয়া হলেও, আফ্রিকান রাইটার্স অব ইংলিশ এক্সপ্রেশন শীর্ষক এই সম্মেলনের আলোচ্য এজেন্ডার প্রথমেই ছিল, ‘‘আফ্রিকান সাহিত্য কী?”

 

বিতর্কটি ছিল প্রাণবন্ত। এটি কি সেই সাহিত্য যা রচিত আফ্রিকাকে নিয়ে, নাকি আফ্রিকান অভিজ্ঞতাকে নিয়ে? এটি কি সেই সাহিত্য যা আফ্রিকানদের দ্বারা রচিত? একজন অ-আফ্রিকান যদি আফ্রিকা বিষয়ে লিখেন তাহলে তার রচনা কি আফ্রিকান সাহিত্য? একজন আফ্রিকান যদি গ্রিনল্যান্ডে তাঁর কাজ করেন তাহলে সেটিকে কি আফ্রিকান সাহিত্য বলা যায়? নাকি আফ্রিকান ভাষাই হলো বিচারের মাপকাঠি? তাহলে আরবি ভাষার কী হবে, এই ভাষাও কি আফ্রিকায় বিদেশি ভাষা নয়? ফরাসি বা ইংরেজি ভাষার কী হবে, যা আফ্রিকান ভাষায় পরিণত হয়েছে? কী হবে যদি একজন ইউরোপিয়ান ইউরোপ বিষয়ে লেখেন একটি আফ্রিকান ভাষায়? যদি… যদি… যদি… এটা অথবা ওটা নিয়ে আলোচনা হলো; শুধু আলোচনা হলো না সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের দ্বারা আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের উপর কর্তৃত্বপরায়ণতার বিষয়ে। সেখানে কোন ফাগুনওয়া কিংবা শাবান রবার্ট কিংবা আফ্রিকান ভাষার কোন লেখক ছিলেন না যিনি এই সম্মেলনকে এসব বিমূর্ত আলোচনা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারেন। আমরা যা লিখি তা কি আফ্রিকান সাহিত্য হিসেবে গণ্য হবে? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি কখনোই গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করা হয় নি। জাতীয় ও শ্রেণিভিত্তিক অডিয়েন্স উভয়ের জন্য ভাষাই যেখানে নির্ধারক সেখানে সাহিত্য ও এর অডিয়েন্সের অঞ্চল নিয়ে কোন আলোচনা সেখানে আকৃতি পায় নি। বিতর্কটি ছিল খুবই বিষয়গত এবং লেখকদের জাতিগত উৎস ও ভৌগোলিক বাসস্থান সম্পর্কিত।

 

আফ্রিকার একটি জাতির ভেতর কিংবা বিভিন্ন আফ্রিকান জাতির ভেতর কিংবা অন্য মহাদেশের সাথে সাহিত্যবিষয়ক, এমনকি রাজনৈতিক মধ্যস্থতার স্বাভাবিক ভাষা মনে করা হতো ইংরেজিকে; ফরাসি ও পর্তুগিজের ক্ষেত্রেও এমন ধারণাই ছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে মনে করা হতো একই দেশে অবস্থান করা আফ্রিকানদের ভেতর ভাষাকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা রয়েছে তার বিপরীতে এসব ইউরোপীয় ভাষা আফ্রিকানদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে।

এজন্যই ট্রানজিশন নাম্বার ১১ তে এজেকিয়েল এমফাহলেলে এস্তার লিখেছিলেন যে, ইংরেজি এবং ফরাসি এখন বহুল-ব্যবহৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে যা ব্যবহার করা যায় সাদা নিপীড়কদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের ফ্রন্টে। ‘‘যেসব স্থান থেকে সাদারা চলে গিয়েছে সেসব স্বাধীন রাষ্ট্রেও এই দুইটি ভাষা ঐক্যবদ্ধকারী শক্তি হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে।’’ সাহিত্যাঙ্গনে বিষয়টিকে এমনভাবে দেখা হতো যে, এসব ভাষা আফ্রিকান ভাষাগুলোকে নিজেদের থেকে রক্ষা করতেই এসেছে। বিরাগো ডিয়োপের লেখা কন্টেস দি আমদৌ কুমবা বইয়ের মুখবন্ধে দেখা যায় সেদার সেংহর ফরাসি ভাষায় লিখে আফ্রিকার পুরনো পৌরাণিক কাহিনি ও আখ্যানগুলোর চৈতন্য ও ধরনকে রক্ষার জন্য ডিয়োপের প্রশংসা করছেন। ‘‘গুলোকে ফরাসি ভাষায় রূপ দেয়ার সময় এদের ভেতর নতুনত্ব আসে, ভদ্রতা ও সততার ভাষা হিসেবে ফরাসি যেমন তার ভাষার প্রতিভাবানদের সম্মান দেয়, ঠিক একইভাবে তা নিগ্রো-আফ্রিকান ভাষার গুণাবলিকেও সংরক্ষণ করে।’’ ইংরেজি, ফরাসি ও পর্তুগিজ ভাষা আমাদের রক্ষা করার জন্য এসেছে এবং আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে এই না চাইতেই পাওয়া উপহার গ্রহণ করেছি। এজন্যেই ১৯৬৪ সালে চিনুয়া আচেবে তাঁর দ্য আফ্রিকান রাইটার অ্যান্ড দ্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ শীর্ষক বক্তৃতায় বলেছিলেন :

এটা কি ঠিক যে একজন তার মাতৃভাষাকে পরিত্যাগ করবে অন্যের ভাষার জন্য? একে মনে করা হয় ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা ও এক দোষী অনুভূতি। কিন্তু আমার অন্য কোন উপায় নেই। আমাকে এই ভাষাটি দেয়া হয়েছে এবং আমি তা ব্যবহার করতে চাই।

 

এখানে প্যারাডক্স হলো, ‘‘ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা’’ ও ‘‘এক দোষী অনুভূতি’’র মতো শব্দবন্ধগুলো মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক ধরনের চিন্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি করে। কিন্তু বিদেশি ভাষা তৈরি করে এক ধরনের নিঃশর্ত ইতিবাচকতা যার ফলে ১০ বছর পর আচেবে নিজেই একে বলেন, ‘‘আমাদের সাহিত্যে ইংরেজির অনাক্রম্য অবস্থান বিষয়ে নিয়তিবাদী যুক্তি ।’’

 

সত্য হলো, ঐ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কিংবা তাদের পরের প্রজন্ম যারা ইউরোপীয় ভাষা বেছে নিয়েছেন, তারা এই নিয়তিবাদী যুক্তি কম হোক বা বেশি, গ্রহণ করেছিলেন। আমরা এর দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলাম এবং আমাদের প্রধান চিন্তা ছিল কীভাবে এই ধার করা ভাষা দিয়ে আফ্রিকান অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রকাশ করা যায়। যেমন আফ্রিকান প্রবাদ এবং আফ্রিকান ভাষ্য ও ফোকলোরের অন্যান্য অদ্ভুত বিষয়াদি। এর একটি উপায় হলো ঐসব ইউরোপীয় ভাষাকে ব্যবহার করা। এজন্য আচেবে (থিংস ফল অ্যপার্ট; অ্যারো অব গড), আমোস তুতুওলা (দ্য পামওয়াইন ড্রাঙ্কার্ড; মাই ফাইফ ইন দ্য বুশ অব ঘোস্টস) এবং গ্যাব্রিয়েল ওকারা (দ্য ভয়েজ) প্রায়ই তিনটি বিকল্প মডেলের কথা বলেন। মরচে পড়া অস্থিসন্ধিতে সেংহরের ‘‘কালো রক্ত’’ প্রবেশ করিয়ে (!) বিদেশি ভাষাকে সমৃদ্ধ করার এই উদ্দেশ্যে সফল হওয়ার জন্য আমরা যা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় ট্রনজিশনে পুনরায় ছাপা হওয়া গ্যাব্রিয়েল ওকারার লেখায় :

আফ্রিকান চিন্তা, আফ্রিকান দর্শন এবং আফ্রিকান ফোকলোর ও চিত্রকল্পের সম্পূর্ণ ব্যবহারে বিশ্বাসী একজন লেখক হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, একমাত্র উপায় হলো লেখকের স্থানীয় ভাষা থেকে তিনি যে ইউরোপীয় ভাষায় ভাব প্রকাশ করবেন সে ভাষায় প্রায় পুরোপুরি আক্ষরিক অনুবাদ। আমার ব্যবহৃত শব্দ যেন স্থানীয় আবেগের বহিঃপ্রকাশের যতটা সম্ভব কাছাকাছি হয় সেজন্য আমি খুবই চেষ্টা করি। এর জন্যে, যে কোন আফ্রিকান ভাষায় একটি শব্দ, কতিপয় শব্দ, একটি বাক্য এবং এমনকি একটি নাম থেকেও একজন আমাদের সামাজিক প্রথা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে জানতে পারে।

আফ্রিকান ভাষ্যের অত্যুজ্জ্বল চিত্রকল্পগুলোকে ধারণ করার জন্য আমি আমার চিন্তা প্রকাশের জন্য ইংরেজি ব্যবহারের অভ্যাসকে সতর্কভাবে দূরে সরিয়ে রাখতাম। এটি প্রথমে কঠিন ছিল, আমার ব্যবহৃত প্রতিটি আইজো  অভিব্যক্তির অর্থ আমাকে জানতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে। একই সাথে অভিব্যক্তিগুলো কোন প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয় তাও বুঝতে হয়েছে যেন তা থেকে আমি সবচেয়ে কাছের ইংরেজি শব্দ ও এর অর্থ বের করে আনতে পারি। একে আমার খুব আকর্ষণীয় চর্চা মনে হয়েছে।১০

আমরা প্রশ্ন করতেই পারি যে কেন একজন আফ্রিকান লেখক বা অন্য কোন লেখক এতটা ঘোরগ্রস্ত হবেন নিজের মাতৃভাষার মাধ্যমে অন্যের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে? কেন তিনি একে তার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে নিবেন? আমরা কখনো নিজেদের প্রশ্ন করি না যে কিভাবে আমরা আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারি? কিভাবে আমরা অন্য মানুষদের, অন্য সময়ের এবং অন্য স্থানের সমৃদ্ধ মানবিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে ব্যবহার করতে পারি নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্যে? কেন বালজাক, তলস্তয়, শলোকভ, ব্রেখট, লু সুন, পাবলো নেরুদা, এইচ. সি. অ্যান্ডারসন, কিম চি হা, মার্ক্স, লেনিন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, ইস্কিলাস, অ্যারিস্টটল এবং প্লেটো আফ্রিকান ভাষায় নয়? আর কেন আমরা আমাদের নিজেদের ভাষায় সাহিত্যকীর্তি তৈরি করছি না? অন্য কথায়, কেন ওকারা আইজো ভাষায় সৃষ্টির জন্য কাজ করছেন না, যাকে তিনি বলেছেন দার্শনিক গভীরতাসম্পন্ন এবং বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ও অভিজ্ঞতায় পূর্ণ? আফ্রিকান মানুষের সংগ্রামের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কী ছিল? না, এই প্রশ্নগুলো করা হয় নি। আমাদের আরো বেশি চিন্তিত হতে হয় যখন দেখি নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষাকে জীবন্ত ও তেজস্বী করার এসব সাহিত্যবিষয়ক জিমন্যাসটিক্সের পর প্রশ্ন করা হলো এর ফলাফল কি ভালো ইংরেজি বা ভালো ফরাসি হিসেবে গণ্য হবে? ভাষার মালিকরা কি আমাদের ব্যবহারের সমালোচনা করবেন? এক্ষেত্রে আমাদের অধিকারের প্রতি আমরা ছিলাম অনেক বেশি জিদে পূর্ণ! চিনুয়া আচেবে লিখেছিলেন :

আমি মনে করি ইংরেজি আমার আফ্রিকান অভিজ্ঞতার ভার বইতে পারবে। তবে একে হতে হবে এক নতুন ইংরেজি, পূর্ব ঠিকানার সাথে এর থাকবে পূর্ণ যোগাযোগ কিন্তু এটি পরিবর্তিত হবে নতুন আফ্রিকান পারিপার্শ্বিকের সাথে মিলে যাওয়ার জন্য।১১

এ বিষয়ে গ্যাব্রিয়েল ওকারার অবস্থান আমাদের প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করতো :

অনেকে এভাবে ইংরেজি লেখাকে ভাষার দূষণ মনে করতে পারেন যা সত্য নয়। জীবন্ত ভাষা জীবন্ত বিষয়ের মতোই বেড়ে উঠতে থাকে, আর ইংরেজির অবস্থান একটি মৃত ভাষা থেকে অনেক দূরে। ইংরেজির আমেরিকান, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান ও নিউজিল্যন্ডীয় সংস্করণ রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে প্রতিফলনের সাথে সাথে এসব সংস্করণ ভাষায় জীবন ও শক্তি যোগ করেছে। তাহলে কেন একটি নাইজেরিয়ান বা পশ্চিম আফ্রিকান ইংরেজি ভাষা থাকতে পারবে না যার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের চিন্তা, ভাবনা ও দর্শন প্রকাশ করবো?১২

আমাদের সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে ‘‘ইংরেজির অনাক্রম্য অবস্থান বিষয়ে নিয়তিবাদী যুক্তি’’র এই গ্রহণযোগ্যতায় আমরা কীভাবে পৌঁছলাম? ১৮৮৪ সালের বার্লিনের ১৯৬২ সালে মাকারেরে হয়ে ১০০ বছর পরও আজকে বিদ্যমান ও কর্তৃত্বশীল যুক্তির যাত্রাপথ কী ছিল? কিভাবে আমাদের, আফ্রিকান লেখকদের নিজেদের ভাষার ওপর দাবি এতটা দুর্বল হলো আর অন্য ভাষার প্রতি, বিশেষত আমাদের উপনিবেশ করে রাখা ভাষার প্রতি দাবি এতটা শক্তিশালী হলো?

১৮৮৪ সালে এখানে বার্লিনের প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল তলোয়ার ও বুলেটের মাধ্যমে। কিন্তু তলোয়ার ও বুলেটের অন্ধকারকে অনুসরণ করে এসেছিল চক ও ব্ল্যাকবোর্ডের আলো। যুদ্ধের ময়দানের শারীরিক সহিংসতার পেছন পেছন এসেছিল শ্রেণিকক্ষের মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা। তবে, প্রথমটি ছিল নৃশংস, আর পরেরটি ছিল বেশ ভদ্রোচিত। পদ্ধতিটি সবচেয়ে ভালো বর্ণিত হয়েছে চেইখ হামিদু কেনের উপন্যাস অ্যাম্বিগুয়াস অ্যাডভেঞ্চার-এ যেখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের সেই কৌশলের কথা বলছেন যার দ্বারা দক্ষতার সাথে হত্যাও করা যায় আবার সারিয়েও তোলা যায় :

একজন বুঝতে শুরু করলো যে কালো মহাদেশে তাদের প্রকৃত শক্তি কামানে নয় বরং কামানকে যা অনুসরণ করে এসেছে তাতেই নিহিত আছে। কামানের পেছনেই ছিল নতুন বিদ্যালয়। নতুন বিদ্যালয়ের প্রকৃতি ছিল একই সাথে কামান ও চুম্বকের মতো। কামানের মাধ্যমে এটি অস্ত্রের ক্ষমতা কেড়ে নেয়। তবে কামানের চেয়েও ভালোভাবে এটি বিজয়কে স্থায়ী করে। কামান দেহের উপর চাপ প্রয়োগ করে আর বিদ্যালয় আত্মাকে মুগ্ধ করে।১৩

আমার মতে ভাষাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন যার মাধ্যমে ঐ শক্তি আমাদের মুগ্ধ করেছে ও আমাদের আত্মাকে বন্দি করেছে। বুলেট ছিল শারীরিক অধীনতা তৈরির উপায়। আর ভাষা ছিল আত্মিক অধীনতা তৈরির উপায়। আমার নিজের শিক্ষা বিশেষত ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে আমি এ বিষয়ে আরো আলোকপাত করতে চাই।

তিন

আমি একটি বৃহৎ কৃষক পরিবারে জন্মেছিলাম। বাবা, চারজন স্ত্রী এবং ২৮টি বাচ্চা। একইসাথে আমি সেইসব দিনের আর সবার মতোই আরো বর্ধিত একটি পরিবার এবং সার্বিকভাবে পুরো সম্প্রদায়ের অংশ ছিলাম।

 

আমরা মাঠে কাজ করতাম এবং গিকুয়ু ভাষায় কথা বলতাম। বাড়ি বা বাইরে আমরা এই ভাষাতেই কথা বলতাম। সেসব দিনে আগুনের পাশে বসে গল্পবলা সন্ধ্যাগুলো আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল। তখন মূলত বড় হয়ে যাওয়ারা বাচ্চাদের গল্প বলতো, যদিও সবাইই পুরো ব্যাপারটায় আগ্রহী ও যুক্ত থাকতো। পরের দিন এই গল্পগুলোই আমরা সেসব বাচ্চাদের পুনরায় বলবো যারা ইউরোপীয় বা আফ্রিকান ভূমিমালিকদের মাঠে পায়ারথ্রাম ফুল, চা পাতা কিংবা কফি বীজ তুলে থাকে।

 

এসব গল্পের প্রতিটিই গিকুয়ু ভাষায় বলা হতো যেখানে বেশির ভাগ সময় গল্পের মূল চরিত্র থাকতো কোন প্রাণি। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল দুর্বল কিন্তু রসিক ও উদ্ভাবনী দক্ষতার খরগোশ। সিংহ, চিতা, হায়েনা প্রভৃতি জন্তুর বিরুদ্ধে সংগ্রামরত হিসেবে তার সাথে আমাদের পরিচয়। তার বিজয় ছিল আমাদেরই বিজয় এবং এ থেকে আমরা শিখেছিলাম যে আপাত দুর্বলও বুদ্ধি ব্যবহার করে শক্তিমানকে হারাতে পারে। খরা, বৃষ্টি, তাপ ও বাতাসের মতো বিরূপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে টিকে থাকতে তাদের ভেতর কখনো কখনো পারস্পরিক সহায়তার সম্পর্ক দেখা যেত। কিন্তু আমরা তাদের নিজেদের ভেতরের সংগ্রামের ব্যাপারেও আগ্রহী ছিলাম। বিশেষত হিংস্র জন্তুর সাথে শিকারে পরিণত হওয়া প্রাণিদের। প্রকৃতি ও জন্তু উভয়ের সাথে এই সংগ্রাম মানব জগতের বাস্তব সংগ্রামেরই প্রতিফলন ছিল।

 

এমন নয় যে আমরা মূল চরিত্রে মানুষ থাকে এমন গল্প অবজ্ঞা করতাম। মানুষকেন্দ্রিক আখ্যানগুলোতে দুই ধরনের চরিত্র দেখা যেত। একটি ছিল সাহসী, দয়াবান, ক্ষমাশীল, খারাপের প্রতি ঘৃণা, অন্যদের খেয়াল রাখার মতো প্রকৃত মানবিক চরিত্র সম্পন্ন প্রজাতি; অন্যটি ছিল মানুষখেকো দুই মাথাওয়ালা প্রজাতি যার ছিল লোভ, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং বৃহৎ পারস্পরিক সহায়তাকারী সম্প্রদায়ের জন্য ভালো এমন বিষয়ের প্রতি ঘৃণা। পারস্পরিক সহায়তার গুণগানই ছিল এসব গল্পের স্থায়ী বিষয়বস্তু। এসব গল্পে রাক্ষস ও জন্তুদের বিরুদ্ধে মানুষ ও প্রাণিদের ঐক্যের কাহিনি ছিল, ঠিক যেমন দেখা যায় একটি গল্পে যেখানে একটি ঘুঘু তাকে খাওয়ানোর প্রতিদান হিসেবে বাসা থেকে দূরে কাজ করা এক কামারকে খুঁজে নিয়ে আসে যখন এমন দুই মাথাওয়ালা এক রাক্ষস কামারের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ভয় দেখাচ্ছিল।

 

সেই সময় ভালো এবং খারাপ দুই ধরনের গল্পকথক ছিল। একজন ভালো কথক একই গল্প বারবার বলতে পারতেন কিন্তু প্রতিবারই তা আমাদের কাছে নতুন মনে হতো। তারা অন্য কারো থেকে শোনা গল্প আরো বেশি জীবন্ত ও নাটকীয়রূপে বলতে পারতেন। মূলত শব্দ ও চিত্রকল্পের ব্যবহার এবং বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণের সময় কন্ঠস্বরের ওঠা-নামাই তাদের ভেতর পার্থক্য গড়ে দিতো।

 

এর ফলে আমরা শব্দের অর্থ ও দ্যোতনার মাধ্যমে শব্দগুলোকে বিচার করতে শিখেছিলাম। ভাষা শব্দ দিয়ে তৈরি নিছক দড়ি নয়। তাৎক্ষণিক ও আভিধানিক অর্থ ছাড়াও এর রয়েছে ইঙ্গিত দেয়ার ক্ষমতা। এই ক্ষমতার বিষয়ে আমাদের উপলব্ধি আরও দৃঢ় হতো ধাঁধা, প্রবাদ, সিলেবলের স্থানবিন্যাস অথবা অর্থহীন কিন্তু সুরেলা শব্দগুচ্ছ দিয়ে খেলার মাধ্যমে।১৪  অর্থাৎ আমরা এসব বিষয়ের মাধ্যমে আমাদের ভাষার ভেতরের সুরটি শিখে গিয়েছিলাম। চিত্র ও প্রতীকের মাধ্যমে ভাষা আমাদের জগত সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা দিতো, কিন্তু এর নিজস্ব সৌন্দর্যও ছিল। বাসা এবং মাঠ ছিল আমাদের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়। তবে এই আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো এই যে, আমাদের সন্ধ্যায় শিক্ষণের ভাষা, আমাদের সম্প্রদায়ের ভাষা এবং মাঠে কাজ করার সময় ব্যবহৃত ভাষা সবই ছিল এক ও অভিন্ন।

 

আর এরপর আমি বিদ্যালয়ে গেলাম, যা ছিল একটি ঔপনিবেশিক বিদ্যালয় আর তখনই এসব ঐকতান ভেঙে গেলো। আমার শিক্ষার ভাষা আর আমার সংস্কৃতির ভাষা এক থাকলো না। আমি প্রথমে যাই মিশনারি দ্বারা পরিচালিত কামান্দুরাতে; এরপর যাই মাংগুতে যা পরিচালনা করতো গিকুয়ু ইন্ডিপেনডেন্ট এবং কারিঙ্গা স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয়তাবাদীরা। আমাদের শিক্ষার মাধ্যম তখন পর্যন্ত গিকুয়ু ছিল। আমি প্রথম সংবর্ধনা পেয়েছিলাম গিকুয়ু ভাষায় লেখা একটি রচনার জন্যে। তাই বলা যায় যে প্রথম চার বছর পর্যন্ত আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও লিমুরু কৃষক সম্প্রদায়ের ভাষার ভেতর এক ধরনের ঐকতান ছিল।

 

১৯৫২ সালে কেনিয়ায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় এবং জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা পরিচালিত সকল স্কুলকে ঔপনবেশিকরা একজন ইংরেজের অধীনে থাকা জেলা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নিয়ে যায়। তখন ইংরেজি আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ভাষায় পরিণত হয়। কেনিয়াতে ইংরেজি ভাষার চেয়েও বেশি কিছু ছিল। এটি ছিল সেই ভাষা যার সামনে অন্য সব ভাষাকে মাথা নিচু করে রাখতে হতো।

 

সেই সময় বিদ্যালয়ের কাছাকাছি কোথাও গিকুয়ু ভাষায় কথা বলে ধরা পড়াটা ছিল সবচেয়ে অপমানজনক অভিজ্ঞতা। অপরাধীকে শারীরিক শাস্তি দেয়া হতো। খোলা পাছায় তিন থেকে পাঁচটি বেতের বাড়ি অথবা একটি ধাতব প্লেট ঘাড়ের চারপাশে বহন করতে হতো যাতে লেখা থাকতো ‘‘আমি নির্বোধ’’ অথবা ‘‘আমি একটা গাঁধা’’। কখনো কখনো অপরাধীদের জরিমানা করা হতো যা তারা কদাচিৎ পরিশোধ করতে পারতো। আর কিভাবে শিক্ষকরা অপরাধীরদের ধরতেন? একজন ছাত্রের হাতে একটি বোতাম দেয়া হতো যেন অন্য কেউ তার মাতৃভাষায় কিছু বলামাত্র সেটি তার হাতে দিয়ে দেয়া হয়। দিনের শেষে যার হাতে বোতামটি পাওয়া যায় তাকে বলতে হয় কে তাকে এটি দিয়েছে। এভাবে সারা দিনের সকল অপরাধীর খোঁজ পাওয়া যেত। এভাবেই বাচ্চাদেরকে উইচহান্টারে পরিণত করা হতো আর একই সাথে নিজের সম্প্রদায়ের সাথে বেইমানি করার আকর্ষণীয় মূল্য সম্পর্কেও তাদের ধারণা দেয়া হতো।

 

ইংরেজির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ঠিক এর বিপরীত। কথ্য বা লেখ্য ইংরেজিতে যে কোন অর্জনকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করা হতো উপহার, সম্মান, হাততালি দিয়ে; যা ছিল উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার টিকেটের মতো। ইংরেজি পরিণত হয়েছিল মানবিকী, বিজ্ঞান ও শিক্ষার অন্য সকল শাখায় মেধা ও সক্ষমতা বিচারের মাপকাঠি। ইংরেজি পরিণত হয়েছিল আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় একটি শিশুর উন্নয়নের প্রধান নির্ধারক।

 

আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, আপারথেইড বর্ণবাদী ভেদবিন্যাস ছাড়াও ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি পিরামিডসদৃশ কাঠামো থাকে। একটি প্রশস্ত প্রাথমিক ভিত্তি, সরু হয়ে আসা মাধ্যমিক পর্যায়, এবং আরো সরু হয়ে যাওয়া বিশ্ববদ্যালয় বা শীর্ষবিন্দু। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে বাছাই হতো একটি পরীক্ষার মাধ্যমে। আমার সময় একে বলা হতো কেনিয়া আফ্রিকান প্রিলিমিনারি এক্সামিনেশন। এতে একজনকে গণিত, প্রকৃতি অধ্যয়ন, কিশওয়াহিলি ভাষাসহ ছয়টি বিষয়ে পাশ করতে হতো। সবগুলো পরীক্ষাই হতো ইংরেজি ভাষায়। অন্যান্য বিষয়ে যত ভালো ফলাফলই হোক না কেন, ইংরেজিতে ফেল করলে কাউকে পাশ করানো হতো না। আমার ক্লাসের একটি ছেলের কথা মনে পড়ে যে সকল বিষয়ে ডিস্টিঙ্কশনসহ পাশ করেছিল কিন্তু ফেল করেছিল ইংরেজিতে। তাই তাকে পুরো পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরে সে একটি বাস কোম্পানিতে চালকের সহকারি হওয়ার চেষ্টা করেছিল। আমি অন্যান্য বিষয়ে শুধু পাশ করেছিলাম তবে ইংরেজিতে ক্রেডিট পাওয়ায় অ্যালায়েন্স হাই স্কুলে সুযোগ পেয়ে যাই, যা ছিল উপনিবেশিত কেনিয়ার সবচেয়ে এলিটিস্ট প্রতিষ্ঠান। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তথা মাকারেরে ইউনিভার্সিটি কলেজে সুযোগ পাওয়ার শর্তগুলোও প্রায় একই ছিল। স্নাতকের লাল গাউন কেউ পরতে পারতো না, যত ভালোই সে করুক না কেন অন্যান্য বিষয়ে, যদি না তার ইংরেজিতে ক্রেডিট থাকতো, শুধু পাশ হলেও চলবে না। তাই প্রবল কামনার পিরামিডের ঐ সর্বোচ্চ স্তরে ও বিদ্যমান ব্যবস্থায় ঢুকতে হলে তা শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষার ঐ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। ইংরেজি ছিল ঔপনিবেশিক অভিজাততন্ত্রের দাপ্তরিক বাহন ও জাদুকরি ফর্মুলা।

 

সাহিত্যবিষয়ক শিক্ষাও কর্তৃত্বশীল ভাষাতেই সম্পন্ন হতো, একই সাথে সম্পন্ন হতো সেই কর্তৃত্বের শক্তিবৃদ্ধিও। কেনিয়ার ওরাটিউর১৫ একরকম স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমি পড়া শুরু করলাম সরলীকৃত ডিকেন্স ও স্টিভেনসন, তার সাথে রাইডার হ্যাগার্ড, জিম হকিন্স, অলিভার টুইস্ট ও টম ব্রাউন। আমার কল্পনার রাজত্ব এরা দখল করায় হারিয়ে গেল খরগোশ, চিতা ও সিংহ। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্কট ও জি. বি. শ পাল্লা দিচ্ছিলো আরও আরও রাইডার হ্যাগার্ড, জন বুচান, অ্যালান প্যাটন, ক্যাপ্টেন ডব্লিউ. ই. জোন্সের সাথে। মাকারেরেতে আমি পড়েছি ইংরেজি, চসার থেকে টি. এস. এলিয়ট, সাথে গ্রাহাম গ্রিন।

 

এভাবেই ভাষা ও সাহিত্য আমাদেরকে আমাদের থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলো, আমাদের দুনিয়া থেকে আমাদের অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যাচ্ছিলো।

 

আমাদের কেনিয়ান বাচ্চাদের সাথে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা কী করছিল? একদিকে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি নিগ্রহ অন্যদিকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের এই ক্রমোন্নয়নের ফলাফল কী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাকে প্রথমে পরীক্ষা করতে দিতে হবে মানুষের অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি ও বাস্তবতার প্রতি ধারণার সাথে ভাষার সম্পর্ক।

 

উৎস ও টীকা

১. ১৮৮৪-৮৫ সালের বার্লিন কনফারেন্সের কথা বলা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আফ্রিকা মহাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেই ইউরোপীয় ঔপনবেশিক দেশগুলোর তৎপরতা ছিল। আফ্রিকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে মহাদেশটির নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ভেতর দ্বন্দ্ব তৈরি হলে ১৮৮৪ সালে নভেম্বরে সুইজারল্যান্ড ব্যতীত ইউরোপের সকল রাষ্ট্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অটোমান সাম্রাজ্য বার্লিন কনফারেন্সে অংশ নেয়। কনফারেন্স শুরুর ১০৪ দিন পর ১৮৮৫ সালের ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখে ইউরোপের ১৩টি দেশ জেনারেল অ্যাক্ট শীর্ষক চুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের ভেতর ভাগ করে নেয়। এ বিষয়ে আরও জানা যেতে পারে https://www.sahistory.org.za/article/berlin-conference ও https://www.aljazeera.com/indepth/opinion/berlin-1884-remembering-conference-divided-africa-191115110808625.html থেকেÑঅনুবাদক

২. ‘‘আফ্রিকানদের কাছে ইউরোপীয় ভাষা এতটাই গুতুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে তারা তাদের একটি অংশের পরিচয় দিতো ঐসব ভাষায়। আফ্রিকানরা একে অপরকে বর্ণনা করতে শুরু করেছিল ফরাসি কিংবা ইংরেজিভাষী আফ্রিকান হিসেবে। এমনকি মহাদেশটিকেও ফরাসিভাষী রাষ্ট্র, ইংরেজিভাষী রাষ্ট্র ও আরবিভাষী রাষ্ট্র হিসেবে ভাবা হতো।’’ (আলি এ. মাজরুয়ি, আফ্রিকাজ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস, লন্ডন: ১৯৭৭, পৃ. ৯২)

আরবি আসলে এই শ্রেণিবিভাগের সাথে যায় না। আরবিভাষী রাষ্ট্রের স্থলে মাজরুয়ির পর্তুগিজভাষী রাষ্ট্র বলা উচিত ছিল। আরবি আসলে এখন একটি আফ্রিকান ভাষা, যদি না আমরা উত্তর আফ্রিকা, মিশর, সুদানের সকল স্বদেশি মানুষকে আফ্রিকান হওয়া থেকে বাদ দিতে চাই।

এবং ইউরোপ দ্বারা প্রভাবিত সমসাময়িক আফ্রিকান বাস্তবতার প্রতি মাজরুয়ির এই তীক্ষè ও অন্তর্দৃষ্টিস¤পন্ন বর্ণনা, পর্যবেক্ষণ ও তুলনায় প্রায়ই দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপরিবর্তনীয় অনিবার্যতার বোধ ও তা মেনে নেয়ার ধ্বনি পাওয়া যায়Ñলেখক

৩. কনফারেন্সটির আয়োজন করেছিল প্যারিসভিত্তিক কিন্তু আমেরিকা দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও অর্থায়িত কমিউনিস্টবিরোধী সোসাইটি ফর কালচারাল ফ্রিডম। পরে তাদের পেছনে সিআইএ-র অর্থায়নের বিষয়টিও সামনে আসে। এই ঘটনা থেকে দেখা যায় কিভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পছন্দের ব্যাপারগুলো সাম্রাজ্যবাদের মেট্রোপলিটন কেন্দ্রগুলো থেকে নির্দেশিত হয়Ñলেখক

৪. আফ্রিকান ভাষাÑঅনুবাদক

৫. এই তর্কটি প্রায়শই ঔপনিবেশিক মুখপাত্রদের দ্বারা সমর্থিত হয়। ১৯৬৪ সালের ১৫ জুলাইয়ের ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান উইকলিতে প্রকাশিত এমফাহলেলের মন্তব্যের সাথে জিওফ্রে মুরহাউজের মন্তব্যের তুলনা করা যায়, যা উদ্ধৃত হয়েছিল আলী এ. মাজরুয়ি এবং মাইকেল টাইডি দ্বারা ১৯৮৪ সালে লন্ডনে প্রকাশিত তাদের ন্যাশনালিজম অ্যান্ড নিউ স্টেটস ইন আফ্রিকা শীর্ষক কাজে।

‘‘আফ্রিকার উভয় পার্শ্বে, অধিকন্তু ঘানা এবং নাইজেরিয়ায়, উগান্ডা এবং কেনিয়াতে শিক্ষার বিস্তারের সাথে সাথে প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজির চাহিদা বৃদ্ধি পেতে দেখা গিয়েছে। (লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো উপনিবেশবাদের প্রতীক হিসেবে ইংরেজিকে প্রত্যাখ্যান করা হয় নি, বরং একে গ্রহণ করা হয়েছিল উপজাতীয় গালাগালের বাইরে একটি রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ভাষা হিসেবে — থিয়োঙ্গো)। ভারত বা মালয়েশিয়ার চেয়ে আফ্রিকায় এটি ছিল অনেক বেশি আকর্ষণীয় প্রস্তাব কারণ তুলনামূলকভাবে খুব অল্প সংখ্যক আফ্রিকানই তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা এবং মৌখিক যোগাযোগের ভাষায় স¤পূর্ণভাবে শিক্ষিত ছিল। হাউসা বা সোয়াহিলি, যে ভাষায় লক্ষ লক্ষ মানুষ কথা বলে সে ভাষা পড়তে ও লিখতে জানা মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি নয়।’’

মুরহাউজ কি আমাদের বলতে চান যে নব্য-উপনিবেশের সাথে আফ্রিকান দ্বন্দ্বে ইংরেজি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ? তিনি কি বলতে চাচ্ছেন যে ১৯৬৪ সালে আফ্রিকান ভাষার চেয়ে ইউরোপীয় ভাষায় বেশি আফ্রিকান শিক্ষিত ছিল? যদি সেটা হয়েও থাকে, তাহলে কি আফ্রিকানরা তাদের নিজেদের জাতীয় ও আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষিত হতে পারতো না? মুরহাউজ সাহেবের মুখে কি আফ্রিকান শব্দটি আটকে গিয়েছিল? — লেখক

৬. অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এর ইংরেজি নাম হলো আমাদৌ ক্যুমবার আখ্যান। বইটির প্যারিস সংস্করণের প্রেজেন্স আফ্রিকেইন থেকে এই বিশেষ অংশটি বেইরুথে আমার জন্যে অনুবাদ করে দিয়েছেন ড. বাচির ডায়ানেÑলেখক

৭. প্রবন্ধটি এখন পাওয়া যায় মর্নিং ইয়েট অন ক্রিয়েশন ডে (লন্ডন, ১৯৭৫) শীর্ষক রচনা সংগ্রহেÑলেখক

৮. ১৯৬৪ সালের নিজের অবস্থান থেকে আচেবে তাঁর মর্নিং ইয়েট অন ক্রিয়েশন ডে-র ভূমিকায় নিশ্চিতভাবেই কিছুটা বেশি সমালোচনামূলক হয়েছিলেন। এই শব্দবন্ধটি আমাদের, আফ্রিকান লেখকদের একটি প্রজন্মের জন্যে যথযথÑলেখক

৯. আফ্রিকান জাতিগোষ্ঠীÑঅনুবাদক

১০. ট্রানজিশন ১০ম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৬৩, ডায়ালগ, প্যারিস থেকে পুনঃপ্রকাশিত — লেখক

১১. চিনুয়া আচেবে, দ্য আফ্রিকান রাইটার অ্যান্ড দ্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ, সূত্র: মর্নিং ইয়েট অন ক্রিয়েশন ডেÑলেখক

১২. গ্যাব্রিয়েল ওকারা, ট্রানজিশন ১০ম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ — লেখক

১৩. চেইখ হামিদ্যু কেন, এলভেনচার আমবিগুই (দ্ব্যর্থবোধক অভিযানÑঅনুবাদক)। এই পৃষ্ঠাটি আমার জন্যে অনুবাদ করেছিলেন বাচির ডায়ানে — লেখক

১৪. এমন একটি দুরুচ্চার্য শব্দের উদাহরণ হলো, ‘‘কানা লিয়া নিকুরা কুনা কুরা কুরা: না কো কুরা কুনা কানা লিয়া নিকুরা কুরা কুরা‘‘। এই উদাহরণের জন্যে আমি ওয়াঙ্গুই ওয়া গোরোর কাছে ঋণী। এর অর্থ হলো, ‘‘নিচোলার বাচ্চা একটি শিশু ব্যাঙ দেখলো এবং দৌড়ে চলে গেলো: আর যখন শিশু ব্যাঙটি নিচোলার বাচ্চাকে দেখলো তখন সেও দৌড়ে চলে গেলো।‘‘ এটি ঠিকমতো উচ্চারণের জন্যে একটি গিকুয়ুভাষী শিশুর স্বরবর্ণগুলোর সঠিক ধরণ ও দৈর্ঘ্য এবং বিরতি স¤পর্কে জানতে হবে। নাহলে এটি ‘ক’, ‘র’ ও ‘না’ ধ্বনির ভেতর তালগোল পাকিয়ে ফেলে। — লেখক

১৫. মৌখিক সাহিত্য — অনুবাদক

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here