মূল : মাহমুদ দারবিশ
সে আসে নি
সে আসে নি।
বলেছিলাম, সে আসবেও না।
এই যে তার না আসা আর আমার ব্যর্থতা — এসব মিলিয়ে
আমি তখন সন্ধ্যাটাকে অন্যভাবে সাজিয়েছিলাম
ইলেক্ট্রিক বাল্বগুলো জ্বালিয়ে,
মোমের আলোটাকে নিভিয়ে দিয়েছিলাম।
তার গেলাসের সবটুকু ওয়াইন গিলে ফেলে, ভেঙে ফেলেছিলাম সেটাকে
যে সুর বাজছিল ঘরে; তাকেও বদলে দিয়েছিলাম।
তীক্ষ্ণ বেহালার সুরের বদলে ছেড়েছিলাম পার্সিয়ান গান।
নিজেকেই বলেছিলাম, সে আর আসবে না
আমার গলার টাই আলগা করি (আরেকটু আয়েশী হই)
নীলরঙা রাতের পোশাক পরি
তাকে অথবা তার অনুপস্থিতিকে ভুলতে আমি এখন
চাইলেই খালি পায়ে হাঁটতে পারি
বা পায়ের উপর পা তুলে বসতে পারি তার সোফাটায়
আজকের এই সন্ধ্যার জন্য যা যা বের করেছিলাম,
সবকিছুই আবার দেরাজে গুছিয়ে রেখে দিলাম
জানালাটা খুললাম
পর্দা সরালাম
দাঁড়ালাম রাত্রির মুখোমুখি
শুধু তার জন্য অপেক্ষা আর তাকে না পাওয়া ছাড়া
আমার শরীরে আর কোন গোপনীয়তা নেই
আমার ভেতরকার আকুলতাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতে
বাতাসে গোলাপ আর লেবুর পানি ছড়িয়ে দিলাম
সে আর আসবে না
তার এই অবহেলাকে শাস্তি দিতে, অর্কিডগুলোকে ডান দিক থেকে বাঁদিকে সরিয়ে রাখব
আমার কোট দিয়ে আরশিটা ঢেকে দিব
সেখানে তার উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব দেখতে চাই না আর
আমি স্বগতোক্তি করলাম, তার জন্য বাছাই করা আদিম ভালবাসার পঙক্তিগুলো ভুলে যাও
এমন কি সে একটা চুরি করা কবিতা পাওয়ারও যোগ্য নয়
তারপর তাকে ভুলে গিয়েছিলাম
হাতের সামনে যা ছিল তা খেয়ে নিলাম চট করে
আর দূরের এক গ্রহ সম্পর্কিত একটা বইয়ের অধ্যায়ও পড়ে ফেললাম
আর তার কষ্ট ভোলার জন্য একটা কবিতা লিখলাম।
হুম, এই কবিতাটাই!
কিচ্ছু ভাল্লাগে না আমার
কিচ্ছু ভাল্লাগে না আমার
বাসের যাত্রীটি বললেন
কিচ্ছু ভাল্লাগে না আমার —
রেডিও না, সকালের পত্রিকা না,
এমনকি পাহাড়ের উপরের ওই প্রাসাদগুলাও না।
কাঁদতে ইচ্ছা হয় খালি!
ড্রাইভার বলে উঠল : গন্তব্যে যান তো আগে
তারপর একা একা কাঁদুন যত ইচ্ছা
জনৈক ভদ্রমহিলা বললেন : আমারও। কিচ্ছু ভাল্লাগে না।
আমি আমার ছেলেকে আমার কবরে নিয়ে এসেছি
সে জায়গাটা পছন্দ করেছে; ঘুমিয়ে আছে এখানে
এমনকি, জানেন!
সে আমার কাছে বিদায়ও নেয় নি।
একটা কলেজের ছাত্রও বলে উঠল : সেই তো, কিচ্ছু ভাল্লাগে না
আমি এত করে প্রত্নতত্ব পড়লাম, কই আমার পরিচয় তো কোন পাথরে পেলাম না!
আমি কি সত্যিই ‘আমি’?
এবং একজন যোদ্ধা বললেন :
আমারও ঠিক তাই। ভাল্লাগে না কিচ্ছু।
কী একটা ভূত সবসময় ঘিরে থাকে আমায়
আর আমি তাকে তাড়া করতে থাকি।
বাস ড্রাইভার এখন বিরক্ত স্বরে বলল : এই তো শেষ স্টপেজের কাছে চলে এসেছি আমরা
নামার জন্য তৈরি হয়ে যান
সবাই তখন সমস্বরে চিৎকার দিল :
প্লিজ না!
শেষ স্টপেজের পরে কি আছে দেখতে চাই আমরা!
প্লিজ আপনি চালাতে থাকুন
আমি তখন আপনমনে বললাম :
আমি বরং নেমেই যাই।
আমিও উনাদের মতন।
কিচ্ছু ভাল্লাগে না আমার।
কিন্তু এই ভ্রমণে আমি বড় ক্লান্ত!
সে কারও জন্যই অপেক্ষা করে না
সে কারও জন্যই অপেক্ষা করে না
নিজেকে নিয়েও তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই
পিছনের নদীটা ধুসর; তার কোটের মত
সূর্যের আলো তাকে আলোকিত করে
আর বৃক্ষ করে তাকে উন্নত
আর এই জায়গাটা নিয়েও তার কোন আফসোস নেই
তার কাঠের চেয়ার, কফি, পানির গ্লাস
এই না-চেনা মানুষের দল, ক্যাফের অন্যান্য সব জিনিস,
সবকিছু যেমন ছিল তেমনই আছে
আর খবরের কাগজও তাই :
গতকালকের খবর, যথারীতি দুনিয়া ভেসে যাচ্ছে খুন-খারাবিতে।
যখন মরুভুমির মধ্যে কোন অজানা কিছু সবুজ হয়ে ওঠে,
বা একটা নেকড়ে যখন ছুটতে থাকে কোন গিটারের পিছন,
তখনও সে তার নিঃসঙ্গতা দূর করার কোন তাগিদ বোধ করে না।
কিচ্ছুটির জন্যই সে অপেক্ষা করে না, এমনকি কোনো চমকের জন্যও না
আর সে কোনো কিছুর পুনরাবৃত্তিও করে না
সে স্বগতোক্তি করে, আমি এই পথের শুরু থেকে শেষ অব্দি জানি।
আমি এই পৃথিবী থেকে সরেও যাচ্ছি না, আবার একে কাছেও টানছি না
সে কারও জন্যই অপেক্ষা করে না
আর এটা নিয়ে মন খারাপও করে না
সে শরতের রাজকীয় আতিথিয়েতায় সিক্ত হয়
যে তাকে নিয়ে যায় সোনালি রেনেসাঁর কালে
যে তাকে নিয়ে যায় এমন কবিতার কাছে যা গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছড়িয়ে যায়
সে নদীর তীরে কারও জন্যই অপেক্ষা করে না
এই, এই অবস্থাতেই, আমি এক চড়ুইপাখির মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম
এই, এই অবস্থাতেই আমি একটি নদী
সে আরও বলল,
আমার নিজের বা অন্য কারও উপরেই ক্ষিপ্ত নই
এবং, আমি ঠিকই একটা অনিবার্য প্রশ্নকে এড়িয়ে যাই, সেটা হলো,
আমি কী চাই
আমি আসলে কী চাই?
দারবিশের কবিতা আগে পড়েছি, কিন্তু বাংলা অনুবাদ পড়িনি। অসম্ভব ভাললাগলো। উনার কবিতার মধ্যে যে একটা ব্যাপার আছে, যেটার নাম আমি জানিনা, কিন্তু অনুভব করতে পারি (হয়ত আমি আরোও জ্ঞানী জ্ঞানী বইপত্র পড়লে উনার কবিতার মাঝে ঠিক কী আছে সেটা শব্দে প্রকাশ করতে পারতাম), সেই ব্যাপারটা এই অনুবাদেও ফুটে উঠেছে।
অনেক ধন্যবাদ ????