পূর্ব হিমালয়ান অঞ্চলে অবস্থিত দেশ ভুটানে আছে ২০ টির মত শহর বা জেলা। এর মধ্যে কেবল ৩টি শহর আমাদের কাছে অধিক পরিচিত — থিম্পু পারো আর পুনাখা। প্রচারের অভাব, সঠিক নির্দেশনা না থাকা, দুর্গম পাহাড়ি পথ হওয়া আর বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতার কারণে ভুটানের প্রায় পুরোটুকই আমাদের সবার কাছে অজানা। কেবল বাংলাদেশি ভ্রমণকারী নয়, সমগ্র বিশ্বের ভ্রমণকারী কদাচিত বাকি শহরগুলোতে গিয়ে থাকে।
খুব অবাক করার বিষয় হচ্ছে ভুটান খুবই ছোট্ট একটা দেশ হলেও তার প্রতিটি শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য , সংস্কৃতি আর বৈশিষ্টের দিক একটি আরেকটির থেকে ভিন্ন। ভুটানে প্রথমবার যাওয়ার পরেই বুঝে গিয়েছিলাম কেবল এই তিন শহর দেখে আমার মনের সাধ মিটবেনা। আপনারা সেখানে গিয়ে যেন স্বচক্ষে এই অজানা অপার্থিব সৌন্দর্যগুলো দেখে আসতে পারেন। আজ আমার জানবো কীভাবে খুব সহজে আমরা থিম্পু, পারো আর টাইগার নেস্টে গিয়েছিলাম।
ঢাকা টু ইন্ডিয়া টু ভুটান
যাত্রা শুরু হয় ৩০ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে। আমাদের ভুটান ট্যুর একটি গ্রুপ ট্যুর ছিল। মোটামুটি ৩২ জন ছিলাম। আমাদের যাত্রা শুরু হয় কল্যাণপুর বাস টার্মিনাল থেকে। সকাল সাতটায় আমরা পৌঁছাই বুড়িমারি। তারপর ইমিগ্রেশনের পালা। আর হ্যাঁ, ট্রাভেল টেক্সট অবশ্যই ঢাকা থেকে দিয়ে যাবেন তাহলে অনেকটাই সময় বাঁচবে। তারপর ইমিগ্রেশন শেষ করে কারেন্সি এক্সচেঞ্জ করি। এরপর একটি জিপ নিয়ে সোজা জয়গাও। কিন্তু অনেকটা পথ যাওয়ার পর ড্রাইভার বুঝতে পারলো সে ভুটান না গিয়ে শিলিগুঁড়ির পথ ধরে দার্জিলিঙে চলে যাচ্ছে। কারণ এই ট্যুরের আরো একটি টুইস্ট হল আমরা প্রথমে ভুটান হয়ে দার্জিলিঙে যেতাম। ড্রাইভার আগে দার্জিলিঙে, তারপর ভুটানে নিয়ে যেতো। গাড়ি টার্ন ব্যাক করে আবার জায়গাওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ইন্ডিয়ান জয়গাও ইমিগ্রেশনে একদম ভিড় থাকেনা বললে চলে। ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে পায়ে হেঁটে ভুটানে প্রবেশ করি।
ফুয়েন্টশোলিং টু থিম্পু
ফুয়েন্টশোলিং থেকে থিম্পু যেতে সময় লাগবে চার ঘন্টা এবং থিম্পু থেকে পারো যেতে সময় লাগবে এক ঘণ্টার মত। ভূপৃষ্ঠ থেকে যতো ওপর দিকে যাবেন ততটাই নতুন কিছু-না-কিছু দেখতে পাবেন। ভুটানের রাস্তা একদম ভিন্ন। রাস্তা কখনো একদম খাড়া উঠে গেছে ১০-১৩ হাজার ফুট উঁচু পর্যন্ত, কখন একদম ঢালু, আর একটু পর পর রাস্তার মারাত্মক সব বাঁক। সব মিলিয়ে একদম পার্ফেক্ট এডভেঞ্চারাস লং ড্রাইভ। ভুটানের একটা বিশেষ পরিচিত হল : এই দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিচ্ছন্ন ও সুখী একটি দেশ। তাছাড়া এর আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ওদের দেশ কেনো বাস নেই। তাই জ্যাম পাওয়ার কেনো সম্ভাবনা নেই। মজার ব্যাপার হলো যত দিন ভুটানে ছিলাম আমি কেনোও গাড়ি হর্ন শুনতে পাই নি। মোটামুটি ৪ ঘন্টার মধ্যে ফুয়েন্টশোলিং থেকে থিম্পু চলে আসি। সেখানে পৌঁছে প্রথমে যাই বৌদ্ধ মূর্তি দেখতে। প্রায় ৫২ মিটার উচ্চতা-সম্পন্ন। এর আশেপাশের পরিবেশটা অনেক সুন্দর ছিল। বৌদ্ধ মূর্তি দেখার পর আমরা আবার পারোর উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
থিম্পু টু পারো
মোটামুটি ১ঘন্টা ৫৫ মিনিট সময় লেগেছে থিম্পু থেকে পারো যেতে। তারপর হোটেলের কথায় আসি। হোটেলগুলো এত সুন্দরভাবে সাজানো দেখার পর মনটাই ভরে গেল। এত কম টাকায় এত সুন্দর হোটেল পাওয়া যাবে সেটা ভাবিনি। সব কাজ শেষ করে বের হলাম রাতের ভুটান শহরকে দেখতে। কি অদ্ভুত সুন্দর! ছোট্ট শহরের পুরোটাই ঘিরে রেখেছে আকাশচুম্বী একেকটি বিশাল পর্বত। যা পুরো শহরটাকে ভুটানের অন্যশহরগুলো থেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। পুরো শহরটা হেঁটে হেঁটে দেখার মজাই আলাদা। তার ওপর এপ্রিল মাসে অসময় শীতকালে ।
ফাইনাল ডেসটিনেশন
পরের দিন সকালে যাত্রা শুরু করি টাইগার নেস্টের উদ্দেশ্য। টাইগার নেস্ট দেখার আগে ভাবি নি শেষ পর্যন্ত যেতে পারবো কিনা। কারণ, পাহাড়ের উচ্চতা ছিল ১০হাজার ফুট। যাই হোক, ২৫০রুপি দিয়ে মনাস্ট্রির জন্য এন্ট্রি টিকিট কাটলাম। তারপর শুরু করলাম পথ চলা। টাইগার নেস্টের আশেপাশে অনেক পাইন গাছ রয়েছে। বেশ মনোরম ছিল জায়গাটা।
ট্রেকিঙের সময় শরীরের সুগার কমে যায়। তাই কিছু মিষ্টি আর ক্যালরি জাতীয় খাবার নিয়ে গেলে ভালো হবে। আমি ট্রেকিঙের সময় অনেকগুলো লাড়ু নিয়েছিলাম সাথে; আর ছিল বাদাম, চকোলেট ও পানি। কেউ যদি কেনো দিন টাইগার নেস্টে যান অবশ্যই পানি বাদাম আর চকোলেট সাথে নিতে ভুলবেন না। শরীরের সুগার কমে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে এগুলো অবশ্যই সাথে নেবেন।
টাইগার নেস্ট উঠার সময় অনেক বিদেশি ছিল। তাই ট্রেকিংটা আমার কাছে ততটা খারাপ লাগেনি। মোটামুটি ৬ ঘন্টা পর সেই ফাইনাল ডেসটিনেশনে পৌঁছলাম। প্রায় ২২৮১৯ স্টেপ লেগেছে পৌঁছাতে। ঠিক সন্ধ্যায় ট্রেকিং শেষ করে লাঞ্চের জন্য রেস্টুরেন্ট খুঁজছিলাম। তারপর বহু কষ্টে এক রেস্টুরেন্টের খোঁজ পেলাম, যেখানে বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। ভুটানের খাবার গুলা অনেক মজার ছিল খাবার গুলা দেখার পর খেতে আপনি বাধ্য। অনেকটাই ইন্ডিয়ান স্টাইল। আমার কাছে বেশ মুখরোচক লেগেছে।
আমার এই ট্রেকিঙের সব কিছুই ভালো ছিল। কিন্তু দিনের শেষে পাগুলো ব্যথার যন্ত্রণায় জ্বর নিয়ে আমার মিশন শেষ করলাম।