আলমা টমাস (১৮৯১-১৯৭৮) ছিলেন ওয়াশিংটন, ডি.সি.-র একজন আফ্রিকী-আমেরিকান চিত্রকর। তিনি ওয়াশিংটন কালার ফিল্ড চিত্রকরদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্কুল শিক্ষক হিসেবে কাজ থেকে অবসর নেবার পরই কেবল তিনি সার্বক্ষণিকভাবে আঁকতে শুরু করেন। লী ক্রাসনার (১৯০৮-১৯৮৪) ছিলেন নিউ ইয়র্কের ইহুদী-আমেরিকান চিত্রকর, এবং তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন নিউ ইয়র্কের স্কুল-অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অভিব্যক্তিবাদ বা এক্সপ্রেশনিযমের সঙ্গে। আমাদের মনে হলো তাঁরা দুজন একসঙ্গে বসে চা বা ডাবল স্কচ পান করছেন এমনটা কল্পনা করতে পারলে মন্দ হয় না :
আলমা : আচ্ছা, লী, এই যে তোমার সারা জীবন নিউ ইয়র্কে কাটানো, খুব নামী-দামী আর্ট স্কুলে যাওয়া, আর অন্যান্য সব অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিস্টের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, এই ব্যাপারটা কেমন ছিল? আমার কথা যদি বলো, উত্তরের জর্জিয়া থেকে আমরা চ’লে আসার পর আমি প্রায় সারা জীবন ওয়াশিংটনেই কাটিয়েছি। আমি যদিও নিউ ইয়র্কের টিচার্স কলেজে পড়েছি, কলাম্বিয়ায়, কিন্তু আমি শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। আমাদের পরিবারে পুরুষেরা ব্যবসা-বাণিজ্য করত (এবং সেই সঙ্গে আমি যোগ করব, বেশ সাফল্যের সঙ্গেই), আর মেয়েরা শিক্ষকতা।
লী : আমি সবচাইতে ভাল ভাল আর্ট স্কুলে পড়েছি, কিন্তু নারী হিসেবে কখনো কোনো বৈষম্যের শিকার হইনি। তবে অবশ্যই, লোকে যাতে আমাকে গুরুত্ব দেয় সেজন্য আমাকে অন্যদের চাইতে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে, কিন্তু সেটাই জগতের নিয়ম; এটা তুমি বদলাতে পারবে না। আমার শিক্ষক হান্স হফম্যান যখন আমার একটা ক্যানভাস দেখে বললেন যে সেটা ‘এত ভাল যে এটা যে কোনো নারীর আঁকা তা কেউ ভাবতে পারবে না’ তখন আমি কথাটাকে একটা প্রশংসা হিসেবেই নিয়েছিলাম। আমি আমার নাম লেনোরে থেকে বদলে লী-ক’রে ফেলেছিলাম, আর আমার পেইন্টিংগুলো আদ্যক্ষর দিয়ে সাইন করতাম। কিন্তু তখন সবাই সেটাই করত। অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিস্টদের কথা যদি বলো — যেসব নারী সেডার বারে যেতেন, যেখানে পুরুষেরা মাতাল হয়ে আর্ট নিয়ে কথা বলতো — সেক্ষেত্রে বলতে হয়, তাদেরকে গরুর পাল হিসেবে দেখা হতো। সেটা মিস করেছো ভালই হয়েছে।
আলমা : আমি সারা জীবন আমার সব সহকর্মী আর শিক্ষকের সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছি, বিশেষ ক’রে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আমিই ছিলাম প্রথম আর্ট স্টুডেন্ট। সেই ১৯৪০-এর দশক থেকেই আমি অন্য সব আফ্রিকী-আমেরিকান শিল্পীর সাথে নিয়মিতভাবে মিশতাম; তাদের বেশিরভাগই ছিল আমার মতো স্কুলটিচার। আমরা আমাদেরকে বলতাম, ‘ছোট্ট প্যারিস’, আর আমরা এক সঙ্গেই স্কেচ করতাম, ছবি আঁকতাম, আর্ট নিয়ে অনর্গল কথা ব’লে যেতাম। নিউ ইয়র্কে কী ঘটছে তার চাইতে ইউরোপিয়ান মডার্নিজম নিয়ে আমরা বেশি মগ্ন ছিলাম। আমরা এতোটাই বিচ্ছিন্ন ছিলাম যে এমনকি আমাদেরকে নিজেদের একটা গ্যালারি খুলতে হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে আমি বার্নেট-আডেন গ্যালারি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলাম, যেটা ছিল, আমি গর্বের সঙ্গেই বলতে পারি ডি.সি.-র প্রথম ইন্টিগ্রেটেড বা সমন্বিত (?) গ্যালারি।
লী : নিউ ইয়র্ক ছিল আর্টিস্ট আর আর্ট গ্যালারিতে ভরা, কিন্তু কারো কাজ প্রদর্শন করা অত সহজ ছিল না, নারী হলে তো কথাই নেই। আমরা যারা শ্বেতাঙ্গ নারী অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট আমাদের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে ব’লে আমাদের মনে হয়নি, যদিও নারীবাদীরা আমাদেরকে তার উল্টোটাই বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল। আমাদের বেশিরভাগই সেসব পুরুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম যারা মাচো নন্দনতত্ত্ব সৃষ্টি করতেন। আমরা তাঁদের খুব ভালোবাসতাম। তাঁরা প্রশংসা পেলে আমরা খুশি হতাম। জ্যাকসন পোলোক আর আমি বছরের পর বছর একসঙ্গে কাজ করেছি, আর আমাদের পেইন্টিং এক সঙ্গেই বিবর্তিত হয়েছে। ওর কাজগুলো ছিল সাধারণত বড়, আমারগুলো অপেক্ষাকৃতভাবে ছোট। (ওর স্টুডিওটা ছিল আমাদের বিশাল গোলাঘরে, আর আমারটা একটা ওপরতলার ছোট্ট ঘরে)। আমার প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ‘বেটি পারসনস’-এ; তখন আমার বয়েস তেতাল্লিশ, আর আমি আমার বয়েস নিয়ে এতোটাই লজ্জিত ছিলাম যে আমি আমার বায়োডাটায় কয়েক বছর কমিয়ে ফেলেছিলাম। তাছাড়া, আমি খেয়াল রাখতাম জ্যাকসনের কাজের সঙ্গে মিল রয়েছে আমার এমন কাজ যেন প্রদর্শিত না হয়, কারণ সবাই মনে করত আমাদের স্টাইলটা তাঁরই শুরু করা।
সমালোচক ও ইতিহাসবিদেরা মনে করেন নতুন কোনো আইডিয়া বা চিন্তা বুঝি বিশেষ কোনো একজন ব্যক্তির কাছ থেকে আসে। আর্টটাকে তাঁরা ঘোড়দৌড়ে পরিণত করেন। এমনকি আর্থার ডানতোর মতো যথেষ্ট সম্মানিত সমালোচকেরাও আমাকে ঠিকভাবে বা আলাদাভাবে চিনতে পারলেন না। ‘তাঁকে তাঁর চাইতে বড় শিল্পীদের থেকে, তাঁর শিক্ষক হফমান, তাঁর স্বামী, এবং নিউ ইয়র্ক স্কুলে তাঁর উজ্জ্বল (বা বিখ্যাত) সমসাময়িকদের ছায়া ছাড়া আলাদাভাবে শনাক্ত করা মুশকিল।’এই ব্যাপারটা আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি, এমনকি জ্যাকসন মারা যাওয়ার পরেও। শিল্প জগতের একজন ‘প্রতিভা’-কে বিয়ে করাটা সবসময় আমার পক্ষে কাজ করেনি।
আলমা : তুমি এই কথাটা ঠিক বলেছো যে আমার জীবনকে জটিল করেছে এমন কোনো পুরুষের সঙ্গে আমাকে কখনো কাজ করতে হয়নি। আমি মোটামুটিভাবে নিজেকে নিয়েই ছিলাম। কিন্তু তুমি আর আমি দু’জনেই যা হয়েছি তা বেশ দেরি ক’রেই হয়েছি, সব অবিচার আর নিষ্ঠুরতা কী ক’রে প্রতিরোধ করতে হয় তা শেখার পর। আমি যখন সার্বক্ষণিক পেইন্টার হয়েছি ততদিনে আমার বয়স প্রায় ষাট হয়ে গেছে, এবং আমি অবসরে গিয়েছি। আমার বাড়ির পেছনের আঙিনায় আমি যা কিছু দেখতে পেতাম সেসবের ওপর ভিত্তি ক’রে ছোপ ছোপ নিখাদ উজ্জ্বল রঙে আমি আঁকতে শুরু করি। এরপর আমি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করি এবং সেখানেই আমার সঙ্গে সেই সব কালার ফিল্ড পেইন্টারদের সঙ্গে দেখা হয়: কেনেথ নোল্যান্ড, মরিস লুইস, স্যাম গিলিয়াম এবং জিন ডেভিসের। আমি জানতাম নারীদের সাধারণত অনুসারী হিসেবে ভাবা হয়, কিন্তু আমাকে সব সময়ই শিল্পগতভাবে তাদের সমকক্ষ ব’লে গণ্য করা হতো। তফাত কেবল একটাই যে তারা আমার চাইতে অন্তত পঁচিশ বছর আগে কাজ শুরু করেছিল। তাদের সবার স্টুডিও-ও ছিল। আর আমি কোথায় ছবি আঁকতাম জানো? আমার রান্নাঘরের টেবিলে। তোমার আর আমার ‘শোবার ঘর ও রান্নাঘরে আর্ট শেখার স্কুল’খোলা উচিত।
লী : জ্যাকসন মারা যাওয়ার পরে নির্বোধ ইন্টারভিউয়াররা আমাকে এ-ধরনের প্রশ্ন করত: ‘আপনার কি মনে হয় আপনি আত্মপরিচয় হারিয়েছেন, কারণ ঘটনাক্রমে আপনি জ্যাকসন পোলকের স্ত্রী ছিলেন? তাঁর দুই গার্ল ফ্রেন্ড – একজন যে কিনা গাড়ি দুর্ঘটনার সময় ওর সঙ্গে ছিল আর পেগি গগেনহাইম, জ্যাকসন যার বিখ্যাত ফায়ার প্লেসে পেশাব ক’রেছিল, তারা দুজনেই এস্টেটর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। শিল্প সমালোচক হ্যারল্ড রোজেনবার্গ, যে কখনো আমার সম্পর্কে কখনো কোনো নরম কথা বলেনি, সে যখন আমাকে ‘অ্যাকশন উইডো’ নাম দিল, তার এই তত্ত্বটার প্রতি জোর দিতে যে জ্যাকসন ছিল একজন অ্যাকশন পেইন্টার, তখন আমি ‘উইডো অভ্ অ্যাকশন’ হবো ব’লে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি তাঁর স্টুডিওটা নতুন ক’রে সাজিয়ে নিয়ে বড় বড় ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করলাম। আর আমার পুরানো ড্রইং থেকে কোলাজ করতে লাগলাম। বিশ বছর ধরে আমি এঁকেই গেলাম, এঁকেই গেলাম, এবং শেষ অব্দি শিল্প জগৎ একথা স্বীকার করতে প্রস্তুত হলো যে একজন গুরুত্বপূর্ণ নারী শিল্পী একজন গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ শিল্পীকে বিয়ে করতে পারেন। আমি গুজব শুনেছি যে ১৯৮৩ সালে আধুনিক শিল্পের জাদুঘরে (মিউজিয়াম অভ্ মডার্ন আর্ট) আমার রেট্রোস্পেক্টিভটা হয়েছিল কিছু নারীবাদী শিল্পী এবং শিল্পের ইতিহাসবিদের চাপে, কিন্তু আমি সেকথা বিশ্বাস করিনি। নারীবাদীরা আমাকে সাহায্য করবে কেন, যেখানে তাদের আদর্শের প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি নেই? যদিও, অন্যের জন্য, আমার জন্যে আমি অনেক করেছি: দরিদ্র শিল্পীদের সাহায্য করার জন্য আমি আমার টাকা-পয়সা (যার বেশিরভাগই জ্যাকসন পোলকের মৃত্যুর পরের বিক্রি থেকে এসেছিল) পোলক-ক্র্যাসনার ফাউন্ডেশনে দান ক’রে দিয়েছি।
আলমা : হুম, আমাদের দুজনের জন্যেই ব্যাপারটা বেশ কষ্টকর ছিল। আমার মনে হয় আমার তিনটি নির্দিষ্ট জীবন ছিল : প্রথমটি শিক্ষক হিসেবে, তারপর একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, আর শেষে চিত্রকর হিসেবে। ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১ সালে আমার নতুন কাজ নিয়ে একটা বড় সড় প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল; তখন আমার বয়েস আশি। এরপর আমার একটা প্রদর্শনী হয় ‘আমেরিকান শিল্পের হুইটনি জাদুঘরে’, আর তারপর আরো বড় একটা, ১৯৭২ সালে, এখানে এই ডি.সি.-তে, ‘করকোরান গ্যালারি অভ্ আর্ট’-এ । সময় হয়ে এসছিল। ওই গেরিলা গার্লরা ঠিক কথাই বলেছিল যে, নারী শিল্পী হওয়ার একটা সুবিধে হলো কারো ক্যারিয়ার আশি বছর বয়েসে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। তবে সেটা পঁয়ত্রিশে ফুরিয়ে যাওয়া শ্বেতাঙ্গ পুরুষ প্রতিভা হওয়ার চাইতে ভালো।”
লেখক তথা গেরিলা গার্লস পরিচিতি
“আমরা একদল নারী শিল্পী এবং শিল্প পেশাজীবী যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমরা শিল্প বিশ্বের বিবেক, এবং আমরা রবিন হুড, ব্যাটম্যান, ও লোন রেঞ্জারের মতো অজ্ঞাতপরিচয় ভালোমানুষদের মুখ্যত পুরুষ ঐতিহ্যের প্রতিরূপ (কাউন্টারপার্ট। আমরা ৮০টির বেশি পোস্টার, মুদ্রিত প্রকল্প এবং অন্যান্য তৎপরতার জন্ম দিয়েছি যা বৃহত্তর শিল্প জগতের অন্যায় যৌন পক্ষপাত (সেক্সিযম) এবং জাতিবৈশিষ্ট্যবাদের (রেসিযম) চরিত্র উন্মোচন করে। আমাদের ব্যক্তিত্বের চাইতে বরং সমস্যাগুলোর ওপর যাতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় সেজন্য আমরা গরিলার মুখোশ প’রে থাকি। নারীবাদীরা যে মজার হতে পারেন সেটা বোঝাবার জন্য আমরা হাস্যরসের আশ্রয় নেই। আমাদের কাজ আমাদের সমমনা মানুষজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এবং তাঁরাও নিজেদেরকে গেরিলা গার্লস ব’লে মনে করেন। আসলে, আমরা যে-কেউই হতে পারি; আমরা সবখানেই রয়েছি।
নারীবাদী শিল্পী এবং শিল্প ইতিহাসবেত্তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, ‘সমগ্র পাশ্চাত্য ইতিহাসে আরো বেশি মহৎ নারী শিল্পী দেখা যায় না কেন?’ গেরিলা গার্লস এই প্রশ্নটি একটু ঘুরিয়ে এভাবে করতে চায়: ‘সমগ্র পাশ্চাত্য ইতিহাসে আরো বেশি নারী শিল্পীকে মহৎ ব’লে গণ্য করা হলো না কেন?’ ”