মায়েদের কি অবসর সময় আছে? যদি বলি নেই তাহলে কি চমকে উঠবেন পাঠক? হ্যাঁ মায়েদের অবসর সময় নেই। যদিও হরেক রকমের মা আছে পৃথিবীতে। গৃহিণী, কর্মজীবী, একা থাকা মা, যৌথ পরিবারে থাকা মা, নিন্মবিত্তের মা, উচ্চবিত্তের মা, বস্তিপাড়ায় বসবাসকারী মা, উঁচু দালানের মা, আদিবাসী মা, গ্রামে বা শহরে বসবাসকারী মা, ছোট শিশুর মা, বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুর মা, বয়স্ক ব্যক্তির মা। কিন্তু অবসরকেন্দ্রিক আলোচনায় তারা কমবেশি সকলেই সমান। তাদের অবসর নেই। কেন বলছি মায়েদের অবসর নেই। কারণ মায়েদের মধ্যে সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও মিলের জায়গা হলো তাদের মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা। যদিও মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা নারীর সামাজিক অবস্থানভেদে ভিন্ন হয় তবে সচরাচর আদর্শ বা মহান মাতৃত্বের যে সামাজিক নির্মিতি সেটিই কমবেশি মায়েদের মাতৃত্বের অভিজ্ঞতাকে আকৃতি দান করে। সেজন্য নারীর মাতৃত্ব ও অবসরকেন্দ্রিক ধারণা পরষ্পর সম্পর্কিত এবং মায়েদের অবসরকেন্দ্রিক আলোচনা মাতৃত্বের ধারণাকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। এই প্রবন্ধের শুরুতেই থাকবে মাতৃত্ব ও অবসর এই বিষয়দুটোর ধারণায়ন, এরপর দুটি কেসের মাধ্যমে দুজন মায়ের কর্মব্যস্ততা ও অবসরকেন্দ্রিক একটি চিত্র উপস্থাপন করা হবে এবং শেষাংশে দেখানো হবে মা ও অবসর এদুটি বিষয় কিভাবে সাংঘর্ষিক সে আলোচনা।
প্রথমে আসি মাতৃত্ব কী এই আলোচনায়। প্রথাগত মাতৃত্বের ধারণায় প্রতিটি নারী এক এক জন সম্ভাবনাময়ী মা এবং নারী মাত্রই মাতৃসত্তার ধারক। মাতৃসত্তা বলতে বোঝায় সন্তানকে ঘিরে মায়েদের তথাকথিত আবেগ, অনুভূতি, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গী যা নারীর চরিত্রে প্রোথিত এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হয় এবং আরও ধরে নেয়া হয় নারী মাত্রই এই বৈশিষ্ট্যসমূহ নিজের ভিতরে লালন করে। আমদের সমাজে যুগযুগ ধরে বিভিন্ন উপমা এবং রূপকের সাহায্যে এবিষয়গুলো ‘সার্বজনীন সত্য’ হিসাবে টিকে আছে। যেমন : “সন্তান জন্মদানেই নারী জীবণের সার্থকতা,” “সন্তান জন্মদানই নারীকে পুরুষের থেকে আলাদা করে,” “মা ডাক যে কোন নারীকে উদ্বেল করে তুলতে পারে” ইত্যাদি। প্রথাগত ধারণায় মাতৃসত্তা যেহেতু প্রাকৃতিক সেহেতু মা এবং শিশু অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। ফলে মা মানেই শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে নারী একনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত থাকবে এবং প্রাথমিক পরিচর্যাকারী হিসাবে শিশু প্রতিপালন করবে।
এই ধারণাটি মোটের ওপর যে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হলো নারীর সন্তান ধারণের সক্ষমতা। নারী যেহেতু সন্তান ধারণ করে সেহেতু শারিরীক সংযুক্তির কারণেই সে সন্তান পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করবে। এটি মূলত মাতৃত্বকে ঘিরে শরীর নির্ধারণবাদী একটি ভাবনা যার সাথে যুক্ত হয় সামাজিক সংস্কার ও লিঙ্গীয় ভূমিকা (gender role)।
সামাজিক পরিসরে মা হয়ে ওঠার নানাবিধ সমাজ নির্দেশিত বিধিমালা আছে। যে বিধিমালা আবার শ্রেণি, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং এসব বিধিমালা তৈরি হয় সমাজের লিঙ্গীয় শ্রমবিভাজনকে জারি রেখে। ফলে নির্ধারিত যাত্রাপথে পথ নির্দেশনা না মানলে চালককে যেমন শাস্তি পেতে হয় তেমনি সমাজ-স্বীকৃত ‘আদর্শ মা’ হয়ে ওঠার জন্য নারীকে হতে হয় সমাজের আজ্ঞাবহ সেবাদাসী আর তা না করতে পারলে হতে হয় চক্ষুশূল। যেমন : “কেমন মা বাচ্চা এমন অস্থির, চঞ্চল?“ “বাচ্চার তো কোন ভদ্রতা জ্ঞান নাই, মা কী শিখায়?” এমনকি বাচ্চা খায়না, বাচ্চা অসুস্থ, বাচ্চা মারামারি করে, এসব কিছুই ঘটে মায়ের কারণে। তার ওপর মা যদি চাকুরীজীবী হন তাহলে তো সোনায় সোহাগা! যেমন : “বাচ্চা তো এমন করবেই মাকে কাছে পায়না, কেমন মা বাচ্চার চেয়ে চাকরী বড়?“ আবার যে মা শুধু গৃহেই শ্রম দেয় তাকেও নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতে কম করেনা। যেমন : “হাউজ ওয়াইফ, ঘরে বসে স্বামীরটা খেয়ে কী আর করে, টিভি সিরিয়াল দেখে, সিনেমা দেখে, ফেসবুক করে অথচ বাচ্চার স্বাস্থ্য কত খারাপ!“ “এত গয়নাগাটি পরে! হাউজ ওয়াইফ তো মাথায় কিছু নাই, সেজেগুজে পুতুল হয়ে ঘরে বসে থাকে এদিকে বাচ্চার রেজাল্ট এত্ত খারাপ হয়।“ অর্থাৎ জগতে মা এমন এক প্রাণী যাকে ইচ্ছেমত দুকথা শুনিয়ে দেয়া সবার অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। মা হওয়ার রাস্তা তাই খুব বন্ধুর। যে মা যতবেশী আত্মত্যাগী সে মা সমাজের বিচারে তত “ভালো” আর যে তা নয় সে হয় “খারাপ”।
এবার আসি অবসর বলতে কী বুঝি সে প্রসঙ্গে। অবসর বলতে সাধারণত বোঝানো হয় “মুক্ত সময়কে” অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে করা কাজ, গৃহস্থালির কাজ, শিশু প্রতিপালন ও ব্যক্তিগত কাজ বাদে বাকি যে সময়টা থাকে। কেউ কেউ অবসর সময় বলতে বোঝান যেসময় বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড করা হয় বা যে সময়টা অলস পড়ে থাকে তাকে।
কেসস্টাডি
প্রবন্ধের এই অংশে দুটি কেসের মাধ্যমে দেখতে চেষ্টা করবো একজন মায়ের একদিনের কাজের তালিকায় কী কী থাকে এবং কতটা সময় তাদের অবসর জোটে সেই হিসাবে।
কেস ১: রেহানা (ছদ্মনাম ) একজন গৃহিণী। সে নিন্ম, মধ্য বা উচ্চ যে কোন বিত্তের নারী হতে পারেন। দুই সন্তানের জননী – একজনের বয়স ৬, স্কুলে যায়, আরেকজন দুইবছর বয়সী। দুই সন্তান, স্বামী, ও দুজন বয়োবৃদ্ধসহ ছয় সদস্যের সংসার দেখাশোনা করেন। আসুন দেখি মোটাদাগে এই মা ২৪ ঘন্টায় কী কী করেন।
সময় |
ঘন্টা |
কাজ |
সকাল | ৬টা থেকে ১২ টা | ঘুম থেকে ওঠা
নাস্তা বানানো বাড়ির সবাইকে নাস্তা দেয়া বড় সন্তানকে তৈরি করা স্কুলে পাঠানো/নিয়ে যাওয়া ছোট সন্তানের খাবার তৈরি ও খাওয়ানো ছোট সন্তানকে সময় দেয়া নিজে নাস্তা করা স্বামীকে টিফিন দেয়া ঘর গোছানো পরিচ্ছন্নতা কাপড় ধোয়া সাহায্যকারী থাকলে তাকে কাজকর্ম দেখিয়ে দেয়া |
দুপুর | ১২:০১ থেকে ৩টা | রান্না
ছোট সন্তানকে সময় দেয়া। যেমনঃ গোছল করানো, খাওয়ানো, বিনোদনে অংশ নেয়া নিজের গোসল, খাওয়া স্কুল থেকে বড় সন্তানকে নিয়ে আসা/সন্তান স্কুল থেকে ফিরলে তাকে কিছু সময় দেয়া, গোছল, খাওয়া ইত্যাদি দেখাশোনা করা। স্কুলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজ নেয়া বাসার সবার খাবার দেয়া, খাবার গুছিয়ে রাখা |
বিকেল | ৩:০১ থেকে ৬টা | দুই সন্তানকে ঘুম পাড়ানো
দরকারি ফোন করা বড় সন্তানের স্কুলের ডায়েরি, হোম ওয়ার্ক ইত্যাদি দেখা বয়স্ক সদস্যদের খোঁজ নেয়া, সময় দেয়া |
সন্ধ্যা | ৬:০১ থেকে ৮টা | বাচ্চাদের সন্ধ্যার খাবার তৈরি করা
বাচ্চাদের খাওয়ানো বয়স্কদের চা দেয়া বড় বাচ্চাকে বাড়ির কাজ করানো ছোট সন্তানকে সৃষ্টিশীল কাজে নিযুক্ত করা অতিথি আসলে আপ্যায়ন করা স্বামী অফিস থেকে ফিরলে চা দেয়া, দরকারি আলাপ করা |
রাত | ৮:০১ থেকে ১১টা | দুই সন্তানকে খাওয়ানো
বড় সন্তানের পরদিন স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া, যেমন : টিফিন বানানো, পোশাক-বই-খাতা-পেন্সিল গুছিয়ে রাখা বাড়ির সবাইকে রাতের খাবার দেয়া, খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে তোলা পারিবারিক আলাপে অংশ নেয়া |
১১:০১ থেকে ১২টা | সন্তানদেরকে ঘুম পাড়ানো | |
১২:০১ থেকে রাতের যে কোন সময় | ঘুমাতে যাওয়া
ঘুমন্ত সন্তানদের দেখা, ডায়াপার/কাঁথা পরিবর্তন করা ছোট বাচ্চাকে দুধ পান করানো |
|
উপরিউক্ত কর্মকাণ্ডের সাথে আরও যোগ হবে সাপ্তাহিক বাজার করা, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তার সেবাযত্ন করা, আত্মীয় স্বজন-বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ রাখা। নিমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করা। সন্তানের সাথে টিভি বা ইউটিউব দেখা ইত্যাদি। |
কেস ২: মৌসুমী একজন কর্মজীবী নারী (নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্ত)। এক সন্তানের মা। সন্তানের বয়স ১৪ বছর। মৌসুমী ৯-৫টা কাজের মধ্যে থাকেন। স্বামী, সন্তানের পাশাপাশি বাসায় মা/শ্বাশুরিকে নিয়ে বসবাস করেন।
সময় |
ঘন্টা |
কাজ |
ভোর | ৫টা থেকে ৭টা | ঘুম থেকে ওঠা
নাস্তা বানানো বাসার সবাইকে নাস্তা দেয়া স্বামীকে টিফিন দেয়া নিজে নাস্তা করা |
সকাল | ৭:০১ থেকে ৮:৩০টা | বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়া |
সকাল | ৮:৩১ থেকে ১২ টার মধ্যে | নিজের কাজের পাশাপাশি বাসায় ফোন দিয়ে বিভিন্ন কাজ সারা। যেমন :
সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বাড়ির লোকজন অথবা সাহায্যকারী থাকলে তাকে কাজকর্মের নির্দেশ দেয়া, রান্না কি হবে বলে দেয়া |
দুপুর | ১২:০১ থেকে ১টা | দুপুরের খাবার খাওয়া
বাসায় ফোন দেয়া । খোঁজখবর নেয়া। |
দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৫টা | কাজে ব্যস্ত থাকা
দরকারী ফোন করা, যেমন : সন্তান স্কুল থেকে ফিরেছে কিনা খোঁজ নেয়া |
|
বিকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা | কর্মস্থল থেকে বাসার ফেরা | |
সন্ধ্যা | ৬:০১ থেকে ৮টা | সন্তানকে সময় দেয়া, সন্ধ্যার খাবার তৈরি করা, সন্ধার নাস্তা দেয়া, বয়স্কদের চা-নাস্তা দেয়া
সন্তানের পড়াশোনার খোঁজ নেয়া (কোচিং/প্রাইভেট ইত্যাদি) অতিথি আপ্যায়ন করা স্বামী ও বয়স্ক সদস্যদের খোঁজ নেয়া, সময় দেয়া, দরকারি আলাপ করা |
রাত | ৮:০১ থেকে ১১টা | সন্তানের পরদিন স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া, যেমন : টিফিন বানানো, পোশাক-বই-খাতা-পেন্সিল গুছিয়ে রাখা
বাড়ির সবাইকে রাতের খাবার দেয়া, খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে তোলা পারিবারিক আলাপে অংশ নেয়া |
১১:০১ থেকে ১২টা | সবার ঘুমের প্রস্তুতি করে দেয়া
নিজে ঘুমাতে যাওয়া |
|
উপরিউক্ত কর্মকাণ্ডের সাথে আরও যোগ হবে সাপ্তাহিক বাজার করা, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে তার সেবাযত্ন করা, আত্মীয় স্বজন-বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ রাখা। নিমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করা। সন্তানের সাথে টিভি বা ইউটিউব দেখা ইত্যাদি। |
উপরিউক্ত দুটি কেসের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে গৃহিণী ও কর্মজীবি দুই ধরণের মা’ই (যাদের সন্তানরা এখনও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেনি) দিনের পুরোটা সময় ব্যস্ততার মধ্যে কাটাচ্ছেন এবং অবসর বলতে সে অর্থে কোন সময় তাদের রুটিনে নেই।
মাতৃত্ব এবং অবসর কি সাংঘর্ষিক?
নিবিড় মাতৃত্ব শ্রমঘন একটি বিষয়। একজন নারীর সময়, শ্রম ও চিন্তার অনেকখানিই বিনিয়োগ করতে হয় সন্তান প্রতিপালনে। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা ব্যয় করে একজন নারীকে মা হয়ে উঠতে হয় এবং সন্তান স্বাবলম্বী হয়ে না উঠা পর্যন্ত এ-প্রক্রিয়া চলমান। একটা বয়স পর্যন্ত দিনের প্রতিটি ভাগে মা’কে সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে হয়, এমনকি ঘুমও মা’কে সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও মায়েরা বাচ্চার ন্যাপি বা কাঁথা বদলে দেন, স্তন পান করান অথবা ফিডারের বোতল মুখে পুরে দেন, শিশুকে টয়লেটে নিয়ে যান অথবা পোশাক বদলে দেন ইত্যাদি। অন্যদিকে বয়োসন্ধিকালীন বা তরুন সন্তানের বেলায় মায়ের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সন্তান কি বলছে, কি করেছে, কি দেখছে, কি পড়ছে, কার সাথে মিশছে সেদিকে নজরদারী করা। আরও বড় হলে হয়তো সন্তান কিভাবে কর্ম ও সংসারজীবন পরিচালনা করছে, আর্থিক, সামাজিক, মানসিক দিক থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় আছে কিনা প্রভৃতি বিষয়ে খোঁজখবর করতে হয়।
অর্থাৎ শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে পরিচর্যার ধরণ শুধু বদলায় কিন্তু মাকে সন্তানের সাথে যুক্ত থাকতে হয় নানানভাবে। মা-সন্তানের এই যুক্ততা সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও অনুমোদিত। ফলে এই যুক্ততা মায়ের উপর কতটা চাপ তৈরি করে সেটি নিয়েও কেউ আগ্রহ দেখায় না বা প্রশ্ন তোলেনা। বরং “ভালো মা” হওয়ার মূল শর্তই হলো আত্মত্যাগ এবং প্রশ্নহীনভাবে সন্তানের কথিত “মঙ্গল”র এর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। মায়েদের উপর এটি এক ধরনের সামাজিক আরোপণ এবং এই আরোপন প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজন ও বৈষম্যকে কেন্দ্র করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত হয়। এখানে প্রচণ্ড লিঙ্গীয় ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করে এবং এটি নারীর উপর ভীষণ রকম চাপ সৃষ্টি করে। পুরুষ যেচে পড়ে এই দায়িত্ব নেয়না। কেউ কেউ হয়তো নেয় কিন্তু সেটা খুবই সামান্য। মূল দায়িত্ব থাকে মায়ের ঘাড়েই। ফলে পারিবারিক পরিসরে পুরুষের অবসর থাকলেও নারীর থাকে না।
প্রথাগত মাতৃত্ব নারীর উপর একটি সামাজিক আরোপন এই লিঙ্গীয় বিভাজনের কারণেই। ফলে মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মা অফিসে বসেই হয়তো নির্দেশ দেন শিশু কী খাবে, কখন তার ঔষধ খেতে হবে, কোন পোশাক পড়বে, স্কুলে কী টিফিন নিবে, এবং বাসায় ফিরে তাকেই আবার সন্তানের বাড়ির কাজ নিয়ে বসতে হয়। একজন নিন্মবিত্তের মা’র যিনি বস্তিতে থেকে উচ্চবিত্তের সংসারে সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করেন তাকেও মোটামুটি ঘর ও সন্তানের কাজ গুছিয়েই নিজের কাজে বের হতে হয়। আমরা দুটি কেসের মাধ্যমে দেখেছি মা কখনও চিন্তাহীন নন, বরং সবসময় সংসার, সন্তান বা সন্তানকেন্দ্রিক ভাবনার মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকেন। তাছাড়া ঘরে যদি বিভিন্ন বয়সী সন্তান থাকে মায়ের চিন্তাভাবনা নানা দিকে ভাগ করতে হয়। বয়সের পার্থক্য, তাদের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, ও পছন্দকে বিবেচনা করে সবধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে পরিবারের নানা বয়সী সদস্যদের দেখভাল করা এবং ঘর-গেরস্থালির অন্যান্য কাজ। ফলে গৃহস্থালির সকল কাজে যদি মায়ের সময় ভাগ হয়ে যায় তাহলে মায়েদের অবসর কখন? তার উপর মা যদি কর্মজীবী হন তাহলে সাধারণ হিসাবে উনার বাইরের কাজে সময় দেয়ার পর বাকি সময়টা ভাগ হয়ে যায় গৃহস্থালি কাজে। অনেকে যেটাকে মায়েদের ‘সেকেন্ড শিফট’ বলে মনে করেন। সুতরাং তার অবসরের সময় কোথায়? বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে যে ‘অখণ্ড অবসর’ বলে মায়েদের আসলে কোন অবসর নেই। কারণ মায়েরা কিছু সময় ফুরসত পেলেও বাচ্চাকে সাথেই রাখেন অথবা পরবর্তী কালে বাচ্চা অথবা সংসারের জন্য কী করবেন সেই পরিকল্পনা করতে থাকেন। মানে তারা সবসময় বিবিধ কাজের (মাল্টিটাস্কিং) মধ্যেই থাকেন যেটাকে সমাজবিজ্ঞানীরা আদতে ‘দূষিত সময়’ বলে চিহ্নিত করতে চান।
তাহলে পাঠক বলুন মায়েদের কি অবসর সময় আছে?
আমাদের সমাজের “মা” দের সম্পর্কে প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলো খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক..সেইসাথে লেখাটি অবশ্যই ভাবনার উদ্রেক করে পাঠকের মনে যে “মায়েদের অবসর আসলে কোথায়”..এরকম বাস্তবধর্মী গবেষণামূলক লেখার জন্যে লেখককে ধন্যবাদ..
পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখককে আনন্দ দেয়। এই আনন্দ দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ সেঁজুতি। ভালো থাকবেন